০৬. মৃত পতি পুত্রাদি দর্শনে গান্ধারী প্রভৃতি স্ত্রীগণের বিলাপ ও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গান্ধারীর অনুযোগ

জন্মেজয় কহিলেন শুন মহামুনি।
গান্ধারী কি কহিলেন কহ তাহা শুনি।।
কেমনে ধরিল প্রাণ শত পুত্রশোকে।
ক্রোধ করি কোন্ কথা কহিল কৃষ্ণকে।।
পূর্ণব্রক্ষ্ম অবতার দেব নারায়ণ।
জানিয়া শাপিল দেবী কিসের কারণ।।
এই ত আশ্চর্য্য অতি মম মনে লয়।
বিস্তারিয়া সেই কথা কহ মহাশয়।।
কহেন বৈশস্মায়ন শুনহ রাজন।
একচিত্ত হয়ে শুন ভারত কথন।।
কৃষ্ণের প্রবোধ বাক্য মনেতে বুঝিয়া।
উঠিয়া বসিল দেবী চেতন পাইয়া।।
কহে কিছু কৃষ্ণকে গান্ধারী প্রতিব্রতা।
বিচিত্র বীর্য্যের বধূ রাজার বনিতা।।
দেখ কৃষ্ণ একশত পুত্র মহাবল।
ভীমের গদার ঘাতে মরিল সকল।।
দেখ কৃষ্ণ বধূগণ উচ্চৈঃস্বরে কান্দে।
দেখিতে না পায় যারে কভূ সূর্য্যে চান্দে।।
শিরীষ কুসুম জিনি সুকোমল তনু।
দেখিয়া যাহার রূপ রথ রাখে ভানু।।
হেম বধূগণ দেখ আসে কুরুক্ষেত্রে।
ছিন্নকেশ মত্তবেশ দেখ তুমি নেত্রে।।
এই দেখ নৃত্য করে পতিহীনা বধূ।
মুখ অতি শুশোভন অকলঙ্ক বিধু।।
এই দেখ গান করে নারী পতিহীনা।
কন্ঠশব্দ শুনি যেন নারদের বীনা।।
পতিহীনা কত নারী বীরবেশ ধরি।
ওই দেখ নৃত্য করে হাতে অস্ত্র ধরি।।
হে কৃষ্ণ দেখহ মম পুত্রের দুর্গতি।
যাহার মস্তক ছিল সুবর্ণের ছাতি।।
নানা আভরণে যার তনু সুশোভন।
সে তনু ধূলায় ওই দেখনারায়ণ।।
সহজে কাতর বড় মায়ের পরাণ।
সুপুত্র কুপুত্র দুই মায়ের সমান।।
এতকালে এত শোক সহিতে না পারি।
বুঝাইবা আমারে কিরূপে হে মুরারী।।
পুত্রশোক শেল সব বাজিছে হৃদয়।
দেখাবার ছৈলে দেখাতাম মহাশয়।।
সংসারের মধ্যে শোক আছয়ে যতেক।
পুত্রশোক তুল্য শোক নাহি তার এক।।
গভীধারী হয়ে যেই করেছে পালন।
সেই সে বুঝিতে পারে পুত্রের মরণ।।
এ শোক সহিতে কেবা আছয়ে সংসারে।
বিবরিয়া বাসুদেব কহ দেখি মোরে।।
সহিতে না পারি আমি হৃদয়ের তাপ।
ভাবিতে উঠয়ে মনে মহা মনস্তাপ।।
মাহবলবন্ত মম শতেক নন্দন।
কি দিয়া আমারে বুঝাইবা নারায়ণ।।
মহারাজ দুর্য্যোধন লোটায় ভূতলে।
চরণ পূজিত যার নৃপতিমন্ডলে।।
ময়ুরের পাখে যার চামর ব্যঞ্জন।
কুক্কুর শৃগাল তারে করয়ে ভক্ষণ।।
