২৪. গয়াক্ষেত্রের উপাখ্যান

রাজা বলে কহ শুনি গঙ্গার নন্দন।
কি করিল পরেতে কৌণ্ডিন্য তপোধন।।
ভীষ্ম বলিলেন গয়া গেল মুনিবর।
মহাপুণ্যক্ষেত্র সেই বাখানে অমর।।
গয়াসুর নামে ছিল দুরন্ত অসুর।
তাহার সৃজিত ক্ষেত্র খ্যাত তিনপুর।।

এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।
পশ্চাৎ শুনিব কৌণ্ডিন্যের উপাখ্যান।
আগে কহ শুনি দেব ইহার আখ্যান।।
অসুর সৃজিত ক্ষেত্র পূজ্য কি কারণ।
ভীষ্ম বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।।

তমোগুণে জন্ম হৈল অসুর কুমার।
ত্রিপুর নামেতে দৈত্য বিখ্যাত সংসার।।
দেবদ্বিজে হিংসা দুষ্ট করে নিরন্তর।
তার ভয়ে পলাইল যতেক অমর।।
শিবের নিকটে গিয়া করিলেন স্তুতি।
প্রকারেতে ত্রিপুরে মারেন পশুপতি।।
ত্রিপুরে মারিয়া নাম হৈল ত্রিপুরারী।
ত্রিপুরের ভার্য্যা শুকদৈত্যের কুমারী।।
সতী গুণবতী কণ্যা রূপে অনুপম।
ত্রিপুরের প্রিয় ভার্য্যা প্রভাবতী নাম।।
গর্ভবতী সেইকালে আছিল সুন্দরী।
নারদ কহিল আসি দৈত্য বরাবরি।।
এই তব ভার্য্যা গর্ভে আছে তব সুত।
তার কর্ম্ম ভবিষ্যতে হইবে অদ্ভূত।।
শীঘ্রগতি রাখ লয়ে জনকের ঘরে।
তবে শিব সহ তুমি প্রবেশ সমরে।।
এত বলি অন্তর্দ্বান হন তপোধন।
পিতৃগৃহে কন্যারে রাখিল সেইক্ষণ।।
তবেত শিবের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভিল।
শিবের বাণেতে দৈত্য পরাণ ত্যাজিল।।
পিতৃগৃহেতে কন্যা প্রসবিল যে নন্দন।
গয়াসুর নাম হল বিখ্যাত ভুবন।।
সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ হয় মহাবীর।
তাহার সমরে দেবগণ নহে স্থির।।

এক দিন গয়াসুর কোন কর্ম্ম কৈল।
বিরলে বসিয়া জননীরে জিজ্ঞাসিল।।
শুনগো জননী মোর এক নিবেদন।
বিবরিয়া কহ মোরে ইহার কথন।।
যখন পড়িতে আমি যাই শুক্রস্থানে।
পিতৃহীন বলি মোরে বলে সর্ব্বজনে।।
কহত জননী শুনি পূর্ব্বের কথন।
কোন্ বংশে জন্ম মম কাহার নন্দন।।
পিতৃহীন সুতের অসুখী সদা মন।
জলহীন নদী যেন নহে সুশোভন।।
চন্দ্রহীন রাত্রি যেন পদ্মহীন সর।
পিতৃহীন সন্তানের তেমতি অন্তর।।

