১৩. ধর্ম্মাধর্ম্ম প্রস্তাবে হরিনামের মহাত্ম্য কথন

জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির করিয়া বিনয়।
ধর্ম্মাধর্ম্ম কথা কহ শুনি মহাশয়।।
কিরূপে অধর্ম্ম ভোগ করে পাপিগণ।
ধর্ম্মিলোক ধর্ম্মভোগ করয়ে কেমন।।
শুনিয়া কহেন হাসি গঙ্গার তনয়।
কহিব সকল কথা শুনহ নিশ্চয়।।
যমরাজপুরী নাম বিখ্যাত ভুবনে।
অদ্ভূত তাঁহার পুরী না যায় বর্ণনে।।
ষোলশত যোজন তাহার পরিমাণ।
যমের অদ্ভূত পুরী বিচিত্র নির্ম্মাণ।।
দান যজ্ঞ করে যেই ভজে নরায়ণে।
পুণ্যবান জন করে গমন সেখানে।।
ব্রাহ্মণেরে গাভী দান করে যেইজন।
বিষ্ণু তুল্য জানি বিপ্রে করয়ে সেবন।।
সর্ব্বদ্বার দিয়া যায় যমের সদন।
যমের বিচিত্র পুরী করে নিরীক্ষণ।।
নবঘনশ্যাম অঙ্গ মোহন মুরারী।
দেখিতে অপূর্ব্ব শোভা যেন চক্রধারী।।
সম্ভাষ করিয়া যম চিত্রগুপ্তে বলে।
পাপ পুণ্য বিচার করয়ে সেই কালে।।
যোগ ধর্ম্ম সাধিয়া ভজয়ে নারায়ণ।
বিধিমত ভক্তিভাবে করয়ে পূজন।।
সেইক্ষণে ধর্ম্মরাজ বিবিধ প্রকারে।
বিষ্ণুতুল্য করি পূজা করয়ে তাহারে।।
বৈকুন্ঠ হইতে তবে দেব নারায়ণ।
দিব্য রথ পাঠাইয়া দেন সেইক্ষণ।।
যমেরে প্রণমি, রথে করি আরোহণ।
দেবতুল্য হয়ে করে বৈকুন্ঠ গমন।।
জনদান অন্নদান করে যেই জন।
আত্ম তুল্য অতিথিরে করয়ে সেবন।।
রথে চড়ি যায় সেই বৈকুন্ঠ ভুবন।
কোনকালে তাহার না হইবে পতন।।
তান্বুল গুবাক দান করে যেইজন।
দিব্যরথে যায় সেই যমের ভবন।।
ঘৃত দান করে দ্বিজে করে অন্নব্রত।
যমের নগরে যায় অরোহিয়া রথ।।
ধান্য দান ব্রাহ্মণেরে দেয় যেইজন।
বৃত্তিদান দিয়া যেই তোষেন ব্রাহ্মণ।।
বিচিত্র বিমানে যায় যমের নগরে।
নানা উপভোগ সেই ভুঞ্জয়ে সত্বরে।।
ভূমিদান দিয়া যেই তোষয়ে ব্রাহ্মণে।
পিতৃ-অঙ্গ দেব অঙ্গ করে নিরীক্ষণ।।
ব্রাহ্মণের সেবা যেই করে অনুব্রতে।
ইন্দ্র আদি দেব পূজা করে শুদ্ধচিত্তে।।
পথে পথে ক্ষীর দান করিতে করিতে।
দিব্যরথে চড়ি যায় যমের পুরেতে।।

