১০. অনুশাম্বের যুদ্ধ

জিজ্ঞাসেন জন্মেজয়, ওহে মহামুনি।
কহ দেখি কি উৎপাত, তব মুখে শুনি।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুনহ রাজন।
আরম্ভ না হতে যজ্ঞ যুদ্ধের পত্তন।।
অনুশাল্ব নামে এক দৈত্যের ঈশ্বর।
কৃষ্ণের উদ্দেশে আসে হস্তিনা নগর।।
গজ বাজী রথ রথী সেনাগণ লৈয়া।
বহু সৈন্যে অনুশাল্ব আইল সাজিয়া।।
বেড়িল হস্তিনাপুরী শঙ্কা নাহি করে।
হাট বাট বেড়িল পদাতি থরে থরে।।
উচ্চৈঃস্বরে ডাকে দৈত্য কোথা গদাধর।
পলায়ে আইলে মোর মারি সহোদর।।
আজি তোমা বিনাশিব, ইথে নাহি আন।
পাণ্ডবে শরণ নিলে রাখিবারে প্রাণ।।
পলাইয়া আইলে হে দ্বারকা ছাড়িয়া।
হস্তিনা আইনু আমি তোমার লাগিয়া।।
এত বলি অনুশাল্ব কহে সৈন্যগণে।
কৃষ্ণকে মারিব আমি আজিকার রণে।।
ভয় না করিহ কেহ করিতে সংগ্রাম।
আমার বিপক্ষ বড় দেব ভগবান।।
আজি কৃষ্ণে আমি যদি দেখিবারে পাই।
ক্ষণমাত্রে বিনাশিব, শুনহ সবাই।।
যতনে করহ সবে কৃষ্ণ অন্বেষণ।
লুকাইল মোর ডরে যাদব-নন্দন।।
যে মোরে দেখাবে কৃষ্ণ সংগ্রাম ভিতরে।
নানা ধন দিয়া তুষ্ট করিব তাহারে।।
কৃষ্ণকে জিনিয়া আমি যত ধন পাব।
সত্য করি কহিলাম, সব তারে দিব।।
যে আমারে দেখাইবে, গোপের নন্দনে।
সেই সে পরম বন্ধু, শুন সর্ব্বজনে।।
এত অহঙ্কার করি প্রবেশে নগরে।
দূত গিয়া সমাচার কহে যুধিষ্ঠিরে।।
অনুশাল্ব দৈত্য আসি বেড়িল নগর।
অহঙ্কারে আসিতেছে করিতে সমর।।
কুবচন কহিলেক কত নারায়ণে।
সে সকল কথা রাজা না শুনি শ্রবণে।।
দূতের বচনে যুধিষ্ঠির নরপতি।
সংগ্রাম করিতে আজ্ঞা দেন শীঘ্রগতি।।
কৃষ্ণ-নিন্দা শুনি সব পাণ্ডবের গণ।
দৈত্যের সহিত যায় করিবারে রণ।।
সহদেব নকুল আর যে ভীমবীর।
অর্জ্জুন গাণ্ডীব লয়ে সাজিলেন ধীর।।
মেঘবর্ণ আর সাজে সুবেগ কুমার।
নানা অস্ত্র লইয়া যতেক পরিবার।।
নানা অস্ত্র লয়ে তবে পাণ্ডবের গণ।
দৈত্যের সম্মুখে আসি দিল দরশন।।
সৈন্য দেখি অনুশাল্ব বলে উচ্চৈঃস্বরে।
কোথা কৃষ্ণ সৈন্য সব, দেখাহ আমারে।।
কোথা গেল গোপ উগ্রসেন-অনুচর।
আইস আমার সঙ্গে করিতে সমর।।
পাণ্ডব সহিত আমি যুদ্ধ নাহি করি।
প্রতিজ্ঞা আমার আছে মারিব শ্রীহরি।।
এত যদি অনুশাল্ব বলিল বচন।
তাহা শুনি কুপিত হইল সর্ব্বজন।।
রণে প্রবেশিল সবে ধনু টঙ্কারিয়া।
দৈত্যকে বিন্ধিল বাণ আকর্ণ পূরিয়া।।
ভীম সহদেব দোঁহে ধনুক পাতিল।
দেখি অনুশাল্ব দৈত্য গর্জ্জিতে লাগিল।।
কুপিত হইয়া তবে দৈত্যের ঈশ্বর।
