১৭. নারায়ণ ও একাদশীর মাহাত্ম্য

ভীষ্ম বলিলেন রাজা করহ শ্রবণ।
পৃথিবীতে জন্মি পুণ্য করে যেই জন।।
সর্ব্ব পাপে মুক্ত সেই নিষ্পাপ শরীর।
অন্তে মোক্ষগতি লভে শুন যুধিষ্ঠির।।
অষ্টমীর উপবাস করে যেই জন।
শুদ্ধচিত্তে শিবদুর্গা করে আরাধন।।
ভূমিদান রত্নদান করিয়া ব্রাহ্মণে।
অতিথি অথর্ব্ব পূজা করে অন্নাদানে।।
দিব্য অন্ন উপহার করিয়া রন্ধন।
কুটুম্বেরে দিয়া পরে করয়ে পারণ।।
এমত মাসে মাসে অষ্টমীর ক্ষণে।
শুদ্ধচিত্তে এই ব্রত করে সাবাধনে।।
সর্ব্ব পাপে মুক্ত হৈয়া শিবলোকে যায়।
কদাচিত যমের তাড়না নাহি পায়।।

নারায়ণ নামে ব্রত বিখ্যাত জগতে।
নারায়ণ ব্রত যেই করে শুদ্ধ চিত্তে।।
তাহার ‍পুণ্যের কথা না যায় বাখান।
সংক্ষেপে কহিব কিছু কর অবধান।।
গৃহ ধর্ম্মে থাকিয়া করিবে যেই জন।
সর্ব্বভূতে দয়া করি করিবে পূজন।।
যেমন বৈভব তথা করিবেক ব্যয়।
ব্রাহ্মণেরে দিবে ধন হৈয়া শুদ্ধাশয়।।
মূলমন্ত্র তিনবার করিবে চিন্তন।
উপহার বৈভব করিবে নিবেদন।।
অবশেষে প্রণমিয়া পড়িবে ধরণী।
ভক্তিভাবে বলিবে বিবিধ স্তুতিবাণী।।
লক্ষী নারায়ণ জয় জগত জীবন।
নমস্তে গোবিন্দ জয় জয় নারায়ণ।।
এইরূপে ভক্তি করি লক্ষী নারায়ণ।
অবশেষে করি আবাহন বিসর্জ্জন।।
ভূমিদান দিবে আর অন্নদান আদি।
অতিথি ব্রাহ্মণেরে পূজিবে যথাবিধি।।
দ্বিজ গুরু আজ্ঞা তবে মস্তকে ধরিয়া।
পশ্চাতে ভুঞ্জিবে সুখে নিয়ম করিয়া।।
এইমত নারয়ণ ব্রত যে আচরে।
কুটুম্বের সহ যায় বৈকুণ্ঠ নগরে।।

একাদশী মহাব্রত বাখানে পুরাণে।
তার কথা কহি রাজা শুন একমনে।।
গালব নামেতে মুনি মহাতপোধন।
ভদ্রশীল নাম ধরে তাহার নন্দন।।
সর্ব্ব ধর্ম্ম ত্যজিয়া আরাধে নারায়ণ।
তাহার পণ্যের কিছু কহিব কথন।।
স্বয়ম্ভূ নন্দন হেন ধ্রুব মহাশয়।
শিশুকাল অবধি আরাধে জন্মেজয়।।
সেইরূপ ধর্ম্মশীল গালবনন্দন।
সর্ব্ব ধর্ম্ম ত্যজিয়া আরাধে ‍নারায়ণ।।
দেব পাঠ তপ জপ শাস্ত্র অধ্যয়ণ।
সব ত্যজি করে হরিমন্দির মার্জ্জন।।
মাসে মাসে কৃষ্ণ শুক্লা দুই একাদশী।
শুদ্ধচিতে আরাধয়ে পরম তপস্বী।।
দেখিয়া পুত্রের কর্ম্ম সবিস্ময় মন।
জিজ্ঞাসিল কহ তাত ইহার কারণ।।
নানামত বিষ্ণুভক্তি আছে শাস্ত্রমতে।
তপ জপ পূজা ধর্ম্ম বিখ্যাত জগতে।।
ব্রাহ্মণের তপ জপ ধর্ম্ম আচরণ।
ইহার কি ফল কহ শুনি হে নন্দন।।

