৪০. হস্তিনায় অর্জ্জুনাদির পুনঃ প্রবেশ ও যজ্ঞ সমাপন

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
পুনশ্চ আইল অশ্ব হস্তিনানগরে।।
এই বিবরণ রাজা কহিনু তোমারে।
শুন বলি যজ্ঞ সাঙ্গ হইল যেমনে।।
নিবৃত্ত হইল দোঁহে হরষিত মনে।
তুরগ ধরিয়া ভীম নিজ বাহুবলে।।
হস্তিনায় প্রবেশ করিল কুতূহলে।
দূত গিয়া সমাচার কহে যুধিষ্ঠিরে।।
অশ্ব লয়ে ধনঞ্জয় আইলেন পুরে।
তাহা শুনি যুধিষ্ঠির আনন্দিত অতি।।
বলিলেন অর্জ্জুনে আনহ শীঘ্রগতি।
নৃপাদেশে অর্জ্জুন সহিত নারায়ণ।।
যুধিষ্ঠির সম্মূখে করেন আগমন।
অসিপত্র ব্রত ‍ পালি পেয়ে বড় দুঃখ।।
কৌতুকে চাহেন রাজা অর্জ্জুনের মুখ।
প্রণাম করেন দোঁহে রাজার চরণে।।
আশীর্ব্বাদ দেন রাজা আনন্দিত মনে।
মুনিগণে প্রণাম করেন ধনঞ্জয়।।
বসিলেন ধর্ম্মপাশে হইয়া নির্ভয়।
ধর্ম্মরাজ জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুনের স্থানে।।
অর্জ্জুন কহেন কথা করিয়া বিনয়।
যথা তথা ভ্রমণ করিল যজ্ঞ হয়।।
যত রাজগণ সহ সংগ্রাম বাধিল।
অর্জ্জুনের মুখে সব প্রকাশ হইল।।
শুনিয়া পুলক হৈল রাজার শরীরে।
যুধিষ্ঠির বলেন আনহ সবাকারে।।
তবে কৃষ্ণ ধনঞ্জয় করিয়া গমন।
যজ্ঞস্থানে আনিলেন যত রাজগণ।।
নিজ পরিচয় দিল যতেক ভূপতি।
সমাজে বসিল ধর্ম্মে করিয়া প্রণতি।।
হস্তিনানগরে বড় আনন্দ হইল।
নানামত আয়োজনে সবারে তুষিল।।
রজনী বঞ্চিল সবে অতি কুতূহলে।
সমাজ করেন কৃষ্ণ অতি ঊষাকালে।।
অর্জ্জুন বিদুর ধৃতরাষ্ট্র নরপতি।
যুধিষ্ঠির পাছে সব বসিলেন তথি।।
হংসধ্বজ নীলধ্বজ শিখিধ্বজ রায়।
যুবনাশ্ব বীরব্রহ্ম বসিল সভায়।।
অনুশাল্ব বভ্রুবাহ চন্দ্রহংস আদি।
আর কত নাম লব যতেক নৃপতি।।
ত্রিকোটি পদ্মিনী সঙ্গে প্রমীলা সুন্দরী।
সভাতে বসিল সবে নানা বেশ ধরি।।
গান্ধারী প্রভৃতি রাণী আর যে রমণী।
বসিল উত্তম স্থানে সঙ্গেতে রুক্মিণী।।
হস্তিনানগর মধ্যে যত প্রজা ছিল।
যজ্ঞ দেখিবারে সবে সত্বরে চলিল।।
পরিহাস অর্জ্জুনে করেন নারায়ণ।
প্রমীলা সহিত সখা ভাল হৈল রণ।।
তিন কোটি পদ্মিনীর সঙ্গেতে বঞ্চিলা।
আমি মনে ভয় পাই কেমনে তুষিলা।।
