০২. অশ্বথামার মুন্ডচ্ছেদনার্থ ভীমের যাত্রা

শিবির দেখিয়া রাজা দুঃখ অসম্ভব।
অশ্রু বহে নেত্রে কান্দে যতেক পান্ডব।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি হত দেখি যুধিষ্ঠির।
বিলাপ করেন কত নেত্রে বহে নীর।।
সকল মরিল রাজ্যে কিবা প্রয়োজন।
বৃথা করিলাম এত অসাধ্য সাধন।।
ভীম বলে রাজা শোক কর অনুচিত।
আপনার কর্ম্মভোগ কে করে খন্ডিত।।
আপনি থাকিলে সর্ব্ব পাবে মহাশয়।
অকারণে কর শোক ইতরের প্রায়।।
কর্ম্মবশে জন্ম মৃত্যু হয় পুনঃ পুনঃ।
কোথা ছিলে কোথা যাবে তাহা নাহি গণ।।
কর্ম্মবশে আসি মিলে কেহ নহে কার।
জন্মিলেই মৃত্যু আছে নহে খন্ডিবার।।
যে মরিল সে চলিল যথা কর্ম্মভোগ।
কেবল শরীর ছাড়ে দৈবের সংযোগ।।
কালপূর্ণ হৈলে পরে কে রাখিতে পারে।
কত শত মহারাজ পুনঃ পুনঃ মরে।।
অষ্টাদশ দিন যুদ্ধ করিয়া সকলে।
সকলে জিনিয়া মৃত্যু হৈল নিশাকালে।।
কালপূর্ণ হৈলে নরে বিধির নির্ব্বন্ধ।
কালেতে সংহার করে শাস্ত্রীয় প্রবন্ধ।।
ইথে শোক অনুচিত ভাবিয়া কি কার্য্য।
শাস্ত্রবিজ্ঞ হয়ে হও শোকেতে অধৈর্য্য ।।
অতঃপর দ্রৌপদী কহেন শোকাবেশে।
অশ্বথামা মুন্ড আনি দেহ মম পাশে।।
দ্রৌণির মস্তকে বদ্ধ আছে এক মণি।
মুন্ড কাটি সেই মনি যদি দেহ আনি।।
তবে শোক নিবারণ হয়তো আমার।
নহে ভাতৃ পুত্রশোকে না বাঁচিব আর।।
শুন ভীম মহাবীর তোমা সম নাই।
বিক্রমে বিশাল তোমা করিল গোঁসাই।।
সুগন্ধি কুসুমোদ্যানে জিনি যক্ষরাজ।
হিড়িম্বে মারিলে তুমি অরণ্যের মাঝে।।
ব্রাক্ষ্মণ রক্ষনে বকে করিলে বিনাশ।
কির্ম্মীরে বধিয়া কৈলে কাননে নিবাস।।
জয়দ্রথ ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার।
কীচকে বধিয়া মান রাখিলে আমার।।
এখন এ শোকসিন্ধু মধ্যে ডুবে মরি।
রক্ষা কর আমারে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করি।।
দুঃশাসন রক্তপান কৈলে রণমাঝে।
উরুভাঙ্গি ভুমেতে পাড়িলে কুরুরাজে।।
প্রতিজ্ঞা পূরণে গদাঘাত কৈলে শিরে।
সমুদ্র তরিয়া মরি গোক্ষুরের নীরে।।
আমার বচন ধর বধ অশ্বথামা।
সকল নিষ্ফল হৈল তোমার মহিমা।।
এখন উচিত হয় এই সব কথা।
শ্রীঘ্র মোরে আনি দেহ দ্রোহপুত্র-মাথা।।
ব্রাক্ষ্মণ হইয়া রাক্ষসের কর্ম্ম করে।
নিদ্রাগত পেয়ে দুষ্ট সকলে সংহারে।।