ভীম সহদেবে বিন্ধি করিল জর্জ্জর।।
দৈত্য-শরে অচেতন হৈল দুই বীর।
সহিতে নারিল রণে, হইল অস্থির।।
ভয়ে ভঙ্গ দিল দোঁহে পরিহরি রণ।
মার মার ডাক ছাড়ে দৈত্য-সেনাগণ।।
দৈত্যের বিক্রম দেখি বীর ধনঞ্জয়।
লোহিত লোচন অতি কুপিত হৃদয়।।
মহাক্রোধে পার্থ বীর করেন সমর।
তাহা দেখি ডাকে তবে দৈত্যের ঈশ্বর।।
শুনহ অর্জ্জুন তুমি আমার বচন।
তোমার প্রতিজ্ঞা যত জগতে ঘোষণ।।
আমারে জিনিতে তব নাহিক শকতি।
সংগ্রাম করিব আমি শ্রীকৃষ্ণ সংহতি।।
আমার বিবাদ-যোগ্য দেব নারায়ণ।
তোমার সহিত আমি না করিব রণ।।
অশক্ত জনের সনে না করি সংগ্রাম।
তুলারাশি দেখি আমি তব যত বাণ।।
এত যদি ডাকিয়া বলিল দৈত্যেশ্বর।
কহিলেন কুপিয়া গাণ্ডীবী ধনুর্দ্ধর।।
কি বলিলি ওরে মূঢ়, নাহি তোর জ্ঞান।
আমি কি সংগ্রামে নহি তোমার সমান।।
খাণ্ডব দহিয়া আমি তুষিনু অনলে।
নিবাতকবচগণে জিনিনু পাতালে।।
আমার সংগ্রামে তুষ্ট হিইলা ঈশান।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্বেরে কৈনু অপমান।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি যত কুরুসেনা।
সবারে জিনিয়া আমি রাখিনু ঘোষণা।।
তোর সম নাহি পাপী, শুন রে বর্ব্বর।
কৃষ্ণের সহিত চাহ করিতে সমর।।
বামন হইয়া চাহ চন্দ্রমা ধরিতে।
আমি তোমা বিনাশিব আজি সমরেতে।।
যদ্যপি আমার হাতে পাও অব্যাহতি।
তবে সে করিহ যুদ্ধ শ্রীকৃষ্ণ সংহতি।।
ইহা বলি অর্জ্জুন গাণ্ডীব লয়ে করে।
অগ্নিবাণ মারিলেন দৈত্যের উপরে।।
ক্রুদ্ধ হৈল অনুশাল্ব অর্জ্জুনের বাণে।
সংগ্রাম করয়ে বীর কঠোর সন্ধানে।।
অর্জ্জুনের যত বাণ নিবারিল শরে।
দুই বীরে মহাযুদ্ধ সংগ্রাম ভিতরে।।
বরুণাস্ত্র সন্ধানিল বীর ধনঞ্জয়।
বায়ুবাণে নিবারিল দৈত্য দুরাশয়।।
মারেন বরুণবাণ ইন্দ্রের নন্দন।
অগ্নিবাণে দৈত্য বীর করে নিবারণ।।
সর্পবাণ এড়িল অর্জ্জুন মহামতি।
গরুড়াস্ত্রে সংহার করিল দৈত্যপতি।।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণ এড়েন শ্বেতবাহন।
ক্ষুরপা বাণেতে দৈত্য করে নিবারণ।।
হেনমতে অর্জ্জুনের যত অস্ত্র ছিল।
অনুশাল্ব দৈত্য তাহা বাণে নিবারিল।।
হেনমতে অর্জ্জুনের যত অস্ত্র ছিল।
অনুশাল্ব দৈত্য তাহা বাণে নিবারিল।।
জিনিতে না পারিলেন ইন্দ্রের তনয়।
দৈত্যের সমরে বড় উপজিল ভয়।।
তবে অনুশাল্ব দৈত্য বিচারিয়া মনে।
অর্জ্জুনে বিন্ধিল বীর এক লক্ষ বাণে।।
মূর্চ্ছিত হইয়া রথে পড়েন কিরীটি।