ধর্ম্মাধর্ম্ম ফলাফল কহিতে বিস্তার।
সংক্ষেপে কহি যে কিছু শুন সারোদ্ধার।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম ভুঞ্জয়ে আপনি যমরাজে।
ধর্ম্মাধর্ম্ম বিবেচনা তাঁহার সমাজে।।
যে যেমন ধর্ম্ম করে সে তেমন পায়।
সর্ব্বসুখে পূর্ণ হয়ে যমপুরে যায়।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম বিচারিতে কর্ত্তা ধর্ম্মরাজ।
অন্তকালে যায় জীব যমের সমাজ।।
সংসারের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব দামোদরে।
যাঁর নাম শ্রবণে অশেষ পাপ হরে।।
বিবিধ বিষ্ণুর ভক্তি বেদের বচন।
কি কারনে তাহা নর না করে সাধন।।
শুনহ গোবিন্দ তত্ত্ব কঠিন না হয়।
কি কারণে তাহে লোক মানে পরাজয়।।
পরদ্রব্য হরে, করে হিংসা পরদার।
চুরি হিংসা করি তোষে আত্ম-পরিবার।।
বিপ্রে দান দেয়, কিন্তু মনে অহঙ্কার।
অতিথি না পূজে, নাহি দেয় পুরষ্কার।।
ব্রাহ্মণী হরণ করে কামে মত্ত হয়ে।
প্রকার প্রবঞ্চ করে মন্দ মিথ্যা কয়ে।।
এইমতে যত পাপ করয়ে অর্জ্জুন।
বিষ্ঠাকুণ্ডে পড়ি, বিষ্ঠা করয়ে ভক্ষণ।।
কান্দয়ে যতেক পাপী, করি হাহাকার।
মস্তক উপরে করে মুদগর প্রহার।।

এইরূপে পাপ ভোগ করে পাপিগণ।
ইতিহাস কথা এক শুনহ রাজন।।
জগতের হর্ত্তা কর্ত্তা দেখ নিরঞ্জন।
তাঁর রূপ তাঁর গুণ বেদের বচন।।
এতেক ভাবিয়া চিত্তে ব্রহ্মার নন্দন।
শীঘ্রগতি গেলেন যেখানে পদ্মাসন।।
করযোড়ে স্তুতি নতি অনেক করেন।
তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা নারদেরে জিজ্ঞাসেন।।
কি হেতু এ সত্যলোকে তব আগমন।
অসন্তোষ চিত্ত তব দেখি কি কারণ।।
সুরালোক কিবা পরমাদ হইয়াছে।
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব কিবা অসুর হয়েছে।।
অসুরের পীড়া কি হয়েছে দেবলোকে।
কি হেতু তোমার চিত্ত মগ্ন দেখি দুঃখে।।

এত শুনি কহিল নারদ তপোধন।
আমার চিত্তের দুঃখ না হয় খণ্ডন।।
যত ভাবিলাম চিত্তে দিতে নাহি সীমা।
জানিতে না পারি হরিনামের মহিমা।।
বেদশাস্ত্র বহির্ভূত মন অগোচর।
এই হেতু ভাবিয়া হয়েছি চিন্তান্তর।।
জগতের হর্ত্তা কর্ত্তা তুমি সনাতন।
তোমাতে উৎপত্তি হয় তোমাতে নিধন।।
সংসারের পতি তুমি সবার ঈশ্বর।
সংসারের আদি অন্ত তোমাতে গোচর।।
সে কারণে আসিলাম ত্বরিত হেথায়।
নামের মহিমা তুমি কহিবা আমায়।।
তোমা বিনা অন্যজন কহিতে না পারে।
কৃপা করি শীঘ্রগতি কহিবে আমারে।।

এত শুনি হাসি ব্রহ্মা কহিলা বচন।
জগতের এক আত্মা সেই নিরঞ্জন।।
কে করিতে পারে তাঁর নাম নিরূপণ।
আমি নাহি জানি হরি নামের কথন।।
পূর্ব্বাপর আছে হেন বেদের উত্তর।
নামের মহিমা কিছু জানেন শঙ্কর।।
শিবের সদনে তুমি করহ গমন।
নামের মহিমা কহিবেন ত্রিলোচন।।

এত শুনি আনন্দিত হয়ে তপোধন।
প্রণমিয়া চলিলেন হরের সদন।।
দণ্ডবৎ করি হরে করিছেন স্তুতি।
জয় জয় বিরূপাক্ষ কাত্যায়নী- পতি।।
সনাতন পূর্ণব্রহ্ম সিদ্ধ অবতার।
তোমার মহিমা আমি কি বলিব আর।।
সে কারণে আসিলাম তোমার সদন।
কহিবে আমাকে তুমি নাম নিরূপণ।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন ত্রিলোচন।
কে কহিতে পারে হরিনামের কথন।।
সমুদ্রলহরী যেবা গণিবারে পারে।
পৃথিবীর রেণু যেবা গণে এ সংসারে।।
আকাশের তারা গণি করে নিরূপণ।
শীঘ্রগতি তার স্থানে করহ গমন।।