তাহার বিনাশে নাহি ব্রক্ষ্মবধ ভয়।
অধর্ম্ম করিল সেই দুষ্ট দুরাশয়।।
কান্দিতে কান্দিতে এত দ্রৌপদী কহিল।
অনুমতি হেতু ভীম ধর্ম্মে জানাইল।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন এই সে উচিত।
কর্ম্ম অনুসারে শাস্তি শাস্ত্রের বিহিত।।
এত শুনি ভীমবীর রথ আরোহিয়া।
নকুলে সারথি করি চলিল ধাইয়া।।
ভীমের এতেক সজ্জা আরম্ভ দেখিয়া।
গোবিন্দ বলেন ধর্ম্মরাজ সম্বোধিয়া।।
অশ্বথামা বিনাশে পাঠাও বৃকোদরে।
বিচার না করি রাজা যুক্তি দিলে তাঁরে।।
অসাধ্য সাধন তেই সিদ্ধি অসম্ভব।
সংসার বিজয়ী সে, কে করে পরাভব।।
পরাক্রম তাহার কি না আছ বিদিত।
না বুঝিয়া হেন কর্ম্ম কর বিপরীত।।
ত্রিলোকেতে সেই একা মহাধনুর্দ্ধর।
পরাক্রম করি জিনে সব চরাচর।।
কি করিবে ভীম তার করি মহারণ।
ভীম হৈতে না হইবে তাহার দমন।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কহি, যবে ছিলা বনে।
অম্বথামা নিরবধি ভ্রমিত কাননে।।
দৈবে একদিন গেল দ্বারকা ভুবনে।
দেখিয়া বান্ধবগণ হরষিত মনে।।
বিক্রম করিয়া বলে আমার সাক্ষাতে।
ব্রক্ষ্মশির অস্ত্র আমি জানি ভালমতে।।
তাহা লৈয়া চক্র মোরে দেহ চক্রপাণি।
ত্রৈলোক্য জিনিতে পারি হেন অস্ত্র জানি।।
অব্যর্থ আমার অন্ত্র জানে ত্রিভুবন।
ইহা লৈয়া চক্র মোরে দেহ নারায়ণ।।
উপরোধ হেতু আর দেরী না করিয়া।
দ্রৌণিকে দিলাম চক্র তখনি আনিয়া।।
তুলিতে নহিল শক্ত রাখি চক্রধর।
কহিল না লব চক্র রাখ চক্রধর।।
ইহার অধিক নম আছে ব্রক্ষ্মশির।
বজ্রদন্ডে জিনি আমি শুন যদুবীর।।
পৃথিবী সংহার দেব কর এই বাণে।
কাহারে না দিয়া অস্ত্র দিল মম স্থানে।।
করিলাম জিজ্ঞাসা সে দ্রোণের নন্দনে।
তবে চক্রচাহ কেন আমার সদনে।।
অশ্বথামা বলে তোমা জিনিবার মনে।
অস্ত্র হৈতে শ্রেষ্ঠ চক্র জানিনু এক্ষনে।।
কার্য্য নাহি তোমা সহ বিবাদে আমার।
এত বলি তথা হৈতে কৈল আগুসার।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই শুন মহাশয়।
বুঝিয়া করিবা কার্য্য যেবা মনে লয়।।
দ্রোণপুত্র দুরাত্মা সে ক্রোধন চঞ্চল।
ব্রক্ষ্মশির অস্ত্র তার সদা করতল।।
আমার বচনে তুমি ‍রাখ ভীম বীরে।
শুনিয়া চিন্তিত বড় রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
