৩৬. অষ্টমীর ব্রত মাহাত্ম্যে সুবাহ রাজার উপাখ্যান

ভীষ্ম বলিলেন শুন পাণ্ডুর নন্দন।
আর কিছু ব্রতকথা শুন দিয়া মন।।
অষ্টমী নামেতে ব্রত পার্ব্বতী সেবনে।
জন্ময়ে অক্ষয় পুণ্য বেদেতে বাখানে।।
আশ্বিনের শুক্লপক্ষে অষ্টমীর দিনে।
শিবদুর্গা আরাধনা করে যেই জনে।।
সর্ব্বদুঃখে তরে সেই নাহিক সংশয়।
ইতিহাস কথা কহি শুন ধর্ম্মরায়।।
কহিলেন পূর্ব্বে যাহা ব্যাস মুনিবর।
শুনিয়া বিস্মিত মম হইল অন্তর।।
সেই কথা কহি রাজা কর অবগতি।
সুবাহু নামেতে এক ছিল নরপতি।।
মহাধর্ম্মশীল রাজা ধর্ম্ম কর্ম্মে রত।
ব্রাহ্মণেরে নানা দান দেন অবিরত।।
বিচিত্র আরাম এক করিয়া রচন।
বিপ্রে পূজে দিয়া মাল্য অগুরু চন্দন।।
এইমত বহুদিন পূজিল ব্রাহ্মণে।
দৈববশে কতকালে ‍পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে।।
কোটি কোটি ব্রাহ্মণ করিল নিমন্ত্রণ।
দিব্য ভোগে সবাকারে করিল তোষণ।।
যথোচিত দক্ষিণা দিলেন দ্বিজগণে।
আশীর্ব্বাদ করি সবে গেল নিজ স্থানে।।
অন্তঃপুরে যায় রাজা ভোজন কারণ।
হেনকালে দেখ এক দৈবের ঘটন।।
সেইকালে এক দ্বিজ সুদেব নামেতে।
যাচঞা করিল আসি রাজার সাক্ষাতে।।
যথোচিত দান মোরে দেহ নরবর।
কালবশে হৈল রাজা ক্রোধিত অন্তর।।
কালে যাহা করে তাহা কে খণ্ডিতে পারে।
অন্ন বস্ত্র আদি নানা দিল ব্রাহ্মণেরে।।
তাহা পেয়ে সত্বরে চলিল নিজ ঘরে।
ক্রোধচিত্তে নৃপতি চলিল অন্তঃপুরে।।
এই হেতু মহাপাপ ফলিল রাজনে।
কতদিনে নৃপতি দেখিল পুষ্পবনে।।
প্রতিদিন আসি পুষ্প গন্ধর্ব্বের হরয়।
ক্রোধচিত্ত নরবর পুষ্প নাহি পায়।।
ভাবিয়া ভূপতি তবে রক্ষক রাখিল।
কোন্ জন তুলে পুষ্প লক্ষিতে নারিল।।
মনুষ্যের শক্তি নহে জানিল কারণে।
আপনি রহিল রাজা কুসুম রক্ষণে।।
পুষ্প তুলিবারে এল গন্ধর্ব্বের পতি।
পুষ্পবনে অন্নবৃষ্টি বরষয়ে অতি।।
অন্নবৃষ্টি দেখি হল সচিন্তিত মন।
সেই রাত্রি রহিলেক জানিতে কারণ।।
প্রাতঃকালে নৃপতি দেখিল গন্ধর্ব্বেরে।
নিকটে আসিয়া রাজা জিজ্ঞাসিল তারে।।
কি নাম ধরহ তুমি কোথায় বসতি।
কোন্ হেতু ইস পুষ্প তোল নিতি নিতি।।
আমারে সম্ভ্রম কিছু নাহি তোর মনে।
আজি সে উচিত শাস্তি পাবে মম স্থানে।।
গন্ধর্ব্ব বলিল মম স্বর্গেতে বসতি।
পুষ্পধর নাম মম বিদ্যাধর জাতি।।
সুবেশ করিবে যত বিদ্যাধরীগণ।
এই হেতু পুষ্প আমি করি যে হরণ।।
আজি হৈতে মিত্র তুমি হইলে আমার।
কোন্ কার্য্য সাধি দিব কহত তোমার।।
কিন্তু এক সবিস্ময় হৈল মম মনে।
নিত্য নিত্য পুষ্প হরি আসিয়া কাননে।।
এক অপরূপ বড় দেখি হে রাজন।
কালি হৈতে অন্ন কেন হয় বরিষণ।।
এখনও অন্নবৃষ্টি হয় এই বনে।
রাত্রি বঞ্চিলাম আমি জানিতে কারণে।।
হেতু যদি জান রাজা কহিবে আমারে।
এত শুনি নরপতি কহিছে তাহারে।।
কোথা অন্নবৃষ্টি হয় ‍না পাই দেখিতে।
মিথ্যা কথা বলি কেন ভাণ্ডও আমাতে।।
বিদ্যাধর বলে মিথ্যা হইবে কেমনে।
দিব্যচক্ষু দিব তুমি দেখহ নয়নে।।
এত শুনি দিব্যচক্ষে চায় নরনাথ।
অন্ন বরিষণ দেখে করি দৃষ্টিপাত।।
পূর্ব্বের কারণ তা হইল স্মরণ।
গন্ধর্ব্ব চাহিয়া বলে শুন বিবরণ।।
