০১. পঞ্চপুত্রের মৃত্যু শ্রবণে যুধিষ্ঠিরাদির খেদ

জন্মে বলিলেন কহ তপোধন।
ধৃষ্টদ্যুন্নে বধি গের দ্রোণের নন্দন।।
শুনিয়া কি করিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
বিস্তারিয়া সেই কথা কহ তপোধন।।
মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের তনয়।
সর্ব্ব সৈন্য বধি গেল রজনী সময়।।
শোকাবেশে রজনী হইল সুপ্রভাত।
ডাকে কাক কোকিল উদয় দীননাথ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সারথি আছিল নিশাকালে।
জীবন রাখিয়াছিল মড়ার মিশালে।।
প্রলয় মানিয়া মনে পাইল তরাস।
দেখিল নিভৃতে রহি সকল বিনাশ।।
রবির প্রকাশে নিশা প্রসন্ন দেখিয়া।
যুধিষ্ঠিরে বার্ত্তা দিতে চলিল ধাইয়।।
আছে বা না আছে ধর্ম্ম মনের ভাবনা।
উরুতে চাপড় মারে রোদন বিমনা।।
কান্দিতে কান্দিতে গেল যথা ধর্ম্মরাজ।
উপনীত হইয়া কহিছে সভামাঝ।।
অবধান কর রাজা ধর্ম্মের নন্দন।
নিশাকালে বধি গেল সব সেনাগণ।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি করি যত বীর ছিল।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সহিত মারিল।।
নিশাতে আসিয়া দুষ্ট দ্রোণের নন্দন।
অকস্মাৎ শিবিরেতে করিল গমন।।
নিদ্রায় কাতর ছিল যত সেনাগণ।
একে একে মারিলেক নাহি একজন।।
মৃত সঙ্গে ছিনু আমি করিয়া প্রকার।
বার্ত্তা দিতে আসিয়াছি অগ্রেতে তোমার।।
শুনিয়া করেন খেদ ধর্ম্মের নন্দন।
সকলি করিল নষ্ট দ্রৌণি দুষ্টজন।।
কিরূপে এমন যুদ্ধ হৈল কহ শুনি।
সূতপুত্র বলে অবধান নৃপমনি।।
ইহার বৃত্তান্ত রাজা কি বলিব আর।
কালি নিশাকালে সৈন্য করিল সংহার।।
কোন দেবে সহায় করিয়া কি আইল।
কোন দেবতায় সাধি এ বর পাইল।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন শিখন্ডী প্রভৃতি বীরবর।
সংগ্রামের পরিশ্রমে শ্রান্ত কলেবর।।
শিবিরে নিশায় সবে আছিল শয়নে।
আসিয়া দ্রোণের পুত্র বধিল জীবনে।।
যার যত সেনা ছিল সুহৃদ বান্ধব।
একাকী বধিয়া গেল দেখি অসম্ভব।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সবার জীবন।
নিদ্রায় কাটিল শির দ্রোণের নন্দন।।
সংহতি বাহিনী যত ছিল সন্বোধিতে।
সকল মারিল শেষ জান নরপতে।।
রমনী আছিল যত যাহার সংহতি।
অঙ্গ ভঙ্গ করিয়া রাখিল মারি লাথি।।
অশ্বথামা দুর্ম্মতির দয়া নাহি প্রাণে।
কাতরে চরণে পড়ে তবু শিরে হানে।।
অস্ত্র শস্ত্র বিবর্জ্জিত ছিল যত সেনা।
কেহ বা শয়নে ছিল হয়ে অচেতনা।।
কেশে ধরি আনি তার শির ফেলে কাটি।
নিদ্রায় কাতর অতি করে ছটফটি।।
তোমাকে কহিতে বিধি রাখিল আমায়।
যে ছিল মরিল সবে শুন ধর্ম্মরায়।।
শুনি রাজা ভূমিতে পড়েন অচেতনে।
যেমন পড়য়ে বৃক্ষ মূলের ছেদনে।।
সন্বিত পাইয়া রাজা করেন বিলাপ।
কি করিতে কি হইল কত ছিল পাপ।।
