৩৪. চান্দ্রায়ণ ব্রত উপলক্ষে চন্দ্রকেতু রাজার উপাখ্যান

ভীষ্ম বলিলেন রাজা করহ শ্রবণ।
আর কিছু ব্রত কথা কহিব এখন।।
চান্দ্রায়ণ মহাব্রত বিখ্যাত সংসারে।
শ্রদ্ধাভক্তি করি ব্রত যে জন আচরে।।
সর্ব্বকাম ফল লভে নাহিক সংশয়।
পূর্ব্বে কহিয়াছি আমি এ সব নির্ণয়।।
এক ইতিহাস কহি শুন দিয়া মন।
পূর্ব্বে চন্দ্রকেতু রাজা ইক্ষ্বাকুনন্দন।।
চন্দ্রের নন্দিনী সেই পতিব্রতা সতী।
চন্দ্রাবতী নামে কন্যা তাহার যুবতী।।
শাপ হেতু জন্ম নিল নীলধ্বজ ঘরে।
চন্দ্রাবতী নাথ হৈল বিখ্যাত সংসারে।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।
চন্দ্রের সে নন্দিনীকে শাপে কোন্ জন।
মর্ত্ত্যলোকে তাহার জনম কি কারণ।।

ভীষ্ম বলিলেন রাজ্য কর অবধান।
পড়িবারে যান চন্দ্র বৃহস্পতি স্থান।।
সর্ব্বশাস্ত্রে সিদ্ধ দ্বিজ অঙ্গিরা তনয়।
নানা শাস্ত্র চন্দ্রকে পড়ান অতিশয়।।
জীবের রমনী যেই তারকা নামেতে।
মোহিত হইল চন্দ্র তাহার রূপেতে।।
কামে বশ হয়ে গুরুপত্না না মানিল।
প্রবন্ধ মায়ায় তারে হরিয়া লইল।।
তারারে লইয়া গেল আপন ভব্ন।
চিরকাল তারা সহ করিল রমণ।।
মর্ত্ত্যলোকে গিয়াছিল গুরু বৃহস্পতি।
যজ্ঞ সাঙ্গ করিয়া আইল মহামতি।।
পরলোক স্থানে শুনি এ সব কথন।
গুরুপত্নী সুধাকর করিল হরণ।।
ক্রুদ্ধ হয়ে গেল গুরু চন্দ্রের সদন।
বলিল পাপিষ্ঠ তুই বড়ই দুর্জ্জন।।
বৃথা শাস্ত্র মম স্থানে করিলা পঠন।
গুরুপত্নী হরি পাপ করিলা অর্জ্জন।।
গুরুগর্ব্ব নাহি দেখ আপন অপায়।
আজি হৈতে হইবে কলঙ্ক তব গায়।।
তবে আর মম বাক্য শুনরে অধম।
মম শাপে মর্ত্তলোকে হইবে জনম।।
কুরুবংশে ধনঞ্জয় পাণ্ডুর কুমার।
তাহার ঔরসে জন্ম হইবে তোমার।।
কৃষ্ণের ভাগিনা হয়ে সুভদ্রা গর্ভেতে।
অল্প দিনে শাপ মুক্ত হইবে তাহাতে।।

এত শুনি চন্দ্রে তবে হৈল ক্রুদ্ধমন।
বৃহস্পতি গুরুরে শাপিল সেইক্ষণ।।
নিজ বশ নয় আত্মা পরবশ হয়।
জানিয়া আমারে শাপ দিলা মহাশয়।।
তোমারে ত শাপ আমি দিব সে কারণ।
হীন পক্ষীযোনি মধ্যে পাইয়া জনম।।
গৃধিনী নামেতে পক্ষী অবশ্য হইবা।
চিরদিন ভোগ ভুঞ্জি শাপে মুক্ত হবা।।

এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্ম নরপতি।
কিরূপেতে পক্ষীযোনি পায় বৃহস্পতি।।
কতদিনে গত হৈল শাপ বিমোচন।
কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।
গাঙ্গেয় বলেন ভূপ করহ শ্রবণ।
চন্দ্রের বচন কভু না যায় খণ্ডন।।
গৃধ্র পতগেতে জন্ম হৈল বৃহস্পতি।
বৃন্দারক গিরিতটে করিল বসতি।।
পরম কৌতুকে রহে ভার্য্যার সংহতি।
কত দিনে পক্ষিণী হইল গর্ভবতী।।
চারিগুটি ডিম্ব কত দিনে প্রসবিল।
ডিম্ব ফুটি চারি শিশু তাহাতে জন্মিল।।
দুই গুটি ডিম্বে হৈল দুই গুটি সুতা।
স্বামী সহ পক্ষিণী হইল আনন্দিতা।।
সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর শিশু দেখি চারিজন।
বাৎসল্য ভাবেতে দোঁহে করিল পালন।।
ক্ষণেক না ছাড়ে দোঁহে শিশুর সংহতি।
নানা উপহার ভোগে পালে নীতি নীতি।।
এইরূপে কত দিন আনন্দ কৌতুকে।
ভার্য্যা পত্নী সহ পক্ষী বঞ্চে নানাসুখে।।
একদিন দৈববশে তাহার কারণ।
একেশ্বর সে পক্ষী চলিল ঘোর বন।।
ভার্য্যারে রাখিয়া ঘরে শিশুর রক্ষণে।
আহার কারণে গেল দণ্ডক কাননে।।
হেনকালে এক ব্যাধ আইল সেখান।
পক্ষীরে দেখিয়া অন্ত্র করিল সন্ধান।।
অল্পমাত্র অন্ত্র হইল শরীরে।
উড়িয়া পড়িল পক্ষী রেবানদী তীরে।।
শূন্য এক দেবালয় ছিল সেই স্থলে।
তাহার ভিতরে গেল ক্ষতে অঙ্গ জ্বলে।।
পশ্চাতে দেখিয়া ব্যাধ আইল সত্বর।
ত্বরাত্বরি প্রবেশিল মন্দির ভিতর।।
বাণেতে পীড়িত পক্ষী উড়িবারে নারে।
ফিরি ফিরি চলে পক্ষী ধরিতে না পারে।।
সাতবার প্রদক্ষিণ কৈল দেবালয়।
তবে মহাক্রুদ্ধ ব্যাধ হৈল অতিশয়।।
পুনরপি দিব্য অস্ত্র করিল প্রহার।
বাণাঘাত তনুত্যাগ হইল তাহার।।
পক্ষী লয়ে গৃহে ব্যাধ গেল হৃষ্টচিত্তে।
বিষ্ণু প্রদক্ষিণ ফল লফিল তাহাতে।।
সেই পুণ্যে শাপে মুক্ত হৈল সেইক্ষণ।
দিব্যমূর্ত্তি হইয়া চলিল নিকেতন।।
যাহা জিজ্ঞাসিল রাজা কহিনু তোমারে।
শুরু শিষ্য দোঁহে শাপ দিলেন দোঁহারে।।
গর্ভবতী ভার্য্যা তবে দেখি বৃহস্পতি।
ক্রুদ্ধচিত্তে তাহারে বলয়ে মহামতি।।
অবলা স্ত্রীজাতি তুমি কি বলিব আর।
মম বাক্যে এই গর্ভ করহ সংহার।।
তবে সে লইব তোমা আপন ভবনে।
শীঘ্রগতি গর্ভ ত্যাগ এর এইক্ষণে।।
ভয়েতে আকুল প্রসবিল সেইক্ষণ।
এক গুটি সুতা হৈল একটি নন্দন।।
দেখি হরষিত জীব কহেন তখন।
মম কন্যা পুত্র এই বিধির সৃজন।।
চন্দ্র বলে মম পুত্র কন্যা এ হইল।
আমার ঔরসে জন্ম জানয়ে সকল।।
কথায় কথায় দ্বন্দ্ব হয় দুই জন।
জানিয়া সকল তত্ত্ব দেব পদ্মাসন।।
শীঘ্রগতি সেই স্থলে করিল গমন।
দ্বন্দ্ব নিবারণ হেতু কহেন বচন।।
আমার বচনে দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।
এই কন্যা পুত্রেরে জিজ্ঞাস বিবরণ।।
যাহার ঔরসে জন্ম কহিবে কাহিনী।

এত শুনি জিজ্ঞাসা করিল নিশামণি।।
নন্দিনী কহিল দেব কর অবধান।
যার ক্ষেত্র তার পুত্র শাস্ত্রের বিধান।।
এত শুনি ক্রোধেতে বলিল শশধর।
মম শাপে নরলোকে হও লোকান্তর।।
নরলোক গিয়া জন্ম লভহ পাপিনী।
নীলধ্বজ ঔরসেতে জন্মিবে নন্দিনী।।
সেইক্ষণে লোকান্তর হইল তাহার।
তবে চন্দ্র জিজ্ঞাসিল চাহিয়া কুমার।।
কহ সত্য জন্ম তব কাহার ঔরসে।
মিথ্যা না কহিবা সত্য কহিবা বিশেষে।।
এত শুনি করযোড়ে বলয়ে বচন।
তোমারে ঔরসে জন্ম তোমার নন্দন।।
এত শুনি পুত্রে চন্দ্র করিল চুম্বন।
কোলে করি নিজ গৃহে লইল নন্দন।।
বুধ বলে নাম তার ঘোষয়ে জগতে।
তারারে লইয়া গুরু গেল ধৈর্য্য চিতে।।
সত্যলোকে প্রজাপতি করিল গমন।
খণ্ডন না যায় কভু চন্দ্রের বচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে শুনিলে তরযে ভববারি।।