২৫. পঞ্চ প্রেতোপাখ্যান

ভীষ্ম বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।
গয়াক্ষেত্র ভ্রমিল কৌণ্ডিন্য তপোধন।।
আর যত ক্ষেত্র তীর্থ পৃথিবীতে ছিল।
একে একে তাহা মুনি সকলি ভ্রমিল।।
কুরুক্ষেত্র উত্তরে আইল তপোধন।
লক্ষ লক্ষ শব তথা হতেছে দাহন।।
শ্মশানের নিকটে আইল তপোধন।
দেখিলা বসিয়া আছে প্রেত পঞ্চজন।।
বিকৃতি আকার সব বিকৃতি বদন।
লম্ব ওষ্ঠ লম্ব কেশ লম্বিত দশন।।
স্থূল নাশা কুপবর সদৃশ নয়ন।
বিষ্ঠা মুত্র আদি যত অঙ্গেতে ভূষণ।।
দেখিয়া বিস্ময় চিত্ত হৈল তপোধন।
জিজ্ঞাসিল কে তোমরা হও পঞ্চজন।।

এতেক শুনিয়া তবে মুনির বচন।
কহিতে লাগিল তারা হয়ে হৃষ্টমন।।
প্রেতকূলে জন্ম মোর অদৃষ্ট কারণ।
তার কথা কহি মুনি শুন দিয়া মন।।
নিজ কর্ম্মদোষে মোরা হইনু এরূপ।
তুমি কেবা মহাশয় কহিবে স্বরূপ।।
রবি চন্দ্র জিনি কান্তি দেহের বরণ।
শিরেতে পিঙ্গল জটা মহা সুলক্ষণ।।
মোহন মুরতি তনু জিনি নবঘন।
মুখরুচি পূর্ণশশী জিনিয়া শোভন।।
করিকর ভুজবর পঙ্কজ নয়ন।
মধ্যদেশ মৃগ জিনি অতি সুগঠন।।
কণ্ঠ কম্বু জিনি জম্ভু রক্ত পঞ্চ স্থল।
রক্ত কোকনদ পদ অতি সুশীতল।।

দ্বিজ বলে হই আমি ব্রাহ্মণ নন্দন।
কৌণ্ডিন্য আমার নাম বিখ্যাত ভুবন।।
তীর্থযাত্রা করি আমি ভ্রমি এ সংসার।
গয়া গঙ্গা আদি তীর্থ ভ্রমিনু অপার।।
জগতের হিত চিন্তি জগত নিস্তার।
কহ সত্য পঞ্চজন কাহার কুমার।।
কোথায় নিবাস কিবা নাম সবাকার।
কে হেতু দেখি যে মূর্ত্তি বিকৃতি আকার।।

এত শুনি পঞ্চ প্রেত বলয়ে বচন।
অরণ্যে নিবাস করি শুন তপোধন।।
সূচীমুখ নাম মোর কর অবগতি।
শীঘ্রক ইহার নাম শুন মহামতি।।
পর্য্যুষিত খ্যাত ‍নাম ধরে এইজন।
লেখক পাঠক নাম ধরে দুইজন।।
এই পঞ্চজন মোরা অরণ্যেতে বসি।
এত শুনি পুনরপি জিজ্ঞাসিল ঋষি।।
এমত কুৎসিত নাম হৈল কি কারণ।
কোথায় আছিলা কিবা করহ ভক্ষণ।।
সত্য করি কহ ভাষা ‍না ভাণ্ডিহ মোরে।
এত শুনি একে একে কহিল তাঁহারে।।

সূচীমুখ বলে মুনি কর অবধান।
আমার পাপের কথা না হয় বাখান।।
পূর্ব্বেতে ছিলাম আমি বৈশ্যের নন্দন।
মহাধনবান ছিনু শাস্ত্রে বিচক্ষণ।।
একদিন অতিথি আইল মম ঘরে।
সম্ভাষ তাহারে না করিনু অহঙ্কারে।।
দিব্য অন্ন উপহারে ভার্য্যা, পুত্র লৈয়া।
করিলাম ভক্ষণ অতিথিরে না দিয়া।।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সেই আকুল হইল।
মম অদৃষ্টের বশে উঠিয়া সে গেল।।
এই হেতু সূচীমুখ নাম যে আমার।
প্রেতযোনি হইলাম বিখ্যাত সংসার।।