এত শনি কহে মাতা রোদন করিয়া।
পিতৃহীন বাপু তুমি বড় অভাগিয়া।।
ধন্দ অসুরের বংশ ত্রিপুর নামেতে।
তোমার জনক সেই বিখ্যাত জগতে।।
আমার গর্ভেতে তুমি আছিলা যখন।
নারদ আসিয়া দৈত্যে কহিল তখন।।
শিব সহ তোমার হইবে মহারণ।
অতএব আইলাম হইবে মহারণ।।
অতএব, আইলাম তোমার সদন।
এই গর্ভবতী যেই তোমার রমণী।।
ইহাতে জন্মিবে এক মহাবীর মণি।
জনকের ঘরে লয়ে রাখ এইক্ষণে।
তবে সে করিবে রণ ধূর্জ্জটির সনে।।
এত শুনি তব পিতা আনিয়া হেথাতে।
রাখিয়া করিল যুদ্ধ শিবের সঙ্গেতে।।
কপট প্রবন্ধে কহে সর্ব্ব দেবগণ।
শিব হাতে তব পিতা হইল নিধন।।
ভ্রাতৃবন্ধু আদি যত ছিল দৈত্যগণ।
সকলেরে দেবগণ করিল নিধন।।
ত্রিপুরের বংশে তুমি এক বংশধর।
এত বলি তারমাতা কান্দিল বিস্তর।।

এত শুনি গয়াসর সক্রোধ অন্তর।
মায়ে প্রবোধিয়া গেল শুক্রের গোচর।।
করযোড়ে প্রণমিল শুক্রের চরণে।
নিজ পরিচয় দৈত্য দিল সেইক্ষণে।।
শুনি শুক্র দৈত্যগুরু আশ্বাস করিল।
অস্ত্র শস্ত্র নানা বিদ্যা সব পড়াইল।।
ত্রিভুবনে যত বিদ্যা কিছু নাহি শেষ।
গুরু প্রণমিয়া দৈত্য আসে নিজ দেশ।।
আসিয়া মায়ের পায়ে দণ্ডবৎ কৈল।
জননী বিস্তর তারে আশীর্ব্বাদ দিল।।
অবশেষে যত দৈত্য ত্রিভুবনে ছিল।
গয়াসুরে আসি সবে সত্বরে মিলিল।।
তবে গয়াসুর বীর মহাকোপ ভরে।
বহু সৈন্য সাজি গেল সুমেরু শিখরে।।
ইন্দ্র আদি দেব যত অদিতি তনয়।
বাহুবলে সবারে করিল পরাজয়।।
তদন্তরে শিবসহ কৈল মহারণ।
একে একে জিনিল সকল দেবগণ।।
একচ্ছত্র দৈত্য রাজা হৈল ত্রিভুবনে।
উদাসীন হয়ে ফিরে যত দেবগণে।।
ইন্দ্র সহ যুক্তি করি যত দেবগণ।
ক্ষীরোদ উত্তর দিকে করিল গমন।।
জগৎ ঈশ্বর বিষ্ণু দিকে সনাতন।
করযোড় করি সবে করিল স্তবন।।
জয় জয় জনার্দ্দন জয় জগৎপতি।
ত্রিভুবন চরাচর তোমার বিভূতি।।
তুমি সৃজ তুমি পাল করহ সংহার।
এ মহাবিপদে দেব করহ নিস্তার।।
তোমার স্থাপিত দেব যত দবেগণ।
আপনি স্থাপিয়া কর আপনি নিধন।।
এইরূপ স্তুতিবাদ করে দবেগণ।
সেইক্ষণে প্রত্যক্ষ হৈলেন নারায়ণ।।
চারু চতুর্ভুজ পীতবাস পরিধান।
ডাকিয়া বলেন দেবগণে ভগবান।।
দৈত্যের ভয়েতে ভীত আছ দেবগণ।
নির্ভর হইয়া যাহ আপন ভবন।।
আজি আমি গয়াসুরে করিব সংহার।
রহিবে অদ্ভূত কীর্ত্তি জগৎ মাঝার।।

