৩৬. ব্রাহ্মণবেশে কৃষ্ণার্জ্জুনের শিখিধ্বজ রাজার সভায় গমন

পুত্রের বচন শুনি আনন্দ পাইল।
আলিঙ্গন দিয়া রাজা পুত্রকে তুষিল।।
শুভ সমাচর পুত্র কহিলে আমারে।
আইলেন নারায়ণ রত্নাবতীপুরে।।
সার্থক তপস্য মম হৈল এত দিনে।
দেখিব পরমানন্দে কিরীটী মিলনে।।
বান্ধিয়া রাখহ ঘোড়া মিলাইল বিধি।
সবান্ধবে পরশিব কৃষ্ণ গুণনিধি।।
যার পাদপদ্ম হৈতে গঙ্গার জনম।
আইলেন মম পুরে সেই নারায়ণ।।
যার পদ পরশে সানন্দ বসুমতী।
মুনিগণ যাঁর পদ ভাবে দিবারাতি।।
হেন যাদবেন্দ্র আইলেন মম পুরে।
পূর্ব্ব তপফলে আমি দেখিব তাঁহারে।।
তুমি পুত্র আমার জন্মিলে শুভক্ষণে।
কৃষ্ণ দরশন পাব কিরীটী মিলনে।।
শুনিলাম তব মুখে যুদ্ধ বিবরণ।
বাহুবলে পরাজিলে শ্রীবভ্রুবাহন।।
এক লক্ষ রাজা যাঁর খাটে ছত্রতলে।
তাহাকে জিনিলা তুমি নিজ বাহুবলে।।
যুবনাশ্ব অনুশাল্ব বড় বীরবর।
তাহারে জিনিয়া তুমি করিলা সমর।।
সাত্যকি ও বৃষকেতু বড় বলবান।
তাহাকে জিনিলা তুমি বিক্রমে প্রধান।।
পরাজিলা রতিনাথে আশ্চর্য্য কথন।
কিরীটী তোমার বাণে হল অচেতন।।
এ সব আশ্চর্য্য কথা শুনে লাগে ভয়।
একেলা করিলা তুমি সবাকারে জয়।।
পাণ্ডব বান্ধব করিবেন আগমন।
অশ্ব হেতু গোবিন্দের দেখিব চরণ।।
এত বলি আনন্দ পুলকে নরপতি।
সমাজ করিল পাত্র মিত্রের সংহতি।।
পুনঃ আলিঙ্গনে পুত্রে তোষে নৃপবর।
সিংহাসনে বসিলেন সভার ভিতর।।
হেথা জনার্দ্দন যুক্তি বিচারিল মনে।
দ্বিজরূপ হইলেন অর্জ্জুনের সনে।।
বৃদ্ধ বিপ্ররূপ হইলেন ‍নারায়ণ।
রাজারে করিতে কৃপা করেন গমন।।
খুঙ্গি পুথি ‍কাখে শিষ্যরূপে ধনঞ্জয়।
নৃপতির স্থানে যান হইয়া নির্ভয়।।
সমাজ করিয়া রাজা আছেন যেখানে।
তথা উপনীত কৃষ্ণ অর্জ্জুনের সনে।।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া রাজা উঠিল সত্বরে।
প্রণমিয়া পাদ্য অর্ঘ্য দিল দ্বিজবরে।।
যোড়হাত হয়ে রাজা বলেন বচন।
কি হেতু আইলে তুমি কহ বিবরণ।।
রাজার বচন শুনি দেব নারায়ণ।
কপট করিয়া কৃষ্ণ কহেন বচন।।
শুনহ ভূপতি মম দুঃখের কাহিনী।
কহিতে বদনে মম নাহি সরে বাণী।।
কৃষ্ণশর্ম্মা নামে দ্বিজ তোমার নগরে।
পুত্রের সম্বন্ধ আমি কৈনু তার ঘরে।।
বিবাহ দিবস দৈবে নিকট হইল।
নিমন্ত্রণ ইষ্টবন্ধু কুটুম্ব আইল।।
বল লয়ে আসিতে ছিলাম হরষিতে।
দৈবে এক সিংহ আসি আগুলিল পথে।।
মম পুত্র খাইবারে চাহিল কেশরী।
ভয়ে আমি কহিলাম যোড়হাত করি।।
আমারে ভক্ষণ কর ছাড়িয়া পুত্রেরে।
এক পুত্র বিনা আর নাহিক সংসারে।।
পুত্রশোক সহিতে না পারিব যে আমি।
শুন সিংহ আমারে ভক্ষণ কর তুমি।।
সিংহ বলে তব মাংসে প্রীতি নাহি পাব।
