৩৮. কৌণ্ডিন্যপুরে অর্জ্জুনাদির প্রবেশ ও চন্দ্রহংস রাজার উপাখ্যান

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
কৌণ্ডিন্যনগরে গেল পাণ্ডবের হয়।।
ধৃষ্টবুদ্ধি নামেতে রাজার পাত্র ছিল।
কালকূট মিশাইয়া রাজারে মারিল।।
আপনি করয়ে রাজ্য বসি সিংহাসনে।
জন্মিয়াছে চন্দ্রহংস ইহা নাহি জানে।।
তবে ‍ধৃষ্টবুদ্ধি মন্ত্রী বিরলে বসিয়া।
মদনে লিখিল পত্র যতন করিয়া।।
শুন জন্মেজয় রাজা পত্রের লিখন।
খলের নির্ম্মল মতি নহে কদাচন।।
স্বস্তি আগে লিখিয়া লিখিল আশীর্ব্বাদ।
শুনহ মদন তুমি আমার সম্বাদ।।
চন্দ্রহংসে পাঠাইনু তব বিদ্যমানে।
যাবামাত্র বিষ দান করিবে যতনে।।
তোমার মঙ্গল হবে এ কর্ম্ম করিলে।
নহে পুত্র দুঃখ পাবে অবশেষ কালে।।
কদাচিত না লঙ্গিবে আমার বচন।
আমি ত পশ্চাতে যাব নিজ নিকেতন।।
আমার অপেক্ষা কদাচিত না করিবে।
যাবামাত্র চন্দ্রহংসে বিষদান দিবে।।
পত্র লিখি পরে তাতে এক চিহ্ন দিল।
চন্দ্রহংস হাতে দিয়া বিশেষ কহিল।।
শুন চন্দ্রহংস তুমি বিষ্ণুভক্তজন।
মদনে লিখিনু আমি বিশেষ কথন।।
না পড়িবে এই পত্র নিষেধিনু আমি।
মদনেরে পত্র দিয়া তত্ত্ব আন তুমি।।
শিব বিষ্ণু ভেদ কৈলে যত পাপ হয়।
এ পত্র পড়িলে হবে কহিনু নিশ্চয়।।
এত বলি পত্র দিল চন্দ্রহংস হাতে।
কলিঙ্গ যাত্রা করিলেন শুভক্ষণে।।
মন্ত্রীর নগরে গেল আনন্দিত মনে।
নিদাঘ সময়ে সেই প্রথম জ্যৈষ্ঠমাসে।।
দেখিলেন উপবন নগর প্রবেশে।
চারিদিকে পুষ্পোদ্যন মধ্যে সরোবর।।
বকুলের বৃক্ষ শোভে পাড়ের উপর।
রম্যস্থান দেখি চন্দ্রহংস হরষিত।।
বসিল বকুল মূলে পাইয়া পীরিত।
পথশ্রমে চন্দ্রহংস বসিল সেখানে।।
নিদ্রা আকর্ষিল আসি তাহার নয়নে।
শুন শুন জন্মেজয় অপূর্ব্ব কথন।।
দৈবমায়া বুঝিতে না পারে কোনজন।
ধৃষ্টবুদ্ধি রাজার দুহিতা রৃপবতী।।
সখীসঙ্গে উপবনে আইল ঝটিতি।
পুষ্প তুলি সেই কন্যা শিবপূজা করে।।
স্নান হেতু উপনীত হৈল সরোবরে।
কতদূরে পুষ্প লয়ে আসে সখীগণ।।
একাকিনী আসে কন্যা স্নানের কারণ।
বৃক্ষ তলে নিদ্রা যায় পুরুষ সুন্দর।।
কন্দর্প জিনিয়া রূপ অতি মনোহর।
কামে বশ হৈল কন্যা তাহারে দেখিয়া।।
মস্তক উপরে পত্র দেখিতে পাইয়া।
পাত্র লয়ে পড়িল বসিয়া রূপবতী।।
বাপের লিখন দেখি মদনের প্রতি।
গতিমাত্র চন্দ্রহংসে বিষদান দিবে।।
কদাচ বিলম্ব এতে তুমি না করিবে।
লিখন পড়িয়া কন্যা করে মনস্তাপ।।
বিষয়া বলিল বড় নিদারুণ বাপ।
দেখিয়া এমন রূপ দয়া না জন্মিল।।
বিষদান দিয়া এরে মারিতে বলিল।