তাহা দেখি ভঙ্গ দিল সেনা কোটি কোটি।।
কৃতবর্ম্মা সাত্যকি সুবেগ ধনুর্দ্ধর।
অনুশাল্ব সহ গেল করিতে সমর।।
বাণাঘাতে বীর সব অচেতন হৈল।
সংগ্রাম ত্যজিয়া সবে রণে ভঙ্গ দিল।।
যুবনাশ্ব রাজা তবে প্রবেশিল রণে।
অনেক সংগ্রাম কৈল অনুশাল্ব সনে।।
দৈত্যবাণে নরপতি হইয়া জর্জ্জর।
প্রাণভয়ে পলাইল ত্যজিয়া সমর।।
গদ শাল্ব আদি করি যত বীর ছিল।
অনুশাল্ব দৈত্য সহ অনেক যুঝিল।।
জিনিতে নারিল যুদ্ধে প্রাণপণ করি।
ভয়ে পলাইল সবে রণ পরিহরি।।
চিন্তিত পাণ্ডব-সৈন্য দৈত্যের প্রহারে।
প্রাণ লয়ে গেল সবে কৃষ্ণের গোচরে।।
সংগ্রাম-বৃত্তান্ত যত কৃষ্ণেরে কহিল।
তাহা শুনি শ্রীকৃষ্ণের দয়া উপজিল।।
দৈত্য-যুদ্ধে পার্থ বীর হইল কাতর।
শুনিয়া ঈষৎ হাসিলেন গদাধর।।
হাতে পান করি বলে দেব নারায়ণ।
অনুশাল্ব দৈত্যে ধরি দিবে যেই জন।।
আসিয়া লউক পান আমার গোচরে।
ঘুষিবে তাহার যশ জগৎ ভিতরে।।
বীরপুঞ্জ সমক্ষেতে কহিলাম আমি।
ঘুষিতে থাকুক তার যশের কাহিনী।।
ইহা শুনি প্রদ্যুম্ন সাহসে করি ভর।
লইতে কৃষ্ণের পান সবার ভিতর।।
অঙ্গীকার করিলেক কৃষ্ণের সাক্ষাতে।
সাজিল মকরধ্বজ দৈত্যকে মারিতে।।
ধনুর্ব্বাণ নানা অস্ত্র নিল যুদ্ধ হেতু।
সুসজ্জ হইয়া রথে চড়ে মীনকেতু।।
অনুশাল্ব দৈত্য যথা আছয়ে সমরে।
তথাকারে গেল বীর যুদ্ধ করিবারে।।
সৈন্যেতে বেষ্টিত হয়ে আইল অনঙ্গ।
দুই বীরে দেখাদেখি হৈল বড় রঙ্গ।।
আকর্ণ পূরিয়া কাম পূরিল সন্ধান।
অনুশাল্ব হৃদয়ে মারিল দশ বাণ।।
বাণাঘাতে ক্রুদ্ধ হৈল দৈত্য-অধিপতি।
ডাক দিয়া প্রদ্যুম্নেরে বলে শীঘ্রগতি।।
যুঝিতে আইলে তুমি লয়ে ধনুর্ব্বাণ।
দেখিলে না সংগ্রামে বীরের ভঙ্গীয়ান।।
সম্মুখ হইয়া যদি যুঝ মোর সনে।
তবে পাঠাইব তোমা যমের সদনে।।
চোরবংশে জন্ম তোর, জানহ চাতুরী।
গোপঘরে তোর বাপ ননী কৈল চুরী।।
উদুখলে নন্দজায়া বান্ধিল তাহারে।
মিথ্যা নহে এই কথা বিদিত সংসারে।।
গোপিকার বসন হরিল যে শ্রীহরি।
রুক্মিণীরে তোর বাপ আনে চুরি করি।।
কপট করিয়া সে মারিল যত জনে।
না বুঝি অবোধ লোক তাহারে বাখানে।।
কিন্তু সে সকল কর্ম্ম নারিব করিতে।
আমি তোরে যমঘরে পাঠাব নিশ্চিতে।।
এতেক বচনে কাম ক্রুদ্ধ হৈল মনে।
যুড়িল সহস্র বাণ ধনুকের গুণে।।
আকর্ণ পূরিয়া মারে দৈত্যের উপরে।
অনুশাল্ব দৈত্য তাহা নিবারিল শরে।।
তবে দৈত্য শত বাণ পূরিল সন্ধান।
আকর্ণ পূরিয়া কামে মারিলেক বাণ।।
বাণেতে কাটিল সব কৃষ্ণের কুমার।
