০৬. দুর্য্যোধনের দ্বৈপায়ন হ্রদে প্রবেশ

সঞ্জয় বলেন রাজা কর অবগতি।
আপন সমর শেষ দেখি মহামতি।।
করুকুলে সিংহ যেন ছিল মহারাজ।
দাবানল দহে যেন শুল্ক বনমাঝ।।
অগাধ শুষিল যেন মহোদধি জল।
পান্ডবে শুবিল তেন কৌরবের বল।।
অমাত্য বান্ধব যত সব হৈল হত।
সমর সমাজে অনুকূল ছিল যত।।
লোকলাজে অভিমানে না দেখি উপায়।
শূন্য হৈল বসুমতী জানিয়া নিশ্চয়।।
জয় পরাজয় কর্ম্ম বিধির ঘটন।
আপনার শাক্য নহে কর্ম্ম নিবন্ধন।।
এত ভাবি দুর্য্যোধন চলিল সত্বর।
হস্তে গদা ধায় যেন নত করিবর।।
সর্ব্ব শূন্য অবশেষে দেখিয়া বিমন।।
দ্বিতীয় বান্ধব নাহি সঙ্গে একজন।
চিন্তাযুক্ত দুর্য্যোধন করিল গমন।।
কেহ না দেখিল কোথা গেল দুর্য্যোধন।
দৈবাৎ সঞ্জয় রণে আসিয়া মিলিল।।
দেখি ধৃষ্টদ্যুন্ন সাত্যকিরে আদেশিল।
দেখহ কৌরবপক্ষে আইল সঞ্জয়।
রাখিয়া কি কার্য্য এরে শীঘ্র কর ক্ষয়।।
তাহা শুনি সাত্যকি লইল খড়গ করে।
বিনাশিতে সঞ্জয়ে ধাইল ক্রোধভরে।।
অকস্মাৎ আসি সত্যবতীর নন্দন।
সাত্যকির প্রতি করিলেন নিবারণ।।
তথা হতে আসিতেছে ফিরিয়া নগরে।
দেখিলেন পথে অতি দীন কুরুবরে।।
গদা হাতে দুর্য্যোধন অতি দানবেশ।
নেত্র নীর ঝরে মুখে নাহি বাক্যলেশ।।
দেখিয়া সঞ্জয়ে জিজ্ঞাসিল কুরুরায়।
কে আছে জীবিত কহ আমার সহায়।।
সঞ্জয় কহিল আছে এইমাত্র সার।
কৃপাচার্য্য কৃতবর্ম্মা দ্রোণের কুমার।।
এতেক শুনিয়া রাজা ছাড়িল নিশ্বাস।
অচেতন হৈল পুনঃ মুখে নাহি ভাষ।।
গদগদ ভাষে রাজা কহে সকরুণে।
এমন করিবে বিধি নাহি ছিল মনে।।
জন্মিলে মরণ আছ না হয় অন্যথা।
অপমান যত কিছু সেই কাটা মাথা।।
সঞ্জয় সকলি জান কি কাহব আর।
বিধি বিড়ম্বিল মোরে মজিল সংসার।।
সর্ব্বনাশ করিলেন দারুণ বিধাতা।
জনকের স্থানে সব কহিবা বারতা।।
কিছু না রহিল সেনা আমার সমাজ।
ত্বরিত গমনে যাহ যথা অন্ধরাজ।।
আমার দৈবের কথা কহিবা বিশেষ।
নিষ্ফল হইল যত হইল আবেশ।।
বৃদ্ধকালে শোকে অন্ধ হইলেন তাত।
এখন আমার ভাগ্যে যে থাকে পশ্চাৎ।।
কালপ্রাপ্ত হৈলে লোক না শুনে বচন।
কালেতে সংহার করে দৈবের কারণ।।
সুখ দুঃখ কর্ম্মভোগ বিধাতার বশ।
অনিত্য সংসার এই ধর্ম্ম কীর্ত্তি যশ।।
আমার বাসনা তাত ছাড়হ এখন।
পাত্র মিত্র জ্ঞাতি আর ইষ্ট বন্ধুগণ।।
সকল মরিল আমি জীবিত কেবল।
বংশনাশ হৈল মম জীবন বিফল।।
বিফল জীবনে আর নাহিক বাসনা।
দৈবের নির্ব্বন্ধ এই না করি ভাবনা।।
যাহ তুমি সঞ্জয় কহিও সমাচার।
ইহ পরলোকে দেখা নাহি হবে আর।।
এত বলি হ্রদজলে করিল গমন।
প্রবেশ করিল দুঃখে রাজা দুর্য্যোধন।।
তথা হৈতে আসিছে সঞ্জয় বিষ্যাদিত।
হইল সাক্ষাৎ এই তিনের সহিত।।
কৃপাচার্য্য কৃতবর্ম্ম অশ্বন্থামা আর।
জিজ্ঞাসিল সঞ্জয়ে কি কহ সমাচার।।
মহারাজ দুর্য্যোধন আছেন কোথায়।
কি করিব মন দহে না দেখি উপায়।।
শুষ্ক বন দহে যেন জ্বলন্ত আগুনে।