বিষয়া বলিল মোরে মিলাইল ধাতা।।
নিশ্চয় হইব আমি ইহার বনিতা।
পূজিলাম শিব পদ ইহার কারণে।।
চন্দ্রহংস হবে পতি বিচারিয়া মনে।
নয়ন কজ্জল নিল নখেতে করিয়া।।
যা লিখিয়া পত্র দিল হরষিত হৈয়া।
মুদিত করিয়া পত্র রাখিল সেখানে।।
বিষয়া গেলেন ঘরে আনন্দিত মনে।
স্নান করি কন্যাগণ শিবপূজা কৈল।।
হেথা চন্দ্রহংস পরে নিদ্রাভঙ্গ হৈল।
দিবাশেষে উত্তরিল মদনের স্থানে।।
দিলেন মন্ত্রীর পত্র পরম যতনে।
মদন পড়িয়া পত্র সকল জানিল।।
বিষয়াকে দান দিতে লিপি পাঠাইল।
চন্দ্রহংসে সমর্পিব বিষয়া সুন্দরী।।
বাপের বচন আমি লঙ্ঘিতে না পারি।
নানাবাদ্য হরিষে বাঙ্গায় রাজপুরে।।
বিষয়াকে সমর্পিল চন্দ্রহংস বরে।
নানা ধন কৌতুকে তুষিল তার মন।।
ক্ষীরভোগ অবশেষে কৈল দুইজন।
কুসুম শয্যাতে দোঁহে করিল শয়ন।।
হেথা ধৃষ্টবুদ্ধি মন্ত্রী বিচারিয়া মন।
কলিঙ্গে করিল বন্দী নিল সর্ব্বধন।।
প্রজাগণে মহাপাপী করিল তর্জ্জন।
রজনী প্রভাতে হেথা মদন উঠিয়া।।
বাদ্যোদ্যম করিলেন আনন্দিত হৈয়া।
আইল ভিক্ষুক যত ভিক্ষার কারণে।।
তা সবারে মদন তুষিল নানা ধনে।
পথেতে যতেক যায় হরষিত হৈয়া।।
মদন প্রতিষ্ঠা যত কহিয়া কহিয়া।
হেনকালে মন্ত্রী আসে কৌণ্ডিণ্য হইতে।।
নানা রত্ন গজবাজী লইয়া সহিতে।
মন্ত্রী দেখি আশীর্ব্বাদ কৈল দ্বিজগণ।।
শুভক্ষণে তব পুত্র জন্মিল মদন।
বিষয়াকে দিল দান চন্দ্রহংস বরে।।
তা সম সুন্দর নাহি সংসার ভিতরে।
চক্ষু আছে মদনের বুঝি অভিপ্রায়।।
তুষিলেন নানা ধনে আমা সবাকায়।
তাহা শুনি ধৃষ্টবুদ্ধি অতি কোপে জ্বলে।।
আরক্ত করিয়া আঁখি কটুবাক্য বলে।
আরে মম কুলে তুই কুপুত্র জন্মিলি।।
কার বাক্যে চন্দ্রহংসে মম কন্যা দিলি।
মদন বলিল তব পাইয়া লিখন।।
চন্দ্রহংসে বিষয়া করিনু সমর্পণ।
মন্ত্রী বলে কোথা লিখিলাম আন দেখি।।
মদন যোগায় পত্র হইয়া কৌতুকী।
ধৃষ্টবুদ্ধি সেই পত্র করে নিরীক্ষণ।।
মদনের দোষ নাহি বিচারিলা মনে।
চন্দ্রহংসে আনিতে কহিল সেইক্ষণে।।
চন্দ্রহংসে আনিতে দিলেন পাঠাইয়া।
ধৃষ্টবুদ্ধি অনুচরে আনিল ডাকিয়া।।
শুন অনুচরগণ আমার ভারতী।
চণ্ডিকা আলয়ে তোরা যাহ শীঘ্রগতি।।
নিশীথে দেখিবি যারে চণ্ডিকার ঘরে।
যদি মম পুত্র হয় কাটিবে তাহারে।।
ছাড়িয়া না দিবে তারে কহিলাম আমি।
এত বলি অনুচরে দিলেন মেলানি।।
তীক্ষ্ণ অস্ত্র লয়ে তারা চলিল সত্বরে।
চন্দ্রহংস আসে হেথা মন্ত্রীর গোচরে।।
বিষয়া সহিত চন্দ্রহংস মহামতি।
মন্ত্রীর চরণে আসি করিল প্রণতি।।
আশীর্ব্বাদ না করিল মনে দুঃখ পেয়ে।