দেখিতে না পারি আমি এ সব যন্ত্রণা।
শকুনি দিলেক যুক্তি খাইয়া আপনা।।
যাত্রাকালে পুত্র মোরে জিজ্ঞাসিল জয়।
যে কথা কহিনু তাহা শুন মহাশয়।।
যথা ধর্ম্ম তথা কৃষ্ণ জয় সেইখানে।
এই কথা আমি কহিলাম দুর্য্যোধনে।।
না শুনিল মম বাক্য করি অনাদর।
রাখিল ক্ষত্রিয় ধর্ম্ম করিয়া সমর।।
কাতর না হৈল রণে আমার নন্দন।
সমর করিয়া সবে ত্যজিল জীবন।।
হৃদয়ে রহিল কিন্তু বড় এক ব্যথা।
সংগ্রামে আইল দুর্য্যোধনের বনিতা।।
এই দুঃখ নারায়ণ না পারি সহিতে।
ওই দেখ বধূগণ আম্রশাখা হাতে।।
আর এক নিবেদন শুন অন্তর্য্যামী।
দুর্য্যোধন না মানিল হিত উপদেশ।।
তাহার উচিত ফল পাইল বিশেষ।
শকুনি আমার ভাই বড় দুরাচার।
তাহার বুদ্ধিতে হৈল বংশের সংহার।।
মরিলেক শত পুত্র বংশের সংহতি।
বৃদ্ধকালে রাজার হইবে কিবা গতি।।
পান্ডুর নন্দন রাজ্য লবে আপনার।
পুত্র নাহি কেবা আর যোগাবে আহার।।
জলাঞ্জলি দিতে কেহ নাহি পিতৃগণে।
এইহেতু ত্রুন্দন করি যে রাত্র দিনে।।
এত বলি গান্ধারী হইল অচেতন।
করুণা সাগর কৃষ্ণ করেন সান্ত্বন।।
কৌরব বনিতা কান্দে পতি পুত্রশোকে।
তা দেখিয়া পান্ডব আছয়ে অধোমুখে।।
মৃতপুত্র কোলে করি করয়ে বিলাপ।
যুধিষ্ঠির রাজার বাড়িল মনস্তাপ।।
এমন সময়ে আসি দ্রৌপদী সুন্দরী।
পুত্রশোকে কান্দে শিরে করাঘাত করি।।
বিরাটনন্দিনী কান্দে শোকে অচেতনা।
তাহা দেখি পাইলেন অর্জ্জুন বেদনা।।
উত্তরা ধরিয়া অভিমন্যুর চরণ।
লাভ ভয় ত্যাগ করি যুড়িল ক্রন্দন।।
উত্তরা বলিল মোরে বিধি প্রতিকূল।
হেনজন মরে যার গোবিন্দ মাতুল।।
ধনঞ্জয় পিতা যায় হেন জন মরে।
এ বড় দারুণ শোক রহিল অন্তরে।।
মোহেতে আকুল বড় রাজা যুধিষ্ঠির।
বিলাপিয়া ভূমেতে পড়িল ভীমবীর।।
শোকেতে অর্জ্জুন বীর করেন রোদন।
বিলপিয়া কান্দে দুই মাদ্রীর নন্দন।।
কুন্তী যাজ্ঞসেনী দোঁহে শোকে অচেতনা।
মহা শোক সিন্দু মাঝে পড়ে সর্ব্বজনা।।
ফুকারিয়া কুন্তীদেবী না পারে কান্দিতে।
হইল অন্তরে দগ্ধ কর্ণের শোকেতে।
বিলপিয়া উত্তরা যে যায় গড়াগড়ি।
প্রাণনাথ কোথা ওহে গেলে মোরে ছাড়ি।।
গোবিন্দ তোমার মামা পিতা ধনঞ্জয়।
আহা মরি কোথা গেলে অর্জ্জুন তনয়।।
অস্থির পান্ডবগণে দেখি নারায়ণ।
সান্ত্বনা করেন কহি মধুর বচন।।
কুরুক্ষেত্রে উঠিল ক্রন্দন কোলাহল।