এত শুনি আনন্দিত যত দেবগণ।
প্রণমিয়া গেল সবে যে যার ভবন।।
সত্বর গেলেন প্রভু যথা গয়াসুর।
সাজিল মহেশ যেন মারিতে ত্রিপুর।।
নানাবিধ দিব্য অস্ত্র লইয়া প্রচুর।
সংগ্রাম চাহিল গিয়া যথা গয়াসুর।।
শুনি গয়াসুর ক্রোধে হইল বাহির।
গোবিন্দেরে ডাকিয়া বলিল মহাবীর।।
জগতের নাথ তুমি ঘোষে সুরাসুর।
দেবতার বিবাদেতে মজিল ত্রিপুর।।
ত্রিপুরের পুত্র আমি বিখ্যাত জগতে।
সহজে বাপের বৈরী দেবতা বধিতে।।
সমতায় মম সহ যুঝিবা আপনি।
মম কীর্ত্তি রহে যেন যাবৎ ধরণী।।
এত বলি দিব্য অস্ত্র করিল বাছনি।
হাসিয়া নিলেন অস্ত্র দেব চক্রপাণি।।
শেল শূল শক্তি জাঠি মুষল মুদগর।
পরশু ভূষণ্ডি গদা আদি অস্ত্রবর।।
নিরন্তর ফেলে দোঁহে দোঁহার উপর।
এইরূপে হৈল যুদ্ধ শতেক বৎসর।।
কেহ পরাজয় নহে সম দুই জনে।
ভাবিয়া ডাকিয়া দৈত্য বলে নারায়ণে।।
তোমার সংগ্রামে তুষ্ট হইলাম আমি।
বর ইচ্ছা আছে যদি মাগি লহ তুমি।।

হাসিয়া বলেন হরি শুন দৈত্যপতি।
মোরে বর দিতে তুমি ইচ্ছা কৈলা যদি।।
এই বর দেহ মোরে দৈত্যের ঈশ্বর।
কভু হিং‍সা না করিবে দেব আর নর।।
পাষাণ শরীর হয়ে থাকহ শুইয়া।
অঙ্গীকার কৈল দৈত্য প্রাক্তন স্মরিয়া।।
শুনি আনন্দিত হইলেন নারায়ণ।
মোরে বর দিলা তুমি দৈত্যের নন্দন।।
মোক্ষ বর মাগিয়া লইবা মম স্থানে।
তব কীর্ত্তি রহে যেন এ তিন ভুবনে।।

এত শুনি হৃদয়ে ভাবিয়া দৈত্যবর।
প্রণমিয়া গোবিন্দেরে করিল উত্তর।।
যদি কৃপা আমারে করিলা চক্রপাণি।
ভক্তজন বাক্য তুমি পালিবা আপনি।।
পূর্ব্বেতে নারাদ যে দিলেন উপদেশ।
সেই আজ্ঞা মোরে করিবেন হৃষীকেশ।।
এই ক্ষেত্র মধ্যে মম যাউক পরাণী।
শিলারূপ হয়ে থাকি তব আজ্ঞা মানি।।
আমার মস্তকে পদ দেহ নারায়ণ।
মম নামে ক্ষেত্র এই হউক সৃজন।।
গয়াক্ষেত্র বলি নাম হউক ইহার।
সুখে ত্রিভুবন লোক করুক বিহার।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় আদি জগতের জন।
আমার উপরে যেবা করিবে তর্পন।।
পিতৃলোকে পিণ্ডদান করিবে যে জন।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয়ে তারে পিতৃগণ।।
চিরকাল বৈসে যেন অমর নগর।
এই বর আজ্ঞা মোরে দেহ দামোদর।।
পিণ্ডদান মুক্ত যেই দিন না হইব।
সেই দিন উঠি আমি সংসার নাশিব।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া বর দিয়া নারায়ণ।
দৈত্যের মস্তকে পদ করেন স্থাপন।।
অসুর শরীর হত হৈল সেইক্ষণ।
আনন্দেতে নিজস্থানে যান নারায়ণ।।
শিলারূপ হয়ে দৈত্য আছে চিরকাল।
অতঃপর যে কহি সে শুন মহীপাল।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে অবহেলে ভবসিন্ধু তরি।।