০৮৯. যযাতির আত্মকথা

একোননবতিতম অধ্যায়
যযাতির আত্মকথা

যযাতি কহিলেন, “আমি নহুষের পুৎত্র এবং পুরুর পিতা, আমার নাম যযাতি। আমি ইন্দ্র-সন্নিধানে আত্মপ্রশংসা করিয়াছিলাম বলিয়া ক্ষীণপুণ্য ও দেবলোক হইতে ভ্রষ্ট হইয়া পৃথিবীতে পতিত হইতেছি। আমি অপেক্ষাকৃত অধিকবয়স্ক, এই নিমিত্ত তোমাদিগকে অভিবাদন করি নাই; কারণ, যিনি বিদ্যা, তপস্যা ও জন্ম দ্বারা প্রধান হয়েন তিনিই পূজনীয়।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! তুমি কহিতেছ যে, যিনি বয়োবৃদ্ধ, তিনিই সকলের প্রধান ও পূজ্য, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে; যিনি বিদ্যা ও তপস্যা দ্বারা সকলের প্রধান হয়েন, তিনিই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ও পূজনীয়।” যযাতি কহিলেন, “সৎকর্ম্মের প্রতিকূলতাই পাপ; পাপাসক্ত হইলেই নিরয়গামী হইতে হয়; সাধুপুরুষেরা কদাচ পাপকর্ম্মের অনুষ্ঠান বা আনুকূল্য করেন না। আমার বিস্তর অর্থ ছিল, এক্ষণে তাহা বিনষ্ট হইয়াছে, আমি এক্ষণে অনুসন্ধান করিলেও তাহা আর পাইব না, এইরূপ অবধারণ করিয়া যিনি আপনার হিতসাধনে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনিই যথার্থ সাধু। যিনি মহাধনসম্পন্ন হইয়া বহুবিধ যাগ-যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, যিনি সর্ব্ববিদ্যায় পারদর্শী, যিনি বেদাধ্যয়নসম্পন্ন ও তপঃপরায়ণ, তিনি পরিণামে সুরলোকে গমন করেন। বহুধনের অধিপতি হইয়াও প্রফুল্ল হওয়া বিধেয় নহে। নিরহঙ্কারচিত্ত হইয়া সর্ব্বদা বেদাধ্যয়ন করা কর্ত্তব্য, কারণ, এই জীবলোকে এবংবিধ বহুবিধ পদার্থ বিদ্যমান আছে, যাহা চেষ্টার বহির্ভূত, কেবল দৈবপরতন্ত্র; অতএব ধীর ব্যক্তি দৈবকে বলবান্ জানিয়া লব্ধ সেই বস্তু কদাচ নষ্ট করিবেন না। সুখ ও দুঃখ সকলই দৈবাধীন, স্বেচ্ছাক্রমে কেহ কখন সুখী বা দুঃখী হইতে পারে না, অতএব দৈবই বলবান্, এই বিবেচনা করিয়া কদাচ দুঃখে বিষণ্ণ বা সুখে উল্লাসিত হইবে না। ধীমান্ ব্যক্তি দুঃখে সন্তপ্ত বা হর্ষে উন্মত্ত হয়েন না। তাঁহারা সুখ-দুঃখ সমজ্ঞান করেন, যেহেতু, সুখ-দুঃখ দৈবায়ত্ত, উহাতে কখন প্রসন্ন বা বিষণ্ণ হইবে না। হে অষ্টক! বিধাতা যেরূপ বিধান করিয়াছেন, তাহা কদাচ অন্যথা হইবার নহে, এই ভাবিয়া আমি কখন ভয়ে মুগ্ধ হই না এবং আমার মনে কদাচ সন্তাপের সঞ্চার হয় না। কি স্বেদজ, কি অণ্ডজ, কি উদ্ভিদ, কি সরীসৃপ, কি কৃমি, কি মৎস্য, কি প্রস্তর, কি তৃণ, কি কাষ্ঠ, প্রারম্ভ-ক্ষয় হইলে সকলেই নষ্ট হয়। হে অষ্টক! সুখ দুঃখের অনিত্যতা বুঝিয়াছি, অতএব আর কি বলিয়া সন্তপ্ত হইব? কি করিব, কি করিলে সন্তাপ না হয়, এইরূপ নানাপ্রকার তর্ক-বিতর্ক করিয়া আমি অপ্রমত্তচিত্তে সন্তাপ বিসর্জ্জন করিয়াছি।”

অনন্তর অষ্টক সর্ব্বগুণসম্পন্ন মাতামহ যযাতির এইরূপ ধর্ম্মসঙ্গত কথা শ্রবণ করিয়া পুনর্ব্বার কহিলেন, “মহারাজ! আত্মবেদী” পুরুষের ন্যায় বহুবিধ ধর্ম্মসংক্রান্ত কথার উল্লেখ করিতেছেন, তাহা শ্রবণ করিয়া আমাদিগের কর্ণযুগল চরিতার্থ হইতেছে, অতএব আপনি যত কাল সেরূপে যে-সকল লোকে অবস্থিতি করিয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক সমুদায় বলুন।” যযাতি কহিলেন, “আমি নিজ বাহুবলে সমস্ত দিগ্বিজয় করিয়া এই সসাগরা পৃথিবীর সম্রাট্ হইয়াছিলাম। সহস্র বৎসর পরমসুখে সাম্রাজ্য ভোগ করিয়া পরলোকে গমন করি, পরে শত যোজনবিস্তীর্ণ সহস্র-দ্বারসংযুক্ত পরমরমণীয় অমরাবতী নগরীতে সহস্র বৎসর অতিবাহিত করি। অনন্তর পরম-দুর্লভ ব্রহ্মলোক লাভ করিয়া তথায় সহস্র বর্ষ বাস করি। তৎপরে দেবদেব মহাদেবের বাসভূমি কৈলাসভূমিতে বিহার করিয়া, দেবগণ ও ঈশ্বরগণ কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া কিয়ৎকাল যাপন করি। তদনন্তর নন্দনবনে কুসুমগন্ধমোদিত চারুরূপ পর্ব্বতসকল নরীক্ষণ ও সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী বিদ্যাধরীগণের সহিত পরমসুখে বিহার করিয়া অযুত শতাব্দী বাস করি। দেবলোক-সুলভ সুখে আসক্ত হইয়া তথায় এই সুদীর্ঘকাল বাস করিলে একদা এক ঘোররূপী দেবদূত আসিয়া প্লুতস্বরে তিনবার কহিল, ‘তুমি সুখভ্রষ্ট হও।’ সম্প্রতি আমি ক্ষীণপুণ্য হইয়া নন্দনবন হইতে ভ্রষ্ট হইতেছি এবং দেবগণ অন্তরীক্ষে আমার নিমিত্ত অতি করুণস্বরে রোদন করিতেছেন, ইহাও শুনিতেছি। হে নরেন্দ্র! আমি ইহা ব্যতীত আর কিছুই জানি না। আমি তাঁহাদের ‘হা পুণ্যকীর্ত্তে যযাতি! তুমি ক্ষণপুণ্য হইয়া স্বর্গ হইতে ভ্রষ্ট হইতেছ’, এইরূপ বিলাপ শুনিয়া কহিলাম, ‘হে দেবগণ! আমি যাহাতে সাধুসন্নিধানে পতিত হই এমত কোন উপায়-বিধান করুন।’ তাঁহারা আপনাদিগের যজ্ঞভূমিতে যাইতে কহিলেন। আমি হবির্গন্ধের অনুসরণক্রমে যজ্ঞভূমির অনুমান করিয়া সত্বর আসিতেছি।”