০৩. বশিষ্ঠ তীর্থের বিবরণ কথন

বলেন বৈশম্পায়ন শুন নরপতি।
যেই যেই তীর্থে রাম করিলেন গতি।।
একমন হইয়া শুনহ নরবর।
ইহার শ্রবণেতে নিষ্পাপ হয় নর।।
গেলেন বশিষ্ঠ তীর্থে সরস্বতী তীরে।
স্নান করি দান করিলেন ধনাথীরে।।
ব্রাহ্মণ-ভোজন করাইয়া বলরাম।
অতিথি সেবিয়া পূর্ণ করিলেন কাম।।
রাজা বলে সেই তীর্থ হৈল কি কারণ।
বশিষ্ঠ তীর্থের কথা কহ তপোধন।।
মুনি বলে অবগতি কর মহারাজ।
যে হেতু বশিষ্ঠ তীর্থ শুন তার কার্য।।
বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠে বিবাদ অনুক্ষণ।
পূর্ব্বে কহিয়াছি আমি এ সব বচন।।
বড়ই তেজস্বী ক্রোধী মুনি বিশ্বামিত্র।
যুক্তিতে মারিল বশিষ্ঠের শত পুত্র।।
সৌদাস রাজারে ব্রক্ষ্মরাক্ষস করিয়া।
বশিষ্ঠের পুত্র মুনি দেখাইল নিয়া।।
শক্তিরে ধরিয়া রাজা করিল ভক্ষণ।
গর্ভ মধ্যে আছিলেন শক্তির নন্দন।।
পরাশর হইলেন বংশের রক্ষণ।
তাঁর পুত্র হইলেন ব্যাস তপোধন।।
এই বিসন্বাদে দোহে রাত্রি দিবা আছে।
বশিষ্ঠ করেন স্থিতি সরস্বতী কাছে।।
পূর্ব্বকূলে বশিষ্ঠের আশ্রম সুন্দর।
তথা রহি তপস্যা করেন মুনিবর।।
শিষ্ঠের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সতত করিতে।
বিশ্বামিত্র রহিলেন পশ্চিম কূলেতে।।
কিছুকাল উভয়ে থাকেন দুই পারে।
বশিষ্ঠের ইচ্ছা নাহি দ্বন্দ্ব করিবারে।।
কলহে আসক্ত বড় বিশ্বামিত্র মুনি।
নিরন্তর বশিষ্ঠের ছিদ্র অনুমানি।।
অগাধ সলিল বহে নাহি পারপার।
দুজনে দেখিতে পান আশ্রয় দোঁহার।।
বশিষ্ঠের মনে নাহি কলহ বিবাদ।
বিশ্বামিত্র চাহে বশিষ্ঠের অপরাধ।।
একদিন বিশ্বামিত্র আশ্রমে বসিয়া।
সরস্বতী নদীরে ডাকিল আশ্বাসিয়া।।
বিশ্বামিত্র ভয়ে ভীতা সদা সরস্বতী।
সাক্ষাৎ করিল গিয়া ধরিয়া আকৃতি।।
বিশ্বামিত্র কহে শুন নদী সরস্বতী।
এক কথা কহি আমি কর অবগতি।।
বশিষ্ঠে আমাতে দ্বন্দ্ব আছে পূর্ব্বাপর।
বিশেষ জানহ তুমি সব কথান্তর।।
বশিষ্ঠ আছেন যোগে বসিয়া আসনে।
অন্তর্ব্বাহ্য জ্ঞান তার নাহিক কথনে।।
জলে একাকার করি ভাসায়ে মুনিরে।
অবিলম্বে বশিষ্ঠেরে আনহ এ পারে।।
শুনি সরস্বতী ভয়ে করিল স্বীকার।
কি জানি শাপিতে পারে মুনি দুরাচার।।
আপনার স্থানে যান নদী সরস্বতী।
নিশা মধ্যে জলপূর্ণা হইলেন অতি।।
বশিষ্ঠের আশ্রম ভাঙ্গিয়া স্রোতজলে।
ভাসাইয়া বশিষ্ঠে আনিল পরকূল।।
বশিষ্ঠ আছেন ধ্যানে কিছু নাহি জ্ঞান।
উপনীত করিলেন বিশ্বামিত্র স্থান।।
দেখি বিশ্বামিত্র বড় ‍আনন্দ হৈয়া।
সরস্বতী প্রতি কহে আশ্বাস করিয়া।।
বশিষ্ঠেরে আপনি রাখহ এই খানে।
খড়গ আনি গিয়া আমি ইহার নিধনে।।
ভয়ে সরস্বতী বড় হইল ফাঁপর।