তাহা দেখি দৈত্য-কেপি বাড়িল অপার।।
দিব্য অস্ত্র ধনুকে যুড়িল দৈত্যপতি।
প্রদ্যুম্নে মারিল বাণ করিয়া শকতি।।
সারথি সহিত উড়াইল রথখান।
পড়িল প্রদ্যুম্ন গিয়া কৃষ্ণ-বিদ্যমান।।
কামদেব দেখি ক্রোধ হৈল গদাধরে।
লাথি মারিলেন তার মস্তক উপরে।।
দৈত্য-বাণে অচেতন ছিল শম্বরারি।
চেতন পাইল বীর পরশিতে হরি।।
তবে কৃষ্ণ কহিলেন প্রদ্যুম্নে চাহিয়া।
রণে ভঙ্গ দিলে তুমি মম পুত্র হৈয়া।।
শুন রে পামর পুত্র তুমি কুলাধম।
তোমা হৈতে কলঙ্ক হইল অনুপম।।
প্রাণভয়ে পলাইলি ত্যজিয়া সংগ্রাম।
কিসের কারণে হেন রাখহ পরাণ।।
আমার সম্মুখে গেলে করি অহঙ্কার।
রণে ভঙ্গ অপযশ ঘুষিবে সংহার।।
ইহা যদি নারায়ণ কহিলেন ক্রোধে।
অধোমুখে রহে কাম মনের বিষাদে।।
পুত্র-অপমান দেখি দুঃখিতা রুক্মিণী।
চিন্তিত হইলেন যুধিষ্ঠির নৃপমণি।।
অর্জ্জুন আসিয়া তবে প্রদ্যুম্নে তুলিল।
এ কর্ম্ম উচিত নহে, কৃষ্ণকে কহিল।।
যুদ্ধে জয় পরাজয় আছে সবাকার।
আপনি জানহ কৃষ্ণ সংসারের সার।।
গরুড়ে চাপিয়া তবে গেলেন শ্রীহরি।
প্রবেশ করেন রণে গদা চক্র ধরি।।
কৃষ্ণে হেরি হরষিত হৈল দৈত্যপতি।
নানা অস্ত্র লয়ে যুঝে কৃষ্ণের সংহতি।।
শত শত বাণ দৈত্য কৈল অবতার।
চক্রে নাশিলেন তাহা দেবকী-কুমার।।
তবে গদা সন্ধান পূরিল নারায়ণ।
প্রাণভয়ে পলাইল দৈত্য-সেনাগণ।।
সৈন্য ভঙ্গ দেখিয়া কুপিল দৈত্যেশ্বর।
ধনু ধরি যুদ্ধ করে কৃষ্ণের গোচর।।
অপার মহিমা কৃষ্ণের জানে কোন্ জন।
দৈত্যসহ করিলেন ঘোরতর রণ।।
দৈত্যশরে জর্জ্জরিত হয়ে দেব হরি।
রহিতে না পারিলেন গরুড় উপরি।।
জর্জ্জর হইল বাণে বিনতা-নন্দন।
দৈত্যশরে কাতর অত্যন্ত নারায়ণ।।
ক্রোধে অনুশাল্ব দৈত্য গদা লয়ে হাতে।
সক্রোধে মারিল গদা গরুড়ের মাথে।।
মোহ গেল, পক্ষীরাজ পলায় সত্বরে।
কৃষ্ণেরে লইয়া গেল ধর্ম্মের গোচরে।।
অচেতন নারায়ণ গরুড় উপরে।
তা দেখি জন্মিল ভয় রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
চিন্তাকুল হৈল বড় পাণ্ডবের গণ।
রণে ভঙ্গ দিয়া আইলেন নারায়ণ।।
এই অমঙ্গল কথা শুনিয়া রুক্মিণী।
কৃষ্ণের সম্মুখে আসি কহে প্রিয়বাণী।।
বুঝিতে পরের দুঃখ কেহ নাহি জানে।
ফলিল আপন অঙ্গে, জ্ঞান হয় মনে।।
যুদ্ধ করি কামদেব হৈল হীনবল।
পলাইল সারথি, পাইলে তুমি ছল।।
চরণ-প্রহারে তারে কৈলে অপমান।
তুমি কেন ভয়ে ভঙ্গ দিলে ভগবান।।
দৈত্য-যুদ্ধ সহিবারে না পারিলে তুমি।
প্রদ্যুম্নে মারিলে লাথি, কি বলিব আমি।।