তদন্তরে শীঘ্রক করিল নিবেদন।
আমার পাপের কথা শুন তপোধন।।
পূর্ব্বজন্মে ব্যাধকুলে উৎপত্তি আমার।
হীন শূদ্রজাতি ছিনু বড় দুরাচার।।
পরদ্রব্য পরধন করি অপহার।
চুরি হিংসা করিয়া পুষিনু সুতদার।।
এইরূপে কত দিন কৈনু নির্ব্বাহন।
অতিথি আইল দৈবে আমার সদন।।
ক্ষুধাতুর হয়ে অন্ন মাগিল আমারে।
ক্রোধে বহু তিরস্কার করিলাম তারে।।
পাপিষ্ট অধম তুই বড় দুরাচার।
ভিক্ষা মাগি খাও তুমি এ কোন্ আচার।।
নিজ পরাক্রমে ধন করিয়া অর্জ্জন।
উদর পুরিতে নার জীয় অকারণ।।
এত বলি জ্যেষ্ঠ পুত্রে কহিনু ক্রোধেতে।
ধাক্কা মারি দেহ দুষ্টে মোর বাড়ী হতে।।
এত শুনি অতিথি হইল ক্রুদ্ধমন।
নাহি দিয়া দুষ্ট মোরে করহ তাড়ন।।
মোরে অপমান যেন কৈলি দুরাচার।
প্রেতযোনি জন্ম দুষ্ট হইবে তোমার।।
ক্ষুধার্ত্ত অতিথি জনে করিলি বঞ্চন।
বিষ্ঠা মূত্রে হইবেক তোমার মরণ।।
এত বলি দুঃখচিত্তে করিল গমন।
শীঘ্রক আমার নাম হৈল সে কারণ।।

তদন্তরে আর প্রেত কহিল বচন।
পূর্ব্বজন্মে ছিনু আমি দ্বিজের নন্দন।।
অযাজ্য যাজক ছিনু লুব্ধ অতিশয়।
ধর্ম্মাধর্ম্ম করিয়া অর্জ্জিনু ধনচয়।।
সুত দারা পরিবার করিয়া পোষণ।
ক্রূরমতি ছিনু অতি আশয় কৃপণ।।
একদিন বসি শাস্ত্র করিতে লিখন।
হেনকালে আসে এক অতিথি ব্রাহ্মণ।।
ক্ষুধাতুর আসি অন্ন মাগিল আমারে।
ক্রোধে বহু তিরস্কার করিনু তাহারে।।
সেই পাপে লেখক হইল মম নাম।
শয়ন আসন মম অমঙ্গল ধাম।।

তদন্তরে অন্য প্রেত বলয়ে বচন।
কহিব আমার কথা শুন তপোধন।।
পূর্ব্বজন্মে ছিনু আমি বৈশ্যের নন্দন।
মম ঘরে অতিথি আইল একজন।।
ক্ষুধার্ত্ত হইয়া অন্ন মাগিলা আমারে।
কপট করিয়া আমি পুছিনু তাহারে।।
তিরস্কার করি অন্ন করি পুর্য্যষিত।
অল্প অন্ন দিনু নহে উদর পূরিত।।
সেই পাপে পর্য্যুষিত নাম যে থুইল।
অদৃষ্টের ফলে মম প্রেতত্ব হইল।।

অন্য প্রেত বলে দ্বিজ শুনহ বচন।
অল্প দোষে হৈল মম দুর্গতি লক্ষণ।
সঙ্গদোষে অল্প পাপে পাপ বাড়ে নীতি।
মোসবার বিবরণ শুন মহামতি।।
বিষ্ঠা মূত্র ম্লেচ্ছোদক করি যে ভক্ষণ।
শ্মশানে মশানে নিত্য করি যে শয়্ন।।
বিশেষে নিবাস মম শুন তপোধন।
সন্ধ্যা বীজমন্ত্রহীন যেইত ব্রাহ্মণ।।
তাহার শরীরে করি নিয়ত বিহার।
আর যাহা করি তাহা শুন সারোদ্ধার।।
সন্ধ্যাহীন যেই গৃহে তৈলের বিহনে।
বিহীন যাহার বাড়ী তুলসী কাননে।।
যে যুবতী নিজপতি করি পরিহার।
অনু পুরুষের সঙ্গে করে অনাচার।।
বাসি বস্ত্র প্রক্ষালন আলস্যে না করে।
বাসি ঘরে শোয় আর থাকে অনাচারে।।
তাহার শরীরে মোরা থাকি অনুক্ষণ।
পূর্ব্বজন্ম কথা কহি শুন দিয়া মন।।

