০৫. ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, বিদুর ও সঞ্জয়ের অরণ্যযাত্রা

ধৃতরাষ্ট্র রাজা যান গহন কানন।
শুনিয়া ব্যাকুল চিত্ত ধর্ম্মের নন্দন।।
ভ্রাতৃগণ কৃষ্ণাসহ আসি দৌড়াদৌড়ি।
অন্ধরাজ গান্ধারী কুন্তীর পায়ে পড়ি।।
ধূলায় ধূসর হৈয়া করয়ে ক্রন্দন।
আনাথ হইল আজি পান্ডুপুত্রগণ।।
পিতৃশোক নাহি জানি তোমার কারণে
সর্ব্বশোক পাসরিনু তোমা দরশনে।।
তোমার বিহনে সব হৈল অন্ধকার।
কোন সুখে গৃহেতে রহিব মোরা আর।।
কি দেখি ধরিব প্রাণ উপায় কি হবে।
তোমার সহিত তাত বনে যাব সবে।।
এইরূপে যুধিষ্ঠির কান্দিয়া অপার।
প্রবোধ করেন সবে অশেষ প্রকার।।
বিদুর সঞ্জয় দোঁহে বিচারিয়া মনে।
ডাকিয়া নিভৃতে কহে মাদ্রীর নন্দনে।।
রাজার নন্দিনী কুন্তী রাজার গৃহিনী।
জনম দুঃখেতে গেল হেন অনুমানি।।
তোমরা উভয় তাঁর অতিপ্রিয়তর।
কুন্তীরে প্রবোধ দেহ দুই সহোদর।।
তোমা দোঁহাকার স্নেহ নারিবে ছাড়িতে।
যাইতে নারিবে কুন্তী হেন লয় চিতে।।
এত শুনি দুই ভাই চলিল তখন।
জননীর গলে ধরি কান্দে দুইজন।।
কোথায় যাইবে তুমি নিষ্ঠুর হইয়া।
কিমতে বঞ্চিত মোরা তোমা না দেখিয়া।।
যদি আমা দোঁহে ছাড়ি যাইবে কাননে।
এখনি ত্যজিব প্রাণ তোমা বিদ্যমানে।।
এত বলি কান্দে দোঁহে উচ্চরব করি।
ব্যাকুল হইয়া চিত্তে ভোজের কুমারী।।
কি করিবে ইহার উপায় নাহি দেখি।
কহিতে লাগিল কুন্তী দ্রৌপদীরে ডাকি।।
তুমি শ্রদ্ধা পতিব্রতা লক্ষ্মী অবতার।
এই বাক্য প্রতিপাল্য করিবা আমার।।
এই দুই পুত্র মোর প্রাণের সমান।
এদিগে পালিবা তুমি হৈয়া সাবধানে।।
আমারে পাসরে যেন তোমার পালনে।
অনুমতি কর মাতা আমি যাই বনে।।
এত বলি শিরোঘ্রাণ করিল চুম্বন।
প্রণমিয়া যাজ্ঞসেনী করয়ে রোদন।।
পঞ্চপুত্র কোলে করি ভোজের নন্দিনী।
শিরে চুম্ব দিয়া করে আশীর্ব্বাদ বাণী।।
বিবিধ প্রকারে প্রবোধিয়া পঞ্চজনে।
চলিলেন কুন্তীদেবী ধৃতরাষ্ট্র সনে।।
উচ্চেঃস্বরে কান্দে সবে প্রবোধ না মানে।
শোকের নাহিক অন্ত ভাই পঞ্চজনে।।
মা মা বলি যুধিষ্ঠির ডাকেন সঘনে।
নির্দ্দযা নিষ্ঠুর মাতা হৈলা কি কারণে।।
সহদেব নকুল এ ভাই দুইজনে।
তিলেক না জীব মাতা তোমার বিহনে।।
পূর্ব্বে যবে বনে পাঠাইল দুর্য্যোধন।
মম মঙ্গে বনে গেল ভাই চারিজন।।
ঝরিত নয়ন সদা তোমার বিহনে।
তোমার ভাবনা বিনা না করিত মনে।।
তদন্তরে তোমার পাইয়া দরশন।
তিলেক বিচ্ছেদ নহে ভাই দুইজন।।
কেমনে চলিলা মাতা নির্দ্দয়া হইয়া।
এই দুই শিশু প্রতি না দেখ চাহিয়া।।
আমা সম ভাগ্যহীন নাহি অবনীতে।
জনম অবধি মজিলাম দুঃখ চিতে।।
ছার রাজ্য ধন মম ছার গৃহবাস।
তোমা বিনা হৈল মম সকল নিরাশ।।
ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির যত বধূগণ।
দুঃশলা সুন্দরী আদি কান্দে সর্ব্বজন।।
