১১. নীলধ্বজ রাজার সহিত যুদ্ধ

বৈশম্পায়ন কহেন শুন জন্মেজয়।
দক্ষিণ দিকেতে গেল পাণ্ডবের হয়।।
পশ্চাতে চলিল সৈন্য নানা অস্ত্র ধরি।
করিল প্রবেশ গিয়া মাহেশ্বরা পুরি।।
মাহেশ্বরী পুরে রাজা নীলধ্বজ নাম।
অস্ত্র শস্ত্র বিশারদ বীর গুণধাম।।
ধর্ম্মেতে পৃথিবী পালে নীলধ্বজ রায়।
নানা সুখে আছে প্রজা ক্লেশ নাহি পায়।।
প্রবীর নামেতে তার প্রধান তনয়।
যৌবনে হইয়া মত্ত নাহি ধর্ম্ম ভয়।।
যুবতী লইয়া সদা কেলি করে জলে।
নানা রঙ্গে নানা ভঙ্গে খেলে কুতূহলে।।
হেনকালে সেই অশ্ব যায় সেই পথে।
প্রবীর বনিতা তাহা পাইল দেখিতে।।
মদন মঞ্জরী নামে প্রবীর বনিতা।
স্বামী আগে যোড়হাতে কহে ধীরে কথা।।
হের দেখ অশ্ব আসে সর্ব্বসুলক্ষণ।
ঘোড়ার অঙ্গেতে কত মুকুতা রতন।।
সোথার নূপুর ‍বাজে অশ্বের চরণে।
ভুলিল আমার মন অশ্ব দরশনে।।
অশ্ব ধরি দেহ মোরে প্রাণের ঈশ্বর।
নহিলে মরিব আমি তোমার গোচর।।
বনিতার বাক্য শুনি রাজার নন্দন।
ছুটিয়া ধরিল ঘোড়া, সর্ব্ব সুলক্ষণ।।
অশ্ব ভালে লিখন পড়িল নৃপসুত।
পড়ি লেখা অহঙ্কার বাড়িল বহুত।।
অশ্ব ধরি কুমার কহিল নারীগণে।
ঘোড়া লয়ে তোমরা চলহ নিকেতনে।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করে রাজা যুধিষ্ঠির।
অশ্বেরে রক্ষিতে এল ধনঞ্জয় বার।।
অহঙ্কারে অশ্বভালে করেছে লিখন।
ধরিতে আমার ঘোড়া, আছে কোনজন।।
যদি কেহ অশ্ব ধরে বিনাশিব তারে।
আনিব যজ্ঞের ঘোড়া, হস্তিনানগরে।।
কদাচিত আমি অশ্ব না দিব পাণ্ডবে।
ঘোড়া না পাইলে আসি সংগ্রামে করিবে।।
অতএব তোমা সবা যাও অন্তপুরে।
বান্ধিয়া রাখহ ঘোড়া লয়ে পাক ঘরে।।
হেথা অশ্ব না দেখিয়া পাণ্ডবেরগণ।
নানা অস্ত্র লয়ে যায় করিবারে রণ।।
আগে আসে পার্থ বীর ধনুঃশর হাতে।
দেখা হল তবে তাঁর প্রবীরের সাথে।।
জিজ্ঞাসা করেন তাঁরে বীর ধনঞ্জয়।
ধরিলে যজ্ঞের ঘোড়া মনে নাহি ভয়।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করিছেন যুধিষ্ঠির।
ঘোড়া ধরে পৃথিবীতে আছে কোন বীর।।
প্রবীর বলিল নাহি কর অহঙ্কার।
ঘোড়া ধরি আমি নীলধ্বজের কুমার।।
বুঝিব তোমার শক্তি পাণ্ডব নন্দন।
লইবে কেমনে ঘোড়া করি তুমি রণ।।
হাসিয়া অর্জ্জুন বলে যুদ্ধ তোর সনে।
একথা জানিলে হাসিবেক ক্ষত্রগণে।।
বিবাদ করিব আমি বালক সংহতি।
যুঝিবে তোমার সঙ্গে মম সেনাপতি।।
অর্জ্জুনের বাক্য রোষে রাজার কুমার।
আকর্ণ পুরিয়া দিল ধনুকে টঙ্কার।।
এত শুনি অগ্নিদেব প্রবেশিল রণে।
অর্জ্জুন কটক সব দহিল আগুনে।।
দেখিয়া অর্জ্জুন কহিছেন বৈশ্বানরে।
ক্ষমা করি অগ্নি হও সদয় আমারে।।
খাণ্ডব দহিয়া আমি তুবিনু তোমারে।
অক্ষয় কবচ তুমি দিয়াছ আমারে।।
এখন শত্রুতা কর কিসের লাগিয়া।
মিনতি করিয়া বলি যাহ নিবর্ত্তিয়া।।
অশ্বমেধ করিবেন পাণ্ডুর নন্দন।
তাহাতে করিবে তুমি আহুতি ভক্ষণ।।
