০৮. শ্রীকৃষ্ণের আদর্শনে যুধিষ্ঠিরের উদ্বেগ ও শ্রীকৃষ্ণের পুনরাগমন

হেথা যুধিষ্ঠির রাজা রজনী প্রভাতে।
ডাক দিয়া অর্জ্জুনেরে আনেন সাক্ষাতে।।
একেলা অর্জ্জুনে দেখি কহেন রাজন।
বলহ কিরীটি কোথা বিপদ ভঞ্জন।।
অর্জ্জুন বলেন হরি ছিলেন সভায়।
তত্ত্ব নাহি জানি, তিনি আছেন কোথায়।।
ধর্ম্ম বলিলেন কৃষ্ণ তোমার গোচরে।
সতত থাকেন ইহা বিদিত সংসারে।।
না বলিয়া গোবিন্দ গেলেন নিজালয়ে।
কি পাপ জন্মিল ভাই আমার হৃদয়ে।।
এত বলি অধোমুখে আছেন নৃপতি।
ভীম সহদেব তথা আইল ঝটিতি।।
ধৃতরাষ্ট্র বিদুর আইল দুইজন।
হেনকালে আসিলেন ব্যাস তপোধন।।
ব্যাসে দেখি যুধিষ্ঠির করেন প্রণতি।
আশীর্ব্বাদ করিলেন ব্যাস মহামতি।।
অবধান কর শুন মুনি মহামতি।
ঘোড়া আনিলেক ভীম করিয়া শকতি।।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ বিক্রম করিল।
সহ পরিবার রাজা আমারে ভজিল।।
আপনি আইল রাজা তুরঙ্গ লইয়া।
সম্প্রীতি পাইল রাজা আমারে দেখিয়া।।
মুনি কন যুধিষ্ঠির শুনহ বচন।
আর ভয় নাই যজ্ঞ কর আরম্ভন।।
নিমন্ত্রিয়া আন যত্ ঋষি মুনিগণে।
যজ্ঞ আরম্ভন কর আজি শুভক্ষণে।।
উত্তম মধ্যমাধম এ তিন প্রকার।
সবাই পালিবে ধর্ম্ম যথাশক্তি যার।।
উত্তম যে লোক তার শুন ব্যবহার।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম ধর্ম্মের কুমার।।
লোভ মোহ ক্রোধ ত্যজি ‍কৃষ্ণে কর মতি।
উত্তম সে ভাগবত শুনে নরপতি।।
শত্রু মিত্র বলি তত্ত্ব কিছুই না জানে।
মধ্যম সে ভাগবত জানে সর্ব্বজনে।।
পরনারী পরদ্রব্য হরিবারে মন।
অধম বলিয়া তারে জানিবে রাজন্ ।।
চণ্ডাল করয়ে যদি বৈষ্ণবের কাজ।
মহাজন বলিয়া জানিবে মহারাজ।।
ব্রাহ্মণ করয়ে যদি চণ্ডালের কর্ম্ম।
চণ্ডাল বলিয়া তারে জানিহ হে ধর্ম্ম।।
যার যেই নিজ বৃত্তি করে যেই জন।
ধর্ম্মবন্ত বলি তারে জানিবে রাজন।।
নিজবৃত্তি ছাড়ি যেবা পরবৃত্তি করে।
সেই সে অধর্ম্ম বলি জানাই তোমারে।।
পিতৃকার্য্য দেবকার্য্য অতিথি সেবন।
যে জন করয়ে সেই হয় মহাজন।।
শুচি আর সত্যবাদী পালে নিজ ধর্ম্ম।
ইহার সমান আর নাহি কোন কর্ম্ম।।
কহিলাম সংক্ষেপে শুনহ নরপতি।
কৃষ্ণে আনি যজ্ঞ কর রাজা মহামতি।।
এ বড় বিস্ময় মম উপজিল মনে।
তোমার সংহতি কৃষ্ণ নাহি দেখি কেনে।।
যুধিষ্ঠির গেলেন ছিলা চক্রপাণি।
দ্বারকা গেলেন হরি তত্ত্ব নাহি জানি।।
কৃষ্ণ না দেখিয়া মম উচাটন মন।