নবীন কোমল মাংস পেট পুরে খাব।।
তপস্যায় শুস্ক মাংস তোমার শরীরে।
খাইতে নারিব আমি কহিনু তোমারে।।
পুত্রের নিমিত্ত মোর বড় হৈল মায়া।
পুনঃ সিংহে কহিলাম যোড়হাত হৈয়া।।
কি বস্তু পাইলে ছাড় আমার কুমারে।
আজ্ঞা কর সেই দ্রব্য দিব সে তোমারে।।
তবে সিংহ কহিলেন নিদারুণ বাণী।
সে কথা কহিতে নাহি পারি নৃপমণি।।
রাজা বলিলেন কহ সেই ত কথন।
কি কহিল সে কেশরী শুনি বিবরণ।।
বিপ্র বলে সেই কথা কহিতে না পারি।
যে নিষ্ঠুর বাক্য মোরে কহিল কেশরী।।
শুন বিপ্র পুত্রের বাঞ্ছহ যদি প্রাণ।
ময়ুরধ্বজের অঙ্গ কাটি শীঘ্র আন।।
নানা ভোগযুক্ত সেই রাজ কলেবর।
খাইতে আমার বাঞ্ছা আছয়ে বিস্তর।।
তবে সে ছাড়িব আমি তোমার নন্দনে।
এত বলি আজ্ঞা দিনু পরম যতনে।।
নির্ব্বন্ধ করিয়া আইলাম তব স্থান।
তুমি অঙ্গ দিলে রহে তনয়ের প্রাণ।।
এতেক বচন বিপ্র বলে বারে বারে।
নিজ তনু দিয়া তুমি রাখহ আমারে।।
দ্বিজের শুনিয়া কথা হরিষ রাজন।
দিব বলি অঙ্গীকার করিল তখন।।
তাহা দেখি পাত্রমিত্র করে হাহাকার।
যোড়হাত করি বলে ‍রাজার কুমার।।
তাম্রধ্বজ বলিলেন শুন নিবেদন।
তুমি গেলে শূণ্য হবে রাজ সিংহাসন।।
আমি যাই দ্বিজ সঙ্গে সিংহের সম্মূখে।
পরম হরিষে সিংহ খাইবে আমাকে।।
রাজা বলে তোমা যদি লয়ত ব্রাহ্মণ।
তবে সত্য হয় পুত্র আমার বচন।।
তবে তাম্রধ্বজ বড় সন্বিত পাইয়া।
দ্বিজ কাছে কহে কথা হরষিত হৈয়া।।
শুন দ্বিজ তোমারে যে করি নিবেদন।
যেই পিতা সেই পুত্র শাস্ত্রের কথন।।
সিংহাসন শূন্য হবে ভূপতি বিহনে।
আমি শিশুমতি প্রজা পালিব কেমনে।।
অনুমতি দেহ আমি যাই সিংহপাশে।
নিজ পুত্র লয়ে তুমি যাই গৃহবাসে।।
এত যদি কহিলেন ভূপতি নন্দন।
তাহা শুনি হাসি বলে কপট ব্রাহ্মণ।।
যেই পুত্র সেই পিতা করিলা প্রমাণ।
সমান শরীর তুমি ইথে নাহি আন।।
কিন্তু সে সিংহের কথা কহি যে তোমাকে।
ভূপতির অর্দ্ধ অঙ্গ মাগিল আমাকে।।
ভূপতির অর্দ্ধ অঙ্গ যদি পাই ভিক্ষা।
তবে সে আমার পুত্র পাইবেক রক্ষা।।
শুনহ ময়ুরধ্বজ আমার বচন।
সমস্ত শরীরে মম নাহি প্রয়োজন।।
অর্দ্ধাঙ্গ দিবেক তুমি বলহ আমারে।
পুত্র হেতু এই ভিক্ষা মাগিহে তোমারে।।
রাজা বলিলেন অঙ্গ দিব আপনার।
ইহাতে তিলেক দুঃখ নাহিক আমার।।
অর্দ্ধ অঙ্গ ব্রাহ্মণে দিলেন নরপতি।
সমাচার পায় পুরে নারী কুমুদ্বতী।।
দুই চারি দাসী সঙ্গে আইল সেখানে।
যোড়হাত করি বলে দ্বিজ দিব্যমানে।।
নৃপতির অর্দ্ধ অঙ্গ গণি যে আমাকে।
মোরে সিংহে দিয়া রাখ আপন বালকে।।
কেন সিংহাসনশূণ্য কর দ্বিজবর।
আজ্ঞা দেহ আমি যাই সিংহের গোচর।।
আমা দরশনে তুষ্ট হবেন কেশরী।