এখন কি করি আর লইয়া ভুবন।
সর্ব্ব শূন্য দেখি এবে সব অকারণ।।
মুনিগণ সহ ভাল ছিলাম কাননে।
পাপভোগ হয় মম রাজ্যের কারণে।।
জ্ঞাতি বন্ধুগণ যত শ্বশুর মাতুল।
মায়া হেতু আসি সবে হয় অনুকূল।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন আদি হেন সহায় আমার।
কোথায় শিখন্ডী সখা না দেখিব আর।।
কুটুম্ব প্রধান মম হিতকারী জন।
বলিষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ছিল দুষ্টের দমন।।
পুত্র পৌত্র সঙ্গে করি পরম উল্লাস।
আসিয়া আমার কার্য্যে হইল বিনাশ।।
বুদ্ধিমন্ত মহারাজ অতুল পৌরুষে।
ক্ষিতিতে প্রধান ইন্দ্র গণি যে বিশেষে।।
সাধিয়া আপন কার্য্য স্বচ্ছন্দ শয়নে।
গুরুপুত্র আসি নাশে ধর্ম্ম নাহি মানে।।
নাম ধার কত রাজা করেন বিলাপ।
স্বকার্য্য সাধনে মম হৈল মনস্তাপ।।
অভিমন্যু মরে রণে মহাযুদ্ধ করি।
সেই মহাশোক আমি পাসরিতে নারি।।
দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র নিদ্রায় আছিল।
মুঢ়মতি অশ্বথামা সবারে মারিল।।
আমার হিতের হেতু ছিল যত জন।
গৃহেতে না গেল সবে হইল নিধন।।
জননী রমনী যারা আছয়ে আলয়।
কান্দিয়া কতেক নিন্দা করিবে আমায়।।
এ সব ‍ভাবিয়া মম স্থির নহে মন।
এমন হইল দশা দৈবের ঘটন।।
বীরশূন্য হইলাম নাহি কিছু সেনা।
বৃথা রাজ্যে কার্য্য নাহি সংসার বাসনা।।
বাঞ্ছা করি পুনঃ গিয়া বনবাস করি।
তপ আচরণ করি হৈয়া ব্রক্ষচারী।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ মদ্রপতি আদি।
এক এক বীর জিনে পৃথিবী অবধি।।
সবারে করিনু জয় কৃষ্ণ সহকারে।
কে জানে দুর্দ্দশা শেষে ঘটিবে আমারে।।
রাজার বিলাপ শুনি কান্দে সর্ব্বজন।
দ্রৌপদী কান্দিয়া বলে করুণ বচন।।
পিতৃ ভ্রাতৃ আদি করি যত বন্ধুগণ।
এককালে অকস্মাৎ হইল নিধন।।
শুনিয়া নিষ্ঠুর বাক্য হরিল চেতনা।
মস্তক উপরে যেন পড়িল ঝনঝনা।।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দে দেবী পড়ে অশ্রুজল।
ভাই ভাই বলি কান্দে হইয়া বিকল।।
জয় হেন মানি চিত্তে আনন্দ বিশাল।
তার বিপরীত আজি ঘটাইল কাল।।
যেমন আনন্দ হৈল তেন নিরানন্দ।
ভাবিয়া কি হবে এবে বিধি কৈল মন্দ।।
এমত করিবে বিধি জানিব কেমনে।
কৌরব সহিত দ্বন্দ্ব হইল যখনে।।
সকল করিয়া নাশ আপনি বিনাশ।
পাপ রাজ্যে কার্য্য নাহি যাব বনবাস।।
উজ্জ্বল হইয়া দীপ্তি হইল নির্ব্বাণ।
আমার বৈভব লাভ তাহার সমান।।
সেইরূপ সৈন্য ছিল যামিনী শোভনে।
সকল বিনাশ হৈল নাহি দেখি দিনে।।
এককালে নানা শোক উপজিল আসি।
শোকসিন্ধু মধ্যে আমি তৃণ হেন ভাসি।।
কষ্টভাগ্যে কষ্ট হয় নাহি হয় দূর।
স্বয়ন্বয়ে পাই দুঃখ দ্রুপদের পুর।।
লক্ষ রাজা স্বরন্বরে করিল গমন।
লক্ষ্য বিন্ধি প্রাপ্ত হইল ইন্দ্রের নন্দন।।