সকল মজিল রাজ্য কি কার্য্য বিশেষ।
নিশ্চয় মরিব আমি শুন হৃষীকেশ।।
অগ্রে ভীম চলি গেল না শুনি বারণ।
এখন উচিত যাহা কর নারায়ণ।।
তোমা বিনা গতি আর নাহি ত্রিভুবনে।
বল বুদ্ধি পরাক্রম নাহি তোমা বিনে।।
যে হয় উপায়ে এবে করহ উচিত।
তোমার বিনা পান্ডবের অন্য নাহি স্থিত।।
গোবিন্দ বলেন চল ভীমের পশ্চাৎ।
বিলম্ব না কর আর শুন নরনাথ।।
অর্জ্জুন সহিত হরি করিলা গমন।
তাহার পশ্চাতে যান ধর্ম্মের নন্দন।।
রথ রথী পদাতিক চলিল অপার।
নানা বাদ্য কোলাহল হৈল আগুসার।।
অশ্বথামা সর্ব্বসৈন্য করিয়া বিনাশ।
ভয়ে পলাইয়া রহে যথা মুনি ব্যাস।।
তথা উপনীত হৈল ভীম মহাবাহু।
অশ্বথামা দেখি যেন চন্দ্রে গিলি রাহু।।
বাদ্য শব্দে অশ্বথামা কম্পিত হইল।
ভীমের গর্জ্জন শুনি বিস্ময় মানিল।।
ভীমে দেখি অশ্বথামা করিল সাহস।
মরণ চিন্তিল মনে রাখিবারে যশ।।
অম্বথামা অস্ত্র ধনু নাহি ধরে করে।
মুষ্টি করি লইল ঈষিকা সব্যকারে।।
মন্ত্র পড়ি ছাড়িলেক দিয়া হুহুঙ্কার।
নিষ্পান্ডবা ক্ষিতি করে প্রতিজ্ঞা তাহার।।
ক্রোধ করি অস্ত্র ছাড়ি করিল গর্জ্জন।
বাণের মুখেতে অগ্নি হয় বরিষণ।।
হেনকালে তথা পার্থ গোবিন্দ আসিয়া।
প্রলয় অনল উঠে সম্মূখে দেখিয়া।।
পার্থেরে কহেন কৃষ্ণ কি দেখহ আর।
ক্ষণেক থাকিলে সর্ব্ব করিবে সংহার।।
সন্বরণ অস্ত্র জান দ্রোণ-উপদেশে।
সত্বরে সন্ধান পূর অস্ত্রের বিনাশে।।
ক্ষণেক থাকিলে হবে অসাধ্য হে সখা।
প্রলয় অনল উঠে নাহি যাবে রাখা।।
অর্জ্জুন শুনিয়া আইলেন ক্রোধভরে।
করতলে ধরি অস্ত্র সাহসী অন্তরে।।
আগু হৈয়া রথ হৈত নামি ধনঞ্জয়।
দান্ডাইয়া রহিলেন কারে নাহি ভয়।।
যোড়হস্তে গুরুপদে করি নমষ্কার।
ধনুক টঙ্কার দেন লোকে চমৎকার।।
এড়িলেন একবাণ উঠিল আকাশে।
গর্জ্জন করিয়া যায় দ্রোণপুত্র নাশে।।
তন্ত্রে মন্ত্রে বাণ এড়িলেক ধনঞ্জয়।
হইল প্রলয় যুদ্ধ দোঁহেতে দুর্জ্জয়।।
তিনলোক শব্দে কাঁপে, কাঁপে চরাচর।
যেন কালদন্ড বাণ জ্বলে বৈশ্বানর।।
উল্কাপাত নির্ঘাত সে বাণ হৈতে খসে।
হইল প্রলয় বড় পৃথিবী বিনাশে।।
ঝাঁকে ‍ঝাঁকে অগ্নিবৃষ্টি হয় ঘনে ঘন।
প্রলয় দেখিয়া স্থান ছাড়ে দেবগণ।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল কাঁপিল সর্ব্বলোক।
মহাশব্দে বন যেন পোড়ায় পাবক।।