কহত সঞ্জয় কোথা পাব দুর্য্যোধন।।
শুনিয়া সঞ্জয় কহে বচন বিশেষ।
দুর্য্যোধন রাজা হ্রদে করিল প্রবেশ।।
এত শুনি তিন বার করিল প্রয়াণ।
উপনীত হৈল আসি হ্রদ সন্নিধ্যন।।
উদ্দেশে চলিল তারা শুনিয়া বারতা।
ধর্ম্মরাজ না জানেন দুর্য্যোধন কোথা।।
নানামতে ভাই সব করে অনুমান।
কোথা গেল দুর্য্যোধন না জানি সন্ধান।।
দুত পাঠাইয়া দিল কৌরবের পুর।
আসি জিজ্ঞাসিল যথা আছয়ে বিদুর।।
ক্ষত্তা বলে নাহি জানি রণ হৈল শেষ।
কোথা গেল কুরুরাজ না জানি বিশেষ।।
দূত বলে রণ শেষ হইবেক যবে।
গদা হাতে পূর্ব্বমুখে রাজা গেল তবে।।
ইহার অধিক আমি না জানি বারতা।
বিস্মিত বিদুর শুনি এই সব কথা।।
সমর জিনিয়া যবে চলিল শিবির।
দুর্য্যোধন হেতু চিন্তান্বিত যুধিষ্ঠির।।
আপন শিবিরে যান ধর্ম্ম মহামতি।
ধৃতরাষ্ট্র প্রতি কহে সঞ্জয় সুমতি।।
দনিয়া সঞ্জয় বাক্য অন্ধ নরপতি।
শোকেতে ব্যাকুল হয়ে ছন্ন হৈল মতি।।
মহা পুত্র কোথা গেল রাজা দুর্য্যোধন।
কেন প্রাণ আছে মম না জানি কারণ।।
জন্মে জন্মে যত পাপ করিয়াছি আমি।
কারণে হইলাম শোক সিন্ধুগামী।।
দুর্য্যোধন বলি ডাকে কোথা দুঃশাসন।
কভু কর্ণ বলি ডাকে কভু ডাকে দ্রোণ।।
পুত্র পৌন্ত্র বন্ধু আর অমাত্য সকল।
বাড়িল সকল বীর রণে মহাবল।।
কতেক ডাকিব আর কত পড়ে মনে।
সমুদ্রের ঢেউ যেন বহে সমীরণে।।
একাদশ অক্ষৌহিনী পতি দুর্য্যোধন।
তাহার এ গতি হৈল দৈবের কারণ।।
ধৃতরাষ্ট্র শোকাকুল পড়িয়া ধরনী।
এমত করিবে বিধি মনে নাহি গণি।।
বৃদ্ধ অন্ধ পিতা মাতা না করিল মনে।
নিষ্ঠুর হইয়া গেল রাজা দুর্য্যোধনে।।
পুত্রহীন বৃদ্ধকালে জীবনে মরণ।
সহায় সম্পত্তি নাহি কি করি এখন।।
অনাথ করিয়া গেল যত অবলারে।
অমাত্য বান্ধব পুত্র গেল সুরপুরে।।
পক্ষহীন পক্ষী যেন রহিল পড়িয়া।
জলহীন মীন যেন মরয়ে ঘুরিয়া।।
পুন্যহীন দেহ যেন ফলহীন বৃক্ষ।
বিষহীন সর্প যেন ধনহীন লোক।।
হস্ত হৈতে রত্ন যেন গেল ছড়াইয়া।
প্রাণহীন দেহ যেন রহিল পড়িয়া।।
রাজ্যভোগ তৃণ যেন ছাড়ি গেলা তুমি।
কি গতি হইবে সদা এই চিন্তি আমি।।
কেন না লইলে মোরে সঙ্গেতে করিয়া।
বৃদ্ধ পিতা মাতা কেন গেলে বিসর্জ্জিয়া।।
বধূগণ অনাথিনা হারাইয়া কুল।
কেমনে ধরিবে প্রাণ হইয়া আকুল।।
সুরাসুরজয়ী যেই গঙ্গার নন্দন।
শিখন্ডীর হাতে হৈল তাহার নিধন।।
ভগদত্ত বীর আদি যত যোদ্ধাগণ।
কর্ণ মহাবীর যেই সংগ্রামে নিপুণ।।
তাহারে মারিল পার্থ সংগ্রামে দুর্জ্জয়।
শত পুত্র মারে মোর পবন তনয়।।
যার যত পরাক্রম করিল সকল।
ভাগ্যহীন হেতু তাহা হইল বিফল।।
কতেক কহিব দুঃখ কহনে না যায়।
ভাবিতে চিন্তিতে মম হৃদয় শুকায়।।
ভীমের বচন আর সহিতে না পারি।
শোকেতে জর্জ্জর হৈল গান্ধারী-কুমারী।।
শুনহ সঞ্জয় মম এই দৃঢ় আশ।
অনলে পড়িব নহে যাব বনবাস।।
সঞ্জয় বলেন রাজা শুনহ বচন।
জয় পরাজয় দেখ বিধির ঘটন।।