না কহিয়া আমারে গেলেন নারায়ণ।।
সেই হেতু আমি বড় ভয় করি মনে।
না বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ গেলেন কি কারণে।।
ব্যাস বলিলেন রাজা শুনহ বচন।
দ্বারকা গেলেন হরি আছে প্রয়োজন।।
ভীমে পাঠাইয়া তুমি আনহ কৃষ্ণেরে।
আমি তপোবনে যাই তপ করিবারে।।
এত বলি ব্যাস চলিলেন তপোবন।
ভীমেরে ডাকেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
কৃষ্ণকে না দেখে মম মন উচাটন।
কৃষ্ণ বিনা নাহি রহে আমার জীবন।।
ভীম বলিলেক যাই কৃষ্ণ আনিবারে।
কি কারণে দুঃখ তুমি ভাবহ অন্তরে।।
রথ আরোহিয়া গেল দ্বারকা নেগরে।
দূত জানাইল গিয়া গোবিন্দ গোচরে।।
ভীম আগমন শুনি দেব নারায়ণ।
আনন্দে কহেন আন করিয়া যতন।।
ভোজন করিতে সুখে ছিলেন শ্রীহরি।
ভীমে আনিলেন দূত সমাদর করি।।
ভোজন করেন সুখে বসি নারায়ণ।
হেনকালে উপনীত পবন নন্দন।।
এস এস বলি কৃষ্ণ ডাকেন ভীমেরে।
দাসীগণ পাদ্য অর্ঘ্য যোগাইল তারে।।
গোবিন্দ বলেন ভাই করহ ভোজন।
রুক্মিনী আনিয়া দিল দিব্যান্ন ব্যঞ্জন।।
ভোজন করেন ভীম মনের হরিষে।
যত দেন তত খান আঁখির নিমিষে।।
ভীমের ভোজন দেখি হাসে সত্যভামা।
ধন্য তব উদর না দিতে পারি সীমা।।
লজ্জিত হইয়া ভীম গোবিন্দ মায়ায়।
না শুনিয়া সেই কথা আচাঁন ত্বরায়।।
কর্পূর তাম্বুল শেষে করিয়া ভক্ষণ।
বিচিত্র প্যলঙ্কোপরে করিল শয়ন।।
ভীম বলে কৃষ্ণচন্দ্র নিবেদি তোমারে।
দ্বারকা আইলে তুমি না কহি রাজারে।।
তোমা না দেখিয়া রাজা দুঃখ পায় মনে।
ব্যাস বলিলেলেন তাঁরে যজ্ঞ আরম্ভনে।।
আপনি তথায় চল যজ্ঞ দেখিবারে।
আমাকে পাঠান রাজা লইতে তোমারে।।
গোবিন্দ বলেন ভাই বঞ্চ এ রজনী।
প্রভাতে ভেটিব গিয়া ধর্ম্ম নৃপমণি।।
এত বলি নারায়ণ করেন শয়ন।
নানা কথা কুতূহলে রজনী যাপন।।
রজনী প্রভাতে হরি বিচারি অন্তরে।
ডাক দিয়া আনিলেন দেব হলধরে।।
অক্রূর উদ্ধব আর বিজ্ঞ সর্ব্বজনে।
গদ শাম্ব প্রদ্যুন্নাদি যত যদুগণে।।
কৃষ্ণে প্রণমিয়া সবে বসিল আসনে।
গোবিন্দ বলেন কথা সবা বিদ্যমানে।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করিবেন যুধিষ্ঠির।
আসিলেক আমারে লইতে ভীম বীর।।
যজ্ঞ দেখিবারে আমি করিব গমন।
করিবে সকলে মেলি দ্বারকা রক্ষণ।।
রাখিয়া দ্বারকাপুরী সযত্ন হইয়া।
আমি যাব কৃতর্ম্মা উদ্ধবে লইয়া।।
দারুক আনিল রথ সাজায়ে সত্বরে।
শুভক্ষণে চাপিলেন হরি তদুপরে।।
