১০. অশ্বমেধ যজ্ঞের উদ্‌যোগ

জন্মেজয় কহিলেন কহ মহামুনি।
যজ্ঞের আরম্ভ কথা অপূর্ব্ব কাহিনী।।
অর্জ্জুন গেলেন যদি অশ্ব রাখিবারে।
ভ্রমণ করিল ঘোড়া পৃথিবী ভিতরে।।
ধরিয়া রাখিল ঘোড়া কোন্ বলবান।
কার সহ কি প্রকার সংগ্রাম বিধান।।
আমাকে সে সব কথা কহ তপোধন।
তোমার প্রসাদে শুনি পূর্ব্ব বিবরণ।।
বলেন বৈশম্পায়ণ শুন জন্মেজয়।
অশ্ববেধ শ্রবণেতে পাপ নষ্ট হয়।।
বলিলেন ব্যাস তবে ধর্ম্মরাজ প্রতি।
মুনি ঋষি আমন্ত্রিয়া আন শীঘ্রগতি।।
আরম্ভ করহ যজ্ঞ মধূ পূর্ণিমাতে।
যজ্ঞের সামগ্রী তুমি আনহ ত্বরিতে।।
ব্যাসের বচনে রাজা ভীমে পাঠাইয়া।
ঋষি মুনি ব্রাহ্মণেরে অনেন ধরিয়া।।
পাণ্ডবের আমন্ত্রণ প্রাপ্তে মুনিগণ।
হস্তিনানগরে আসি দিল দরশন।।
পাদ্য অর্ঘ্যে যুধিষ্ঠির করিয়া পূজন।।
বসিলেন যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে স্মরিয়া।
ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল লইয়া।।
অনুচরে আয়োজন সব যোগাইল।
যজ্ঞের মণ্ডপে যব যতনে থুইল।।
বেদের বিধানে মঞ্চ করিল নির্ম্মাণ।
আশী হাত গর্ত্ত সেই সুন্দর গঠন।।
শাস্ত্রমত কুণ্ড শত হাত পরিসর।
নির্ম্মাইল যজ্ঞবেদী পরম সুন্দর।।
সুবর্ণ রচিত ঘট অরোপিল তাতে।
পুষ্পঝারা বান্ধিল চান্দোয়া চারিভিতে।।
দ্রৌপদীর সহিত ধর্ম্মরাজ করি স্নান।
করিলেন দোঁহে শুক্লবস্ত্র পরিধান।।
বেদধ্বনি করিলেন সর্ব্ব মুনিগণ।
ধৌম্য পুরোহিত করে বেদ উচ্চারণ।।
সঙ্কল্প করেন শুভক্ষণে নরপতি।
তবে ব্যাসদেব নৃপে দেন অনুমতি।।
ব্রাহ্মণ বরণ কর বসন ভূষণে।
ত্বরায় আনহ অশ্ব যজ্ঞ সন্নিধানে।।
ব্যাসের বচনে রাজা সানন্দ হইয়া।
আনাইল তুরঙ্গকে যজ্ঞে সাজাইয়া।।
আসন বসন সব কনকে রচিত।
সুবর্ণের থালি ঝারি মণিতে খচিত।।
বিংশতি সহস্র বিপ্রে করিছে বরণ।
প্রত্যক্ষ সবারে দেন আসন ভূষণ।।
বরণ পাইয়া চিত্তে আনন্দিত মনে।
বসিল সকল দ্বিজ যজ্ঞ আরম্ভনে।।
দ্রৌপদী সহিত ব্রতী হইল রাজন।
মধুপূর্ণিমাতে হৈল যজ্ঞ আরম্ভন।।
সর্ব্ব সুলক্ষণ ঘোড়া আনিয়া সত্বর।
প্রক্ষালেন দুই পদ ধর্ম্ম নরবর।।
কুসুম চন্দনে ঘোড়া করিল ভূষণ।
বান্ধিলেন অশ্বভালে সুবর্ণ দর্পন।।
যুধিষ্ঠির নিজ নাম লিখেন দর্পণে।
পৃথিবী ভ্রমিবে ঘোড়া আপনার মনে।।
যদি কেহ বীর থাকে পৃথিবী ভিতরে।
ধরিলে যজ্ঞের ঘোড়া জিনিব তাহারে।।
