০৮. শাণ্ডিল্যাশ্রমে নারদ বলরামের সংবাদ

জিজ্ঞাসেন জন্মেজয় শুন মুনিবর।
পুনঃ কোন তীর্থে চলিলেন হলধর।।
বলেন বৈশম্পায়ন শুনহ রাজন।
হইয়া একাগ্র মন করহ শ্রবণ।।
পৃথিবীর যত তীর্থ ভ্রমণ করিয়া।
শাণ্ডিল্য আশ্রমে রাম উত্তরিল গিয়।।
শাণ্ডিল্য আশ্রমে সেই যমুনার তীরে।
তথায় দেখেন রাম নারদ মুনিরে।।
তথা স্নানদান করি মনের হরিষে।
ব্রাক্ষ্মণ ভোজন আদি করান বিশেষে।।
নারদ সহিত তথা হইল দর্শন।
বলদেব মুনিবর কহেন বচন।।
তীর্থযাত্রা হেতু তুমি গেলে দেশান্তর।
কৌরব পাণ্ডব যুদ্ধ হৈল ঘোরতর।।
একাদশ অক্ষৌহিণী দুর্য্যোধন সেনা।
মরিল নৃপতি বহু কে করে গণনা।।
সপ্ত অক্ষৌহিণী পতি রাজা যুধিষ্ঠির।
তাহার সহায় হৈল মহা মহা বীর।।
আপনি হইলা কৃষ্ণ অর্জ্জুন সারথি।
সেই যুদ্ধে নষ্ট হয় সকল নৃপতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি পড়িল সমরে।
আর তব ভাগিনেয় অভিমন্যু মরে।।
দুর্য্যোধন একামাত্র কৃপ অশ্বন্থামা।
অবশেষে এই মাত্র কহিলাম সীমা।।
পঞ্চভাই পাণ্ডব দ্রৌপদী পঞ্চসুত।
অবশেষে আর কিছু নাহিক প্রস্তুত।।
হত সৈন্য দেখি পলাইল দুর্য্যোধন।
দ্বৈপায়ন হ্রদ মধ্যে পশিল রাজন।।
তথাপি কৃষ্ণের মনে দয়া না হইল।
হ্রদ হৈতে রাজা দুর্য্যোধনে উঠাইল।।
ভীম দুর্য্যোধনে হবে গদার সমর।
দেখিতে বাসনা যদি থাকে হলধর।।
এই ক্ষণে সেই স্থানে করহ গমন।
বাঁচাইতে পার যদি রাজা দুর্য্যোধন।।
শুনিয়া নারদ বাক্য দেব বলরাম।
তথায় গেলেন দ্রুত না করি বিশ্রাম।।
হইলেন দ্বৈপায়ন হ্রদে উপনীত।
দেখিয়া গোবিন্দ উঠিলেন ত্বরান্বিত।।
যুধিষ্ঠির আদি পঞ্চ পাণ্ডুর নন্দন।
সম্ভ্রমে করিল সবে চরণ বন্দন।।
গোবিন্দেরে আলিঙ্গন বলরাম দেন।
কৃষ্ণ বলরাম শোভা দেখি অনুপম।।
প্রেম-অশ্রুজলে দোঁহে করিলেন স্নান।
প্রীতি বাক্যে জিজ্ঞাসেন সবার কল্যাণ।।
যুধিষ্ঠির পঞ্চজনে করি আশীর্ব্বাদ।
শুভ জিজ্ঞাসেন রাম হরিষ বিষাদ।।
গোবিন্দ কহেন রাম শুন জগন্নাথ।
পৃথিবীর রাজগণে করিল নিপাত।।
যতেক নৃপতিগণ হইল সংহার।
উদ্ধারিতে ক্ষিতি ভার তব অবতার।।
উত্তম করিলে ভাই ইথে নাহি দোষ।
এই কর্ম্মে সবাকার হইল সন্তোষ।।
রামের বচন শুনি কৃষ্ণ মহাশয়।