অঙ্গীকার করিল করিয়া যোড়কর।।
বিশ্বামিত্র খড়গ আনিবারে গেল যদি।
ভয়েতে ভাবিতে লাগিলেন পুন্যনদী।।
বড়ই দুর্ব্বার বিশ্বামিত্র মুনিরাজ।
বশিষ্ঠেরে আনিয়া নহিল ভাল কাজ।।
আপন আশ্রয়ে মুনি আছিল বসিয়া।
এ পারে আনিনু আমি জলে ভাসাইয়া।।
আমা হৈতে মুনিবর ত্যজিলেন প্রাণ।
ব্রক্ষ্মবধি হৈব আমি জানিনু বিধান।।
ব্রক্ষ্মবধ পাপ নাহি খন্ডে কদাচন।
এ অসৎ কর্ম্ম করিলাম কি কারণ।।
বিশ্বামিত্র শাপভয়ে হইয়া আকুল।
আপন কর্ম্মের দোষে হারানু দুকূল।।
বিশ্বামিত্র যেবা করে শাপিয়া আমার।
কৃপাবশে কোন দেব করিবে উদ্ধার।।
ব্রক্ষ্মহত্যা পাপভয়ে কম্পিত অন্তর।
মুনিরে বাঁচাই আমি যা করে ঈশ্বর।।
এত ভাবি বশিষ্ঠেরে পুনঃ ভাসাইয়া।
নিজাশ্রমে পুনর্ব্বার স্থাপিল লইয়া।।
মুনিরে রাখিয়া সরস্বতী লুকাইলা।
খড়গ লয়ে বিশ্বামিত্র সে স্থানে আইলা।।
দেখিল বশিষ্ঠ গেল আপন আশ্রমে।
সরস্বতী নদী আর নাহি সেইখানে।।
ক্রোধমন হয়ে বলে বিশ্বামিত্র মুনি।
আমারে হেলন তুই করিলি পাপিনি।।
ইহার উচিত ফল দিব তোর তরে।
তোরে শাপ দিব কেহ খন্ডাইতে নারে।।
রজঃস্বলা হও তুমি দিলাম এ শাপ।
শোণিত হউক সদা তব সব অপ।।
প্রেত ভুত পিশাচ আনন্দ সবাকার।
অনায়াসে রক্তপান করে অনিবার।।
রক্ত-মাংসহারী সব পৃথিবী ভ্রমিয়া।
থাকিত শোণিত বিনা উপোষ করিয়া।।
বিশ্বামিত্র প্রসাদে আহলাদ সবাকার।
শোণিত করয়ে পান নাহিক নিবার।।
বিশ্বামিত্রে প্রশংসা করয়ে সর্ব্বজন।
ধন্য ধন্য বিশ্বামিত্র মহা তপোধন।।
যাহার প্রসাদে মোরা করি রক্তপান।
সকল মুনির মধ্যে তুমি ভাগ্যবান।।
রাক্ষস আদির বড় হইল আনন্দ।
রাজঋষি দেবঋষি সদা নিরানন্দ।।
সরস্বতী স্নান নাহি করে মুনিগণ।
হাহাকার করিয়া কহেন সর্ব্বজন।।
ধর্ম্মপথ বিনাশিল বিশ্বামিত্র মুনি।
সংসারে হইল হেন কুযশ কাহিনী।।
নারাদাদি মুনি গিয়া ব্রহ্মারে কহিল।
সরস্বতী নদী বিশ্বামিত্র বিনাশিল।।
রজঃস্বলা হও বলি অভিশাপ দিল।
আদ্যোপান্ত পর্য্যন্ত শোণিত জল হৈল।।
স্নান তর্পণাদি নাহি হৈল সবাকার।
শোণিত হইল জল রাক্ষস-আহার।।
ইহার উপায় প্রভু করহ আপনি।
নারদের বাক্যেতে কহিল পদ্মযোনি।।
মহেশের সেবা সব কর মুনিগণ।
উপায় না দেখি কিছু বিনা ত্রিলোচন।।
ত্রিলোচন তুষ্ট হৈলে সকল মঙ্গল।
রক্তজল দূর হয়েহবে পূর্ব্বজল।।
এতেক ‍শুনিয়া মুনি ব্রহ্মার বচন।
সরস্বতী তীরে গেল যথা মুনিগণ।।
ব্রহ্মার বচন সবে কহিল সাদরে।
আজ্ঞা করিলেন ব্রহ্মা শিব সেবিবারে।।
মহেশ সদয় হৈলে হইবেক জল।
আরাধনা কর সবে সেবক বৎসল।।
ইহা কহি দেবঋষি করেন গমন।
ব্রাক্ষ্মণরা করিলেন শিব আরাধন।।
নিরাহারে একমনে হরের চরণ।