ঈষৎ হাসেন কৃষ্ণ রুক্মিণী-বচনে।
হেনকালে ভীমসেন কহে নারায়ণে।।
মোর এক নিবেদন শুন চক্রপাণি।
হাসিয়া কলঙ্ক ঘুচাইতে চাহ তুমি।।
না বুঝিয়া প্রদ্যুম্নে করিলে তিরস্কার।
রণভঙ্গ-কথা আমি শুনিনু তোমার।।
তবে যুধিষ্ঠির রাজা ব্যাসে জিজ্ঞাসিল।
দৈত্য-যুদ্ধে নারায়ণ কেন ভঙ্গ দিল।।
ব্যাস বলিলেন, শুন ধর্ম্মের নন্দন।
অনন্ত-মহিমা কৃষ্ণ, বুঝে কোন জন।।
ব্রাহ্মণের বাক্য কৃষ্ণ সত্য করিবারে।
রণে ভঙ্গ দিয়া যান পুরীর ভিতরে।।
গর্গমুনি অভিশাপ দিল নারায়ণে।
অপমান পাবে তুমি অনুশাল্ব-রণে।।
সে কারণে রণে ভঙ্গ দিলেন শ্রীহরি।
শুন রাজা, তোমারে কহিনু সত্য করি।।
নহে কি কৃষ্ণের ভঙ্গ আছয়ে সংগ্রামে।
উৎপত্তি প্রলয় হয় যাঁহার বচনে।।
যন্ত্রের আকার প্রাণী, শুনহ রাজন।
বেদশাস্ত্রে বাখানিল যন্ত্রী নারায়ণ।।
ব্যাসের বচনে তাঁর বিস্ময় ঘুচিল।
দৈত্য-সিংহনাদে মনে ভয় উপজিল।।
হেনকালে বৃষকেতু রাজার সাক্ষাতে।
অহঙ্কার করি বীর বলে যোড়হাতে।।
আজ্ঞা দেহ, যাব আমি করিতে সমর।
দৈত্যকে বান্ধিয়া আনি তোমার গোচর।।
কৃষ্ণের প্রসাদে আমি জিনিব সমর।
ভয় নাই,আজ্ঞা দেহ, শুন নৃপবর।।
দৈত্য-সিংহনাদ আর না পারি সহিতে।
আজ্ঞা দেহ, যাই আমি সংগ্রাম করিতে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন বাছাধন।
তোমারে পাঠাই, হেন নাহি লয় মন।।
রণে ভঙ্গ দিল যবে স্বয়ং যদুপতি।
কিমতে জিনিবে তুমি সে দুষ্ট দুর্ম্মতি।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব কামদেব আর।
না পারিল সহিবারে পরাক্রম যার।।
তুমি শিশু হয়ে যুদ্ধ করিবে কেমনে।
তাই বৃষকেতু আমি ভয় পাই মনে।।
কর্ণশোক পাসরিনু তোমাকে দেখিয়া।
সমরে নাহিক কাজ থাকহ বসিয়া।।
বৃষকেতু বলে, মোর ভয় নাহি মনে।
আজ্ঞা দেহ, যুদ্ধ আমি করি তার সনে।।
তবে অনুমতি দেন রাজা যুধিষ্ঠির।
ধনুর্ব্বাণ হাতে করে যান মহাবীর।।
সিংহনাদ করি সাজে বীর বৃষকেতু।
গোবিন্দে প্রণমি চলে যুঝিবারে হেতু।।
ধর্ম্মরাজে প্রণমিল আর চারি জনে।
সিংহনাদ করি বীর প্রবেশিল রণে।।
ধনুর্ব্বাণ হাতে করি কর্ণের কুমার।
দৈত্যের সম্মুখে বীর বলে মার মার।।
শত শত বাণ বীর এড়ে একবারে।
অগ্নি হেন বাণ বিন্ধে দৈত্যের শরীরে।।
বাণে বাণ নিবারিল দৈত্য-মহামতি।
হেনমতে দোঁহে কৈল অনেক শকতি।।
তবে বৃষকেতু বীর কর্ণের নন্দন।
হৃদয়ে ভাবনা কৈল অভয়-চরণ।।
কৃষ্ণপদ ধ্যান করি যুড়িলেক শর।