পুত্র লয়ে যাহ তুমি ‍আপনার পুরী।।
এত যদি রাজরাণী করিল সাহস।
গোবিন্দে নিন্দেন পার্থ হইয়া বিরস।।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন শুনহ রাজন।
নারী বাম অঙ্গ মোর নাহি প্রয়োজন।।
দক্ষিণাঙ্গ দেহ রাজা কহিল আমারে।
যাচিঙ্গা করিনু আমি তোমার গোচরে।।
দক্ষিণাঙ্গ দেহ মোরে শুন নরপতি।
মন দিয়া শুন তুমি সিংহের ভারতী।।
স্ত্রী পুত্রে করাত ধরি তোমারে চিরিবে।
তবে তব অর্দ্ধ অঙ্গ কেশরী লইবে।।
কেশরী কহিল এই নিষ্ঠুর বচন।
তবে সে পাইব আমি আমার নন্দন।।
পরকাল তরিবারে এত যত্ন করি।
পুত্র বিনা নিদানে নরকে ঘুরে মরি।।
অতএব মাগিলাম এ ভিক্ষা তোমারে।
কাতর না হয়ে অর্দ্ধ অঙ্গ দেহ মোরে।।
দক্ষিণাঙ্গ দিয়া হে পুরাও অভিলাষ।
পরিণামে তোমার হইবে স্বর্গবাস।।
শিখিধ্বজ বলে ‍অর্দ্ধ অঙ্গ দিব আমি।
ক্ষণেক বিলম্ব কর দ্বিজবর তুমি।।
রাজা বলে তাম্রধ্বজ আর রহ কেনে।
করাতে চিরহ আমা সবা বিদ্যমানে।।
বসিল ময়ূরধ্বজ পূর্ব্ব মুখ হৈয়া।
নবীন তলসীমালা গলায় পরিয়া।।
স্নান করি তাম্রধ্বজ জননীর সনে।
হাতেতে করাত নিল আনন্দিত মনে।।
ব্রাহ্মণের আজ্ঞা পুনঃ লয়ে যোড়হাতে।
করাত দিলেন তবে জনকের মাথে।।
অর্দ্ধ অঙ্গ রাজা দেয় উঠিল ঘোষণা।
দেখিতে আইল যত নগরের জনা।।
শিশু বৃদ্ধ যুবা কেহ না রহিল ঘরে।
স্ত্রী পুরুষ উপনীত নৃপতির পুরে।।
পথে যেতে পরস্পর কহে কোনজনে।
আপনারে নাশে রাজা ধর্ম্মের কারণে।।
কেহ বলে ধন্য ধন্য শিখিধ্বজ রায়।
রাজতনু দিয়া রাজা স্বর্গপুরে যায়।।
কেহ বলে ক্লেশ বিনা নাহি হয় ধর্ম্ম।
কেহ বলে নৃপতি করিল বড় কর্ম্ম।।
অনিত্য শরীর এই বিচারিয়া মনে।
আপনার অঙ্গ রাজা দিলেন ব্রাহ্মণে।।
চল চল দেখি গিয়া ভূপতি সাহস।
ভুবন ভরিয়া রাজা রাখিলেন যশ।।
দূর হবে যত পাপ রাজ দরশনে।
দেখিলে সাহস হয় সত্য জানি মনে।।
এত বলি সকলেতে তথায় চলিল।
ভূপতির পত্নী পুত্র করাত ধরিল।।
শিখিধ্বজ বলিলেন শুন কুমুদ্বতী।
আমাকে চিরিতে নাহি তবে দুঃখমতি।।
করাত ধরহ আমি ভয় নাহি করি।
চিরহ মস্তক মম শুদ্ধচিত্ত করি।।
মাতাপুত্রে আনন্দিত নৃপতি বচনে।
চিরিছে মস্তক তার কৃষ্ণ বিদ্যমানে।।
অন্তর্য্যামী ভগবান জানেন সকল।
বলেন ঈষৎ হাসি ভকতবৎসল।।
আর অর্দ্ধ অঙ্গ মম নাহি প্রয়োজন।
অশ্রদ্ধায় দান আমি না করি গ্রহণ।।
কান্দিয়া অর্দ্ধেক অঙ্গ তুমি দিলা মোরে।
এ দান লইয়া আমি নারি তরিবারে।।
না চিরিহ ভূপতিরে শুন রাজরাণী।
কাতর হইলে দান নাহি লই আমি।।
এত বলি নারায়ণ ধনঞ্জয় সাথে।
সভা ত্যজি উঠিলেন আপনি ত্বরিতে।।
কুমুদ্বতী বলে ভূপে যোড়হাত হৈয়া।