অগ্র হয়ে ভীমসেন আইল সত্বরে।
কৃষ্ণ আগমন কথা কহিল রাজারে।।
শুনিয়া আনন্দ বড় ধর্ম্ম নরপতি।
চলিলেন কৃষ্ণেরে আনিতে শীঘ্রগতি।।
সহদেব নকূল অর্জ্জুন মহামতি।
বিদুরাদি সর্ব্বজন চলিল সংহতি।।
যুবনাশ্ব নরপতি যায় তার সঙ্গে।
কৃষ্ণ আনিবারে চলে অতি বড় রঙ্গে।।
হেনমতে আনন্দিত নগরের জনা।
কৃষ্ণ দরশনে যান সকল হস্তিনা।।
অগ্রগামী যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ আনিবারে।
হেনকালে শ্রীকান্ত আসিলেন নগরে।।
পদব্রজে আসিলেন ধর্ম্ম নরপতি।
দেখিয়া ত্যজেন রথ কৃষ্ণ মহামতি।।
কি কব তুলনা যাঁর দিতে নারে বেদে।
সেই হরি প্রণমিল যুধিষ্ঠির পদে।।
আলিঙ্গন কৃষ্ণেরে দিলেন নরপতি।
হরিষে চলেন কৃষ্ণ পাণ্ডব সংহতি।।
যুধিষ্ঠির পুরে প্রবেশিলেন শ্রীজানি।
রাজসভা সুসজ্জা করেন নৃপমণি।।
সভাসদ্গণ সব বসিল সভাতে।
হেনকালে ব্যাস আসিলেন ইচ্ছামতে।।
কৃষ্ণে দেখি মহামুনি আনন্দ অপার।
প্রশংসা করেন ধন্য পাণ্ডুর কুমার।।
যজ্ঞ হোম দানে যাঁরে না পার দেখিতে।
হেন কৃষ্ণ দেখিলাম তোমার সাক্ষাতে।।
এত বলি সভাতে বসিল মহামুনি।
হেনকালে প্রসঙ্গ করেন চক্রপাণি।।
শুন রাজা যুধিষ্ঠির আমার বচন।
উপস্থিত কর যত আছে আয়োজন।।
দেশে দেশে পাঠাইয়া আন হব্য গব্য।
যজ্ঞ করিবারে চাহি ভাল ভাল দ্রব্য।।
বিলম্ব না হয় আন দূত পাঠাইয়া।
যতনে ‍রাখিবে দ্রব্য ভাণ্ডারে পূরিয়া।।
রাজাকে কহেন তবে ব্যাস তপোধন।
বিলম্ব না কর রাজা কর আয়োজন।।
আমার বচন তুমি শুন নরনাথ।
অশ্বমেধ যজ্ঞে বহু হইবে উৎপাত।।
সাধু কর্ম্মে আছয়ে বাধক বহুতর।
কিন্তু তব সখা এই দেব দামোদর।।
অতএব উদ্বেগ না হবে নরপতি।
তোমারে জিনিতে কার নাহিক শকতি।।
দূত পাঠাইয়া শীঘ্র কর আয়োজন।
আমন্ত্রণ করি আন দেব মুনিগণ।।
ব্যাসের বচনে ‍রাজা অর্জ্জুনে ডাকেন।
যজ্ঞ আয়োজন হেতু যতনে কহেন।।
অর্জ্জুন নিযুক্ত করিলেন যদুগণে।
নানা দ্রব্য আনে তারা পরম যতনে।।
পুরী পরিস্কার করে কত শত জন।
যজ্ঞের মণ্ডপ কেহ করয়ে গঠন।।
দধিকুল্য ঘৃতকুল্য দুগ্ধ সরোবর।
ত্রিবিধ করিল কত দেখিত সুন্দর।।
দধি সরোবর করে অতি মনোহর।
আয়োজনে পূর্ণ কৈল সকল ভাণ্ডার।।
কৃষ্ণ যাহে তুষ্ট তাহা হইল আপনি।
আইল কতেক দ্রব্য সংখ্যা নাহি জানি।।
কৃষ্ণ সঙ্গে যুধিষ্ঠির আছেন সভাতে।
হেনকালে উৎপাত হইল আচম্বিতে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।