অশ্রুতে প্লাবিত হৈল সংগ্রামের স্থল।।
না হয় শোকের অন্ত পুনঃ পুনঃ বাড়ে।
হা নাথ বলিয়া পতিহীনা ডাক ছাড়ে।।
পড়িয়া গান্ধারী আছে অচেতনা শোকে।
দুর্য্যোধন বিনা অন্য শব্দ নাহি মুখে।।
কি বলিব ওহে কৃষ্ণ মুকুন্দ মুরারী।
আজি হৈতে শূণ্য হৈল হস্তিনানগরী।।
না ধরিল আমার বচন দুর্য্যোধন।
তাহার কারণে শত পুত্রের নিধন।।
শান্তনু তনয় কত বুঝাইল নীত।
দ্রোণ কত বুঝাইল শাস্ত্রের বিহিত।।
বিদুর কহিল কত বিবিধ প্রকারে।
না শুনিল কদাচিত গুরু অহঙ্কারে।।
না শুনিল কার কথা যুদ্ধ কৈল পণ।
সকল জীবের গতি তুমি নারায়ন।।
শুনিয়াছি আমি সব সঞ্জয়ের মুখে।
আর কত অনুযোগ কহিব তোমাকে।।
কহিতে কহিতে ক্রোধ হৈল অতিশয়।
পুনরপি শোক ত্যাজি গোবিন্দেরে কয়।।
ওহে কৃষ্ণ জনার্দ্দন দৈবকীকুমার।
তোমা হৈতে হৈল মম বংশের সংহার।।
অনর্থের মূল তুমি দেব নারায়ণ।
কর্ম্ম দেখাইয়া কর দোষ প্রক্ষালন।।
তোমাতে সংহার হয় মিলয় তোমাতে।
জীবের কারণ আর নাহি তোমা হৈতে।।
সকল তোমার মায়া তুমি সে প্রধান।
গুণ দোষ ধর্ম্মধর্ম্ম তুমি ভগবান।।
থাকিয়া প্রাণীর ঘটে যে বলাও যারে।
প্রাণী করে সেই কর্ম্ম দোষ কেন তারে।।
অসাধুর মত কোথা ধর্ম্মের বাসনা।
সাধুব্যক্তি তব পদ করয়ে ভাবআ।।
সাধুযত প্রশংসা করয়ে চক্রপানি।
সংসারে যতেক দেখি তার মূল তুমি।।
অতএব, কহি নাথ কর অবধান।
করাইলে কৌরব পান্ডবেতে সংগ্রাম।।
ভেদ জন্মাইলে তুমি ওহে নরপতি।
না পারি কহিতে দেব তোমার প্রকৃতি।।
কৌরব পান্ডব তব উভয় সমান।
তাহে ভেদ যুক্তি নহে শুন ভগবান।।
ধর্ম্ম আত্না যুধিষ্ঠির কিছু নাহি জানে।
সংগ্রামে প্রবৃত্ত ধর্ম্ম তোমার সন্ধানে।।
হিংসার নাহিক লেশ ধর্ম্মের শরীরে।
ভেদ জন্মাইলে তুমি কহিয়া তাহারে।।
যদি বিসন্বাদ হৈল ভাই দুইজনে।
তোমার উচিত নহে উপস্থিতি রণে।।
তারে বন্ধু বলি সব করায় সমতা।
তুমি শিখাইয়া দিলে বিবাদের কথা।।
কহিতে তোমার কথা ‍দুঃখ উঠে মনে।
সমান সন্বন্ধ তব কুরু পান্ডুসনে।।
বরণ করিতে তোমা গেল দুর্য্যোধন।
পালঙ্কে আছিলা তুমি করিয়া শয়ন।।
জাগিয়া আছিলা তুমি দেখি দুর্য্যোধনে।
কপটে মুদিয়া আঁখি নিদ্রা গেলে কেনে।।
পশ্চাতে অর্জ্জুন আসে সে কথা শুনিয়া।
উঠিয়া বসিলে মায়া নিদ্রা উপেক্ষিয়া।।
