০১. ধৃতরাষ্ট্রের বৈরাগ্য ও বিদুরের সহিত কথোপকথন

জিজ্ঞাসেন জন্মেজয়কহ মহামুনি।
তদন্তরে কি কর্ম্ম হইল তাহা শুনি।।
পিতামহ উপাখ্যান অপূর্ব্ব চরিএ।
তোমার প্রসাদে শুনি হইব পবিত্র।।
অম্বমেধ যজ্ঞ শেষে পিতামহগণ।
কি কি কর্ম্ম করিলেন কহ তপোধন।।
কি করিল অন্ধরাজ সুবল নন্দিনী।
নারীগণ কি করিল কহ শুনি মুনি।।
শুনিতে আনন্দ বড় জন্মায় অন্তরে।
মুনিরাজ দয়া করি বলহ আমারে।।
মুনি বলিলেন রাজা কর অবধান।
অতঃপর শুন পিতামহ উপাখ্যান।।
যজ্ঞ কর্ম্ম সমাপিয়া ভাই পঞ্চজন।
দিলেন ব্রাক্ষ্মণগণে বহুবিধ ধন।।
হেনমতে পঞ্চভাই হরিষ অন্তর।
নানা দান উৎসব করেন নিরন্তর।।
যজ্ঞ বিনা সে সবার অন্যে নাহি মতি।
ভ্রাতৃসহ বঞ্চেন শুনহ নরপতি।।
সত্যধর্ম্মশাস্ত্র আর প্রজার পালন।
দুষ্ট চোর ভয় খন্ডে বৈরীর মর্দ্দন।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।
অনুক্ষণ ধর্ম্ম বিনা গতি নাহি আর।।
দাস দাসী প্রজা আদি অনুগত জনে।
রাজার পালনে সবে সদা হৃষ্টমনে।।
ভ্রাতৃঘণ সহ তথা ধর্ম্মের নন্দন।
ইষ্ট তুল্য ধৃতরাষ্ট্রে করেন সেবন।।
ভীমার্জ্জুন আর দুই মাদ্রীর নন্দন।
সতত রহেন ধৃতরাষ্ট্রের সদন।।
ভীমসেন মহাবীর পবন নন্দন।
পূর্ব্ব দুঃখ অন্তরে না হয় পাসরণ।।
স্মরিয়া সে সব দুঃখ ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস।
ক্রোধ করি অন্ধরাজে কহে কটুভাষ।।
পূর্ব্ব কথা বুঝি প্রায় হৈলে পাসরণ।
জতুগৃহে পোড়াইলে আমা পঞ্চজন।।
খলমতি কদাচারী তুমি কুরুকুলে।
আমা সবা হিংসা করি সবংশে মজিলে।।
শত পুত্র তব আমি করিনু সংহার।
তবু দুঃখ পাসরণ নহেত আমার।।
এত বলি দুই বাহু করে আস্ফালন।
দন্ত কড়মড় করে অরুণ লোচন।।
ভীমবাক্যে ধৃতরাষ্ট্র সর্ব্বদা অস্তির।
অন্তরে অনল দহে কুরু মহাবীর।।
অর্জ্জুন সহিত দুই মাদ্রীর নন্দন।
ধৃতরাষ্ট্র আজ্ঞাতে চলেন অনুক্ষণ।।
ভীম বাক্যজালে রাজা দহে কলেবর।
দ্বিগুন পূর্ব্বের শোক দহয়ে অন্তর।।
হায় পুত্র দুর্য্যোধন বীর চুড়ামণি।
তোমার বিরহে দহে এ পাপ পরানী।।
এক পুত্র হৈলে লোকে আনন্দ অপার।
তোমা হেন শত পুত্র মরিল আমার।।
আজ্ঞাতে করিলে বশ পৃথিবীর রাজা।
ভক্তিভাবে তোমার চরণ কৈল পূজা।।
ইন্দ্রের বৈভব কৈলে পৃথিবী ভিতর।
তোমার জনক হনে হইল কাতর।।
এইরূপে অনুতাপ করে অনুক্ষণ।
দুই এক দিন রাজা না করে ভোজন।।
গান্ধারী প্রবোধ বহু করেন রাজারে।
সত্যবর্ম্ম বিচারিয়া বিবিধ প্রকারে।।
অকারণে তাপ কেন কর নরপতি।
কর্ম্ম অনুরূপ রাজা শুভাশুভ গতি।।
জানি পুনঃ শোচন না করে জ্ঞানবান।