অর্জ্জুন বলেন দেব নাহি জান তুমি।
ষোড়শ সহস্র শত তোমার রমণী।।
কৃষ্ণ অর্জ্জুনের কথা অনেক আছিল।
বাহুল্য কারণে তাহা লেখা নাহি গেল।।
শেষেতে কহিব আমি এ সব কথন।
এবে যজ্ঞ সাঙ্গ কথা শুনহ রাজন।।
ব্যাসে বলিলেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।
কত যজ্ঞ অবশেষে কহ তপোধন।।
ব্যাস বলিলেন শুন ধর্ম্মের তনয়।
কিছু যজ্ঞ অবশেষে পূর্ণ নাহি হয়।।
আয়োজন যজ্ঞ শেষে করহ ভূপতি।
তুরগ আনহ শীঘ্র শুন মহামতি।।
ব্যাসের বচনে সবে পাইয়া আনন্দ।
অষ্টবারী করিলেন মণ্ডপ স্বচ্ছন্দ।।
অষ্টগোটা কুণ্ড স্থাপিলেন সেইখানে।
ধ্বজ দণ্ডে পতাকা শোভিত স্থানে স্থানে।।
যজ্ঞ উপহার যত জানিল সেখানে।
ধৌম্য পুরোহিত আসি বসিল আসনে।।
ব্যাস বলিলেন শুন ধর্ম্ম নৃপমণি।
ভীমে স্মান করিবারে আজ্ঞা দেহ তুমি।।
অশ্বহন্তা এক ভীম বিনা কেহ নয়।
শুন যুধিষ্ঠির আমি কহিনু তোমায়।।
ব্যাসের বচনে রাজা কহেন ভীমেরে।
আজ্ঞা পেয়ে ভীমসেন শীঘ্র স্নান করে।।
খড়গ হস্তে করি ভীম রহিল সেখানে।
অশ্ব আনিলেন পার্থ পরম যতনে।।
নানাতীর্থ জলে ঘোড়া স্নান করাইল।
মনোমত ক্রিয়া যত মুনিরা করিল।।
চারিদিকে জয়ধ্বনি মঙ্গল ঘোষণা।
শঙ্খঘন্টা ধ্বনি আর বিশেষ বাজনা।।
মুনি সব ঢালে ঘৃত অগ্নির উপর।
অশ্ব গলে মালা দেন ধর্ম্ম নরবর।।
ব্যাস বলে নিষ্পাপী হইল অশ্ববর।
অতঃপর খড়গ লহ বীর বৃকোদর।।
হাতে খড়গ নিল ভীম মুনির বচনে।
কাটিল অশ্বের মুণ্ড সভা বিদ্যমানে।।
অশ্বমুণ্ড মহাবেগে উঠিল আকাশে।
জয়ধ্বনি সভামধ্যে হইল হরিষে।।
অশ্ববর স্কন্ধ হইতে দুগ্ধ নিঃসরিল।
রক্ত না ‍পড়িল সবে নয়নে দেখিল।।
সুবাসিত কর্পূর তাম্বুল পুষ্প নিয়া।
যজ্ঞ পূর্ণ ধৌম্য করে বেদ উচ্চারিয়া।।
ইন্দ্র যম বরুণেরে দিলেন আহুতি।
নৈঋতে কুবের আদি যত দিকপতি।।
ত্রিভুবনে দেবাসুর যত চরাচর।
সবাকে আহুতি দেন ধর্ম্ম নরবর।।
অগ্নি বিসর্জ্জিয়া ধৌম্য দক্ষিণা চাহিল।
রজত কাঞ্চন ধন প্রচুর পাইল।।
শিখিধ্বজ রাজা তবে নিজ অশ্ব লয়ে।
যজ্ঞ করিলেন যুধিষ্ঠির আজ্ঞা পেয়ে।।
যত আয়োজন ধর্ম্ম হইতে পাইল।
তুষ্ট হৈয়া শিখিধ্বজ যজ্ঞ সমাপিল।।
ঋষি মুনিগণ সব যজ্ঞ সমাপিয়া।