করিয়া মৃন্ময় লিঙ্গ করয়ে পূজন।।
শর্করা তন্ডুল ‍ঘৃত মধুপুষ্প দিয়া।
শিবশিব বলি কেহ বেড়ায় নাচিয়া।।
হর মহেশ্বর শিব অনাথের গতি।
শূলপাণি শঙ্কর পিনাকী পশুপতি।।
নীলকন্ঠ উমাকান্ত ত্রিপুরনাশন।
পার্ব্বতীর প্রাণনাথ মদনমোহন।।
অনাদি নিধন জ্ঞানযোগের ঈশ্বর।
ধুস্তর কুসুম প্রিয় দেব জটাধর।।
প্রথম ঈশ্বর হর প্রেত ভূত সঙ্গ।
হরিহর একতনু গৌরী অর্দ্ব অঙ্গ।।
বৃষভ বাহন ত্রিনয়ন ভূতনাথ।
সত্ত্বরজস্তমোগুনে তুমি অবিদিত।।
ইত্যাদি অনেক স্তব করে মুনিগণ।
হইল প্রসন্ন তবে দেব পঞ্চানন।।
বলদবাহন হাতে ‍ত্রিশূল ডমরু।
বিল্বপত্র ত্রিপত্র শিরেতে শোভে চারু।।
রজত পর্ব্বত জিনি শুভ্র কলেবর।
জটা বিভূষণ শোভে চারু শশধর।।
শুভ্র পদ্ম জিনি আভা বেষ্টিত অমর।
ব্যাঘ্রচর্ম্ম পরিধান ভস্ম অঙ্গোপর।।
এইরূপে সাক্ষাৎ হৈলেন কৃত্তিবাস।
দেখি মুনিগণে বড় হইল কৃত্তিবাস।।
দেখি মুনিগণে বড় হইল উল্লাস।
মহেশ কহেন বর মাগ মুনিগণ।।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ যেবা লয় মন।
মুনিগণ বলে প্রভু যদি কর দয়া।।
ইষ্টবর মাগি দেহ ছাড়ি নিজ মায়া।
রক্তজল হইয়াছে সরস্বতী নদী।।
পূর্ব্বমত জল হোক আজ্ঞা কর যদি।
তথাস্তু বলিয়া হর কহিলেন কথা।।
তেমন হইল জল পূর্ব্বে ছিল যথা।
আদ্যোপান্ত হইল সলিল মনোহর।।
কহিলেন তীর্থের মহিমা মহেশ্বর।।
হইল বশিষ্ঠ তীর্থ ইহার আখ্যান।
এই পুন্যজলে যেই করে স্নানদান।।
ব্রক্ষ্মহত্যা সুরাপান করে যেই জন।
মিত্রদ্রোহ করে যেই স্থাপিত হরণ।।
গুরুদারা হরে যেই পাপিষ্ঠ দুর্ম্মতি।
কোনকালে নাহি তার পরলোকে গতি।।
ইত্যাদি পাতকী যদি এত করে স্নান।
সর্ব্বপাপ নষ্ট হয় ইথে নাহি আন।।
কোটি কোটি জন্মপাপ খন্ডয়ে প্রসঙ্গে।
ইহা কহি গেলেন স্বস্থানে হর রঙ্গে।।
শুনিয়া নিরক্ত হৈল সরস্বতী জল।
হাহাকার করি এল রাক্ষস সকল।।
মুনিগণে আসিয়া কৈল ক্রোধবাণী।
আমাদের ভক্ষ্য কেন করিয়া হানি।।
দুঃখ পাব মোরা সব আহার লাগিয়া।
তপোবনে তোমা সবে খাইব ধরিয়া।।
নতুবা আমার ভক্ষ্য করি দেহ মুনি।
অকার্য্য হইবে পাছে বলি হিতবাণী।।
রাক্ষস সকল শুন কহে মুণিগণ।
আজি হৈতে ভক্ষ্য তব হৈল নিরূপণ।।
যজ্ঞশেষ দ্রব্য যত উদ্বৃত হইবে।
সে সকল দ্রব্য সব তোমরা খাইবে।।
পর্য্যূষিত অন্ন, হাঁড়ি মধ্যে যাহা রাখে।
সেই সব ভক্ষ্য হৈল খাও গিয়া সুখে।।
এত বলি মুনিগণ হৈল অন্তর্দ্বান।
রাক্ষস সকল গেল নিজ নিজ স্থান।।
তথা উত্তরিয়া রাম করিলেক স্নান।
দ্বিজগণে ভুঞ্জাইয়া দিল বহু দান।।
নানারূপে দ্বিজেরে করেন পরিতোষ।
ভারতের পুন্যকথা সমান পীযূষ।।
কাশীরাম কহে নর হয় নিষ্কলুষ।