০২. যুধিষ্ঠিরের নিকট কৃষ্ণের আগমন

হা কৃষ্ণ দ্বারকানাথ যাদব-নন্দন।
মথুরেশ হৃষীকেশ ত্রাতা জনার্দ্দন।।
এই নাম যুধিষ্ঠির স্মরণ করিতে।
করুণাসাগর তথা আসিল ত্বরিতে।।
একেশ্বর আসিলেন কমললোচন।
যুধিষ্ঠির-দ্বারে আসি দিলা দরশন।।
এই দেখ ভক্তের অধীন যদুরায়।
শিব ব্রহ্মা ধ্যানে যাঁরে দেখিতে না পায়।।
অনাহারে অহর্নিশি যত মুনিগণ।
সমাধিযোগেতে ভাবে যেই নারায়ণ।।
দেখিতে না পায় যাঁরে নানা ক্লেশ করি।
যুধিষ্ঠির-স্মরণে আসেন সেই হরি।।
দ্বারী গিয়া জানাইল ধর্ম্মের গোচরে।
শুন রাজা হৃষীকেশ আসিলেন দ্বারে।।
শুনি হরষিত হয়ে পাণ্ডুর নন্দন।
আগুসারি আনিবারে করেন গমন।।
দ্রৌপদী সহিত রাজা ভ্রাতৃগণ লয়ে।
ত্বরিত গেলেন রাজা আনন্দিত হয়ে।।
যুধিষ্ঠিরে প্রণমেন দেব নারায়ণ।
হরষিত হয়ে রাজা দেন আলিঙ্গন।।
সবা সনে সম্ভাষণ করি যদুপতি।
সভাতে বসেন আসি কৃষ্ণ মহামতি।।
ভীমার্জ্জুন সহদেব নকুল কুমার।
বৃষকেতু আদি যত বসিল অপার।।
সভা সুশোভিত করিলেন নারায়ণ।
দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে কৃষ্ণ আগমন।।
শুন রাজা জন্মেজয় কহি যে তোমারে।
পাণ্ডব সমান কেহ নাহিক সংসারে।।
দ্বিতীয় প্রহর রাত্রে আসিলেন হরি।
পাণ্ডবের কত ভাগ্য বলিতে না পারি।।
তবে রাজা যুধিষ্ঠির করি যোড়হাত।
নিবেদন কৈল, শুন দেব জগন্নাথ।।
অভিষেক করি মোরে দিলে সিংহাসন।
তোমার আজ্ঞায় করি প্রজার পালন।।
কিন্তু মম চিত্ত স্থির না হয় শ্রীহরি।
অন্তরে উদ্বেগ উঠে, বলিতে না পারি।।
জ্ঞাতি গুরু নাশিলাম সংগ্রাম ভিতরে।
সে কারণে সুখ মোর নাহিক অন্তরে।।
বিষাদিত হয়ে আমি মনে মনে গণি।
হেনকালে আসিলেন ব্যাস মহামুনি।।
যত দুঃখ নিবেদন করিলাম আমি।
কহিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞ কর তুমি।।
বলিলাম নিঃস্ব আমি, করিব কেমনে।
ধনের সন্ধান মুনি কহিলা যতনে।।
অর্জ্জুন আনিবে ধন হিমালয় হতে।
উপদেশ করিলেন তুরঙ্গ আনিতে।।
যুবনাশ্ব-পুরে আছে অশ্ব মনোহর।
ভীম আনিবেক ঘোড়া করিয়া সমর।।
প্রতিজ্ঞা করিল তবে সভা বিদ্যমানে।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ আর ভীমসেনে।।
তবে যজ্ঞ বিবরণ কহিলেন মুনি।
অসিপত্র-ব্রত শুনি মনে ভয় গণি।।
সে কারণে স্তুতি আমি করিনু তোমারে।
ত্বরায় আসিলে কৃষ্ণ আমার গোচরে।।
পাণ্ডবে আছয়ে কৃপা শুন যদুরায়।
যজ্ঞসিদ্ধি হেতু আমি জিজ্ঞাসি তোমায়।।
পারি কি না পারি আমি যজ্ঞ করিবারে।
বিচারিয়া কৃষ্ণচন্দ্র বলহ আমারে।।
শুনিয়া বলেন হাসি দেব নারায়ণ।
জলগ গম্ভীর স্বরে মধুর বচন।।
শুন রাজা যুধিষ্ঠির আমার ভারতী।
ঘোটক আনিবে ভীম নহে হেন কৃতী।।
যুবনাশ্ব মহারাজ মহাবলবান।
তার সঙ্গে যুদ্ধ করা সঙ্কটের স্থান।।
সংগ্রামে জিনিতে না পারিবে বৃকোদর।