এককালে দৈবে আমি পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে।
অন্ন বস্ত্র আদি দান দিলাম ব্রাহ্মণে।।
সেই হৈতে অন্নবৃষ্টি হয়ত কাননে।
যাহা দিই পাই তাহা এ নহে এড়ানে।।
তারপর বিদ্যাধর শুনহ এক্ষনে।
যে কালেতে ব্রাহ্মণেরে দিনু অন্নাদান।।
এ পাপে নরক হৈতে নাহিক এড়ান।
এক নিবেদন করি শুনহ আমার।।
এ পাপে যেমতে তরি কহিবা প্রকার।
এত শুনি বিদ্যাধর গেল সুরপুরে।।
কহিল রাজার কথা ইন্দ্রের গোচরে।
শুনিয়া হাসিয়া ইন্দ্র বলিল বচন।।
যত পুণ্য করিল সে না হয় কথন।
পুণ্যফলে স্বর্গেতে আসিবে মতিমান।।
তার তরে আগে হৈতে করেছি উদ্যান।
সুবর্ণ প্রাচীর দেখ সুবর্ণের ঘর।
সুরর্ণ পালঙ্ক শয্যা দেখ মনোহর।।
পুরীর সম্মূখে গিরি দেখ বিদ্যমান।
ভক্ষণ সামগ্রা দেখ অদ্ভুত বিধান।।
এত শুনি বিদ্যাধর হেতু জিজ্ঞাসিল।
রাজভোগে হেন দ্রব্য কি হেতু হইল।।
ইন্দ্র বলে কহি শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
মহাপাপ অর্জ্জিল সুবাহু নৃপিমণি।।
পিতৃশ্রাদ্ধ দিনে এক ক্ষুধার্ত্ত ব্রাহ্মণে।
অন্নদান করিলেন অত্যন্ত যতনে।।
এক গুণ দিলে হেথা হয় সপ্তগুণ।
অন্নদান হেতু এই শুনহ নিপুণ।।
যাহা দেয় তাহা ভুঞ্জে নাহিক এড়ান।
তার ভক্ষ্য হেতু যে রাখিনু মতিমান।।
কিন্তু আর এক কথা শুন বিদ্যাধর।
যখন ব্রাহ্মণে দান দিল নরবর।।
ক্রোধ করি অন্নদান দিলেন ব্রাহ্মণে।
সে পাপ ভূঞ্জিতে হবে যমের সদনে।।
এত শুনি বিস্মিত হইল বিদ্যাধর।
করযোড়ে কহে পুনঃ ইন্দ্রের গোচর।।
সুবাহুর সঙ্গে মম মিত্রতা হইল।
বিনয় করিয়া রাজা আমারে কহিল।।
এই পাপ ভোগ তুমি খণ্ডাবে আমার।
তাহার অগ্রেতে আমি কৈনু অঙ্গীকার।।
হেন পাপ ভোগ সখা ভুঞ্জিবে আপনে।
সাক্ষাতে কেমনে আমি দেখিব নয়নে।।
ইহার প্রকার মোরে বল মহাশয়।
ইথে মুক্ত নরপতি কোন্ মতে হয়।।
ইন্দ্র বলিলেন তার আছয়ে উপায়।
শীঘ্রগতি গিয়া তুমি কহিবে রাঙ্গয়।।
অষ্টমীর উপবাস পার্ব্বতী সেবন।
রাজার নগরে করি থাকে যেই জন।।
তার অঙ্গ সেই দিন পরশ করিবে।
স্নান করি ব্রতী হয়ে তপ আরম্ভিবে।।
কাটিয়া অঙ্গের মাংস রাখিবে রুধিরে।
শিব দুর্গা আরাধিবে এক সন্বৎসরে।।
বৎসর হইলে পূর্ণ ব্রত সাঙ্গ করি।
বেদবিজ্ঞ দ্বিজগণে আনিবে আদরি।।
অন্নদান ভুমিদান দিবে দ্বিজগণে।
আজ্ঞা লয়ে পশ্চাতে সে করিবে পারণে।।
তবে তার এই পাপ হইবে খণ্ডন।
এত শুনি গন্ধর্ব্ব হইল হৃষ্টমন।।
কহিল এ সব গিয়া রাজার গোচরে।
শুনি নরপতি তবে ভ্রমিল নগরে।।
অষ্টমীর উপবাসী কারে না দেখিল।
অনেক ভ্রমিয়া রাজা চিন্তিত হইল।।
নগরের নারী এক ছিল বেশ্যাঘরে।
স্ত্রী পুরুষে কোন্দল করিছে বহুতরে।।
নিরাহারে আছে তারা অষ্টমী দিবস।
তার অঙ্গ দিয়া রাজা করিল পরশ।।
ব্রতী হয়ে সম্বৎসর পার্ব্বতী পূজিল।
মহাপাপ ভোগ হৈতে ভূপতি তরিল।।
দান ধ্যান বহুতর করিল রাজন।
অন্তে তনু ত্যজি গেল বৈকুণ্ঠ ভুবন।।
শোক দূর করি রাজা স্থির কর মন।
স্বধর্ম্মেতে রাজধর্ম্ম করহ পালন।।
অষ্টমীর ব্রত কথা শুনে যেই জন।
সর্ব্ব দুঃখে তরে সেই ব্যাসের বচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে শুনিলে তরয়ে তরবারি।।