০৮৭. যযাতির মুখে ইন্দ্রের নীতি শ্রবণ

সপ্তাশীতিতম অধ্যায়
যযাতির মুখে ইন্দ্রের নীতি শ্রবণ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপ শ্রুত আছে, রাজা যযাতি স্বর্গারোহণপূর্ব্বক দেবতা, সিদ্ধ, সাধ্য, মরুৎ ও বসুগণ কর্ত্তৃক সমাদৃত ও সৎকৃত হইয়া সুদীর্ঘকাল তথায় বাস করেন। তিনি কদাচিৎ ব্রহ্মলোকে, কদাচিৎ দেবলোকে গমনাগমন করিতেন। মহারাজ যযাতি একদা ইন্দ্র-সন্নিধানে উপস্থিত হইলে দেবরাজ রাজার কথাবসানে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাজন্! পুরু তোমার জরা গ্রহণ করে; তুমি তাহাকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া কি উপদেশ দিয়াছিলে, সত্য করিয়া বল, আমার শুনিতে নিতান্ত বাসনা হইতেছে।” যযাতি কহিলেন, “হে দেবরাজ! আমি পুরুকে সমস্ত রাজ্যভার অর্পণ করিয়া কহিলাম, ‘বৎস! গঙ্গা ও যমুনা এই উভয় নদীর অন্তর্গত সমস্ত রাজ্য তোমারই অধিকারভুক্ত হইল; তুমি ধরিত্রীর একমাত্র অধীশ্বর হইলে; তোমার ভ্রাতৃগণ তোমারই অধীনে থাকিয়া অন্ত্যজ-জাতিমাত্র শাসন করিবে। অক্রোধন ক্রোধপরায়ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ক্ষমাবান্ অক্ষম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; অতএব বৎস! তোমাকে এই উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। মানুষ অমানুষ হইতে প্রধান; বিদ্বান্ মূর্খ হইতে প্রধান; যে ব্যক্তি আক্রোশ করিবে, তাহার উপর আক্রোশ না করিয়া ক্রোধ সংবরণ করাই কর্ত্তব্য, যেহেতু, আক্রোষ্টা [আক্রোশকারী- বিদ্বেষবশে মিথ্যা অভিযোক্তা] কোপানলে মনে মনে দগ্ধ হইতে থাকে, কিন্তু অনাক্রোষ্টা [আক্রোশহীন] তাহার পুণ্যভাগী হয়। লোকের মর্ম্মপীড়ক ও নৃশংসবাদী হওয়া নিতান্ত অবিধেয়। যে কথায় অন্যে উদ্বিগ্ন হয়, এমত কথা উচ্চারণ করা অনুচিত। অর্থহীন ব্যক্তির নিকট প্রচুর অর্থ লওয়া অন্যায্য। যে ব্যক্তি লোকের মর্ম্মপীড়ক পুরুষ [কর্কশ] ভাষী ও বাক্যরূপ কন্টক দ্বারা অন্যের হৃদয় বিদ্ধ করে, তাহাকে অলক্ষ্মীক বলে। তাহার মুখে অলক্ষ্মীর চিহ্ন-সকল সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। সচ্চরিত্র ব্যক্তি অগ্রপশ্চাৎ ভাবিয়া সাধুদিগের প্রশংসাযোগ্য কর্ম্ম করেন, সর্ব্বদা অসাধুজনের অতিবাদ [অমূলক দোষ] সহ্য করেন এবং সন্মার্গে চলিয়া থাকেন। অসতেরা আপন মুখ হইতে নির্গত বাক্যরূপ শায়ক দ্বারা অন্যকে আহত করে। আহত ব্যক্তি ঐ সুতীক্ষ্ণ শরাঘাতে জর্জ্জরিত হইয়া অহর্নিশ যন্ত্রণাভোগ করে, অতএব পণ্ডিতেরা তাহা কস্মিন্‌কালেও অন্যের প্রতি নিক্ষেপ করেন না। জীবের প্রতি দয়া,মৈত্রী, দান ও মধুরবাক্য প্রয়োগ, ইহা অপেক্ষা ধর্ম্ম আর লক্ষ্য হয় না। অতএব সর্ব্বদা সান্ত-বাক্য প্রয়োগ করা কর্ত্তব্য, কদাচ কঠোর বাক্য উচ্চারণ করিও না। পূজ্য ব্যক্তির পূজা ও দান করা কর্ত্তব্য, কিন্তু যাচ্‌ঞা অতিশয় নিষিদ্ধ।”