নারায়নী সেনা দিলা আমার নন্দনে।
ছলিতে অর্জ্জুন বাক্য শুনিলা প্রথমে।।
সারথি হইলে তুমি অর্জ্জুনের রথে।
সমান সম্বন্ধ আর রহিল কিমতে।।
তবে সে হইত ব্যক্ত সমান সম্বন্ধ।
তোমাতে উচিত নহে শুন কৃষ্ণচন্দ্র।।
তারপর এক কথা শুনহ অচ্যুত।
করিলে দারুণ কর্ম্ম শুনিতে অদ্ভুত।।
মধ্যস্থ হইয়া যবে গিয়াছিলে তুমি।
চাহিলে সে পঞ্চ গ্রাম শ্রুত আছি আমি।।
না দিলেক মম পুত্র কি ভাবিয়া মনে।
আসিয়া কহিলে তুমি পান্ডব নন্দনে।।
সদাচারী পান্ডুপুত্র রাজ্য নাহি মনে।
তাহে তুমি ভেদ করি কহিলা বচনে।।
আপনি দিলেন ভেদ কৌরব পান্ডবে।
নহে তুমি প্রবৃত্ত হইলে কেন তবে।।
সে কালে আপন ঘরে যেতে যদি তুমি।
সম স্নেহ বলি তবে জানিতাম আমি।।
যুদ্ধ যুক্তি দিলা তুমি পান্ডুর কুমারে।
প্রবঞ্চনা করি কৃষ্ণ ভান্ডিলা আমারে।।
সব জানিলাম তুমি অনর্থের মুল।
করিলা বিনাশ তুমি যত কুরুকুল।।
কহিতে তোমার মর্ম্ম বিদরয়ে প্রাণ।
তবে কেন বল তুমি উভয় সমান।।
আমি সব শুনিয়াছি সঞ্জয়ের মুখে।
না কহিলে স্বাস্থ্য নাহি জানাই তোমাকে।।
কি কহিতে পারি আমি তোমার সম্মূখ।
উচিত কহিতে পাছে মনে ভাব দুঃখ।।
সুখ দুঃখ কহিবেক সবাকার স্থান।
আর কিছু কহি তাহা শুন ভগবান।।
অনাদি পুরুষ তুমি দেব ভগবান।
বিশ্বেশ্বর হও তুমি পুরুষ প্রধান।।
সবাকার মূল তুমি দেব জগন্নাথ।
সহজে অবলা আমি কি কব সাক্ষাৎ।।
কর্ণের আছিলা শক্তি অর্জ্জুন নিধনে।
তাহা দিয়া বিনাশিলে ভীমের নন্দনে।।
যুধিষ্ঠির সহ যুক্তি করি যদুপতি।
যুদ্ধেতে প্রবৃত্ত করাইলা তুমি রাতি।।
ভীমসুত ঘটোৎকচ মায়াযুদ্ধ কৈল।
ক্রোধে কর্ণ সেই অস্ত্র ভৈমীরে মারিল।।
ওহে কৃষ্ণ এ সকল তোমার মন্ত্রণা।
কর্ম্ম সব মূল বলি প্রবোধিলা আমা।।
তোমার যতেক কর্ম্ম না পারি কহিতে।
কুরু পন্ডু সম মিল বলহ সভাতে।।
চক্রুব্যুহ দ্রোণাচার্য্য করিল রচন।
চক্রব্যূহ যুদ্ধ মাত্র জানয়ে অর্জ্জুন।।
আর কেহ নাহি জানে পান্ডব সভাতে।
অভিমন্যু শুনেছিল থাকিয়া গর্ভেতে।।
অভিমন্যু বধ কথা শুনিয়া অর্জ্জুন।
জয়দ্রথে নাশ হেতু করিল সে পণ।।
সঞ্জয়ের মুখে আমি শুনিয়াছি সব।
উপকার যত তুমি করেছ মাধব।।
মহাভারতের কথা অমৃত অর্ণবে।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।