০৩. অশ্ব আনিতে ভীম, বৃষকেতু ও মেঘবর্ণের যাত্রা

শ্রীজনমেজয় বলে, কহ মহামুনি।
অপূর্ব্ব কাহিনী আমি তোমা হৈতে শুনি।।
কেমনে আনিল অশ্ব বীর বৃকোদর।
বিবরিয়া সেই কথা কহ মুনিবর।।
যত কথা শুনি মুনি তত বাড়ে সুখ।
অমৃত করিতে পান কে হয় বিমুখ।।

বলেন বৈশম্পায়ন, শুন জন্মেজয়।
ভীম আনিবারে গেল অশ্বমেধ হয়।।
বৃষকেতু মেঘবর্ণে করিয়া সংহতি।
গোবর্দ্ধন গিরিপরে গেল শীঘ্রগতি।।
সেই গোবর্দ্ধন গিরি সহস্র শিখর।
তাহে আরোহণ কৈল তিন বীরবর।।
পর্ব্বতে বসিল বীর হরষিত হয়ে।
দেখিল রাজার পুরী দুরেতে থাকিয়ে।।
সুবর্ণে রচিত পুরী মুণিমুক্তাময়।
পুরী দরশনে ভীম মানিল বিস্ময়।।
ভীম বলে, বৃষকেতু শুনহ বচন।
জিনিয়া কনকলঙ্কা পুরীর গঠন।।
মনোহর রাজপুরী অতি অনুপম।
কতেক বসতি পুরে, নাহিক নিয়ম।।
পুরীর বাহিরে দেখি রম্য সরোবর।
সলিলে করিছে শোভা কমল নিকর।।
নানা বৃক্ষ পুষ্প শোভে সরোবর পাশে।
চম্পক মালতী যূথী মল্লিকা বিকাশে।।
মধুলোভে অলিগণ ভ্রমিয়া বেড়ায়।
দেখহ কোকিলগণ কুহুস্বরে গায়।।
কলকণ্ঠ-বিহঙ্গম নানা শব্দ করে।
মনোহর উপবন সরোবর-তীরে।।
ওই দেখ বিটপীর তলে দিব্য ছায়।
বনিতা বসিয়া তথা নানা গীত গায়।।
কাঁখে হেমকুম্ভ করি যতেক অবলা।
সরোবর-তীরে আসে যেন চন্দ্রকলা।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যেন দেবের রমণী।
ঊর্ব্বশী জিনিয়া রূপ হেন মনে গণি।।
এক আসে, এক যায় সরোবর-তীরে।
দৃষ্টি করি বৃষকেতু দেখহ অন্তরে।।
অমর-নগর জিনি যুবনাশ্ব-পুরী।
প্রবেশিব কোন্ পথে মনে ভয় করি।।
গড়ের প্রাচীর দুই যোজন বিস্তার।
ভয় লাগে দেখিয়া রাজার সিংহদ্বার।।
রক্ষক সকল দেখ নানা অস্ত্র হাতে।
অগম্য রাজার পুরী যাইব কিমতে।।
পুরীর ভিতরে আছে অশ্ব মনোহর।
কেমনে আনিব ঘোড়া বড়ই দুষ্কর।।
ভীমের বচন শুনি কর্ণের নন্দন।
যোড়হাত করি ভীম করে নিবেদন।।
রাজপুরী মনোহর, অতি অনুপাম।
অমর-নগর জিনি পুরী যে সুঠাম।।
প্রবেশিতে না পারিব যুবনাশ্ব-পুরে।
আসিবে যজ্ঞের ঘোড়া এই সরোবরে।।
আসিবে অনেক সৈন্য ঘোড়ার সংহতি।
ধরিয়া লইব ঘোড়া করিয়া শকতি।।
ভীম বলে, বৃষকেতু কহিলে প্রমাণ।
নিতান্ত ধরিতে ঘোড়া করহ সন্ধান।।
তুরঙ্গ ধরিলে যুদ্ধ হইবে বিস্তর।
কি কর্ম্ম করিব বল কর্ণের কোঙর।।

