০২. শল্যের সহিত পাণ্ডবদের যুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র বলে কহ সঞ্জয় বিশেষ।
উভয় দলেতে সৈন্য কিবা আছে শেষ।।
শল্য দুর্য্যেধন তবে কি কর্ম্ম করিল।
আপন বুদ্ধিতে পুত্র সব বিনাশিল।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি যে নালিশ রণে।
হেন জন সঙ্গে যুদ্ধ করে কি কারণে।।
সঞ্জয় বলেন রাজা ইথে দেহ মন।
আত্মশেষ সৈন্য লয়ে যুঝে দুর্য্যোধন।।
একাদশ সহস্র অযুত আছে রথ।
তিন কোটি মত্ত হস্তী সমান পর্ব্বত।।
দুই পদ্ম অশ্ব আছে রণে অনিবার।
পবন গমন জিনি গমন যাহার।।
তিনকোটি পদাতিক আছে মম সম।
সৈন্যের সহিত যুঝে করিয়া বিক্রম।।
পাণ্ডবের শেষ সেনা আছে মহামতি।
আছয়ে গণণে রাজা সহস্রেক হাতী।।
অশ্ব আছে‌ এক লক্ষ, লক্ষ পদাতিক।
ন্যূন নহে ইহা হৈতে বরঞ্চ অধিক।।
যুধিষ্ঠির যোদ্ধাপতি পাণ্ডব বাহিনী।
দুই দলে মহাযুদ্ধ শুন নৃপমণি।।
যুধিষ্ঠির পরাক্রমে সৈন্য ভঙ্গিয়ান।
দেখিয়া শল্য ভূপতি হৈল আগুয়ান।।
দিব্যরথে সাজিয়া আইল সেইক্ষণে।
শল্য বলে সেনাগণ যুঝ একমনে।।
নকুলের যুদ্ধ কর্ণপুত্র চিত্রসেনে।
কাটিল নকুল ধনু চিত্রসেন বাণে।।
সারথি কাটিয়া রথ করিল বিরথী।
বাণে বিদ্ধ হয়ে চিন্তে নকুল সুমতি।।
তবে খড়গ চর্ম্ম হস্তে তার রথে চড়ি।
চিত্রসেন কবচ ধরি মুন্ড কাটি পাড়।।
নকুলের পরাক্রমে ধন্য ধন্য ধ্বনি।
সত্যষেণ সুষেণ আইল বীরমণি।।
নকুল সহিত যুদ্ধ করে বীরগণ।
দুই বীরে মহাযুদ্ধ সংগ্রাম শোভন।।
সত্যসেন শক্তি মারে সহিল নকুল।
নিজ শক্তি মারি তারে করিল আকুল।।
সত্যসেন পড়িল সুষেণ যুঝে বেগে।
নকুলের অশ্বরথ কাটি পাড়ে আগে।।
বিরথী হইয়া তবে মাদ্রীর নন্দন।
শীঘ্রগতি আর রথে কৈল আরোহণ।।
সন্ধানেতে কাটিলেন সুষেণের শির।
সিংহনাদ করি উঠে নকুল প্রবীর।।
শুন মহারাজ তব বাহিনী সকল।
দলিয়া চলিল সবে পাণ্ডবের দল।।
দেখি শল্য আগু হৈল ধরিয়া ধনুক।
পরাক্রম দেখি কেহ না রহে সম্মুখ।।
যুধিষ্ঠির রাঙ্গ সহ হইল মিলন।
দোঁহে দোঁহা প্রতি করে বাণ বরিষণ।।
যুঝিল নকুল ভীম রাজার পশ্চাতে।
যোদ্ধাগণ আগে যুঝে রথীর সনেতে।।
কৃপাচার্য্য কৃতবর্ন্মা আদি মহাবীর।
শল্যের নিকটে যুঝে হইয়া অস্থির।।
গদাহাতে ভীমসেন হন আগুসার।
মহাকোপে যায় যেন অগ্নি অবতার।।
নিবারিতে নারে শল্য ভীম গদাঘাতে।
রথেতে সারথি ভীম মারে এক ঘাতে।।
লাফ দিয়া শল্যবীর চড়ে আর রথে।
অটল পর্ব্বত প্রায় আছে গদা হাতে।।
শল্য বলে ভীম তোর বড়ই সাহ্স।
অকস্মাৎ গদা হানি চাহ নিজ যশ।।
সহিতে আমার অস্ত্র দেখি পরাক্রম।
এত দিনে আজি তোরে লইলেক যম।।
এত বলি শক্তি ছাড়ি দিল শল্যরাজে।
পড়িল নির্ভয়ে আসি ভীম বক্ষ মাঝে।।
বুক হৈতে ভীম শক্তি নিলেক কাড়িয়া।
শল্য প্রতি মারে বেগে হুহুঙ্কার দিয়া।।
আঘাতে মুর্চ্ছিত হয় মদ্র অধিপতি।
অন্তর হইয়া রথ রাখিল সারথি।।