যুধিষ্ঠিরে কহিল মনে প্রীতি পাইয়া।।
হয়েছে হইবে নাহি সংসার ভিতর।
কৃষ্ণসখা হেতু তব মহিমা বিস্তর।।
যজ্ঞেতে কি কার্য্য তব শুন নৃপবর।
শত শত যজ্ঞফল কৃষ্ণের গোচর।।
নারায়ণ উদ্দেশেতে নানা যজ্ঞ করে।
হেন কৃষ্ণ অবিরত তোমার গোচরে।।
এত বলি মুনিগণ প্রশংসা করিয়া।
সবে গেল তপোবনে বিদায় হইয়া।।
নিজালয়ে নৃপগণ বিদায় হইল।
তুরগ বারণ ধন সম্মান পাইল।।
বিদায় দিলেন যুধিষ্ঠির সবাকারে।
বভ্রুবাহ রাজা তবে গেল মণিপুরে।।
যুবনাশ্ব নরপতি বিদায় হইয়া।
নিজালয়ে গেল যে মনে প্রীতি পাইয়া।।
নীলধ্বজ নিজ দেশে করিল গমন।
চন্দ্রহংস রাজা গেল আপন ভবন।।
শিখিধ্বজ বীরব্রহ্মা গেল নিজপুরে।
মণিভদ্র চলিলেন আপন নগরে।।
আপনার দেশে সবে করিল প্রয়াণ।
যুধিষ্ঠিরে কহিলেন দেব ভগবান।।
বহুদিন আছি আমি হস্তিনানগরে।
অনুমতি দেহ আমি যাই দ্বারাপুরে।।
যুধিষ্ঠির কন আমি কহিব কেমনে।
দ্বারকায় যাহ বাক্য না আসে বদনে।।
ভীম বলিলেন আজ্ঞা দেহ নরবর।
সম্প্রতি যাউক কৃষ্ণ দ্বারকানগর।।
অনুজ্ঞা দিলেন রাজা ভীমের বচনে।
ত্বরান্বিত ‍নারায়ণ দ্বারকা গমনে।।
শ্রীকৃষ্ণ বিদায় হন সবাকার স্থানে।
প্রণাম করেন কৃষ্ণ কুন্তীর চরণে।।
যুধিষ্ঠিরে প্রণাম করেন মহামতি।
আলিঙ্গন ভীমার্জ্জুন নকুল সংহতি।।
সহদেবে আলিঙ্গন দিয়া অকপটে।
বিদায় হইলা পরে দ্রৌপদী নিকটে।।
দারুক আনিয়া রথ যোগায় সত্বরে।
আরোহণ করিলেন হরি রথোপরে।।
ভীষ্মক দুহিতা আদি কৃষ্ণের রমণী।
দৈবকী প্রভৃতি করি কৃষ্ণের জননী।।
সারথি সংযুক্ত রথে কৃষ্ণের সহিতে।
বিদায় হইয়া গেল সবে দ্বারকাতে।।
রহিলেন পঞ্চ ভাই হস্তিনানগর।
রাজ্যসুখ ভোগ করি পঞ্চ সহোদর।।
শুন জন্মেজয় রাজা কহিনু তোমারে।
অশ্বমেধ যজ্ঞ সাঙ্গ হৈল এতদূরে।।
অশ্বমেধ যজ্ঞকথা শুনে যেই জন।
তাহারে করেন দয়া দেব নারায়ণ।।
অচলা কমলা তার থাকয়ে ভবনে।
আয়ুর্যশ বৃদ্ধি হয় এ কথা শ্রবণে।।
কিছু যদি বিশ্বাস থাকয়ে নরপতি।
অন্তকাল স্বর্গে যায় ব্যাসের ভারতী।।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।
কাশীরাম দাস কহে তরি ভববারি।।

অশ্বমেধপর্ব্ব সমাপ্ত।