চন্দ্রহংসে মন্ত্রী কহে অধোমুখ হয়ে।।
যদ্যপি করিলা মম দুহিতা গ্রহণ।
শুনিলাম না পূজিলে কালিকা চরণ।।
কুলের দেবতা মম হন ভগবতী।
তাঁহাকে পুজিতে তুমি যাহ শীঘ্রগতি।।
নানা উপহার গন্ধ চন্দন লইয়া।
চণ্ডীকা পূজিতে যাও একাকী হইয়া।।
চন্দ্রহংস বলিলেন যথা আজ্ঞা হয়।
পূজিব বৈষ্ণবী পদ জানিয়া নিশ্চয়।।
তাহা শুনি মন্ত্রী দাসীগণে আজ্ঞা দিল।
নৈবেদ্য লইয়া চন্দ্রহংসে যোগাইল ।।
চন্দ্রহংস সম্মূখে আনিল দাসীগণ।
চণ্ডিকা পূজিতে তবে করিল গমন।।
ভূঙ্গারে পূরিয়া বারি সব্য করে নিল।
স্বর্ণপাত্র বাম হাতে গমন করিল।।
শুন রাজা জন্মেজয় অপূর্ব্ব কথন।
চন্দ্রহংসে যেমতে ‍রাখেন নারায়ণ।।
অপূর্ব্ব কৃষ্ণের লীলা কে পারে বুঝিতে।
পথে দেখা হৈল তার মদন সহিতে।।
মদন বলিল তুমি যাহ কোথাকারে।
চন্দ্রহংস বলে যাব দেবি পূজিবারে।।
কুলদেবী নাহি পূজি মন্ত্রী দোষ দিল।
আয়োজন দিয়া মোরে হেথা পাঠাইল।।
মদন বলিল তুমি যাহ নিকেতন।
আমি গিয়া চণ্ডিকারে করিব পূজন।।
এত বলি চন্দ্রহংসে পাঠাইল ঘরে।
মদন চলিল হেথা দেবী পূজিবারে।।
দেবী পূজে মদন হইয়া কুতূহলী।
গন্ধ পুষ্প ধূপ দেন হয়ে কৃতাঞ্জলি।।
শঙ্খ ঘন্টা মদন বাজায় কুতূহলে।
শব্দ পেয়ে রাজদূত আসে হেনকালে।।
মন্ত্রীর আদেশে তারা বিচার না কৈল।
তীক্ষ্ম অস্ত্র দিয়া দূত মদনে কাটিল।।
রাজপুত্র দেখি শেষে মনে পায় ভয়।
অকস্মাৎ সেই স্থানে হৈল জয় জয়।।
চন্দ্রহংসে দেখি মন্ত্রী কোপে জ্বলি বলে।
চণ্ডীকা পূজিতে তুমি কেন নাহি গেলে।।
চন্দ্রহংস বলে শুন মোর নিবেদন।
আমারে যাইতে তথা না দিল মদন।।
আপনি গেলেন তথা দেবী পূজিবারে।
তাহার বচনে আমি আইলাম ‍পুরে।।
চন্দ্রহংস মুখে শুনি এতেক ভারতী।
হা পুত্র বলিয়া তবে যায় খলমতি।।
চণ্ডীকা মণ্ডপে গিয়া চারিদিকে চায়।
কাটাস্কন্ধ মদন ভূতলে পড়ে রয়।।
মুণ্ড হাতে করি মন্ত্রী করয়ে রোদন।
আহা মরি কোথা গেল পুত্ররে মদন।।
এত বলি ধৃষ্টবুদ্ধি আত্মঘাতী হৈল।
পুত্রশোকে আপনার মস্তক কাটিল।।
প্রমাদ দেখিয়া তবে অনুচরগণ।
চন্দ্রহংসে আসিয়া করিল নিবেদন।।
মদন সহিত রাজা লোটায় ধরায়।
তত্ত্ব নাহি জানি কেবা কাটিল দোঁহায়।।
শুনিয়া প্রমাদ কথা দূতের বচনে।
চন্দ্রহংস গেল শীঘ্র চণ্ডীকা ভবনে।।
বিচ্ছিন্ন মস্তক দোঁহে আছয়ে পড়িয়া।
ভয় পান চন্দ্রহংস দোঁহারে দেখিয়া।।
যোড়হাতে চণ্ডীকারে করেন স্তবন।
বিষ্ণুরূপা স্বর্ণময়ী শুন নিবেদন।।
বিষ্ণুজায়া বৈষ্ণবী যে ব্রাহ্মণী কমলা।
হরপ্রিয়া হৈমবতী হও অনুকূলা।।