কোপে শল্যরাজ গদা নিল তার পর।
মাতুল আইস বলি ডাকে বৃকোদর।।
আত্মপক্ষ ত্যাগ করি পরপক্ষে গিয়া।
এই অপরাধে মৃত্যু হইল আসিয়া।।
গদায় জানি যে তুমি বিক্রমে বিশাল।
তোমার সহিত যুদ্ধ বাঞ্ছি চিরকাল।।
এত বলি দুই বীরে হৈল বোলচাল।
গদায় গদায় যুদ্ধ বিক্রমে বিশাল।।
গদাযুদ্ধ বিশারদ দোঁহে মহাবীর।
বদন ত্রুকুটি নাদে বাহিনী অস্থির।।
গদাঘাতে কম্পমান দোঁহাকার অঙ্গ।
ইন্দ্র বজ্রাঘাতে যেন ভাঙ্গে গিরিশৃঙ্গ।।
প্রথমে বিহবল দোঁহে সম দেখি বল।
স্বর্গেতে প্রশংসা করে অমর সকল।।
গদা এড়ি ধনু নিল মদ্রপতি রাজা।
মহাযুদ্ধ করে বীর ভীম মহাতেজা।।
তবে বৃকোদর বীর রথে চড়ে গিয়া।
দেখি কৃপাচার্য্য বীর আইল ধাইয়া।।
হইল তুমুল যুদ্ধ নাহি পরিমাণ।
দুর্য্যোধন শল্য এল আর চেকিতান।।
মহাঘোর যুদ্ধ হৈল না যায় বর্ণন।
অশ্ব গজ রক্তে ভাসি বুলে সর্ব্বজন।।
শল্য সহ যুঝে পুনঃ প্রধান পাণ্ডব।
মহাযুদ্ধ হৈল যেন উথলে অর্ণব।।
চন্দ্রসেন মাদ্রসেন হৈল আগুয়ান।
যুধিষ্ঠির সহ বুঝে হয়ে সাবধান।।
যুদ্ধ করি গেল তারা শমন সদন।
ধনু ধরি শল্য আসি পুনঃ করে রণ।।
ভীমসেন সাত্যকি সহিত পাণ্ডুনাথ।
শল্যোপরি করিলেন ঘন বাণাঘাত।।
নিজ অস্ত্রে কাটি পাড়ে শল্য মহাবীর।
পুনঃ আসি উপস্থিত যথা যুধিষ্ঠির।।
উভয়েতে মহাযুদ্ধ হয় অপ্রমিত।
বৃষ্টিধারা যেন পড়ে দেখি চতুর্ভিত।।
কাটেন শল্যের ধ্বজ ধর্ম্ম নরপতি।
ধর্ম্মের ধনুক শল্য কাটে শীঘ্রগতি।।
আর ধনু লইয়া যুঝেন যুধিষ্ঠির।
নিবারিযা করে যুদ্ধ শল্য মহাবীর।।
ক্রোধে ধায় চতুর্ভিতে বাহিনী বিনাশে।
দেখি যুধিষ্ঠির রাজা ভাবেন বিশেষে।।
আপন ভাগিনা বধ কৈল মদ্রপতি।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ যাহে না হইল কৃতী।।
ভীম সংহারিল দুর্য্যোধন সহোদর।
মদ্রপতি বিনাশিতে হইল দুষ্কর।।
শীকৃষ্ণের আজ্ঞা আছে শল্যের নিধনে।
প্রলয় দেখি যে শল্য আজিকার রণে।।
হারিলে কি গতি হতে পাব মহালাজ।
এইমত ভাবিয়া কহেন ধর্ম্মরাজ।।
চক্রব্যূহ করি মোরে দোঁহে বল রাখ।
সহদেব নকুল আমার বামে থাক।।
দক্ষিণেতে ধৃষ্টদ্যুন্ন আর যে সাত্যকি।
ভীমসেন ধনঞ্জয় প্রধান ধানুকী।।
বিনাশিব শল্য আজি মাতৃল প্রবল।
শুনি চারিদিকে রহে হয়ে অনুবল।।
হইল প্রলয় যুদ্ধ ধর্ম্মরাজ ভাগে।
শল্যের সহায়ে দ্রৌণি যাইলেন আগে।।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল সর্ব্বজনে।
দক্ষিণে নিবারে ভীম কৌরব প্রধানে।।
কৃপাচার্য্যে নিবারেণ বীর ধনঞ্জয়।
এইরূপে মহাযুদ্ধ হইল প্রলয়।।
যুধিষ্ঠির শল্য যুদ্ধ সমান সন্ধান।
সর্ব্বাঙ্গে রুধির ধারা পড়ে দোঁহার সমান।।
যুধিষ্ঠিরে কম্পমান দেখি শল্যরাজে।
চারিদিকে সাবধানে রণে সবে যুঝে।।
গোবিন্দ সহায় পাছে বলেন ডাকিয়া।
নাশহ মাতুলে উপরোধ কি লাগিয়া।।
কৃষ্ণের বচনে যুধিষ্ঠির সাবধান।
অকর্ণ পূরিয়া বাণ করেন সন্ধান।।