হাহাকার করি সবে কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।
আমা সবা ছাড়ি কোথা যাও নৃপবরে।।
হাহা বিধি কি ‍উপায় করিব এখন।
এত ক্লেশে পাপ প্রাণ রহে কি কারণ।।
পাষাণে রচিত দেহ আমা সবাকার।
এতেক প্রহারে তনু না হয় বিদার।।
গড়াগড়ি যায় সবে ধূলায় ধূসর।
চিত্তের পুত্তলি প্রায় ভূমির উপর।।
দেখিয়া ব্যথিত হৈল বিদুর সুমতি।
ডাকদিয়া কহিলেন যুধিষ্ঠির প্রতি।।
শোক ত্যজ শুন রাজা আমার বচন।
আমা সবাকার শোক কর নিবারণ।।
ইহা সবাকার প্রতি করহ আশ্বাস।
প্রবোধিয়া সবাকারে লহ গৃহবাস।।
ধর্ম্মের নন্দন তুমি ধর্ম্ম অবতার।
তোমার এতেক মোহ অতি অবিচার।।
সবারে সান্ত্বনা করি স্থির কর মন।
তোমারে বুঝায় হেন আছে কোনজন।।
এইরূপে বিদুর কহিল বহুতর।
অনেক সান্ত্বনা করি পঞ্চ সহোদর।।
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন বিদুর সুমতি।
হেন অবধান কর বিদুরের প্রতি।।
এ সময় ব্রাক্ষ্মনেরে দিব কিছু দান।
কিছু ধন মাগি আন ধর্ম্মরাজস্থান।।
অন্ধের বচনে ক্ষত্তা কহে যুধিষ্ঠিরে।
কিছু ভিক্ষা চাহে তোমা অন্ধ নৃপবরে।।
ধর্ম্ম বলিলেন ভিক্ষা কিসের কারণ।
তাঁহারি সকল রাজ্য প্রজা ধন জন।।
আমি আদি সকল বিক্রিত তাঁর পায়।
হেন বাক্য কহিবারে তাঁরে না যুয়ায়।।
এত বলি যুধিষ্ঠির ডাকি ভ্রাতৃগণে।
ধন আনিবারে আজ্ঞা দিলেন তখনে।।
ধর্ম্মরাজ আজ্ঞা পেয়ে চারি সহোদর।
ভান্ডার হইতে ধন আনে বহুতর।।
প্রবাল মুকুতা স্বর্ণ মনি মরকত।
বিবিধ রতনরাশি কৈল শত মত।।
হরষিত অন্ধরাজ গান্ধারী সহিত।
দ্বিজগণে ধন দান কৈল অপ্রমিত।।
ভূমিদান অন্নদান করিল বিস্তর।
হস্তী অশ্ব ধেনু বৎস রত্ন বহুতর।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি রাজা দুর্য্যোধন।
সবাকার নাম করি দ্বিজে দিল দান।।
দানেতে তুষিয়া সব ব্রাক্ষ্মণ মন্ডল।
বনে যেতে অন্ধরাজ হইল বিকল।।
বহু আশীর্ব্বাদ কৈল ভাই পঞ্চজনে।
আলিঙ্গন শিরোঘ্রাণ করিল চুম্বনে।।
প্রণমিয়া পঞ্চ ভাই কান্দে চুম্বনে।
কৃতাঞ্জলি প্রণমিল গান্ধারীর পায়।।
আশীর্ব্বাদ কৈল দেবী প্রসন্নবদনে।
অঙ্গে হাত বুলাইয়া ভাই পঞ্চজনে।।
একে একে সবাকারে করিয়া বিদায়।
বনবাস গমন করিল কুরুরায়।।
গান্ধারীর স্কন্ধে আরোপিয়া বাম হাত।
ধীরে ধীরে চলিলেন কুরুকুল নাথ।।
গান্ধারীর বামভাগে চলিল সঞ্জয়।
অগ্রে অগ্রে চলিলেন ক্ষত্তা মহাশয়।।
হেনমতে অন্ধরাজ চলেন কানন।
দেখিবারে আইল সকল প্রজাগণ।।
বালবৃদ্ধ যুবা ধায় কুলবধূগণে।
ধৃতরাষ্ট্র বেশ দেখি কান্দে সর্ব্বজনে।।
ওহে অন্ধরাজ তুমি যাও কোথাকারে।
কি হেতু তপস্য বেশ ধরেছ শরীরে।।
দুই চক্ষু অন্ধ তব অর্পূর্ব্ব শরীর।
কি মতে ছাড়েন তোমা রাজা যুধিষ্ঠির।।
বাহড় বাহড় রাজা না যাও কাননে।
