২৬. পাণ্ডবসৈন্যের বৃক্ষদেশে গমন এবং ভীষন রাক্ষস বধ

জন্মেজয় বলিলেন শুন তপোধন।
অমৃত সমান এই ভারত কথন।।
তোমার সুন্দর মুখ পদ্মের সমান।
তাহে কত মধু ঝরে নাহি পরিমাণ।।
পান করি তৃষ্ণা দূর না হয় আমার।
কহ কহ মহামুনি করিয়া বিস্তার।।

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
বৃক্ষদেশ প্রবেশিল পাণ্ডবের হয়।।
বৃক্ষ নামে সেই দেশ মহাভয়ঙ্কর।
ভীষণ নামেতে তথা আছে নিশাচর।।
ত্রিকোটি রাক্ষস আছে তাহার সংহতি।
দেবতা গন্ধর্ব্ব লোকে নাহি করে ভীতি।।
হরগৌরী বরে সেই মহাবলবান।
অমর অসুরগণে করে তুণজ্ঞান।।
অরুণ উদয়কালে যত বৃক্ষগণে।
সুবাসিত পুষ্প তাহে হয় দিনে দিনে।।
মধ্যাহ্ন সময় নবরূপ ফল ধরে।
আনন্দে রাক্ষসগণ তাহা ভোগ করে।।
তাহা দেখি বিস্ময় মানেন ধনঞ্জয়।
প্রবেশিল সেই পাণ্ডবের হয়।।
কামদেব বৃষকেতু আদি বীরগণে।
চমকিত হন সবে রাক্ষস দর্শনে।।
যোড়হস্তে ভীষণ জিজ্ঞাসে সমাচার।
কি কারণে আগমন হইল তোমার।।

পুরোহিত বলে শুন রাক্ষসের পতি।
আজি বড় হৈল মম আনন্দিত মতি।।
স্মরণ হইল এক অপূর্ব্ব কথন।
নরমেধ যজ্ঞ কৈল রাজা দশানন।।
তাহাতে মনুষ্য মাংস খাইনু বিস্তর।
স্ত্রী পুত্রাদি সবাকার পূরিল উদর।।
তুমিহ করহ আজি যজ্ঞ নরমেধ।
তোমার প্রসাদে ঘুচে নরমাংস খেদ।।
(মিসিং)
লম্বোদরী নিশাচরী সম্মূখে দেখিল।
ভীষণ রাক্ষস তারে পাঠাইয়া দিল।।
নরবেশে যাহ তুমি সৈন্যের ভিতরে।
জেনে এস কেবা প্রবেশিল মম পুরে।।
ভীষণের আজ্ঞা পেয়ে হইল মানুষী।
সৈন্যেতে প্রবেশ গিয়া করিল রাক্ষসী।।
একে একে সবাকারে কৈল নিরীক্ষণ।
সম্মূখে দেখিল হনু পবননন্দন।।
হনু দেখি ভয় তার জন্মিল অন্তরে।
তত্ত্ব লয়ে শীঘ্র গেল ভীষণ গোচরে।।
লম্বোদরী বলে শুন রাক্ষসের পতি।
কটক চর্চ্চিয়া এনু যেমত শকতি।।
অর্জ্জুন প্রধান তাহে পাণ্ডুর নন্দন।
আইল যজ্ঞের ঘোড়া করিতে রক্ষণ।।
মহা মহা বীরগণ দেখিলাম তাতে।
হনুমান দেখিলাম অর্জ্জুনের রথে।।
ঘটোৎকচ সুত মেঘবর্ণ মহাবলী।
পাণ্ডব মিলনে অতি হয়ে কুতূহলী।।
কিন্তু হনুমান দেখি উপজিল ভয়।
সংগ্রামেতে কার্য্য নাহি জানাই তোমায়।।
হনুমান দেখি মনে বড় হয় শঙ্কা।
হনুমান হৈতে প্রভু নাশ হৈল লঙ্কা।।
(মিসিং)