তোমার মহিমা মাতা কেহ নাহি জানে।
নিদ্রারূপা হও ‍তুমি বিষ্ণুর নয়নে।।
এত বলি চন্দ্রহংস নানা স্তুতি কৈল।
তথাপিও অভয়ার কৃপা না হইল।।
ভক্ত চন্দ্রহংস তবে বিচারিয়া মনে।
আপনা কাটিতে খড়গ লইল তখনে।।
বৈষ্ণব বিনাশ দেখি নগেন্দ্র নন্দিনী।
আসি চন্দ্রহংস হস্ত ধরিল তখনি।।
চন্দ্রহংস বলিলেন চরণে ধরিয়া।
পিতা পুত্রে দুইজনে দেহ বাঁচাইয়া।।
মদন সহিত মন্ত্রী উঠিয়া বসিল।
চন্দ্রহংস সৌভাগ্য যে দেখিয়া নয়নে।
মন্ত্রীবর তুষিলেন আনন্দিত মনে।।
ধৃষ্টবুদ্ধি বলে মম রাজ্যে নাহি কার্য্য।
আজি হৈতে চন্দ্রহংস হৈল মহারাজ।।
মন্ত্রী বলে যাই আমি যোগ সাধিবারে।
হিংসিয়া বৈষ্ণবগণে কি কাজ শরীরে।।
এত বলি বিবেকী হইল ধৃষ্টবুদ্ধি।
মন্ত্রী গেল কাননে করিতে যোগ সিদ্ধি।।
তথা চন্দ্রহংস তবে কহিল মদনে।
রাজত্ব করহ তুমি বসি সিংহাসনে।।
মদন বলিল রাজ্যে নাহি প্রয়োজন।
শুন চন্দ্রহংস তুমি লহ সিংহাসন।।
মন্ত্রী হয়ে থাকি আমি তোমার গোচরে।
রাজ্য ধন হস্তী ঘোড়া দিলাম তোমারে।।
মদন হইল মন্ত্রী চন্দ্রহংস রাজা।
তাহা দেখি আনন্দিত যত সব প্রজা।।
কলিঙ্গে আনিল চন্দ্রহংস নরপতি।
নানা সুখ ভোগে তার জন্মিল পীরিতি।।
বিষয়ার গর্ভে হল উভয় নন্দন।
মকরাক্ষ পদ্মাক্ষ যে দোঁহে বিচক্ষণ।।
পুনশ্চ কলিঙ্গ গেল আপন নগরে।
চন্দ্রহংস রাজ্য ধন সব দিল তারে।।
এই কহিলাম চন্দ্রহংসের কথন।
হেনকালে তথায় নারদ আগমন।।
মুনি দেখি সম্ভ্রমে উঠিল সর্ব্বজনে।
আশীর্ব্বাদ করিলেন হরষিত মনে।।
অর্জ্জুন পাইয়া বার্ত্তা মুনির গোচর।
কৃষ্ণ দরশন করি যান মুনিবর।।
অর্জ্জুন শুনিয়া কথা নারদের মুখে।
প্রবেশ করেন পুরে পরম কৌতুকে।।
আনন্দিত চন্দ্রহংস পাণ্ডব গমনে।
কৃষ্ণ দরশন পান অর্জ্জুন মিলনে।।
চন্দ্রহংস বলে শুন পুত্র দুইজন।
রাখহ যজ্ঞের ঘোড়া করিয়া যতন।।
অশ্ব লয়ে এল ভূপ হরষিত মতি।
রাখিলেন দুই অশ্ব যথা জগৎপতি।।
প্রণমিল চন্দ্রহংস লোটাইয়া ক্ষিতি।
পুলকে আকুল তনু অধিক ভকতি।।
অভয় চরণে শত দণ্ডবৎ হৈয়া।
যোড়হাতে চন্দ্রহংস রহে দাণ্ডাইয়া।।
চন্দ্রহংসে আশ্বাস করিলা নারায়ণ।
অর্জ্জুন তোষেন তাঁরে দিয়া আলিঙ্গন।।
সবান্ধবে কৈল রাজা কৃষ্ণ দরশন।
নিজালয়ে লয়ে গেল করিয়া যতন।।
নানা আয়োজন সব সমর্পন কৈল।
কৌণ্ডিন্যকপুরে দুই দিবস বঞ্চিল।।
কহিলাম তোমা চন্দ্রহংসের ভারতী।
যেই জন শুনে ইহা কৃষ্ণে হয় মতি।।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।
কাশীরাম দাস কহে শুনি ভবে তরি।।