অর্জ্জুন বচনে অগ্নি সম্প্রীতি পাইল।
তেজ নিবারণ করি অর্জ্জুনে তুষিল।।
অগ্নির পাইয়া আজ্ঞা বীর ধনঞ্জয়।
এড়িলেন বরুণাস্ত্র হইয়া নির্ভয়।।
নির্ব্বাণ হইল অগ্নি সলিল পরশে।
মন্দানল হয়ে গেল নৃপতির পাশে।।
ভয়ে ভঙ্গ দিল যত নৃপ সেনাগণ।
আপনি পলায় রাজা পরিহরি রণ।।
প্রবীর রাজার পুত্র আছিল পশ্চাতে।
দেখিয়া অর্জ্জুনে সেই আইল ত্বরিতে।।
অর্দ্ধচন্দ্রবাণে তার মুণ্ড কাটা গেল।
প্রবীর রাজার পুত্র ভূমিতে পড়িল।।
পুত্রশোকে নীলধ্বজ বিরস বদন।
ভঙ্গ দিল মনোদুঃখ পাইয়া রাজন।।
নীলধ্বজে কহে অগ্নি মধুর ভারতী।
অর্জ্জুনে জিনিতে নাহি তোমার শকতি।।
আমার বচনে তুমি পরিহর রণ।
মনুষ্য না হয় পার্থ নর নারায়ণ।।
আমি অগ্নি শুন রাজা পাণ্ডবের পক্ষ।
পাণ্ডবের সখ্যকরি না করি অসখ্য।।
তুরগ অর্পিয়া তুমি দ্রুত কর প্রীতি।
রাজ্য প্রজা রক্ষা পাবে শুন নরপতি।।
নহেত অসাধ্য বড় হইবে দুষ্কর।
রাখিতে নারিব আমি শুন নৃপবর।।
জামাতার বাক্য শুনি নীলধ্বজ রায়।
অশ্ব আনিবার তরে অন্তঃপুরে যায়।।
পুত্রশোকে নৃপতির অন্তর জর্জ্জর।
নয়নে সলিল ধারা বহে নিরন্তর।।
বিরস বদনে রাজা গেল অন্তঃপুরে।
কহিল সকল কথা প্রিয়ার গোচরে।।
সংগ্রামে পড়িল পুত্র সমাচার পেয়ে।
ক্রন্দন করেন রাণী অচেতন হয়ে।।
কোথা সে প্রবীর বলি কাঁদে নরপতি।
পুত্রশোকে অচেতনা জনা গুণবতী।।
নৃপতি বলেন তুমি না কাঁদিও আর।
অশ্ব দিয়া রাজ্য আমি রাখি আপনার।।
ছিলাম পুরুষ আমি, হইলাম নারী।
এ সব ঈশ্বরলীলা বুঝিতে না পারি।।
সম্প্রীতি করিব আমি অর্জ্জুনের সনে।
সংগ্রামে মরিল পুত্র কার্য্য নাহি রণে।।
জনা বলে কি কথা কহিলে নরপতি।
শত্রু সঙ্গে কেমনেতে করিবে পিরীতি।।
প্রবীরে মারিয়া সে হইল মোর অরি।
তার সঙ্গে প্রীতি কর কহিতে না পারি।।
সাহস করিয়া তুমি কর গিয়া রণ।
অর্জ্জুনে নাশিয়া কর শোক নিবারণ।।
নীলধ্বজ রাজা বলে শুন রূপবতী।
জামাতা হারিল রণে অর্জ্জুন সংহতি।।
যার বাহুবলে আমি জিনি সবাকারে।
স্থির হতে নারে সেই অর্জ্জুনের শরে।।
তুমি কি বুঝাবে নীতি সব আমি জানি।
পাণ্ডবের সহায় আপনি চক্রপাণি।।
প্রীতি করি তীর সনে অশ্ব সমর্পিয়া।
অশ্বরক্ষা হেতু প্রয়ে যাব গোড়াইয়া।।
শুনি তাহা জনা বলে ধিক্ বীরপণা।
রহিল ঘুষিতে অপযশের ঘোষণা।।
ক্ষত্রকুলে জনমিয়া ত্যজিলে সংগ্রাম।
শত্রুর আশ্রয় লয়ে বৃথা ধর নাম।।
তোমর সম্মুখে মৈল কোলের কুমার।
পুত্র শোকে মরি এই তোমার গোচর।।
এত বলি রাজরাণী কাঁদে উচ্চৈঃস্বরে।
অশ্ব লয়ে নরপতি আইল বাহিরে।।
অর্জ্জুনের অশ্ব দিল নীলধ্বজ রায়।
যোড়হাতে বলে ক্ষমা করহ আমায়।।
না জানিয়া মোর পুত্র তুরঙ্গ ধরিল।
বিধাতা তাহার ফল হাতে হাতে দিল।।
এত বলি নীলধ্বজ অর্জ্জুনের সঙ্গে।
তুরঙ্গ রাখিতে রাজা গেল অতি রঙ্গে।।
তাহা শুনি রাণী অতি ক্রুদ্ধা হয়ে মনে।
অন্তঃপুর ত্যজি গেল ভ্রাতার সদনে।।