নিবেদিতে সব কথা করে অভিপ্রায়।।
হেনকালে দুর্য্যোধন কাঁন্দিতে কাঁন্দিতে।
প্রণাম করিল রামে ব্যাকুল চিত্তেতে।।
দুর্য্যোধনে কোলে নিয়া বহে নেত্রজল।
বলরাম জিজ্ঞাসেন তাহার কুশল।।
কহিলেন সর্ব্ব কথা কুরু নৃপমণি।
শুনিয়া ভৎসেন কৃষ্ণে দেব হলপাণি।।
তুমি বিদ্যমানে উহা শোভা নাহি পায়।
সামঞ্জস্য কেন নাহি করিলে দোঁহার।।
জগন্নাথ কহিলা করিয়া যোড়হাত।
নিবেদন করি শুন রেবতীর নাথ।।
শিশুকালে পাণ্ডব যে কৈল দুরাচার।
সকল আছয়ে দেব গোচর তোমার।।
ত্রয়োদশ বৎসর তুমি নাহি ছিলে দেশে।।
যতেক করিল দুষ্ট শুন সবিশেষে।
কপটে খেলিয়া পাশা নিল রাজ্যধন।।
কপট পাশাতে কৈল দ্রৌপদীকে পণ।
শকুনির বশেতে আছিল পাশাসারি।
হারিলেন যুধিষ্ঠির রাজা নিজ নারী।।
দুঃশাসন দ্রৌপদীকে আনে সভামাঝ।
তাহাকে আদেশ কৈল দুর্য্যোধন রাজ।।
দ্রৌপদী হইল দাসী নাহিক বিচার।
শীঘ্রগতি আনহ বসন অলঙ্কার।।
সভামাঝে দ্রৌপদীর বস্ত্র কাড়ি লয়।
কুলবধূ জনে কি এমন উচিত হয়।।
তবে অন্ধ বর দিয়া কৈল পরিত্রাণ।
পুনঃ পাশা খেলিবারে করিল বিধান।।
যে হারিবে দ্বাদশ বৎসর যাবে বন।
অজ্ঞাত বৎসর এক কৈল নিরূপণ।।
আজ্ঞাকারী পাশা যেই ছিল শকুনির।
সেই পণে হারিলেন রাজা যুধিষ্ঠির।।
দ্বাদশ বৎসর বনে ভ্রমিয়া পাণ্ডব।
যত দুঃখ পায় বনে কি বলিব সব।।
বঞ্চিলেন অজ্ঞাত বৎসর মৎস্যদেশে।
অজ্ঞাতে উদ্ধার হৈল উপায় বিশেষে।।
যুধিষ্ঠির চাহিলেন স্বীয় রাজ্যভার।
কদাচিত রাজ্য নাহি দিল দুরাচার।।
দূত হয়ে যাইলাম যথা দুর্য্যোধন।
আমারে রাখিতে চাহে করিয়া বন্ধন।।
কটুবাক্য আমারে কহিল দুর্য্যোধন।
বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব কদাচন।।
তবে সে হইল নাথ যুদ্ধ সমাবেশ।
যুদ্ধে রাজগণ সব হইল নিঃশেষ।।
মম অপরাধ এতে কি হৈল গোঁসাই।
দুর্য্যোধন তুল্য দুষ্ট পৃথিবীতে নাই।।
উহাকে করহ শান্ত রেবতীরমণ।
তব প্রিয় শিষ্য বটে রাজা দুর্য্যোধন।।
যুধিষ্ঠির এক্ষণে চাহেন পঞ্চগ্রাম।
সামঞ্জস্য করিয়া আপনি দেহ রাম।।
তব আজ্ঞা যুধিষ্ঠির না করে লঙ্ঘন।
উহাকে করিয়া দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।।
সকল গিয়াছে একা আছে দুর্য্যোধন।
তবু পঞ্চগ্রাম মাগে ধর্ম্মের নন্দন।।
