৩৩. চন্দ্র কর্ত্তৃক গুরুপত্নী হরণ ও বুধের জন্ম বৃত্তান্ত

ভীষ্ম বলিলেন, রাজা করহ শ্রবণ।
আর কিছু ব্রতকথা কহিব এখন।।
চান্দ্রায়ণ মহাব্রত বিখ্যাত সংসারে।
শ্রদ্ধা ভক্তি করি ব্রত যে জন আচরে।।
সর্ব্বকাম ফল লভে নাহিক সংশয়।
পূর্ব্বে করিয়াছি আমি এ সব নির্ণয়।।
ইতিহাস কহি এবে শুন দিয়া মন।
চন্দ্রকেতু রাজা ছিল ইক্ষবাকু নন্দন।।
চন্দ্রের নন্দিনী সেই পতিব্রতা সতী।
চন্দ্রাবতী নামে কন্যা তাহার যুবতী।।
শাপ হেতু জন্ম নিল নীলধ্বজ-ঘরে।
চন্দ্রবতী নাম হৈল বিখ্যাত সংসারে।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।
চন্দ্রের কন্যারে শাপ দল কোন জন।
মর্ত্ত্যলোকে জন্মে সেই কিসের কারণ।।
ভীষ্ম বলিলেন, রাজা কর অবধান।
পড়িবারে যায় চন্দ্র বৃহস্পতি-স্থান।।
সর্ব্বশাস্ত্রে সিদ্ধ দ্বিজ-অঙ্গিরা-তনয়।
নানা শাস্ত্র চন্দ্রেরে পড়ান অতিশয়।।
ব্যাকরণ শ্রুতি স্মৃতি আদি শাস্ত্রগণ।
কতদিন জীবস্থানে করিল পঠন।।
জীবের রমণী সেই তারকা নামেতে।
মোহিত হইল চন্দ্র তাহার রূপেতে।।
কামে বশ হয়ে গুরুপত্নী না মানিল।
প্রবন্ধ মায়ায় তারে হরিয়া লইল।।
সত্যলোক স্থানে শুনি এ সব কথন।
গুরুপত্নী সুধাকর করিল হরণ।।
ক্রুদ্ধ হয়ে গেল গুরু চন্দ্রের সদন।
বলিল, পাপিষ্ঠ তুই বড়ই দুর্জ্জন।।
বৃথা শাস্ত্র মম স্থানে করিলি পঠন।
গুরুপত্নী হরি পাপ করিলি অর্জ্জন।।
কলঙ্কিত হও আজি হৈতে অমরায়।
কলঙ্কী চন্দ্রমা বলি কহুক তোমায়।।
আর এক বাক্য মম শুনরে অধম।
মম শাপে মর্ত্ত্যলোকে হইবে জনম।।
কুরুবংশে ধনঞ্জয় পাণ্ডুর কুমার।
তাহার ঔরসে জন্ম হইবে তোমার।।
কৃষ্ণের ভাগিনা হবে সুভদ্রা গর্ভেতে।
অল্পদিনে শাপমুক্ত হইবে তাহাতে।।
এত শুনি চন্দ্র তবে হৈল ক্রুদ্ধমন।
গুরুরে শাপিল মহাক্রোধে সেইক্ষণ।।
নিজবশ নহে আত্মা পরবশ হয়।
জানিয়া আমারে শাপ দিলে মহাশয়।।
তোমারে ত আমি শাপ দিব সে কারণ।
হীন পক্ষিযোনি-মদ্যে লভিবে জনম।।
গৃধ্র নামে পক্ষী তুমি অবশ্য হইবে।
দীর্ঘদিন ভোগ ভুঞ্জি শাপে মুক্ত হবে।।
ইহা শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্ম নরপতি।
কিরূপেতে পক্ষিযোনি পায় বৃহস্পতি।।
কত দিন গতে হৈল শাপ বিমোচন।
কহ শুনি পিতামহ সব বিবরণ।।
গাঙ্গেয় বলেন, ভূপ করহ শ্রবণ।
চন্দ্রের বচন কভু না হয় খণ্ডণ।।
গৃধ্র পতঙ্গেতে জন্ম হৈল বৃহস্পতি।
বৃন্দারক গিরিতটে করিল বসতি।।
পরম কৌতুক রহে ভার্য্যার সংহতি।
কত দিনে বিহঙ্গিণী হৈল গর্ভবতী।।
চারিগুটি ডিম্ব কত দিনে প্রসবিল।
ডিম্ব ফুটি চারি শিশু তাহাতে জন্মিল।।
দুই গুটি পুত্র হৈল দুই গুটি সুতা।
স্বামী সহ বিহঙ্গিনী হৈল আনন্দিতা।।
সর্ব্বাঙ্গসুন্দর শিশু দেখি চারি জন।
বাৎসল্য করিয়া দোঁহে করয়ে পালন।।
ক্ষণেক না ছাড়ে দোঁহে শিশুর সংহতি।
নানা উপহার ভোগে পালে নিতি নিতি।।
এইরূপে কত দিন আনন্দ কৌতুকে।
