০৯. কুরুক্ষেত্রের বিবরণ

জিজ্ঞাসিল মুনিবরে রাজা জন্মেজয়।
কুরুক্ষেত্র মহিমা বলহ মহাশয়।।
পুণ্যক্ষেত্র কেমনে হইল সেই স্থান।
আমাকে বলহ মুনি করিয়া ব্যাখ্যান।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
তোমাকে জানাব কুরুক্ষেত্র বিবরণ।।
তব পূর্ব্বপুরুষ ছিলেন কুরুরাজা।
পুত্রবৎ করিয়া পালিত সব প্রজা।।
প্রতাপে ছিলেন রাজা মহাধনুর্দ্ধর।
সসাগরা পৃথিবীর হইল ঈশ্বর।।
বিপক্ষ দলন মহারাজ চক্রবর্ত্তী।
পৃথিবী পূরিয়া যাঁর যশ আর কীর্ত্তি।।
ধনুক অভ্যাস ভৃগুরামের সমান।
পরম যোগেন্দ্র শুকদেব সবজ্ঞান।।
প্রভাতে উঠিয়া নিত্য করে স্নানপূজা।
বৃহৎ লাঙ্গল এক স্কন্ধে নিয়া রাজা।।
দুই নীল বৃষ নিজে যুড়িয়া লাঙ্গলে।
প্রহর পর্য্যন্ত চষে মহা কুতূহলে।।
প্রহর পর্য্যন্ত বৃষ যতদূর যায়।
সেইক্ষণে চাষে ক্ষমা দেন কুরুরায়।।
তারপর রাজকার্য্যে রত নরবর।
দরিদ্র দুঃখীরে দান করে নিরন্তর।।
প্রতিদিন এইমতে চষেণ ভূপতি।
সহস্র বৎসরকাল চষিলেন ক্ষিতি।।
একদিন চষে রাজা আপনার মনে।
ছদ্মবেশে সহস্রাক্ষ গেলেন সে স্থানে।।
জিজ্ঞাসা করিল ইন্দ্র চাতুরী করিয়া।
নৃপবর এই ক্ষেত্র চষ কি লাগিয়া।।
রাজা হয়ে কেন কর কৃষকের কর্ম্ম।
ইহার কি মর্ম্ম রাজা কিবা আছে ধর্ম্ম।।
রাজা বলিলেন স্বর্গে ইন্দ্রের শাসন।
ধর্ম্মাধর্ম্ম করয়ে যতেক রাজগণ।।
পুরন্দর তুষ্ট হৈলে সর্ব্ব ধর্ম্ম হয়।
চারিবেদে এই কথা বিদিত নিশ্চয়।।
স্বর্গেতে অধীপ হৈল কশ্যপের সুত।
তাঁর অংশে রাজগণ ভূমি পুরুহূত।।
যত কর্ম্ম করিবেন ক্ষিতির রাজন।
তার ধর্ম্মাধর্ম্ম পান সহস্রলোচন।।
আপনি করিব যজ্ঞ এই ক্ষেত্রমাঝে।
অগ্র যজ্ঞভাগেতে তুষিব দেবরাজে।।
রাজার এতেক শুনি ধার্ম্মিক বচন।
তুষ্ট হয়ে কহিলেন সহস্রলোচন।।
আমি ইন্দ্র শুন রাজা বলি পরিচয়।
ইষ্টবর মাগ রাজা যেবা মনে লয়।।
লাঙ্গল ছাড়িয়া রাজা গলে বস্ত্র দিয়া।
ইন্দ্রের চরণযুগে পড়িলেন গিয়া।।
তুমি ছদ্মরূপধারী দেব সুরপতি।
চর্ম্মচক্ষে চিনিতে না পারি মূঢ়মতি।।
ইন্দ্র বলিলেন রাজা কিছু নাহি পাপ।
স্তুতিবাদ করি কেন বাড়াও সন্তাপ।।
বর মাগ রাজা তব যেবা লয় মন।
মনোনীত বর দিব শুনহ রাজন।।
রাজা বলে সুরপতি কর অবধান।
মোরে বর দিয়া প্রভু করহ বিধান।।
সহস্র বৎসর আমি চষিয়াছি ভূমে।
কুরুক্ষেত্র বলিয়া হউক মম নামে।।
এ ক্ষেত্রের ধূলি উড়ে লাগে যার গায়।
অসংখ্য জন্মের পাপ সে জনের যায়।।
অনিচ্ছায় বা ইচ্ছায় মরে যে এ স্থানে।
পায় যেন সে নির্ব্বাণ মুক্তি সেই ক্ষণে।।
এই বর দেহ মোরে দেব দৈত্যভেদী।
এই তীর্থ রহিবেক চন্দ্র সূর্য্যাবধি।।
তথাস্তু বলিয়া ইন্দ্র হৈলা অন্তর্দ্ধান।
কুরুরাজ নিজ গৃহে করিল পয়াণ।।
এই হেতু কুরুক্ষেত্র শুন নৃপমণি।
তোমাকে জানানু কুরুক্ষেত্রের কাহিনী।।
জন্মেজয় বলেন শুনহ তপোধন।
তারপর কি হইল ভীম দুর্য্যোধন।।
মুনি বলে শুন শুন অপূর্ব্ব কথন।
দুইজনে যুদ্ধ হয় শুনহ রাজন।।
হেথায় সঞ্জয় কহে অন্ধ নৃপতিরে।
দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে পড়িল সমরে।।
শুনি হাহাকার করি করয়ে ক্রন্দন।
মহাশোকাকুল রাজা হয় অচেতন।।
সঞ্জয় বলেন রাজা কেন কান্দ আর।
সর্ব্বনাশ হৈল রাজা কপটে তোমার।।
কহ রাজা কি হইবে এখন কান্দিলে।
কিংজিতং কিংজিতং বলি যবে জিজ্ঞাসিলে।।
পান্ডবেরে যত তুমি কর ভিন্ন ভাব।
সে সব কর্ম্মেতে এবে হৈল এই লাভ।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে শুন ধর্ম্মের নন্দন।
কিমতে করিল যুদ্ধ ভীম দুর্য্যোধন।।
সঞ্জয় বলেন রাজা শুন মন দিয়া।
ভীম দুর্য্যোধন যুদ্ধ কহি বিস্তারিয়া।।
মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।
যাহার শ্রবণে নর হয় নিষ্কলুষ।।
ব্যাসের বচন শিরে করিয়া বন্দন।
কাশীরাম দাস কহে শুন সাধুজন।।