০৭. যুবনাশ্ব রাজার হস্তিনা গমন ও শ্রীকৃষ্ণ দর্শন

বলেন বৈশম্পায়ন শুনহ নৃপতি।
এই বিবরণ কহিলাম তোমা প্রতি।।
জন্মেজয় বলিলেন শুন তপোধন।
এবে কহ যুবনাশ্ব রাজার কথন।।
ভীমেরে পূজিল রাজা অতি সমাদরে।
কহ সে কেমনে গেল হস্তিনা নগরে।।
কি কহিল নরপতি যুধিষ্ঠির স্থানে।
সে কথা শুনিব প্রভু তোমার বদনে।।

বলেন বৈশম্পায়ন, শুন জন্মেজয়।
সিংহাসনে বসিলেন ভীম মহাশয়।।
নানা উপহারে রাজা ভীমেরে তুষিল।
মহাসুখে বৃকোদর ভোজন করিল।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা সম্প্রীতি পাইয়া।
ভীমের সম্মূখে রহে যোড়হাত হৈয়া।।
তোমার প্রসাদে দেখি গোবিন্দ চরণ।
যুধিষ্ঠির দরশনে পাপ বিমোচন।।
গঙ্গাস্নান করিয়া দেখিব নারায়ণ।
শুন ভীমসেন মম এই নিবেদন।।
প্রভাত সময়ে রাজা দিলেন ঘোষণা।
কৃষ্ণ দরশনে সব যাইব হস্তিনা।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা আনন্দিত হৈয়া।
মায়ের নিকটে বলে প্রণাম করিয়া।।
চল গো জননি যাব হস্তিনানগরী।
গঙ্গাস্নান করি সবে দেখিব শ্রীহরি।।
ঘুচিবে সকল পাপ কৃষ্ণ দরশনে।
বিলম্ব না কর মাতা চল ভীমসনে।।

এত যদি কহিলেন যুবনাশ্ব রাজ।
কহিতে লাগিল মাতা বুঝিয়া অকাজ।।
রাজার নন্দিনী হই আমি রাজরাণী।
দেশান্তরে যাব আমি কভু নাহি শুনি।।
ঘরে বাহির আমি না হই কখন।
কি বুঝিয়া বল বাপু কুৎসিত বচন।।

তবে যুবনাশ্ব বলে, শুন গো জননি।
থাকিলে অনেক ভাগ্য দেখে চক্রপাণি।।
কত জন্ম ফলেতে করয়ে গঙ্গাস্নান।
মরিলে গঙ্গার জলে পাইবে নির্ব্বাণ।।
বধূগণ সঙ্গে লয়ে চলহ সত্বর।
দেখিবে পরমানন্দে হস্তিনানগর।।
শুভক্ষণে অশ্বেরে পালন কৈনু আমি।
দেখিব তুরগ হৈতে অখিলের স্বামী।।

পুত্রের শুনিয়া কথা বলিল আবার।
এতধর্ম্ম না করিল জনক তোমার।।
একছত্রে ভুঞ্জিলেক ভদ্রাবতীপুরী।
নানা যজ্ঞদান কৈল বলিতে না পারি।।
আমার সবা লয়ে কভু না গেল বিদেশে।
কৃষ্ণ নাম না শুনিনু থাকি গৃহবাসে।।
ও ধন সম্পত্তি বাপু রাখি যাব কোথা।
তোমার বচনে বড় মনে পাই ব্যথা।।
কৃষ্ণ দরশনে বাপু কিছু নাহি কাজ।
পুরীর বাহির হ’লে বড় হবে লাজ।।
না যাইব বাপু আমি কৃষ্ণ-দরশনে।
লোকমুখ গঙ্গা-কথা শুনি যে শ্রবণে।।

ক্রোধিত হৈল রাজা মায়ের বচনে।
পাত্রেরে বলিল লহ করিয়া যতনে।।
ভূপাদেশে পাত্র তারে বন্ধন করিল।
দিব্য চতুর্দ্দোল করি তাহাকে লইল।।
চতুর্দ্দোল করি তারে করিলেক স্কন্ধে।
মহাপাপে রাজমাতা উচ্চৈঃস্বরে কান্দে।।
দেখিয়া রাজার ভক্তি বীর কৃকোদর।
ধন্য ধন্য প্রশংসা করিল বহুতর।।
সেই অশ্ব লয়ে রাজা চলিল আপনি।
অগ্রে গেল বৃকোদর বড় অভিমানী।।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ নৃপতির সাথে।
প্রবেশ করিল গিয়া পুর হস্তিনাতে।।
একা ভীমে দেখিয়া কহেন নরপতি।
বষকেতু কোথা ভীম কহ শীঘ্রগতি।।
মেঘবর্ণ বীর কোথা কহ সমাচার।
কোথায় যজ্ঞের অশ্ব না দেখি আমার।।
অশ্ব লয়ে যুবনাশ্ব আইসে আপনি।
কৃষ্ণ দরশন আসে শুন নৃপমণি।।
পরিবার সহিত আইসে নরপতি।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ লইয়া সংহতি।।
ভীমের বচনে আনন্দিত যুধিষ্ঠির।
কোল দিয়া ভীমসেনে চিত্ত করে স্থির।।

