২৩. সুরথের যুদ্ধ ও মৃত্যু এবং হংসধ্বজ রাজার শ্রীকৃষ্ণ দর্শন

জন্মেজয় বলিলেন শুন মুনিগণ।
অপূর্ব্ব ভারত কথা শুনিতে সুন্দর।।
দুই বাণে যুবনাশ্ব হৈল হতজ্ঞান।
রথ লয়ে সারথি হইল পাছুয়ান।।
সুবেগে বিন্ধিল বীর ষষ্ঠি গোটা বাণে।
ভঙ্গ দিল সৈন্যগণ ভয় পেয়ে মনে।।
সৈন্য ভঙ্গ দেখিয়া কুপিত ধনঞ্জয়।
জিজ্ঞাসেন নারায়ণে করিয়া বিনয়।।
সংগ্রাম করিতে আসে কোন্ মহারথী।
সৈন্য ভঙ্গ দিল মম যত সেনাপতি।।
সুরথ উহার নাম বড় বলবান।
সংগ্রামে না হয় কেহ উহার সমান।।
অর্জ্জুন বলেন রথ চালাও শ্রীহরি।
আজি সুরথেরে পাঠাইব যমপুরী।।
পার্থে দেখি সুরথ করয়ে অহঙ্কার।
পড়িলে আমার হাতে নাহিক নিস্তার।।
সুরথের বচনে অর্জ্জুন ক্রুদ্ধ হৈল।
এক শত বাণ বীর ধনুকে যুড়িল।।
মারেন আকর্ণ পূরি সুরথ উপরে।
ভূপতি তনয় তাহা নিবারিল শরে।।
তবেত সুরথ হংসধ্বজের কোঙর।
হুঙ্কারে এড়িল অস্ত্র অর্জ্জুন উপর।।
লুপ্ত হৈল রবিকর সব অন্ধকার।
দিব্য অন্ত্রে সংগ্রাম করয়ে বার বার।।
জিনিতে না পারে যুদ্ধ সুরত চিন্তিত।
চঞ্চল নয়ন বীর দৃষ্টি চারিতিত।।
কপিধ্বজ রথখান দেখিয়া সম্মূখে।
দুই হাতে সাপটিয়া ধরিল তাহাকে।।
সাপটি তুলিল রথ নিজ বাহুবলে।
ফেলাইয়া দিতে চাহে সমুদ্রের জলে।।
তাহা দেখি ঈষৎ হাসিয়া গদাধর।
বিশ্বম্ভর মূর্ত্তি হইলেন রখোপর।।
তুলিতে নারিল রথ ভূমিতে পাড়িল।
আপনার রথে গিয়া আরোহণ কৈল।।
সুরথের বিক্রম দেখিয়া ধনঞ্জয়।
গাণ্ডীব নিলেন বীর অত্যন্ত নির্ভর।।
অর্জ্জুন এড়েন বাণ পূরিয়া সন্ধান।
সুরথের মাথা কাটি করে দুই খান।।
পড়িল সুরথ হংসধ্বজের নন্দন।
মুণ্ড লয়ে শিবদূত করিল গমন।।
বৈষ্ণবের মুণ্ড বলি নিলেন শঙ্কর।
সুরথ পড়িল বার্ত্তা পায় নৃপবর।।
পুত্রশোকে হংসধ্বজ করয়ে রোদন।
প্রবোধ করেন পাত্র মিত্র সর্ব্বজন।।
কেমনে দেখিব হরি বল না আমারে।
পাত্র বলে মহারাজ চলহ সত্বরে।।
রথ পদাতিক লয়ে করহ গমন।
অর্জ্জুনের সারথি দেখিব নারায়ণ।।
আপনি যজ্ঞের ঘোড়া লহ নরপতি।
হরির সম্মূখে রাখি করহ প্রণতি।।
নানা উপহার লয়ে চলে নরপতি।
দূত গিয়া শ্রীহরিরে কহেন ভারতী।।
অশ্ব লয়ে আসে হংসধ্বজ নরবর।
শরণ লইবে তব শুন গদাধর।।
নৃপতির অভিপ্রায় বুঝি যদুবর।
বারণ করেন পার্থে করিতে সমর।।
হেনমতে হংসধ্বজ আইল ত্বরিতে।
দেখিলেন নারায়ণে অর্জ্জুনের রথে।।
শঙ্খ চক্র গদাপদ্ম চতুর্ভুজ লীলা।
মকর কুণ্ডল কর্ণে গলে বনমালা।।
নবজলধর জিনি শ্রীমঙ্গের আভা।
দক্ষিণ বামেতে লক্ষা সরস্বতী শোভা।।
পারিষদগণ তাঁর সঙ্গেতে দেখিল।
রথ হৈতে হংসধ্বজ ভূমেতে নামিল।।
অষ্টাঙ্গে প্রণাম করি পড়িল ভূমেতে।
গোবিন্দ চরণে মাথা লাগিল ভূমিতে।।
যোড়হস্ত হয়ে রাজা করিল স্তবন।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি ত্রিলোচন।।
কুবের বরুণ তুমি দেব পুরন্দর।
তুমি চন্দ্র তুমি সূর্য্য তুমি বৈশ্বানর।।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্ত্য তুমি দিবারাতি।
সলিল সাগর তুমি সর্ব্ব অব্যাহতি।।
তা সবার মূল তুমি দেব নারায়ণ।
তোমাতেই সর্ব্ব সৃষ্টি লভিল জনম।।
অপার মহিমা তব কেহ নাহি জানে।
বলিতে না পারে ব্রহ্মা সহস্র বদনে।।
আমার মনেতে প্রভু এই ছিল সাধ।
অর্জ্জুন সহিত তোমা দেখি কালাচাঁদ।।
সে সাধ সম্পূর্ণ আজি হইল আমার।
দয়াময় দয়া করি করহ নিস্তার।।
ধন্য ধনঞ্জয় বীর পাণ্ডুর নন্দন।
যার রথে আছ তুমি ব্রহ্ম সনাতন।।
সফল জনম মম হৈল এতদিনে।
দেখিনু তোমার রূপ আপন নয়নে।।
এত বলি হংসধ্বজ স্তবন করিলে।
ভক্তপ্রিয় হরি তারে করিলেন কোলে।।
হরির প্রসাদ পেয়ে সুখী নরপতি।
অর্জ্জুন চরণে রাজা করিল প্রণতি।।
আলিঙ্গনে রাজারে তোষেন ধনঞ্জয়।
হেনকালে অনুচরে আনিলেক হয়।।
হংসধ্বজ বলিলেন পাণ্ডুর নন্দন।
ঘোড়া ধরিলাম দেখিবারে নারায়ণ।।
পূর্ণ হৈল অভিলাষ হরিকে দেখিয়া।
শুন অর্জ্জুন তুমি যাহ অশ্ব লৈয়া।।
কিন্তু এক ভিক্ষা আমি মাগিছে তোমারে।
আজি তুমি বিশ্রাম করহ মম পুরে।।
অনুমতি দেন পার্থ রাজার বচনে।
কৃষ্ণ লয়ে গেল রাজা নিজ নিকেতনে।।
সবান্ধবে নৃপতি দেখিল নারায়ণে।
যতেক আনন্দ হৈল না যায় লিখনে।।
যথাযোগ্য আহারে তুষিল সবাকারে।
রজনী বন্ধন দ্বার ধ্বংসজ্ঞ পুরে।।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।
কাশীরাম দাস কহে তরি ভববারি।।