এত শুনি ভদ্রশীল বলয়ে বচন।
এই যে ব্রতের ফল না যায় কথন।।
আকাশের তারা যদি গণিবারে পারি।
সমুদ্রের জল যদি কলসীতে ভরি।।
পৃথিবীর রেণু যদি পারি যে গণিতে।
তথাপি এ ব্রতপুণ্য না পরি কহিতে।।
সংক্ষেপে কহিব কিছু শুন সারোদ্ধার।
সোমবংশে পূর্ব্বজন্ম আছিল আমার।।
ধর্ম্মকীর্ত্তি নাম ছিল বিখ্যাত জগতে।
দুষ্টমার্গে রত বড় ছিলাম মর্ত্ত্যেতে।।
একচ্ছত্র ভূপতি ছিলাম জম্বুদ্বীপে।
অধর্ম্মে ছিলাম রত ধর্ম্মেতে বিরূপে।।
প্রজাগণে পীড়িনু হিংসিনু শান্তজন।
এইরূপে পাপ করিলাম আচরণ।।
একদিন দৈবযোগে সৈন্যের সহিতে।
মৃগয়া করিতে গেনু চড়ি অশ্ব রথে।।
বিপিনে যাইয়া এক ঘেরিনু হরিণে।
ডাক দিয়া কহিনু সকল সৈন্যগণে।।
যার দিক দিয়া এই হরিণ যাইবে।
কদাচিত তারে যদি মারিতে নারিবে।।
বংশের সহিত তারে করিব সংহার।
এই বাক্য সবার বলিনু বার বার।।
শুনিয়া সজাগ হৈল সর্ব্ব সৈন্যগণ।
সশঙ্কিত হৈয়া মৃগ ভাবে মনে মন।।
যদ্যপি পলাই এই সৈন্য দিক দিয়া।
সবংশে তাহারে রাজা ফেলিবে কাটিয়া।।
এক প্রাণী রক্ষা হেতু মরিবে অনেক।
শুভদিন আজি একাদশী অতিরেক।।
ইতিমধ্যে যদ্যপি আমার মৃত্যু হয়।
পশুত্ব খণ্ডিবে মোক্ষ লভিব নিশ্চয়।।
যে হৌক সে হৌক মম যাউক পরাণ।
নৃপতির দিক দিয়া করিব প্রস্থান।।
যদি বা আমাকে রাজা করিবে নিধন।
মোক্ষগতি হবে পাপ পশুত্ব মোচন।।
যদি কদাচিত প্রাণ রহেত আমার।
নৃপতি পাইবে লজ্জা সৈন্যের নিস্তার।।