বৃষকেতু বলে, আমি করিব সমর।
আমা নিবারিতে পারে, নাহি হেন নর।।
তবে মেঘবর্ণ বলে, শুন পিতামহ।
ধরিয়া আনিব ঘোড়া যদি আজ্ঞা দেহ।।
অশ্ব লয়ে থাকিব যে পর্ব্বত উপরে।
তোমরা প্রবৃত্ত দোঁহে হইবে সমরে।।
মেঘবর্ণ-বাক্য শুনি ভীম হৈল প্রীত।
পর্ব্বতে রহিল সবে হয়ে হরষিত।।
শিখরে বসিয়ে তিনে করে নিরীক্ষণ।
জলপান করিতে আইল অশ্বগণ।।
অযুত অযুত ঘোড়া সরোবরে আইল।
আপনার সুখে ঘোড়া জলপান কৈল।।
জলপান করিয়া চলিল অশ্বগণ।
তাহে না দেখিল অশ্ব সর্ব্ব সুলক্ষণ।।
শ্যামবর্ণ পীত পুচ্ছ তাহে না দেখিয়ে।
পর্ব্বতে আছেন তিন পথপানে চেয়ে।।

ভীম বলে, বৃষকেতু হেন লয় মনে।
অন্তঃপুরে আছে ঘোড়া না এল এখানে।।
বাহির না করে ঘোড়া, ইহা জান স্থির।
আইল অনেক ঘোড়া, খাইবারে নীর।।
কোন্ কর্ম্মে করিলাম প্রতিজ্ঞা করিয়া।
হস্তিনাতে যাব আমি কি বোল বলিয়া।।
অব্যর্থ প্রতিজ্ঞা মম, সর্ব্বলোকে জানে।
ঘোড়া না পাইয়া মোর দুঃখ বাড়ে মনে।।

বৃষকেতু বলে, খুড়া শুন অবধানে।
এখনি আসিবে অশ্ব দেখ জলপানে।।
শ্রীকৃষ্ণ দিলেন আজ্ঞা তুরঙ্গ আনিতে।
কার্য্যসিদ্ধি হবে, কেন দুঃখ কর চিতে।।
ঐ শুন নগরেতে বিবিধ বাদ্যধ্বনি।
ঢাক ঢোল বাজে আর বরাক খঞ্জনী।।
খমক ঠমক বাজে মৃদঙ্গ ঝাঁঝরি।
বরঙ্গ মাধুরী বাজে বিশাল ধুধুরি।।
জয়ঢাক বীরঢাক কাংস্য করতাল।
দগড়ি দগড় বাজে দামামা বিশাল।।
কোলাহল শুনি বড় গড়ের ভিতরে।
অভিপ্রায় বুঝি ঘোড়া আসে সরোবরে।।
রাজার গমনে যেন বাজে বাদ্যচয়।
শুন খুড়া জলপানে আসে সেই হয়।।
একদৃষ্টি করি তুমি চাহ হয় পানে।
শব্দ কোলাহলে কিছু নাহি শুনি কাণে।।
আগে পাছে গজ বাজী কত শোভা করে।
সর্ব্বসুলক্ষণ ঘোড়া দেখহ মাঝারে।।
চামর চাঁদোয়া দেখ ঘোড়ার দু-পাশে।
পদধূলি উঠিল যে দেখহ আকাশে।।
অশ্ব দেখি ভীম বীর আনন্দিত মনে।
ঘটোৎকচ-সুতে আজ্ঞা দিল সেইক্ষণে।।
মেঘবর্ণ বলে, তুমি দেখ না বসিয়া।
সৈন্যের মাঝারে ঘোড়া আনিব ধরিয়া।।
এত বলি মেঘবর্ণ হইল বিদায়।
চন্দ্রকে ধরিতে যেন রাহুগ্রহ ধায়।।
মহাভারতের কথা সুধার সুসার।
কাশী কহে, শুন যদি হৈবে ভবপার।।