৪৩. ভীষ্মদেবের স্বর্গারোহণ

ধ্যানযোগে সাক্ষাতে দেখেন নারায়ণ।
নবজলধর তনু অরুণ লোচন।।
পীতবাস পরিধান বনমালাধারী।
নানা অলঙ্কারে রূপ ভূষিত মুরারী।।
চারু চতুর্ভুজ রূপ মোহন মুরতি।
দেখি ভীষ্ম মনে মনে করিলেন স্তুতি।।
সাক্ষাতে পদারবিন্দ দেখিয়া নয়নে।
শরীর ত্যজেন ভীষ্ম দেখে দেবগণে।।

জয় জয় শব্দ হৈল ইন্দ্রের নগরে।
পুষ্পবৃষ্টি কৈল দেব ভীষ্মের উপরে।।
দিব্য রথ পাঠাইয়া দিল সুরপতি।
পবনের গতি রথ মাতলি সারথি।।
রথেতে তুলিয়া স্বর্গে করিল গমন।
বন্ধুগণ সহ গিয়া হইল মিলন।।
চিরদিনের বন্ধুসনে হইল দর্শন।
সম্ভ্রম খণ্ডিল পূর্ব্ব জন্মের কথন।।

মুনি বলে অবধান কর জন্মেজয়।
স্বর্গেতে চলিল ভীষ্ম গঙ্গার তনয়।।
মাঘমাসে শুক্লাষ্টমী তিথি শুভদিনে।
ত্যজিলেন ভীষ্ম তনু চিন্তি নারায়ণে।।
শরীর ত্যজেন ভীষ্ম দেখি যুধিষ্ঠির।
রোদন করেন ভূমে লোটায়ে শরীর।।
ভীমার্জ্জুন সহ কান্দে মাদ্রীর নন্দন।
অনিরুদ্ধ প্রদ্যুন্নাদি যত বন্ধুগণ।।
দ্বিজ ক্ষত্র আদি কত নগরের প্রজা।
রণ অবশেষে আর যত ছিল রাজা।।
ভীষ্মের মরণে সবে অনেক কান্দিল।
প্রলয়ের কালে ‍যেন সিন্ধু উথলিল।।
যুধিষ্ঠির আদি পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।
হাহা ভীষ্ম বলি কান্দে করি হাহাকার।।
কোথা গেল পিতামহ ছাড়িয়া আমারে।
তোমার বিচ্ছেদে আত্মা ধরি কি প্রকারে।।
দুর্য্যোধন পাতক করিল অকারণ।
তাহার কারণে হৈল তোমার নিধন।।
আপনি মরিল দুষ্ট জ্ঞাতি বিনাশিল।
শোক সিন্ধু মধ্যেতে আমাকে ডুবাইল।।

এত বলি কান্দে পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।
তথা আসিলেন ব্যাস জানি সমাচার।।
কুরুক্ষেত্র মধ্যে যথা ভাষ্মের পতন।
তথাকারে করিলেন ত্বরিত গমন।।
ব্যাসে দেখি সম্ভ্রমে উঠিয়া পঞ্চজন।
সম্ভ্রমে করেন তাঁর চরণ বন্দন।।
ধূলাতে ধূসর তনু নেত্রে ঝরে বারি।
সান্ত্বনা করেন ব্যাস সবারে নিবারি।।
নিস্ফল তোমরা সব করহ ক্রন্দন।
কত না বুঝান ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।।
যোগমার্গ ইতিহাস পুরাণের সার।
তবু না ঘুচিল ভ্রম তোমা সবাকার।।
ভ্রম দূর কর রাজা তত্ত্বে দেহ মন।
অকারণে কর শোক ভীষ্মের কারণ।।
পুণ্য আত্মা ভীষ্মবীর বসু অবতার।
শাপ ভ্রষ্ট হয়ে কুরুবংশে জন্ম তাঁর।।
শাপে মুক্ত হয়ে ভীষ্ম গেলেন স্বস্থান।
তাঁর হেতু শোক রাজা কর অকারণ।।
দুর্য্যোধন আদি যত কৌরব আছিল।
ব্রহ্মার আজ্ঞায় কুরুবংশে জনমিল।।
ব্রহ্মার মানস পূর্ণ পৃথিবীর হিতে।
হত হৈল যত ক্ষত্র ভারত যুদ্ধেতে।।
ব্রহ্মার আজ্ঞায় কৃষ্ণ হয়ে অবতার।
পৃথিবীর ভার সব করেন সংহার।।
কিছুমাত্র অবশেষ আছে বিষ্ণু অংশ।
অল্পদিনে কৃষ্ণ তাহা করিবেন ধ্বংস।।
ততদিন রাজ্যভোগ কর নৃপমণি।
শোক ত্যাগ কর রাজা শুন মম বাণী।।
অগনি সংস্কার কর গঙ্গার নন্দনে।
অদাহন পৃথিবী দেখহ যেইখানে।।
আপোড়া পৃথিবী যদি তুমি কোথা পাও।
আমার বচন তুমি নিশ্চয় জানিও।।
কত কত রাজা জনমিল এ সংসারে।
কেহ নাহি, সবে গেল শমনের দ্বারে।।
চতুর্দ্দশ ভুবনের মধ্যে পৃথিবীতে।
আপোড়া কোথাও নাহি কহিনু তোমাতে।।