শূদ্রের কুলেতে জন্ম আছিল আমার।
একদিন কর্ম্ম আমি কৈনু দুরাচার।।
আলস্য করিয়া গৃহে করিনু শয়ন।
হেনকালে অতিথি আইল একজন।।
ক্ষুধায় আকুল হৈয়া ডাকিল আমারে।
জাগিয়া উত্তর আমি না দিনু তাহারে।।
উত্তর না পেয়ে শাপ দিল অতিশয়।
জন্মান্তরে প্রেত দেহ হইবি নিশ্চয়।।
এত বলি অন্য স্থানে করিল গমন।
পাঠক আমার নাম হৈল সে কারণ।।

এত শুনি হৈল মুনি সবিস্ময় মন।
পুনরপি জিজ্ঞাসিল কহ প্রেতগণ।।
কোন্ কর্ম্মে খণ্ডে হেন দুর্গতি লক্ষণ।
প্রেতগণ বলে শুন কহি তপোধন।।
নরযোনি পৃথিবীতে জন্মিয়া যে জন।
জাতি মত কর্ম্ম যে করয়ে আচরণ।।
জাতি জ্ঞাতি বন্ধুগণে করি আবাহন।
মিষ্ট অন্ন পান দিয়া করায় ভোজন।।
দরিদ্রে ভিক্ষুকে যেই করে অন্ন ‍দান।
তাহার পুন্যের কথা না হয় বাখান।।
ব্রত উপবাস করে গোবিন্দ উদ্দেশে।
অনন্ত গোবিন্দ ব্রত আচরে বিশেষে।।
আলস্য শয়ন নিদ্রা করিয়া বর্জ্জন।
স্বহস্তে করয়ে হরি মন্দির মার্জ্জন।।
গোবিন্দের উদ্দেশে করয়ে পুষ্পোদ্যান।
গোবিন্দের নাম যেই করে মতিমান।।
গৃহ-ধর্ম্মচর্য্যা যেই জন পরিহরি।
একেশ্বর ভ্রমে তীর্থ পর্য্যটন করি।।
সর্ব্বভূতে সমভাব করে যেই জন।
শত্রুতে মিত্রেতে যার সম আচরণ।।
মৃত্তিকাদি দিয়া গৃহ করিয়া নির্ম্মাণ।
লিঙ্গরূপে যে জন স্থাপয়ে ভগবান।।
এই সব নর প্রেতযোনি নাহি পায়।

সংসারেতে জন্মি যে দুষ্কর্ম্ম আচরয়।।
পিতৃ মাতৃ নিন্দে যেবা নিন্দয়ে ব্রাহ্মণ।
অতিথিরে যেই জন না করে তোষণ।।
পিতৃযজ্ঞে দেবযজ্ঞে বিমুখ যে জন।
এই সব লোক মুনি হয় প্রেতগণ।।
বহু ছল করি যেই পরবৃত্তি হরে।
ব্রাহ্মণেরে প্রণাম না করে অহঙ্কারে।।
ব্রহ যজ্ঞে উপহাস করে যেই জন।
বলে ছলে পরধন যে করে হরণ।।
দেবতা উদ্দেশে দ্রব্য আনিয়া যে জন।
লোভার্ত্ত হইয়া করে আপনি ভক্ষণ।।
হেলায় না করে যেই তার্থ পর্য্যটন।
এ সব পাতকী হয় প্রেতত্ব কারণ।।
গুরুনিন্দা করে যেই বেশ্যাপরায়ণ।
প্রেতযোনি জন্ম হয় সেই সব জন।।

ভীষ্ম বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।
ধর্ম্ম কর্ম্ম প্রসঙ্গেতে প্রেত পঞ্চজন।।
পূর্ব্বার্জ্জিত পাপ যত ভস্ম হয়ে গেল।
প্রেতমূর্ত্তি ত্যজি পরে দিব্যমূর্ত্তি হৈল।।
স্বর্গ হৈতে পঞ্চ রথ আইল সেক্ষণ।
মুনিরে প্রণমি কৈল রথ আরোহণ।।
ইন্দ্রেরে নগরে শীঘ্র করিল গমন।
দেখিয়া বিস্ময় চিত্ত হৈল তপোধন।।
পৃথিবীর যত তীর্থ করিল ভ্রমণ।
ত্রিভুবনে বিখ্যাত কৌণ্ডিন্য তপোধন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
আমার কি শক্তি ইহা বর্ণিবারে পারি।।
শিরেতে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।