না নিলেন দান বিপ্র কিসের লাগিয়া।।
শুনিয়া কহিল রাজা প্রিয়ার বচন।
কাতর দেখিয়া দান না নিল ব্রাহ্মণ।।
এত বলি রাজা বামনেত্রে জল ঝরে।
যোড়হাত হয়ে বলে কপট দ্বিজেরে।।
বাম নয়নেতে মম দেখি জলধার।
হৈলাম কাতর, মনে হইল তোমার।।
তোমার সাক্ষাতে সত্য কথা কহি আমি।
করাতের ব্যথা নয় শুন দ্বিজস্বামী।।
যে কারণে অশ্রুপাত বাম নয়নেতে।
তাহার কারণ আমি কহি যে তোমাতে।।
দক্ষিণাঙ্গ তুমি মম করিলে গ্রহণ।
অভিমানে বামচক্ষু করয়ে ক্রন্দন।।
এই সে আমার দোষ কহি যে তোমারে।
দক্ষিণাঙ্গ লয়ে তুমি যাহ ত সত্বরে।।
হাসিয়া বলেন কৃষ্ণ শুন নরপতি।
আমি তোমা পরীক্ষিনু কিরীটী সংহতি।।
তাম্রধ্বজ যুদ্ধে কত সম্বিত পাইয়া।
আইলাম পার্থ সঙ্গে কপট করিয়া।।
তোমার সাহস যত দেখিলাম আমি।
যুষিতে রাখিলে যশ ধন্য রাজা তুমি।।
এত বলি বিপ্ররূপ ত্যজিয়া মুরারী।
সেইক্ষণে হইলেন শঙ্খচক্রধারী।।
গদাপদ্ম চতুর্ভুজ বনমালা গলে।
মক্কর কুণ্ডল কর্ণে করে ঝলমলে।।
তকতবৎসল হরি জানে নানা মায়া।
মুগ্ধ করিলেন নিজ মূর্ত্তি প্রকাশিয়া।।
তবেত ময়ুরধ্বজ হরষিত হৈয়া।
প্রণমিল কৃষ্ণপদে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া।।
পরশিল নৃপশির দেব জগৎপতি।
হইল ময়ুরধ্বজ সুন্দর মুরতি।।
তা দেখি উঠিল পুরে জয় জয়কার।
প্রণমিল কৃষ্ণপদে রাজার কুমার।।
কৃষ্ণপদ পরশিল রাজার রমণী।
আশীর্ব্বাদ সবারে দিলেন চক্রপাণি।।
যোড়হাতে শিখিধ্বজ করেন স্তবন।
পরম কারণ তুমি দেব নিরঞ্জন।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর তিন রূপ তুমি।
তোমার মহিমা প্রভু কি বলিব আমি।।
করে পরশিলা তুমি আমারে মুরারী।
আমার ভাগ্যের কথা সীমা দিতে ‍নারী।।
সিদ্ধ হৈল অশ্বমেধ শুন নারায়ণ।
অশ্ব লহ, যজ্ঞে মম নাহি প্রয়োজন।।
এত বলি দুই অশ্ব কিরীটীরে দিল।
কিরীটীর হাতে ধরি করিল প্রবোধ।।
ক্ষম মম অপরাধ তুমি মহাবোধ।
তাম্রধ্বদ্ধ যুদ্ধ কৈল তোমার সংহতি।।
শুনহ সকল দোষ পাণ্ডবের পতি।
কিরীটী বলেন রাজা নহে অবিচার।।
আচরিল ক্ষত্রধর্ম্ম তনয় তোমার।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন শুন নরবর।।
যুধিষ্ঠির যজ্ঞে যাবে হস্তিনানগর।
তাম্রধ্বজ বলে আমি কিরীটী সাথে।।
আজ্ঞা দেহ যাই আমি তুরগ রাখিতে।
তাম্রধ্বজ পুত্রে ডাকি সকলি কহিল।।
পুরী রাখিবারে সেই অঙ্গীকার কৈল।
কিরীটির সঙ্গে রাজা চলিল আপনি।।
সঙ্গেতে চলিল সেনা লেখা নাহি জানি।
মুর্চ্ছাগত সৈন্য যত আছিল সমরে।।
কৃষ্ণ আজ্ঞা পেয়ে সবে উঠিল সত্বরে।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে ভববারি।