শুনিয়া কৃষ্ণের বাণী রোহিণী নন্দন।
দুর্য্যোধন প্রতি কিছু বলিল বচন।।
শুন ভাই দুর্য্যোধন মম হিত কথা।
যুদ্ধ না করিবা তুমি শুনহ সর্ব্বথা।।
সর্ব্ব সৃষ্টিনাশ হৈল আর নাহি কেহ।
যুদ্ধে কিছু কার্য্য নাহি চিত্তে ক্ষমা দেহ।।
হৃদ্যতা করাই তোমা পাণ্ডব সহিতে।
অর্দ্ধ রাজ্য দেহ তুমি পাণ্ডব সম্প্রীতে।।
এতেক কহিল যদি দেব হলধর।
কতক্ষণে দুর্য্যোধন করিল উত্তর।।
মোরে আর হিতবাণী না বল গোঁসাই।
পান্ডবের সহ আর মম প্রীতি নাই।।
যত দুঃখ দিলাম পাণ্ডব পুত্রগণে।
ভগ্ন স্নেহে প্রীতি আর হইবে কেমনে।।
সর্ব্বদুঃখ পাণ্ডব পারিবে পাসরিতে।
অভিমন্যু শোক না ভুলিবে কদাচিতে।।
সপ্তরথী একত্র হইয়া আসি রণে।
মারিনু অন্যায় যুদ্ধে শুভদ্রা নন্দনে।।
এবে মম রাজ্যভার নাহি কিছু মনে।
সৌহৃদ্য করিতে কেন বল অকারণে।।
পূর্ব্বে পণ করিয়াছি সভার ভিতরে।
বিনা যুদ্ধে রাজ্য নাহি দিব পান্ডবেরে।।
সূচী অগ্রে যতখানি উঠিবেক ভূমি।
বিনা ‍যুদ্ধে ততখানি নাহি দিব আমি।।
সমরে আমারে ভীম করিবে সংহার।
যুধিষ্ঠির পাইবেন সব রাজ্যভার।।
সবার ঈশ্বর হয়ে ভূঞ্জিলাম ক্ষিতি।
যুদ্ধে মরি স্বর্গে গিয়া করিব বসতি।।
রাজত্ব আমাকে আর নাহি শোভা পায়।
যুদ্ধে মম প্রাণ পণ করেছি নিশ্চয়।।
এত যদি দুর্য্যোধন কহিলা ভারতী।
তাহারে কহিলা তবে রেবতীর পতি।।
যাহা ইচ্ছা মনে হয় তাহা কর তুমি।
যুদ্ধ কর দোঁহে দ্বারাবতী যাই আমি।।
গোবিন্দ বলিলা দেব শুনিলা আপনি।
পান্ডবের অপরাধ শুনিলে এখনি।।
এইক্ষণে দ্বারকা গমন যুক্তি নয়।
দোঁহাকার গদাযুদ্ধ দেখ মহাশয়।।
বলরাম কহিলেন শুন দামোদর।
দেখিতে হইল তবে গদার সমর।।
যুধিষ্ঠির চাহি বলিলেন বলরাম।
এ ভূমিতে না করাও দোঁহার সংগ্রাম।।
সমন্তপঞ্চক নাম কুরুক্ষেত্র জানি।
শুনিয়াছি মুনিগণ বদনে কাহিনী।।
সেই স্থানে হয় যার সমরে বিনাশ।
চিরকাল হয় তার স্বর্গেতে নিবাস।।
হ্রদতীর নহে শুন সংগ্রামের স্থান।
এই মত ধর্ম্মেরে কহিলা ভগবান।।
সাধুবাদ করিলা সকলে হলধরে।
তখনি গেলেন কুরুক্ষেত্র তীর্থবরে।।
সমর আরম্ভ হৈল ভীম দুর্য্যোধনে।
বসিল সকল লোক যথাযোগ্য স্থানে।।
মহাভারতের কথা সমান পীযূষ।
যাহার শ্রবণে নর হয় নীষ্কলুষ।।