বাণাঘাতে মূর্চ্ছাপন্ন দৈত্যের ঈশ্বর।।
মূর্চ্ছাগত অনুশাল্ব হরিল চেতন।
ধাইয়া ধরিল তারে কর্ণের নন্দন।।
অনুশাল্ব দৈত্যেশ্বরে ধরিয়া ত্বরিতে।
আনিয়া দিলেক শীঘ্র ধর্ম্মের অগ্রেতে।।
ধন্য ধন্য বৃষকেতু করিয়া বাখান।
ধর্ম্মপুত্র দেন তারে আলিঙ্গন দান।।
যুদ্ধেতে রাখিলে তুমি আপনার যশ।
বৃষকেতু-গুণে কৃষ্ণ হিইলেন বশ।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব প্রীতি পায় মনে।
আলিঙ্গন দিল সবে কর্ণের নন্দনে।।
তবে অনুশাল্ব দৈত্য পাইল চেতন।
মায়া ঘুচাইল তার কমললোচন।।
দিব্যজ্ঞান দেন তবে দৈত্যের ঈশ্বরে।
কৃষ্ণে দেখি দৈত্যরাজ দণ্ডবৎ করে।।
প্রণমিয়া কহে দৈত্য যোড় করি হাত।
প্রসন্ন হইবে মোরে দেব জগন্নাথ।।
ধন্য ধন্য বৃষকেতু কর্ণের নন্দন।
বান্ধিয়া আনিল মোরে করিয়া যতন।।
সে কারণে দেখিলাম চরণ তোমার।
সফল হইল জন্ম আজি যে আমার।।
যে চরণ হইতে আইল ভাগীরথী।
যে চরণ পরশে সানন্দা বসুমতী।।
যে চরণ সতত ভাবয়ে যোগিগণ।
সে পদ দেখিনু, মোর সফল জীবন।।
ধন্য যুধিষ্ঠির তুমি ধর্ম্মের কুমার।
কৃষ্ণ দরশন পাই মিলনে তোমার।।
আমার অনেক ভাগ্য জন্মে জন্মে ছিল।
সে কারণে কৃষ্ণ-পাদপদ্ম দেখা গেল।।
মদে মত্ত হৈয়া আমি করিলাম রণ।
অপরাধ না লইবে ধর্ম্মের নন্দন।।
তুমি দোষ ক্ষমা কৈলে আর নাহি ভয়।
প্রসন্ন হবেন মোরে কৃষ্ণ মহাশয়।।
দৈত্যের বচনে কহিছেন ধর্ম্মরাজ।
শুন দৈত্য ক্ষমিলাম তোমার অকাজ।।
এত বলি প্রসাদ দিলেন নরপতি।
ধর্ম্মরাজে দৈত্যরাজ করিল প্রণতি।।
দৈত্যকে কহেন ধর্ম্ম মধুর বচনে।
বিদায় দিলাম আমি, যাহ নিকেতনে।।
তবে অনুশাল্ব বলে করি যোড়হাত।
দেশে না যাইব আমি পাণ্ডবের নাথ।।
থাকিব তোমার সঙ্গে হস্তিনা নগরে।
সতত দেখিতে পাব দেব গদাধরে।।
রাজ্য ধনে মম কিছু নাহি প্রয়োজন।
আজ্ঞা কর, কি করিব ধর্ম্মের নন্দন।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, শুন দৈত্যেশ্বর।
অর্জ্জুন সহিত তুমি যাইবে সত্বর।।
রাখিবে যজ্ঞের ঘোড়া করিয়া শকতি।
এই ভার তোমারে দিলাম দৈত্যপতি।।
তুমি আর যুবনাশ্ব অর্জ্জুন সহিত।
রাখিবে যজ্ঞের ঘোড়া হয়ে অবহিত।।
তাহা শুনি অনুশাল্ব আনন্দিত মন।
নিজ সৈন্য আনিলেক করিয়া সাজন।।
অশ্ব রাখিবারে দৈত্য কৈল অঙ্গীকার।
তাহা শুনি প্রীতি পান ধর্ম্মের কুমার।।
এই বিবরণ কহি তোমার গোচর।
আর কি শুনিতে ইচ্ছা, কহ নৃপবর।।
ভারতে অমৃত-কথা আনন্দ লহরী।
কাশী কহে, শুন যদি যাবে ভবে তরি।।