আমারে যেরূপ ভাবে হৃদয় তোমার।।
সেইরূপ তোমা প্রতি হৃদয় আমার।
ভীম প্রতি যেইরূপ তোমার হৃদয়।।
সেইরূপ ভাবে ভীম শুন মহাশয়।
শিশুকাল হৈতে তুমি ভীমেরে হিংসিলা।।
অনেক মন্ত্রণা করি নানা দুঃখ দিলা।
ধৃতরাষ্ট্র বলে ভীম বড় দুরাচার।
একেশ্বর শত পুত্র মারিল আমার।।
তাহারে দেখিলে মম সর্ব্ব অঙ্গ দহে।
দ্বিগুন বাড়য়ে অগ্নি হৃদয়ে না সহে।।
যুধিষ্ঠির গুণ কথা না যায় বর্ণন।
সাধুপুত্র গুণবান ধর্ম্মের নন্দন।।
ভীমের এমন ভাব সে কিছু না জানে।
যা রহে জীবন মম ভীমের বচনে।।
এইরূপে অন্ধরাজ গান্ধারী সহিত।
হেনকালে বিদুর হইল উপনীত।।
প্রণমিয়া অন্ধেরে বিদুর মহামতি।
জিজ্ঞাসিল উচাটন কেন নরপতি।।
কোন দুঃখে দুঃখী তুমি কহত আমারে।
ইষ্টদেব তুল্য তোমা সেবে যুধিষ্ঠিরে।।
ভ্রাতৃগণে নিয়োজিল তোমার সেবনে।
অপর আছয়ে যত দাস দাসীগণে।।
ধর্ম্মপথে যুধিষ্ঠির নহে বিচলিত।
আর চারি সহোদর তার মনোনীত।।
রাজ্য অর্থ ধন আদি সকলি তোমার।
পিতৃতুল্য ভাবে তোমা ধর্ম্মের কুমার।।
আপন ইচ্ছায় তব যেই মনে লয়।
যত ইচ্ছা দান ভোগ কর মহাশয়।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে তুমি কহিলে প্রমাণ।
বেদতুল্য তব বাক্য কভু নহে আন।।
মমহিত উপদেশ যতেক কহিলা।
না শুনিনু তব বাক্য করে অবহেলা।।
সেই হেতু এই গতি হইল আমার।
তবে সুখ দুঃখ কথা কি আর বিচার।।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির সর্ব্ব গুণাধার।
কোন দোষে দোষী নহে ধর্ম্মের কুমার।।
পুত্রের অধিক মম করয়ে সেবন।
তার গুনে হৈল মম শোক নিবারণ।।
কোন দোষে দোষী নহে রাজা যুধিষ্ঠির।
কিন্তু ভীম দুরাচার দহয়ে শরীর।।
কোন কর্ম্ম হেতু আমি যদি কহি তারে।
কর্ম্ম না করিয়া আর কহে কটুত্তরে।।
শত পুত্র মারি দুঃখ নহে নিবারণ।
দন্ত কড়মড় করে বাহু আস্ফালন।।
ভীমের চরিত্র দেখি দহে মম কায়।
কি কহিব কহ মোরে ইহার উপায়।।
বিদুর কহেন শুন স্থির কর মন।
ভীমের বচনে রাজা নহ উচাটন।।
অপমান করে তোমা যদি যুধিষ্ঠির।
তব যেই চিত্তে লয় কর নররব।।
তুমি যেই ভাবকর বৃকোদর প্রতি।
তোমারেও দুষ্টভাব করয়ে মারুতি।।
ইহা জানি কৃকোদরে ত্যজহ আক্রোশ।
যুধিষ্ঠির প্রতি তুমি নহ অসন্তোষ।।
তোমারে বিমনা যদি শুনে ধর্ম্মরায়।
এইক্ষণে আসিয়া পড়িবে তব পায়।।
তুমি অসন্তোষ যদি হও নরপতি।
রাজ্য ত্যজি বনে যাবে ধর্ম্ম নরপতি।।
তাহারে প্রসন্ন ভাব হও নরনাথ।
এত বলি বিদুর করিল প্রণিপাত।।
পুনরপি ধৃতারাষ্ট্র সকরুণে কয়।
যুধিষ্ঠির ক্রোধ মম কদাচিত নয়।।
আমি ধৃতরাষ্ট্র রাজা বিখ্যাত ভুবনে।