ভার্য্যা পুত্রসহ পক্ষী বঞ্চে নানা সুখে।।
একদিন দৈববশে আহার কারণে।
একেশ্বর পক্ষিবর যায় ঘোর বনে।।
ভার্য্যাকে রাখিয়া ঘরে শিশুর রক্ষণে।
আহার কারণে গেল দণ্ডক কাননে।।
হেনকালে এক ব্যাধ আসিল সে স্থান।
পক্ষীরে দেখিয়া অস্ত্র করিল সন্ধান।।
অল্পমাত্র অস্ত্রক্ষত হইল শরীরে।
উড়িয়া পড়িল পক্ষী রেবানদী-তীরে।।
শূন্য এক দেবালয় ছিল সেই স্থলে।
তাহার ভিতরে গেল, ক্ষতে অঙ্গ জ্বলে।।
পশ্চাতে দেখিল ব্যাধ আসিল সত্বর।
শীঘ্রগতি পাশে দেবালয়ের ভিতর।।
বাণেতে পীড়িত পক্ষী উড়িবারে নারে।
ফিরি ফিরি ভ্রমে পক্ষী ধরিতে না পারে।।
সাতবার প্রদক্ষিণ করে দেবালয়।
তবে মহাক্রুদ্ধ ব্যাধ হৈল অতিশয়।।
পুনরপি দিব্য অস্ত্র করিল প্রহার।
বাণাঘাতে তনু ত্যাগ হিইল তাহার।।
পক্ষী লয়ে গৃহে ব্যাধ গেল হৃষ্টচিত্তে।
বিষ্ণু প্রদক্ষিণ ফল লভিল তাহাতে।।
সেই পুণ্যে শাপে মুক্ত হৈল সেইক্ষণ।
দিব্যমূর্ত্তি ধরি চলে বৈকুণ্ঠ-ভুবন।।
যাহা জিজ্ঞাসিলে রাজা কহিনু তোমারে।
গুরুশিষ্যে দোঁহে শাপ দিলেন দোঁহারে।।
গর্ভবতী ভার্য্যা তবে দেখি বৃহস্পতি।
ক্রুদ্ধচিত্তে তার প্রতি বলে মহামতি।।
অবলা স্ত্রীজাতি তুমি কি বলিব আর।
মম বাক্যে এই গর্ভ করহ সংহার।।
তবে সে লইব তোমা আপন ভবনে।
শীঘ্রগতি গভী ত্যাগ কর এইক্ষণে।।
ভয়েতে আকুল প্রসবিল সেইক্ষণ।
এক গুটি সুতা হৈল, একটী নন্দন।।
দেখি হরষিত হবে কহেন তখন।
মম কন্যা পুত্র এই বিধির সৃজন।।
চন্দ্র বলে, মম পুত্র কন্যা এ হইল।
আমার ঔরসে জন্ম জানয়ে সকল।।
কথায় কথায় দ্বন্দ্ব করে দুই জন।
জানিয়া সকল তত্ত্ব দেব পদ্মাসন।।
শীঘ্রগতি সেই স্থলে করিয়া গমন।
দ্বন্দ্ব নিবারণ হেতু কহেন বচন।।
আমার বচনে দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।
কন্যা পুত্রদ্বয়ে জিজ্ঞাসহ বিবরণ।।
যাহার ঔরসে জন্ম কহিবে কাহিনী।
এত শুনি জিজ্ঞাসা করেন নিশামণি।।
কাহার ঔরসে জন্ম নিলে দুই জন।
মিথ্যা না কহিবে, সত্য কহিবে বচন।।
নন্দিনী কহিল, দেব কর অবধান।
যার ক্ষেত্র তার পুত্র শাস্ত্রের বিধান।।
এত শুনি ক্রোধ করি বলে শশধর।
মম শাপে নরলোকে হও লোকান্তর।।
নরলোকে জন্ম গিয়া লভহ আপনি।
নীলধ্বজ ঔরসেতে জন্মিবে নন্দিনী।।
সেইক্ষণে লোকান্তর হইল তাহার।
তবে চন্দ্র জিজ্ঞাসিল চাহিয়া কুমার।।
কহ সত্য, জন্ম তব কাহার ঔরসে।
মিথ্যা না কহিবে, সত্য কহিবে বিশেষে।।
করযোড়ে শিশু তবে বলয়ে বচন।
তোমার ঔরসে জন্ম, তোমার নন্দন।।
এত শুনি পুত্রে চন্দ্র করিল চুম্বন।
কোলে করি নিজ গৃহে লইল নন্দন।।
বুধ বলি নাম তার ঘোষয়ে জগতে।
তাহারে লইয়া চন্দ্র গেল সুস্থচিত্তে।।
সত্যলোকে প্রজাপতি করিল গমন।
খণ্ডন না যায় প্রভু চন্দ্রের বচন।।
নীলধ্বজ-গৃহে কন্যা আসি জন্ম নিল।
চন্দ্রাবতী নাম তার নৃপতি রাখিল।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে, শ্রবণেতে তরে ভববারি।।