নিজ বলে ছাড়াইয়া তুরগ আনিব।
তবে অশ্বমেধ যজ্ঞে সঙ্কল্প করিব।।
অশ্বভালে দর্পণেতে এ সব লিখিল।
ঘোটক অঙ্গেতে নানা অলঙ্কার দিল।।
কুন্তী আর গান্ধারী প্রভৃতি যত নারী।
হুলাহুলি মঙ্গল করিল আগুসরি।।
সত্যভামা আমি যত কৃষ্ণের রমণী।
মঙ্গল বিধানে অশ্ব পূজিল তখনি।।
ধনঞ্জয়ে ডাকিয়া বলিল নরবর।
অশ্ব রক্ষা হেতু ভাই সাজহ সত্বর।।
আমি ব্রতী হইয়া রহিব যজ্ঞস্থানে।
দিবানিশি দ্রৌপদী সহিত একাসনে।।
অসিপত্র ব্রত আচরণে দিব মন।
যতনে করিও ভাই ঘোটক রক্ষণ।।
অশ্ব চুরি হৈলে যজ্ঞ সাঙ্গ নাহি হবে।
ব্রত নস্ট হবে আর কলঙ্ক রটিবে।।
শুনিয়াছি মুনি মুখে এ সব কথন।
অশ্বহারা হয়ে দুঃখ পায় কত জন।।
যতনে রাখিবে অশ্ব বীর ধনঞ্জয়।
পৃথিবী ভ্রমিলে ঘোড়া কার্য্য সিদ্ধি হয়।।
নকুল থাকিবে মাত্র আমার সংহতি।
সঙ্গেতে লইয়া যাও যত সেনাপতি।।
খাণ্ডব দহিয়া তুমি তুষিলে অনলে।
নিবাত কবচ বিনাশিলে বাহুবলে।।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্বে করিলে অপমান।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ সহ করিলে সংগ্রাম।।
অর্জ্জুন বলেন রাজা চিন্ত অকারণে।
আমারে জিনিতে বীর নাহি ত্রিভুবনে।।
পৃথিবী ভ্রমিয়া আমি তুরঙ্গ আনিব।
যদি কেহ ঘোড়া ধরে তারে বিনাশিব।।
কৃষ্ণের প্রসাদে ভয় না করি কাহারে।
কহিলাম সত্য আমি সবার গোচরে।।
এত বলি ধনঞ্জয় হইল বিদায়।
ঋষি মুনিগণ দিল জয়ধ্বনি তায়।।
অশ্ব পিছে ধনঞ্জয় করেন প্রয়াণ।
বাজায় দামামা তেরি খমক নিশান।।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন ভীম মহাবীরে।
অর্জ্জুনের সঙ্গে যাও অশ্ব রাখিবারে।।
প্রদ্যুন্নকে ডাকিয়া বলিল নারায়ণ।
অশ্ব রাখিবারে পুত্র করহ গমন।।
কৃতবর্ম্মা সাত্যকি যতেক ধনুর্দ্ধর।
গদা শাম্ব সঙ্গে লয়ে চলহ সত্বর।।
রাখিও তুরগ সবে মন্ত্রণা করিয়া।
যুঝিও সমর মধ্যে সাবধান হৈয়া।।
এত বলি প্রত্যেকেরে করিলা বিদায়।
প্রণমিয়া নারায়ণে সব সৈন্য যায়।।
যুবনাশ্ব অনুশাল্ব সুবেগ কুমার।
অর্জ্জুনের সঙ্গে যান অশ্ব রাখিবার।।
বৃষকেতু বীর আদি কর্ণের নন্দন।
অনেকে অশ্বের সঙ্গে করিল গমন।।
দৈবযোগে তুরঙ্গ চলিল শুভক্ষণে।
প্রথমে যজ্ঞের ঘোড়া চলিল দক্ষিণে।।
বিজয় পাণ্ডব কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে ভবরারি।।