ধর্ম্মরাজ ধর্ম্মমতি যুদ্ধে ধর্ম্ম সম্মূখে।
অনুক্রমে মহাশর ছাড়ে মহীপতি।
সেইমত কাটে শল্য ধর্ম্ম ক্রুদ্ধমতি।।
কাঠেন শল্যের অস্ত্র মারি সাতবাণ।
রথধ্বজ সহছত্র হয় খান খান।।
রথ লন্ডভন্ড দেখি ক্রোধে মদ্রপতি।
সুসজ্জা করিয়া রথ আনে শীঘ্রগতি।।
শল্য বলে ভাগিনেয় যুদ্ধে মহাবীর।
যুদ্ধেতে এমত কেন দেখি যুধিষ্ঠির।।
আত্মমত বলে দেখি বুদ্ধি যত যার।
এতক্ষণে যুঝ তুমি অগ্রেতে আমার।।
ধর্ম্মরাজ বলে যুদ্ধ করি উপরোধ।
সব জানি মাতুল অতুল মহাযোধ।।
বিধিমত যুঝি আজি তোমার সংহতি।
তোমারে জিনিলে জয় হইবে সম্প্রতি।।
ক্ষভ্রকুলে ধর্ম্মযুদ্ধ বিজয় ঘোষণা।
যম সম শত্রু আর না কির গণনা।।
মম ভাগ্য হেতু তুমি হৈল রিপুগত।
ক্ষভ্রধর্ম্ম রাখিবারে সব হৈল হত।।
এক্ষণে মাতুল তব হইবে বিনাশ।
শমন ভবনে যাহ হইয়া নিরাশ।।
অপরাধ না লইবে অস্ত্রের ঘাতনে।
আশীর্ব্বাদ কর মামা যাবৎ জীবনে।।
শল্য বলে ধর্ম্মচারে তুমি সে প্রধান।
তোমার বিজয় সত্য নাহিক এড়ান।।
পূর্ব্বে তব দরশনে ইচ্ছা মম ছিল।
পথে পেয়ে দুর্য্যেধন আমারে বরিল।।
সে সব বৃত্তান্ত দূত কৈল তব আগে।
অতএব হইলাম দুর্য্যোধন দিগে।।
ক্ষত্রধর্ম্ম রাখিলে উভয়ে নাহি দোষ।
সম্বন্ধের উপরোধে দূর কর রোষ।।
কহিতে কহিতে দোঁহে করে বাণ বৃষ্টি।
প্রলয়ের মেঘ যেন মজাইতে সৃষ্টি।।
অসংখ্য বরিষে বাণ যেন জলধারা।
খসিয়া পড়য়ে যেন আকাশের তারা।।
ধর্ম্মরাজ ডাকিয়া বলেন যোদ্ধাগণ।
শল্যেরে মারহ বাণ পুরিয়া সন্ধান।।
দুই বীরে মহাযুদ্ধ হয় বহুতর।
দোঁহে দোঁহে বিন্ধিয়া করিল জয় জয়।।
মহাবাণ বজ্র এড়িলেন ধর্ম্মসুত।
ধনু কাটি শল্যের কাটেন অশ্ব রথ।।
আর ধনু লয়ে শল্য হৈল আগুসার।
হইল প্রলয় যুদ্ধ বাণে অন্ধকার।।
ধনু কাটাকাটি পুনঃ হৈল পরস্পর।
পুনঃ ধনু নিল দোঁহে করিতে সমর।।
সন্ধানে সন্ধানে দোঁহে পরম সন্ধানী।
দোঁহে দোঁহা বিনাশিব এই মনে জানি।।
অসিমুখ বাণ শল্য এড়িলেক কোপে।
বুকে বাজি ধর্ম্ম রহিলেন মৃতরূপে।।
ক্ষণে মুর্চ্ছা ভঙ্গ হয়ে উঠে ধর্ম্মকারী।
বাণগুটি ফেলেন কাটিয়া করে ধরি।।
ভীমসেন ধনঞ্জয় সাত্যকি প্রভৃতি।
বিনাশে কৌরব সেনা করিয়া দুর্গতি।।
যুধিষ্ঠিরে অবসন্ন দেখি ভীম বীর।
শল্যের সম্মুখে যুঝে হইয়া সুস্থির।।
ভীমের কবচ কাটি পাড়ে শল্য বাণে।
শল্য অশ্ব কাটে ভীম করিয়া সন্ধানে।।
তাহা দেখি শল্য বীর মহাক্রোধ মনে।
পঞ্চ বাণ ভীমসেন পুরিল সন্ধানে।।
শল্য বাণে ভীমসেনে করিল জর্জ্জর।
নিবারিতে নাহি পারে পবন কোঙর।।
তাহা দেখি পুনঃ যুধিষ্ঠির মহারাজ।
সন্ধান পূরিয়া আসে সমরের মাঝ।।
বাণেতে পীড়িত শল্য দেখি যদুপতি।
ধর্ম্মরাজে ডাকিয়া বলেন শীঘ্রগতি।।
বিনাশ করহ শল্যে কেন কর ব্যাজ।
যুদ্ধকালে উপরোধ নহে ধর্ম্মরাজ।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহর।
কাশীরাম কহে শুনিলে তরয়ে ভববারি।।