৩৭. সরস্বতীপুরে অর্জ্জুনাদির প্রবেশ ও যমের সহিত যুদ্ধ

শ্রীজনমেজয় বলে কহ মহামুনি।
কোন্ দেশে গেল অশ্ব কহ দেখি শুনি।।

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
সরস্বতীপুরে গেল পাণ্ডবের হয়।।
বীরব্রহ্মা নামে রাজা তার অধিকারী।
সেই দেশে যান পার্থ সহিত মুরারী।।
বীরব্রহ্মা নৃপতীর পুত্র পঞ্চজন।
মহাবলবান তারা গুণে বিচক্ষণ।।
ধনুর্ব্বাণ হাতে তারা আছিল নগরে।
দৈবে দুই অম্ব তারা দেখিল গোচরে।।
বীরবেশে অহঙ্কারে তুরগ ধরিল।
অনুচরে নিয়োজিয়া পুরে পাঠাইল।।
ধনুর্ব্বাণ হাতে নিল পঞ্চ সহোদর।
সৈন্যেতে বেষ্টিত রহে করিতে সমর।।
তুরগ ধরিল বীর ব্রহ্মার নন্দন।
তাহা শুনি কিরীটীর মলিন বদন।।
আগে হৈল বৃষকেতু ধনুর্ব্বাণ করে।
বৃষকেতু ডাক দিয়া বলেয়ে তাহারে।।
কে ধরিল যজ্ঞ হয় দেহ পরিচয়।
আয়ুশেষ হৈল কার, যাবে যমালয়।।
বৃষকেতু বচনে কহিল পঞ্চজন।
মোরা অশ্ব ধরি বীরব্রহ্মার নন্দন।।
যজ্ঞ হেতু জনকের আছে অভিলাষ।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করি যাবে স্বর্গবাস।।
দৈবে আসি দুই অশ্ব মিলিল নগরে।
কে তোমরা পরিখার দেহভু আমারে।।
বৃষকেতু বলে আমি কর্ণের নন্দন।
পরিচয় তব সঙ্গে কোন্ প্রয়োজন।।
বাক্যজালে দোঁহাকার ক্রোধ উপজিল।
বৃষকেতু দশঘাণ ধনুকে জুড়িল।।
বীরব্রহ্মা পুত্র তাহা নিবারিল বাণে।
মারিল বিংশতি বাণ কর্ণের নন্দনে।।
বাণাঘাতে বৃষকেতু মানে পরাজয়।
হাতে বাণ অগ্রে হৈল কিরীটী তনয়।।
চিত্রাঙ্গদা সুত বীর বরিষয়ে বাণ।
পঞ্চজনে বিন্ধিয়া করিল খান খান।।
গজবাজী পদাতিক ক্ষয় হৈল রণে।
নিবেদয়ে পঞ্চভাই জনকের স্থানে।।
যুদ্ধ বিবরণ যত বাপেরে কহিল।
তাহা শুনি বীরব্রন্ধে ক্রোধ উপজিল।।
জামাতার প্রতি তবে কহিল ভূপতি।
রাখহ আমার দেশ করিয়া শকতি।।
পরাভব পায় মম পুত্র পঞ্জজন।
আপনি সাজিয়া যাহ করিবারে রণ।।
তোমার সাহসে কারে ভয় নাহি করি।
বাহুবলে তুমি রক্ষা কর মম পুরী।।
শ্বশুরের বাক্য শুনি সূর্য্যের নন্দন।
দণ্ড ধরি মহিষে করয়ে আরোহণ।।
সংগ্রামে শমন এল দণ্ড লয়ে হাতে।
দরশনে সৈন্যগণ ভয় পায় তাতে।।
বভ্রুবাহ আদি করি যত বীরগণ।
প্রাণপণে করিলেন শর বরিষণ।।
শেল টাঙ্গী নানা অস্ত্র মুষল মুদগর।
ভিন্দিপাল ক্ষুরপাদি বাণ প্রাণহর।।
সাহসে যুঝিছে যত পাণ্ডবেরগণ।
নমনের দণ্ডে হয় সব নিবারণ।।
যুবনাশ্ব অনুশাল্ব সুবেগ কুমার।
ধনুর্ব্বাণ ধরিয়া করিল মহামার।।
হংসধ্বজ নীলধ্বজ বরিষয়ে বাণ।
সাত্যকি ধনুক ধরি করয়ে সন্ধান।।
গদা হাস্তে ভীমসেন প্রবেশিল রণে।
প্রদ্যুন্নাদি বীরবর অনেক যুঝেন।।
যমের সংগ্রামে সবে বিষন্ন বদন।
ভয়ে ভঙ্গ দিল সবে রণ পরিহরি।।