এত শুনি হর্ষচিত্তে করিয়া প্রণতি।
ত্বরিতে গেলেন যথা ত্রিদশের পতি।।
দেবঋষি নারদ বিখ্যাত তপোধন।
বৈকুণ্ঠের দ্বারে কেহ না করে বারণ।।
গেলেন সত্বর যথা লক্ষী নারায়ণ।
করযোড়ে প্রণমিয়া করেন স্তবন।।
জয় জয় জগন্নাথ ত্রিদশ ঈশ্বর।
জগতনিবাসী জয় জগতের পর।।
অপার মহিমা তব দিতে নারি সীমা।
শিষ্টের পালন দুষ্ট ভঞ্জন গরিমা।।
সৃজন পালন অংশ যাহার প্রকৃতি।
অখিল কারণ অজ অখিলের পতি।।
নমো নমো দিব্য মৎস্য পূর্ণ অবতার।
সপ্তবিংশ জ্ঞানদাতা বেদের উদ্ভার।।
নমো নমো অবতার দিব্য অসিমুখ।
হিরণ্যাক্ষ বিদার পৃথিবী উদ্ধারক।।
নমস্তে মুকুন্দ নমো নমো মধুহারী।
নমস্তে বামনরূপ নমস্তে মুরারী।।
নমো রঘুকুলোনাথ রাবণ অন্তক।
নমস্তে মাধব নমঃ সংসার পালক।।
এরূপে নারদ করিলেন বহু স্তুতি।
তুষ্ট হয়ে তাঁহারে কহেন লক্ষীপতি।।
ধন্য ধন্য মহামুনি ব্রহ্মার কুমার।
কোন হেতু হেথায় করিলা অগ্রসর।।
ভক্তের অধীন আমি ভকত জীবন।
ভকতের ধন আমি ভকতের মন।।
মনোহর রূপ আমি মন অগোচর।
কাহাতে নির্লিপ্ত আমি কাহে ভিন্ন পর।।
আত্মারূপে সর্ব্বভূতে আমার প্রকাশ।
সে কারণে বিখ্যাত প্রকাশ শ্রীনিবাস।।
আত্মারূপে আমার প্রতিমূর্ত্তি সর্ব্বভূতে।
অন্যজন চিত্তে মোরে না পারে রাখিতে।।
ভক্তের অধীন থাকি ভকত সহিতে।
ভক্তিতে কেবল ভক্ত পারয়ে রাখিতে।।
ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণ আমি করি অনুক্ষণে।
কহ মুনি আসিয়াছ কোন প্রয়োজনে।।

নারদ বলেন তুমি আমার আধার।
সে কারণে গোবিন্দ মাগি যে পরিহার।।
যদি বর দিবা এই দেহ নারায়ণ।
তব গুণ গাই আমি যেন অনুক্ষণ।।
এক নিবেদন দেব শুনহ আমার।
তোমার দুর্ল্লভ নাম জগত নিস্তার।।
ইহার মহিমা দেব কহিবা আমারে।
শুনিয়া মনের ভ্রান্তি সব যাবে দূরে।।

এত শুনি হাসিয়া কহেন নারায়ণ।
সঞ্জীবনীপুরে তুমি করহ গমন।।
মম মূর্ত্তি তথা আছে যম ধর্ম্মরাজ।
ত্বরিতগমনে যাহ তাঁহার সমাজ।।
নামের মহিমা তিনি করেন আমার।
তাহা শ্রুতমাত্র ভ্রম খণ্ডিবে তোমার।।

এত শুনি আনন্দিত হয়ে তপোধন।
প্রণমিয়া চলিলেন কৃতান্ত ভবন।।
যমের বিচিত্র সভা না হয় বর্ণন।
নিবসয়ে তথায় যতেক পুণ্যজন।।
চতুর্ভুজ দিব্য মুর্ত্তি শ্যাম কলেবর।
খঞ্জন গঞ্জন নেত্র সুরঙ্গ অধর।।
পীতবাস পরিধান রাজীবলোচন।
শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম শ্রীবৎসলাঞ্ছন।।
দেখিয়া বিস্ময় মানিলেন ‍মুনিবর।
প্রণাম করিয়া স্তুতি করেন বিস্তর।।
স্তুতিবশে প্রসন্ন হইয়া মৃত্যুপতি।
জিজ্ঞাসেন কি হেতু আইলা মহামতি।।