দুই অস্ত্র সম দেখি কেহ নহে উন।
মহাবীর দুইজন কেহ নহে ন্যুন।।
গিরি বৃক্ষ পোড়ে তাহে প্রাণী কিসে গণি।
অকালে প্রলয় হয় মানে সর্ব্ব প্রাণী।।
মহাশব্দে পুড়ি যায় সব অগ্নিময়।
সমুদ্র মন্থনে যেন বিষের উদয়।।
দ্বাদশ সূর্য্যের দীপ্তি প্রলয়ের কালে।
সেইমত দোঁহে শত শত অস্ত্র ফেলে।।
জল স্থল পুড়ি যায় যেমত ঝঞ্ঝনা।
মহা অস্ত্র দোঁহে নাহি সন্বরে আপনা।।
সর্ব্ব সৃষ্টিনাশ যায় দেখি লাগে ত্রাস।
হেনকালে আইলা নারদ আর ব্যাস।।
দুই বাণ মধ্যে রহিলেন দুই মুনি।
জগতের নিতান্ত বিনাশ অনুমানি।।
দোঁহারে বলেন ডাকি দুই তপোধন।
সৃষ্টিনাশ কর কেন কর সন্বরণ।।
উভয়ে বিবাদে কেন দৃষ্টি কর নাশ।
কিবা মনে করিয়াছ কহ এক ভাষ।।
শুনিয়া দোঁহার বাক্য অর্জ্জুন তখন।
করিলেক আপনার অস্ত্র সম্বরণ।।
দ্রৌণি ডাকে কহে শক্য নহে নিবারণ।
ক্রোধে অস্ত্র ছাড়িলাম কি করি এখন।।
উপরোধ রাখি যদি তোমা দোঁহাকার।
পান্ডবে মারিয়া অস্ত্র আসুক আমার।।
তবে যদি ক্ষমা করি দোঁহা উপরোধে।
উত্তরার গর্ভপাত করিব বিবাদে।।
যেই পুত্র আছে উত্তরার গর্ভবাসে।
চলিল আমার অস্ত্র তাহার বিনাশে।।
অর্জ্জুন বলেন কাটি দ্রোণপুত্র শির।
নহিলে না হবে ক্ষমা শুন যদুবীর।।
ব্যাস বলিলেন শুন বীর অশ্বথামা।
শিরোমণি দিয়া পার্থে চাহ তুমি ক্ষমা।।
তব বাণে মরে যদি শিশু গর্ভবাসে।
তারে জীয়াইব আমি চক্ষুর নিমিষে।।
মণি দিলে শির ক্ষত হইবে তোমার।
বৎসর সহস্র তৈলে নহে প্রতীকার।।
শিরের পীড়ায় তুমি করিবা ভ্রমণ।
যেমন তোমার কর্ম্ম হইল তেমন।।
এত ‍শুনি অশ্বথামা করিয়া ছেদেন।
শিরোমণি ধনঞ্জয়ে করে সমর্পণ।।
হেথা দ্রৌণি বাণ বেগে জটীল আকাশে।
বায়ু বেগে উত্তরার গর্ভেতে প্রবেশে।।
গর্ভে প্রবেশিয়া গর্ভ করিল নিধন।
প্রবেশ করেন গর্ভে কৃষ্ণ সেইক্ষণ।।
গর্ভ বিনাশিয়া বাণ বেগে উটীল আকাশে।
বায়ুবেগে উত্তরায় গর্ভেতে প্রবেশে।।
গর্ভে প্রবেশিয়া গর্ভ করিল নিধন।
প্রবেশ করেন গর্ভে কৃষ্ণ সেইক্ষণ।।
গর্ভ বিনাশিয়া ‍বান হইল বাহির।
পুনঃ গর্ভ জীবিত করেন যদুবীর।।
এই মতে শান্ত হৈল অস্ত্র বরিষণ।
জলেতে নিবৃত্ত যেন হয় হুতাশন।।
মাহভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশী কহে শুনিলে হইবে ভবপার।।