তাহাতে অনেক কষ্ট পাইনু অপার।
কৃষ্টের কৃপায় তাহা হইল নিস্তার।।
ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হইলেন ধর্ম্মরাজ।
ভুবনে বিখ্যাত হৈল রাজসূয় কাজ।।
ত্রিভুবনে নিমন্ত্রণ হইল সবারে।
কত শত রাজা আসি রহিল দুয়ারে।।
কুবের সম্পদ জিনি হইল বৈভব।
পৃথিবীতে একচ্ছত্র হইল পান্ডব।।
জনে জনে বিষয় দিলেন যুধিষ্ঠির।
সম্পদের সংখ্যা নাহি পূর্ণিত মন্দির।।
দেখি দুর্য্যেধন রাজা করিল মন্ত্রণা।
শকুনি পাপিষ্ঠে আনি দিলেক যন্ত্রণা।।
পাশা খেলি রাজ্যধন হরিয়া লইল।
সভামধ্যে আমার যে চুলেতে ধরিল।।
বস্ত্রহরণের কষ্ট দিল দুঃশাসন।
কতেক কহিব তাহা না যায় কথন।।
আকর্ষন করি কেশ টানে পুনঃ পুনঃ।
কেহ কিছু নাহি বলে সকলি বিগুণ।।
দুর্য্যোধন পাপমতি দেখাইল উরু।
এ কারণে ভাঙ্গে ভীম মারি গদা গুরু।।
কর্ণ দুষ্ট আমারে বলিল কুবচন।
মরণ অধিক হৈল না যায় কথন।।
যে কষ্ট হইল তাহা নারি কহিবারে।
অমঙ্গল দেখি অন্ধ চিন্তিল বিচারে।।
আমারে ডাকিয়া অন্ধ দিল বরদান।
ধন ‍রাজ্য দিয়া পুনঃ করিল সম্মান।।
বর পেয়ে নিজ রাজ্যে করিণু গমন।
পুনঃ পাশা খেলি দুষ্ট পাঠায় কানন।।
বনবাসে নানা কষ্ট হইল ভুগিতে।
কত দিনে দুর্য্যোধন বিচারিল চিতে।।
দুর্ব্বাসা মুনিরে পাঠাইল সেই বন।
শিষ্য ষাটি সহস্র লইয়া তপোধন।।
তবে কত দিনে জয়দ্রথে পাঠাইল।
আসিয়া আমার বাসে অতিথি হইল।।
শূন্যঘর দেখি দুষ্ট হরিল আমায়।
ধর্ম্ম রক্ষা করিলেন আমারে সে দায়।।
অনন্তরে গিয়া আমি বিরাট আলয়।
সৌরিন্ধ্রী হইয়া দুঃখ ভুগিলাম তায়।।
তবে কত দিনে দুষ্ট কীচক দুর্ম্মতি।
আমাকে দিলেক দুঃখ অতি পাপমতি।।
প্রকারে মারিল ভীম রজনী সময়।
তবে পাইলাম রক্ষা কৃষ্ণের কৃপায়।।
না জানি কি আছে আর বিধাতার মনে।
জটাসুর দিল দুঃখ কাম্যক কাননে।।
বলে লয়ে যায় দুষ্ট পৃষ্ঠেতে করিয়া।
তাহাকে মারিল ভীম গদা আস্ফালিয়া।।
তাহাতে পাইনু রক্ষা কৃষ্ণের কৃপায়।
কত দুঃখ কব আর কহা নাহি যায়।।
এই সব দুঃখ স্মরি জ্বলে বহ্নিজ্বালা।
কত আর নিভাইব হইয়া অবলা।।
এবে শত্রু বিনাশিয়া মনে হৈল আশ।
গত নিশি আমার ঘটিল সর্ব্বনাশ।।
এখন জীবন ধরে এই পাপ তনু।
আমার উচিত হয় পশিতে কৃশানু।।
পিতৃ ভ্রাতৃ পুত্রশোকে জ্বলে কলেবর।
যেমন গরল জ্বালা জ্বলিছে অন্তর।।
কান্দিয়া শত্রুর নারী মনে পায় ব্যথা।
তাহার অধিক মোর করিল বিধাতা।।
দ্রৌপদী ক্রুন্দন শুনি ভীম ধনঞ্জয়।
অবসন্ন বিষন্ন দেখেন শুন্যময়।।
বিহবল হইয়া পড়ে মাদ্রীর নন্দন।
দ্রৌপদী হইতে করে অধিক ক্রন্দন।।
কোপেতে আকুল হয়ে ধর্ম্মের নন্দন।
শিবির দেখিতে রাজা করেন গমন।।
কাক চিল উড়ে পড়ে শিবা কঙ্ক আদি।
খরস্রোতে বহিতেছে শোণিতের নদী।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।