এত বলি স্বস্থানে গেলেন ব্যাস মুনি।
বিস্ময় মানেন রাজা ব্যাসবাক্য শুনি।।
অর্জ্জুনের আদেশ করিলেন রাজন।
শীঘ্র কপিধ্বজে তুমি কর আরোহন।।
পৃথিবী খুঁজিতে চাহি ব্যাসের বচনে।
ভ্রমিয়া দেখহ সব এ চৌদ্দ ভুবনে।।
অদাহ পৃথিবী যদি থাকে কোনখানে।
তথা লয়ে দাহ কর গঙ্গার নন্দনে।।
জানিয়া আইস ভাই চল শীঘ্রতর।
এত শুনি ধনঞ্জয় চলেন সত্বর।।

কপিধ্বজ রথ আরোহিয়া সেই ক্ষণে।
অগ্রে উপনীত গিয়া ইন্দ্রের ভুবনে।।
কোনখানে স্বর্গেতে নাহিক অদাহন।
একে এক বিচরেন ইন্দ্রের নন্দন।।
সপ্তস্বর্গ পুনরপি করেন বিচার।
পাতালে গেলেন তবে ইন্দ্রের কুমার।।
সপ্ত পাতালেতে সব দেখেন বিচারি।
অদাহন পাতালেতে কোথাও না হেরি।।
অনন্তরে মর্ত্ত্যে আসিলেন ধনঞ্জয়।
সপ্ত দ্বীপ বিচারিয়া করেন নির্ণয়।।
অদাহন পৃথিবী না দেখি কোনখানে।
সবিস্ময় হয়ে আসি কহেন রাজনে।।

শুনিয়া ধর্ম্মের পুত্র মানেন বিস্ময়।
ব্যাসের বচনে পূর্ব্ব ভ্রম দূর হয়।।
শোক ত্যাগ করি রাজা কার্য্যে দেন মন।
ভীমার্জ্জুনে আজ্ঞা তবে করেন রাজন।।
নানা কাষ্ঠ চন্দনাদি আনহ সত্বরে।
এক লক্ষ ঘৃত কুম্ভ সভার ভিতরে।।
কুরুক্ষেত্র মধ্যে শীঘ্র করহ সঞ্চয়।
চতুর্দ্দোলে করি আন গঙ্গার তনয়।।
আজ্ঞামাত্রে ধনঞ্জয় মাদ্রীর কুমারে।
অগনি সংস্কার দ্রব্য আনেন সত্বরে।।
শত শত ঘৃত কুম্ভ কাষ্ঠ রাশি রাশি।
আনিল ক্ষন্ত্রিয়গণ পৃথিবী নিবাসী।।
চতুর্দ্দোলে তুলি নিল ভীষ্মের শরীর।
বিধিমতে অগ্নি দেন রাজা যুধিষ্ঠির।।
ভীষ্মের শরীর দহি ভাই পঞ্চজন।
গঙ্গাতে যাইয়া তবে করেন তর্পন।।
শ্রাদ্ধ শ্রান্তি করিলেক ক্ষন্ত্রিয় বিধানে।
নানারত্ন অলঙ্কার দিলেন ব্রাহ্মণে।।
ভীষ্মের ভাবনা বিনা অন্য নাহি মনে।
অন্ন জল নাহি রুচে দুঃখিত রাজনে।।
মুনি বলে জন্মেজয় কর অবধান।
এতদূরে শান্তিপর্ব্ব হৈল সমাধান।।

শান্তিপর্ব্ব সমাপ্ত।