মহাধনুর্দ্ধর পুত্র একশত জনে।।
সকল সংহার মম করে যেইজন।
তাহার পালিত হয়ে রাখিব জীবন।।
ধিক্ ধিক্ জীবনে এমন ছার আশ।
সংসার যুড়িয়া লজ্জা লোকে উপহাস।।
দ্বিতীয় বাসব মম পুত্র দুর্য্যোধন।
তাহা বিনা পাপ প্রাণ রহে এতক্ষণ।।
এইরূপে শোচনা করিয়া বহুতর।
পুনঃ বিদুরের প্রতি করিল উত্তর।।
অবধানকরভ ভাই বচন আমার।
যে বিধান চিত্তে আমি করেছি বিচার।।
রাজ্য সুখ ভোগ নানা করিনু বিস্তর।
মম সম সুখ নাহি ভুঞ্জে কোন নর।।
অতঃপর চিত্তে সে সকল ক্ষমা দিব।
বনবাসে গিয়া আমি যোগ আরম্ভিব।।
রাজনীতি ধর্ম্ম হেন আছে পূর্ব্বাপর।
শেষকালে প্রবেশিবে অরণ্য ভিতর।।
অবশেষে কাল মম হৈল উপনীত।
যোগ ধর্ম্ম আচরণ হয়ত বিহিত।।
সত্য সত্য বনে যাব নাছিক সংশয়।
যোগ আচরিব গিয়া কহিনু নিশ্চয়।।
বিদুর বলেন রাজা কর অবধান।
যতেক কহিলে সত্য কভু নহে আন।।
রাজা হয়ে শেষকালে যাব বনবাস।
যোগ আচরিব গিয়া করিয়া সন্ন্যাস।।
বেদের বচন ইথে নাহিক সংশয়।
কিন্তু এক কথা কহি শুন মহাশয়।।
আপনি বৃদ্ধক অতি শরীর দুর্ব্বল।
শোকাতুর অন্ধ তব নয়ন যুগল।।
অভ্যন্তর যেতে তব নাহিক শকতি।
ঘোর বনে কিমতে পশিবে নরপতি।।
ভয়ঙ্কর বনজন্তু সিংহ ব্রাঘ্রগণ।
প্রলয় মহিষ গজ ঘোর দরশন।।
কিমতে রহিবে তথা তাহা মোরে কহ।
আর তাহে মহারাজ চক্ষে না দেখহ।।
অপমৃত্যু হয় পাছে এই বড় ভয়।
এই হেতু ইথে মোর চিত্তে নাহি লয়।।
সে কারণে কহি আমি গুন মহারাজ।
গৃহাশ্রমে থাকিয়া না হয় কোন কাজ।।
দ্বিজগণে দান দেহ বহুবিধ ধন।
প্রবাল মুকুতা মণি রজত কাঞ্চন।।
ভুমিদান অন্নদান আর নানা দান।
অন্ন দান নহে অন্য দানের সমান।।
যাহা ইচ্ছা দান কর আপনার মনে।
কৃষ্ণপদ চিন্তা কর বসিয়া নির্জ্জনে।।
সর্ব্ব কার্য্য সিদ্ধ যবে হবে এইমতে।
পাইবা উত্তম গতি শুন নরপতে।।
ধর্ম্মের নন্দন দেখ রাজা যুধিষ্ঠির।
ভ্রাতৃ মন্ত্রী বন্ধুশোকে আকুল শরীর।।
তোমার সেবন হেতু করে গৃহবাস।
তোমার এ মতি শুনি হইবে নিরাস।।
তোমা বিনা সকল ত্যজিবে ধর্ম্মরায়।
ব্রক্ষ্মচর্য্য আচরি কাননে পাছে যায়।।
এই হেতু রাজা আমি কহি যে তোমায়।
গৃহাশ্রমে রহি গতি চিন্তু কর রায়।।
ইহা বিনা উপায় নাহিক রাজা আর।
মম চিত্তে লয় রাজা এই তো বিচার।।
ধৃতরাষ্ট্র কহে তুমি পরম পন্ডিত।
তোমার বচন খ্যাত বেদের বিহিত।।
যতেক কহিলে কিছু না হয় বিধান।
কিন্তু এক কথা কহি কর অবধান।।
করুণানিদান সেই নন্দের কুমার।
করুণানিদান সেই নন্দের কুমার।
একমনে ভজিলে সে করয়ে উদ্ধার।।
সকল ইন্দ্রিয়গণ কর নিবারণ।