এত যদি লম্বোহরী বলিল ভারতী।
দেবের অগম্য তুমি নাম বৃক্ষদেশ।।
মরিতে অর্জ্জুন কৈল ইহাতে প্রবেশ।
ভাল হৈল পিতৃবৈরী আইল আপনি।।
নিশ্চয় বধিব আজি ভীমের পরাণী।
বক নামে মম পিতা বিদিত সংসারে।।
ভীমার্জ্জুন মম শত্রু বিনাশিল তারে।
রাক্ষসের বৈরী বটে বীর হনুমান।।
নিশ্চয় বধিব আজি ভীমের পরাণ।
সাজ সাজ বলি ডাকে ভীষণ রাক্ষস।।
যুদ্ধ হেতু নিশাচর করিল সাহস।
বৃষকেতু কামদেব বরিষয়ে শর।।
বিন্ধিয়া রাক্ষসগণে করিল জর্জ্জর।
যুবনাশ্ব অনুশাল্ব বরিষয়ে বাণ।।
নীলধ্বজ হংসধ্বজ করয়ে সংগ্রাম।
মেঘবর্ণ সহদেব সুবেশ সহিত।।
যুঝয়ে রাক্ষসগণ মনে নাহি ভীত।
অর্জ্জুন যুড়েন বাণ পূরিয়া সন্ধান।।
নানা মায়া ধরে সেই রাক্ষস প্রধান।
মেঘরূপ হয়ে করে বাণ বরিষণ।।
বাণেতে অর্জ্জুন তাহা করে নিবারণ।
বৃক্ষ শিলা পর্ব্বত বরিষে নিশাচর।।
বৃষকেতু বাণ এড়ি কাটয়ে সত্বর।
ক্রুদ্ধ হৈল ভীমসেন রাক্ষসের বাণে।।
গদা হাতে ধায় বীর শঙ্কা নাহি মনে।
কালদণ্ডসম গদা হাতেতে করিয়া।।
ভীষণেরে মারিলেন সাহস করিয়া।
ভীমের গদার বেগ কে সহিতে পারে।।
মুর্চ্ছাগত নিশাচর দারুণ প্রহারে।
ভীষণ রাক্ষস উসে সাহস করিয়া।।
অর্জ্জুনের শিরে মারে মুষল ফেলিয়া।
মোহ যায় ধনঞ্জয় মুষলের ঘাতে।।
তাহা দেখি ভীমসেন ধায় গদা হাতে।
হানিল গদার বাড়ি ভীষণ রাক্ষসে।।
দৈবে প্রাণ পেয়ে সেই পলায় তরাসে।
যুদ্ধ দেখি হনুমানে আনন্দ বাতিল।।
হনুমান দেখিয়া পলায় নিশাচর।
শরীর ত্যজিয়া কেহ গেল যমঘর।।
প্রাণভয়ে পলাইল সবে ঘোর বনে।

কত সৈন্য সঙ্গে লয়ে ভীষণ দুর্ম্মতি।।
মায়াতে হইল সেই মুনির মুরতি।
মায়া পাতি করিল মধুর ফুল ফল।।
মায়াতে নির্ম্মাণ কৈল সরোবর জল।
সঙ্গে নিশাচরগণ শিষ্যরূপ হৈল।।
অধ্যয়ন হেতু তারা চৌদিকে বসিল।
হেনমতে মায়া করি আছে নিশাচর।।
রাক্ষস জিনিয়া যান পার্থ ধনুর্দ্ধার।
কতদূর বনেতে দেখেন তপোধন।।
মুনিরূপে বসে আছে সঙ্গে পুণ্যজন।
অর্জ্জুনে দেখিয়া ভয়ে আদর করিল।।
অতিথি বলিয়া পাদ্য অর্ঘ্য যোগাইল।
দীর্ঘ নখ জটাভার দেখি ধনঞ্জয়।।
মুনিজ্ঞানে তাহারে কহেন সবিনয়।
শুন প্রভু তব স্থানে চাহি আশীর্ব্বাদ।।
অশ্বমেধ সাঙ্গ হৈলে পুরে মনোসাধ।

মুনি বলে শুন তুমি পাণ্ডুর নন্দন।।
যজ্ঞ সাঙ্গ তোমার করিবে নারায়ণ।
কিন্তু বিশ্রাম করহ এই স্থানে।।
আমার অতিথি হও দিন অবসানে।
বিবেচনা মনে করিলেন ধনঞ্জয়।।
রাক্ষস বলিয়া তারে জানেন কথায়।
অর্জ্জুন বলেন মায়া না করিহ তুমি।।
মুনিবেশ ধরিয়াছ জানিয়াছি আমি।
কিন্তু মম স্থানে আজি নাহিক নিস্তার।।
এখনি পাঠাব তোমা যমের দুয়ার।
প্রাণ ভয়ে তপস্বী হইল নিশাচর।।
বিদিত হইল মায়া সবার গোচর।
এত বলি অর্জ্জুন নিলেন ধনুর্ব্বাণ।।
ভয়েতে রাক্ষস হয় নিজ মূর্ত্তিমান।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখি বীর ধনঞ্জয়।।
গাণ্ডীবে টঙ্কার দেন হইয়া নির্ভয়।
গাণ্ডীবে টঙ্কার শুনি এল সর্ব্বজন।।
যুবনশ্ব অনুশাল্ব কর্ণের নন্দন।
ভীম হংসধ্বজ আদি যত বীরগণ।।
ত্বরায় আইল সবে করিবারে রণ।
গাছ শিলা অর্জ্জুনে মারয়ে নিশাচর।।
বাণে নিবারেণ তাহা পার্থ ধনুর্দ্ধর।
বহু যুদ্ধ করিলেন ভীষণ সংহতি।।
গদাঘাতে মারিলেন ভীম মহামতি।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে ভববারি।
(মিসিং)