তবে যুধিষ্ঠির কহিলেন ভীমসেনে।
কহ গিয়া এই কথা দ্রৌপদীর স্থানে।।
যুবনাশ্বে পূজা করি আনহ মন্দিরে।
শুন ভীম এই ভার দিলাম তোমারে।।
আজ্ঞা প্রাপ্তে সত্বরে চলিল বৃকোদর।
কহিল সকল কথা দ্রৌপদী গোচর।।
কুন্তী যাজ্ঞসেনী আদি যত নারীগণ।
স্বর্ণথালে করিল মঙ্গল আয়োজন।।
ধূপ দীপ শঙ্খঘন্টা আদি যত দ্রব্য।
কুসুম চন্দন আর নিল হব্য গব্য।।
নৃপতির অভিলাষ বুঝি নারায়ণ।
দিব্যাসনে বসিলেন প্রসন্নবদন।।
নানামত বাদ্য বাজে হস্তিনানগরে।
ভীমসেন গেল যুবনাশ্বে আনিবারে।।
হেনকালে যুবনাশ্ব আইল নগরে।
ভীম তাঁরে আনিলেন মহা সমাদরে।।
অগ্রভাগে দ্রৌপদী করিতে নির্মঞ্ছন।
কুসুম চন্দন নিল নানা আয়োজন।।
পরিবার সহিত গেলেন নরপতি।
যুধিষ্ঠির চরণেতে করিল প্রণতি।।
নানাদান যজ্ঞ করে যাঁর দরশনে।
দেখিলাম নারায়ণ তোমার মিলনে।।
ধন্য ধন্য যুধিষ্ঠির পাণ্ডুর নন্দন।
তোমা হৈতে দেখিলাম গোবিন্দ চরণ।।

এত বলি যুবনাশ্ব গলে বস্ত্র দিয়া।
ধরিল গোবিন্দ পদ ভূমে লোটাইয়া।
লক্ষ দণ্ডবৎ কৈল গোবিন্দ চরণে।
আনন্দেতে অশ্রু বহে রাজার লোচনে।।
সুবেগ রাজার পুত্র ভূমিষ্ঠ হইয়া।
কৃষ্ণপদ পরশিল দুই হস্ত দিয়া।।
পরে রাজনারী আসি করিল প্রণাম।
আশীর্ব্বাদ সবারে দিলেন ঘনশ্যাম।।

তবে যুবনাশ্ব রাজা মাতারে ধরিয়া।
কৃষ্ণস্থানে কহিলেন বিনয় করিয়া।।
আমার মায়ের দোষ ক্ষম চক্রপাণি।
আপনার গুণে কৃপা করহ আপনি।।
জীবের জীবন তুমি সংসারের ‍সার।
তুমি না করিলে কৃপা কে করিবে আর।।
পরম কারণ তুমি পতিত পাবন।
তোমার দর্শনে মম পাপ বিমোচন।।
হিংসা করি পুতনাও পাইল তোমারে।
স্নেহগুণে তোমায় পাইল যুধিষ্ঠিরে।।
কামভাবে ব্রজবধূ পাইল তোমাকে।
এ সকল কথা শুনিয়াছি মুনি মুখে।।
মহাপাপকারিণী হে আমার জননী।
আপনার গুণে কৃপা কর চক্রপাণি।।

তবে কৃপাদৃষ্টিতে চাহিয়া নারায়ণ।
তাহার যতেক পাপ করেন মোচন।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা সম্প্রীতি পাইয়া।
কৃষ্ণকে করেন স্তব যোড়হস্ত হইয়া।।
তুমি ব্রহ্মা তুমি বিষ্ণু তুমি ত্রিলোচন।
তুমি ইন্দ্র তুমি যম কুবের পবন।।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্ত্য তুমি সে পাতাল।
তুমি জল তুমি স্থল দশদিকপাল।।
তুমি দিবা তুমি রাত্রি পর্ব্বত সাগর।
তুমি যোগ তুমি ভোগ তুমি চরাচর।।
মাস তুমি বার তুমি, তিথি পঞ্চদশ।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর তুমি, তুমি সে তাপস।।
তোমায় মহিমা প্রভু কে বলিতে পারে।
এই তত্ত্ব জানি আমি বিদিত সংসারে।।
এক সুবর্ণেতে হয় নানা অলঙ্কার।
একেলা ধরিলে কত শত অবতার।।
তোমার সকল সৃষ্টি সর্ব্বমূল তুমি।
ব্রহ্মাদি না পায় তত্ত্ব কি বলিব আমি।।
ধন্য যুধিষ্ঠির রাজা ‍পাণ্ডুর নন্দন।
দেখিলাম তোমা হৈতে অভয় চরণ।।
ধন্য বৃষকেতু বীর কর্ণের নন্দন।
যাহা হৈতে দেখিলাম গোবিন্দ চরণ।।
আমার যতেক ভাগ্য বলিতে না পারি।
তোমার অভয় পদ দেখিনু মুরারি।।

এত বলি বাজী বাগ ধরি নৃপবর।
আনিল যজ্ঞের ঘোড়া কৃষ্ণের গোচর।।
হরিষে আছেন যুধিষ্ঠির নরবর।
দ্বারকায় চলিলেন দেব দামোদর।।
অপার মহিমা তাঁর কে কহিতে পারে।
দ্বারকায় গেলেন না কহি পাণ্ডবেরে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।