নারদ বলেন শুন হেথা যে কারণ।
কহিবা আমাকে কৃষ্ণনাম নিরূপণ।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন মৃত্যুপতি।
পুরীর পশ্চিমে মম যাহ মহামতি।।
হরিনান মহিমা পাইবা সেইখানে।
তবে সে তোমার ভ্রান্তি না থাকিবে মনে।।
এত শুনি হাসিয়া গেলেন তপোধন।
পুরীর পশ্চিমদিকে করিলা গমন।।
দেখেন যমের পুরে পাপীর তাড়ন।
কৃমিহ্রদ সারি সারি অদ্ভূত গঠন।।
সেখানে নারদ দেখিলেন ভয়ঙ্কর।
উষ্ণজল বৃষ্টি কোথা হয় নিরন্তর।।
কন্টকের বন কোথা বিপুল বিস্তার।
তাহাতে পড়িয়া পাপী কান্দে অনিবার।।
কোনখানে করে পাশে পাপীরে বন্ধন।
লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি আছে পাপিগণ।।
কোনখানে বিষ্ঠাকুণ্ডে ফেলে পাপিগণে।
মস্তকে মুদগারাঘাত করে দূতগণে।।
কোনখানে অস্ত্রবৃষ্টি হয় ঘনে ঘনে।
অস্ত্রাঘাতে ব্যাকুল কান্দয়ে পাপিগণে।।
এইরূপ প্রহারে ব্যাকুল পাপিজন।
দেখিয়া বিস্ময় মানিলেন তপোধন।।
গোবিন্দ মাধব হরে রাম দামোদর।
এত বলি কর্ণে হাত দিল মুনিবর।।
সেই শব্দ যত যত পাতকী শুনিল।
শ্রুতমাত্র সবাকার পাপমুক্ত হৈল।।
প্রেতমূর্ত্তি ত্যজিয়া হইল দিব্যকায়।
দিব্য বিমানেতে চড়ি স্বর্গধামে যায়।।
অশেষ বিশেষ স্তুতি করে মুনিবরে।
অসংখ্যা অর্ব্বুদ পাপী চলিল সত্বরে।।
দেখিয়া বিস্ময় মানিলেন তপোধন।
অপার মহিমা হরিনামের কথন।।
জয় জয় নামরূপ জয় জগদীশ।
অপার মহিমা জয় জয় আজ ঈশ।।
এই রূপে বহু স্তুতি করে তপোধন।
আনন্দেতে যথাস্থানে করেন গমন।।

ভীষ্ম বলিলেন পুনঃ শুনহ রাজন।
উত্তর দ্বারের কথা কহিব এখন।।
পঞ্চদশ যোজন সহস্র পরিসর।
উত্তরে যমের দ্বার পরম সুন্দর।।
স্থানে স্থানে উদ্যান বিচিত্র মনোহর।
নানাবিধ পসরা শোভিত থরে থর।।
ঘৃত দধি দুগ্ধ ক্ষীর নানা উপহার।
সুগন্ধি শীতল জল সুবাসিত আর।।
পথে পথে স্থানে স্থানে দেব দ্বিজগণ।
সম্মুখ সমর করি মরে যত জন।।
যোগাসনে নিজ দেহ করিয়া দাহন।
উত্তর দুয়ারে যায় সেই সব জন।।
দিব্য ভোগবান হয় পরম আনন্দে।
যম ধর্ম্মরাজে গিয়া ভূমি লুটি বৃন্দে।।
সেই ক্ষণে যম আজ্ঞা দেন দূতগণে।
পত্নী সঙ্গে করি সদা থাকিয়া বিমানে।।
তিন কোটি বৎসর দেবের পরিমাণে।
অমৃতাদি নানা ভোগ করে দিনে দিনে।।
অনন্তর মহীতলে লভয়ে জনম।
সেই নারী পতি মাত্র করয়ে সম্ভম।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খন্ডে পরলোক তরি।।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।