কায়মনোবাক্যেতে চিন্তিবে নারায়ণ।।
গৃহাশ্রমে হেন শক্তি নহিবে আমার।
সে কারণে বনে যেতে করেছি বিচার।।
বনজন্তুগণ হেতু কহিলে প্রমাণ।
আপন অদৃষ্ট ফল না হবে এড়ান।।
যা থাকে অদৃষ্টে তাহা অবশ্য হইবে।
পূর্ববার্জ্জিত ফল যাহা তাহা কে খন্ডাবে।।
অভয় পদারবিন্দ করিয়া ভাবন।
সর্ব্ব ভয় হইতে হইবে বিমোচন।।
ইহা ভিন্ন অন্য চিত্তে না লয় আমার।
বনবাসে যাইব কহিনু সারোদ্ধার।।
ধৃতরাষ্ট্র মন বুঝি বিদুর সুমতি।
আশ্বাসিয়া বলে পুনঃ শুন নরপতি।।
তুমি যদি বনবাসে যাইবা নিশ্চয়।
আমিও সংহতি তব যাব মহাশয়।।
আমি তব ভৃত্য, তুমি আমার ঈশ্বর।
ঈশ্বর বিহনে কিবা করিবে কিঙ্কর।।
যথায় যাইবা তুমি যাইব সংহতি।
তোমার যে গতি রাজা আমারসে গতি।
যুধিষ্ঠিরে প্রবোধ করিব বিধিমতে।
তাঁর অনুমতি বিনা না পারি যাইতে।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে ‍তুলি কহ যুধিষ্ঠিরে।
সাত্ত্বনা পূর্ব্বক কহ বিবিধ প্রকারে।।
তুমি আমি গান্ধারী সঞ্জয় আদি করি।
নানামতে প্রবোধিব ধর্ম্ম অধিকারী।।
এত শুনি বিদুর চলিল ধর্ম্ম স্থানে।
বসিয়া আছেন ধর্ম্ম রত্নসিংহাসনে।।
পাত্র মিত্র ভ্রাতৃগণ চৌদিকে বেষ্টিত।
ব্রাক্ষ্মণমন্ডলী সঙ্গে ধৌম্য পুরোহিত।।
স্বধর্ম্মে করেন রাজ্য ধর্ম্মের নন্দন।
পুত্রবৎ পালেন যতেক প্রজাগণ।।
সর্ব্বজীবে সমভাব দয়ার ঈশ্বর।
ধর্ম্ম অবতার ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির।।
যুধিষ্ঠির গুণে বশ হৈল সর্ব্বজন।
শোক দুঃখ সকল হইল বিস্মরণ।।
প্রাতঃকালে উঠি রাজাকরি স্নান দান।
পাত্র মিত্র ভ্রাতৃগণে করেন সম্মান।
তদন্তরে দ্বিজগণে করিয়া সম্মান।
বিবিধ রতন দেন নাহি পরিমাণ।
অশ্ব বৃষ গাভী বৎস আর নানা ধন।
ভুমিদান অন্নদান বিবিধ বসন।।
হেনমতে দান কর্ম্ম করি সমাপন।
ধৃতরাষ্ট্রে গান্ধারীকে করি সম্ভাষণ।।
সেবায় নিযুক্ত করি ভ্রাতৃ বন্ধুজনে।
আজ্ঞা মাগি রাজকার্য্যে যান সেইক্ষণে।।
সিংহাসনে বসিয়া করেন রাজকার্য্য ।
পাত্রমিত্র ভ্রাতৃ বন্ধু সহিত সাম্রাজ্য।।
রাজকার্য্য অবসানে আসিয়া মন্দিরে।
ব্রাক্ষ্মণে করেন পূজা নানা উপচারে।।
যাহাতে যাহার প্রীতি ভক্ষ্যদ্রব্য আদি।
সবারে করেন দান সহিত দ্রৌপদী।।
যথোচিত তৃপ্ত করি অন্ধ নরবরে।
সেইমত গান্ধারীকে পূজেন সাদরে।।
দোঁহা অনুমতি লয়ে বিদায় হইয়া।
ভোজন করেন রাজা বন্ধুগণ লৈয়া।।
এইমত নিত্যকর্ম্ম করি ধর্ম্মরায়।
সাধু সর্ব্বগুণান্বিত অপ্রমিত কায়।।
ভারত আশ্রমপর্ব্ব অপূর্ব্ব আখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুন্যবান।।