এতেক ভাবিয়া মৃগ সেইরূপ করে।
মম দিক দিয়া মৃগ চলিল সত্বরে।।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ মারি শীঘ্রগতি।
না বাজিল মৃগে বাণ এমতি নিয়তি।।
লজ্জা ভাবি তবে ক্রোধে চড়িয়া অশ্বেতে।
ঘোর বনে গেল মৃগ না পাই দেখিতে।।
দণ্ডক অরণ্যে বহু করিয়া ভ্রমণ।
নাহি পাইলাম মৃগ দৈব নির্ব্বন্ধন।।
অশ্ব হত হৈল, শ্রম হইল বহুল।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় চিত্ত হইল আকুল।।
ক্ষুধা তৃষ্ণাযুত আমি হইয়া বিশেষে।
বৃক্ষতলে রহিলাম দিবা অবশেষে।।
রাত্রিশেষে হৈল মম দৈবে লোকান্তর।
দুই যমদূত আসে অতি ভয়ঙ্কর।।
মহাশাপ দিয়া মোরে করিল বন্ধন।
সত্বরে লইয়া গেল যমের সদন।।
দেখি ধর্ম্মরাজ বড় গর্জ্জিল দূতেরে।
অকারণে কেন হেথা আনিলে ইহারে।।
সর্ব্বপাপে মুক্ত আছে এই নরবর।
একাদশী উপবাসে হৈল লোকান্তর।।
শুন কহি দূতগণ আমার বচন।
একাদশী ব্রত আচরিবে যেই জন।।
দাস্যভাবে করে হরি মন্দির মার্জ্জন।
তারে হেথা তোরা না আনিবি কদাচন।।
গোবিন্দের নাম যেই করয়ে স্মরণ।
সর্ব্বভূতে সমভাবে ভজে নারায়ণ।।
কদাচ তাহারে তোরা হেথা না আনিবি।
সাবধান বিস্মরণ কভু নাহি হবি।।
দেবতুল্য পিতৃ মাতৃ যে করে সেবন।
অতিথি সেবয়ে করে তীর্থ পর্য্যটন।।
ভূমিদান গো দানাদি করে দ্বিজগণে।
দুঃখী দরিদ্রকে তৃপ্ত করে অন্ন ধনে।।
সভামধ্যে মুখে যার মিথ্যা নাহি খসে।
দৈবযজ্ঞ করে যেই ব্রাহ্মণ উদ্দেশে।।
গোধন পালন করে সর্ব্ব জীবে দয়া।
সন্ন্যাস গ্রহণ করে ত্যজি গৃহমায়া।।
যোগ সাধি মৃত্যুঞ্জয়ে ভজে যেই জন।
শুদ্ধভাবে যেই আরাধয়ে নারায়ণ।।
সাবহিত হয়ে করে পুরাণ শ্রবণ।
পুরাণ পড়য়ে যেই শুদ্ধ চিত্ত মন।।
ধর্ম্মকথা কহিয়া লওয়ায় অধর্ম্মিরে।
কদাচিত তাহারে না আন হেথাকারে।।
ব্রাহ্মণের নিন্দা যেই করে অনুক্ষণ।
পিতৃ মাতৃ নিন্দে যেই বেশ্যাপরায়ণ।।
বিষ্ণুভক্তি আশ্রয় করিয়া যেইজন।
পরনারী সঙ্গে সদা করয়ে রমন।।
তাহারে আনিবি তোরা প্রহার করিয়া।
নাসিকা ছেদন করি পাশেতে বান্ধিয়া।।
পরনারী হয়ে যেবা হইয়া অজ্ঞান।
সভামধ্যে গুরুজনে করে অপমান।।
তাহারে আনিবি তোরা আমার সদন।
হাতে গলে মহাপাশে করিয়া বন্ধন।।
দেবতা উদ্দেশে দ্রব্য আনি যেই জন।
দেবতারে নাহি দিয়া করয়ে ভক্ষণ।।
লৌহপাশে বান্ধি তারে আনিবে হেথারে।
করিয়া প্রহার মাথে লৌহের মুদগরে।।
ধর্ম্ম বিঘ্নকর আর বিদ্বেষী যেই জন।
উপহাস করে দ্বিজে হৈয়া দুষ্টমন।।
উপহাস করে দ্বিজে হৈয়া দুষ্টমন।
হেথকারে বান্ধি তোরা আনিবি তাহারে।।
পরবৃত্তি হরে যেবা জন্মিয়া সংসারে।
পরভার্য্যা হরে যেবা বলাৎকার করি।।
অজ্ঞান হইয়া যেবা হরয়ে কুমারী।
তাহারে আনিবি তোরা করিয়া বন্ধন।।
এইরূপ পাপ আচরয় যেই জন।

এই শুনি বিস্ময় মানিল দূতগণ।।
করযোড়ে ধর্ম্মারাজে করয়ে স্তবন।
এ সকল কথা পিতা করিয়া শ্রবণ।।
অবশেষে পাপ মম হইল খণ্ডন।
বিধিমতে যম মোরে করিল পূজন।।
স্বর্গ হতে দিব্য রথ আইল তখন।
অজ্ঞানে হইল একাদশী আচরণ।।
সেই পুণ্যে হল মম স্বর্গে আরোহণ।
কোটি কোটি বর্ষ তাত স্বর্গে হৈল স্থিতি।।
তদন্তরে ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।
কোটি যুগ ব্রহ্মলোকে করিয়া ভ্রমণ।।
তোমার ঔরসে আসি হইল জনম।
দিব্যজ্ঞানে পাপ মোর না হয় বাধক।।
সে কারণে একাদশী করিনু সাধক।।
ইহার বৃত্তান্ত এই কহিলাম পিতঃ।
শুনিয়া গালব মুনি হইল বিস্মিত।।
আনন্দিত হৈয়া পুত্রে করিল চুম্বন।
সেই হৈতে হৈল মুনি হরি পরায়ণ।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।।
একচিত্তে শুনিলে তরয়ে ভববারি।
শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথন।।
সাবহিত হইয়া শুনয়ে যেই জন।
মনোবাঞ্ছা ফল লভে নাহিক সংশয়।।
ব্যাসের বচন ইথে কভু মিথ্যা নয়।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।।
কহে কাশীদাস গদাধরের অগ্রজ।