তোমার বিহনে রাজা জীবে কোনজনে।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।
সেবিবে তোমায় সেই ধর্ম্মের আচার।।
এইরূপে চতুর্দ্দিকে কাঁদে সর্ব্বজন।
প্রবোধিয়া ধৃতরাষ্ট্র চলিল কানন।।
পথ দেখাইয়া ক্ষত্ত, আগে আগে যায়।
কুরুক্ষেত্র নিকটে আইল কুরুরায়।।
তথা হৈতে চলি গেল জাহ্নবীর কূলে।
স্নানদান করিলেন নামি গঙ্গাজলে।।
বসিয়া গঙ্গার তীরে কথোপকথনে।
সেই দিন বঞ্চিল জাহ্নবী জলপানে।।
রজনী প্রভাত হৈল সূর্য্যের উদয়।
প্রভাতে উঠিয়া তবে বিদুর সঞ্জয়।।
গঙ্গার পশ্চিমে বন নামে দ্বৈপায়ন।
নানাবিধ বৃক্ষলতা শোভিত কানন।।
অশোক চম্পক বৃক্ষ পলাশ কাঞ্চন।
অর্জ্জুন খর্জ্জুর আম্র জাম তরু বন।।
রাজবৃক্ষ শাল তাল আর আমলকী।
কন্টকী দাড়িম্ব নারিকেল হরিতকী।।
শিরীষ কদম্ব ঝাটি বদরী খদির।
তিন্তিড়ী বহেড়া আর নারঙ্গ জন্বীর।।
দিবদারু ভদ্রারুক নিম্ব তরুবর।
বিচিত্র কদলীবৃক্ষ দেখিতে সুন্দর।।
নানা পুষ্প সৌরভে শোভিত বনস্থলী।
ভ্রমর গুঞ্জরে তাহে কোকিল কাকলী।।
বিচিত্র তুলসীবৃক্ষ অতি শুশোভন।
বিচিত্র মঞ্জরী তাহে নবদলগণ।।
আমোদে পূর্ণিত হয় সকল কানন।
পুষ্পভরে লম্ববান যত তরুগণ।।
মল্লিকা মালতী যূথী জাতি নাগেশ্বর।
করবী বকুল জবা রঙ্গন টগর।।
সেউতী মাধবীলতা কুটজ কিংশুক।
সেফালিকা সারি সারি দেখায় কৌতুক।।
নব নব দলেতে পূর্ণিত ফল ফুল।
তার গন্ধে মকরন্দ ধায় অলিকুল।।
ময়ূর কোকিলগণে করে কুহুরব।
মন্দ মন্দ সমীরণ বহে সুসৌরভ।।
বন দেখি আনন্দিত বিদুর সঞ্জয়।
হেথায় বঞ্চিব হেন চিন্তিল হৃদয়।।
দুইখানি কুটীর রচিল সেইখানে।
মনিগণ নিবসয়ে তার সন্নিধানে।।
সম্ভাষিয়া মুনিগণে করিয়া বিনয়।
অন্ধের নিকটে গেল বিদুর সঞ্জয়।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী সহিত ভোজসুতা।
সবে লয়ে কুটীরে আইল পুনঃক্ষত্তা।।
কানন নিবাসী যত ঋষি মুনিগণ।
আইল করিতে ধৃতরাষ্ট্র সম্ভাষণ।।
যথাবিধি সবাকারে পূজিয়া সাদরে।
হরযিতে জিজ্ঞাসিল অন্ধ নৃপবরে।।
মহামুনি ঋষিগণ ধৃতরাষ্ট্র প্রীতে।
আশ্রম করিয়া রহিলেন চতুর্ভিতে।।
দেখিয়া পাইল প্রীতি অন্ধ নরবরে।
ব্রক্ষ্মচর্য্য আচরিল শুদ্ধ কলেবরে।।
নিকটে জাহ্নবী নীরে স্নান দান করি।
হোমকর্ম্ম সমাপিয়া কুরু অধিকারী।।
গৃহমধ্যে কুশাসন করিয়া স্থাপন।
পূর্ব্বমুখে বসিলেন করি যোগাসন।।
হৃদয়ে পরম পদ চিন্তিয়া সাদরে।
মন্ত্র জপ করে অন্ধ ভক্তি পুরঃসরে।।
নিকটে বিদুর আর সঞ্জয় সুমতি।
যোগাসন কবি দোঁহে করিলেন স্থিতি।।
এইরূপে সকলে বসিল যোগাসনে।
মন্ত্র ধ্যান করি কৃষ্ণ জপেন সুক্ষণে।।
দিন শেষে বিদুর সঞ্জয় দুইজন।
ফল মূল আনি সবে করিল ভক্ষণ।।
পুন্যকথা আলাপেতে বঞ্চিয়া রজনী।
হেনমতে কাননে রহিল নৃপমণি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুন পুন্যবান।।