যুঝিতে অর্জ্জুন আইলেন ধনু ধরি।
সাহস করিয়া করিলেন বহু রণ।।
দণ্ড লয়ে যম সব করিল বারণ।
যুদ্ধ ত্যাজি পার্থ জিজ্ঞাসেন নারায়ণে।।
সংগ্রামে আইল যম কিসের কারণে।
হরি কহিলেন আদি অন্তের কথন।।
শুনিয়া প্রবোধ পান কুম্ভীর নন্দন।
সেই কথা কহি আমি শুন নরপতি।।
শুনি ভারতের কথা কৃষ্ণে হয় মতি।
বীরব্রহ্মা কন্য নাম হয় যে মালিনী।।
শুন রাজা জন্মেজয় অপূর্ব্ব কাহিনী।
পরমা সুন্দরী কন্যা জিনি রতিরূপ।।
দুহিতা দেখিয়া বড় আনন্দিত ভূপ।
দিনে দিনে সেই কন্যা বাড়িতে লাগিল।।
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন কলাতে পূরিল।
বিবাহের যোগ্য কন্যা দেখিয়া তখনে।।
বীরব্রহ্মা মহারাজ বিচারিল মনে।
বিবাহের যোগ্য হৈল নহে ভাল কার্য্য ।।
কালাতীত হৈলে কন্যা হবে লোক লাজ।
স্বয়ন্বর হেতু কন্যা বিচারিল মনে।।
ডাকিয়া বলেন যত পাত্র মিত্রগণে।
স্বয়ন্বর উদ্যোগ শুনিয়া রূপবতী।।
যোড়হাতে জনকেরে বলিল ভারতী।
কিসের লাগিয়া তুমি কর স্বয়ম্বর।।
যমে আমি বরিয়াছি মনের ভিতর।
যমে আনি বিবাহ করাও নরপতি।।
ত্রিভুবনে যোগ্য দেখি সেই মম পতি।
মরিলে সকলে যায় যমের নগরী।।
আর কারে বরিব তাহাকে পরিহরি।
দুহিতার বাক্য শুনি বীর ব্রহ্মা রায়।।
মহামুনি নারদেরে আনিল সভায়।
নৃপাদেশ পাইয়া আসিল তপোধন।।
কহিল আপন কথা করিয়া বিনয়।
মহামুনি নারদ গেলেন যমালয়।।
নারদে দেখিয়া যম করিল আদর।
যোগাইল পাদ্য অর্ঘ্য আসন সত্বর।।
যম বলে কি হেতু আইলে তপোধন।
মম ভাগ্যে তোমার হইল আগমন।।
নারদ বলেন যম শুন মন দিয়া।
বীরব্রহ্মা রাজা মোরে দিল পাঠাইয়া।।
মালিনী নামেতে তার আছয়ে তনয়া।
তুমি স্বামী হবে তার আছয়ে মনয়া।।
এই হেতু ‍আগমন তোমার গোচরে।
আমার বচনে চল সরস্বতীপুরে।।
অলঙ্ঘ্য মুনির বাক্য লঙ্গিতে নারিয়া।
রবিসুত যাত্রা কৈল ব্যাধিগণ লৈয়া।।
যম আগমনে ব্যাধি লোকেরে পীড়িল।
ব্যাধিভয়ে লোক সব দুঃখিত হইল।।
তবে নারদেরে জিজ্ঞাসিল নরপতি।
ব্যাধি হেতু প্রজানাশ কি হবে যুকতি।।
মুনি বলে রাজা ধর্ম্মপথে দাও মন।
ব্যাধি বল না করিবে শুনহ বচন।।
ধর্ম্ম আচরণে সবে পাবে মহাসুখ।
পরম পুলকে রবে, ভুলি যত দুঃখ।।
নারদের বাক্যে বীরব্রহ্মা নরপতি।
পাত্রমিত্র প্রজা সবে ধর্ম্মে দিল মতি।।
মুনি বলে আসিবেন সূর্য্যের নন্দন।
নিশ্চয় তোমার কন্যা করিবে গ্রহণ।।
মালিনীর অভিপ্রায় বুঝিয়া অন্তরে।
যম আইলেন বীরব্রহ্মার গোচরে।।
পরিচয় আপনার কহিল রাজনে।
হরষিত বীরব্রহ্মা যম আগমনে।।
শুভক্ষণ করি কন্যা দিল নরপতি।
মালিনীর সঙ্গে হৈল পরম পীরিতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।