ভীম হৈতে কর্ম্ম সিদ্ধি নহে নৃপবর।।
অপকর্ম্মান্বিত ভীম সর্ব্বলোকে জানে।
কামাতুর হয়ে মজে রাক্ষসীর সনে।।
রাক্ষস আকার তার, রাক্ষস আচার।
মনুষ্যের রক্ত খায়, রাক্ষস আহার।।
কোন গুণ নাহি দেখি ভীমের শরীরে।
হেন জনে বল তুমি অশ্ব আনিবারে।।
ভীম হৈতে না হইবে সিদ্ধ প্রয়োজন।
নিশ্চয় জানিহ ইহা ধর্ম্মের নন্দন।।
ক্রেতাযুগে যজ্ঞ করিলেন রঘুনাথ।
ব্রহ্মবধ করেছিলা পূর্ব্বে তাঁর তাত।।
নিয়োজিল লক্ষ্মণেরে অশ্ব রাখিবারে।
আনন্দে ভ্রময়ে ঘোড়া পৃথিবী ভিতরে।।
অক্ষৌহিণী সঙ্গে করি সুমিত্রা-নন্দন।
অশ্ব লয়ে করিলেক পৃথিবী ভ্রমণ।।
দৈবযোগে গেল ঘোড়া বিষ্ণুপদীপুরে।
লব কুশ দুই ভাই ধরিল ঘোড়ারে।।
আনিতে নারিল ঘোড়া সুমিত্রা-নন্দন।
আপনি গেলেন তথা কমললোচন।।
শ্রীরাম আনেন অশ্ব, যজ্ঞ সাঙ্গ হয়।
এই সব কথা রাজা জানিহ নিশ্চয়।।
এত যদি কহিলেন দেব গদাধর।
তাহা শুনি কহিতে লাগিল বৃকোদর।।
নিবেদন করি শুন দেব নারায়ণ।
কহিলে আমারে তুমি গর্ব্বিত বচন।।
তুমি যদি বল, আমি কি করিতে পারি।
কিন্তু আপনার ছিদ্র নাহি জান হরি।।
ডাগর উদর মম দেখ নারায়ণ।
তোমার উদরে কৃষ্ণ এ তিন ভুবন।।
আমা সম কামাতুর না দেখ আপনি।
ষোল শত অষ্ট হয় তোমার রমণী।।
তাহা লয়ে ক্রীড়া কর দিবস রজনী।
আমা কিসে কামাতুর বল গুণমণি।।
নিন্দিলে আমার আছে রাক্ষসী বনিতা।
তোমার গৃহেতে আছে ভল্লুক-দুহিতা।।
আপনা না জানি কৃষ্ণ নিন্দহ অন্যেরে।
কত কীর্ত্তি রাখিয়াছ গোকুল নগরে।।
পাসরিলে সেই কথা রাধার জীবন।
আমায় নিন্দিয়া কহ কুৎসিত বচন।।
ভয় নাহি করি আমি যুবনাশ্ব বীরে।
তুরঙ্গ আনিব আমি জিনিয়া তাহারে।।
তুমি যারে প্রসন্ন আছহ যদুরায়।
ইন্দ্রে পরাজিতে পারি, এবা কোন্ দায়।।
আমা সবাকার নাথ তুমি নারায়ণ।
সত্য বলি এই কথা বলে সর্ব্বজন।।
আমার অসাধ্য নাহি এই চরাচরে।
শুন কৃষ্ণ কহিলাম তোমার গোচরে।।
ভীমের বচনে তুষ্ট হয়ে নারায়ণ।
যুধিষ্ঠিরে কহিলেন মধুর বচন।।
অশ্বমেধ যজ্ঞ সিদ্ধ হইবে তোমার।
অসিপত্র আচরিবে ধর্ম্মের কুমার।।
অন্য মত না হইবে, বলিলাম আমি।
তুরঙ্গ আনিবে ভীম, স্থির জেন তুমি।।
কৃষ্ণের বচনে হরষিত যুধিষ্ঠির।
পুনরপি কহিতে লাগিল ভীম বীর।।
শুনহ অর্জ্জুন বীর আমার বচন।
সতত করিবে তুমি রাজার রক্ষণ।।
পালিহ হস্তিনাপুরী রাজার সহিতে।
তিনজন যাই মোরা তুরঙ্গ আনিতে।।
এতেক কহিল যদি পবন-কুমার।
শুনিয়া অর্জ্জুন তাহা করেন স্বীকার।।
যুধিষ্ঠির-পদে ভীম করিল প্রণাম।
আশীর্ব্বাদ দেন তারে ধর্ম্ম গুণধাম।।
যাহ ভীম, অশ্ব তুমি আনহ ত্বরিতে।
বিলম্ব না কর ভাই, ইহা রাখ চিতে।।
ইহা শুনি ভীম বীর চলিল সত্বরে।
বৃষকেতু মেঘবর্ণ লইয়া দোঁহারে।।
বিজয় পাণ্ডব-কথা অমৃতলহরী।
কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।।