শকুনি

শকুনি

আমার পরিচিত সেই বন্ধু বলেছিলেন— কী যে বলেন মশাই! স্ত্রীলোকের ওপর উৎপীড়ন, নির্যাতন, কত কী বলে তো আমাদের পুরুষ-সমাজটাকে একেবারে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যেন আমরা সব দাগি আসামি, প্রত্যেকে যেন আমরা নিজের বউটিকে খুন করে এসে এখানে বসে রসালাপ করছি। তাও যদি আপনার বউদিদিকে চাক্ষুষ না দেখতেন। দিন-রাত তো ফাই-ফরমাশ খাটছিই, তার মধ্যে আজ তার ভাইয়ের বায়না, কাল তার বোনের বায়না। মশাই, সাতগুষ্টির বায়না দেখে দেখে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম, আর আপনারা বড় বড় কথা লিখবেন— উৎপীড়ন হচ্ছে, নারী-নির্যাতন হচ্ছে, আরও কত কী?

বন্ধুটির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ নিয়ে আমি বললাম— আরে মশাই! আমি এখনকার কথা বলিনি, আপনাদের কথাও বলিনি, আমি প্রাচীনকালের কথা বলছি। সেকালের নারীসমাজের ওপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে নিপীড়ন-উৎপীড়ন আবহমান কাল ধরে চলেছে, আমি সেই কথা বলেছি। বন্ধুটি বললেন— থামুন মশাই! সেকালেও কী ভদ্রলোকের সমাজে স্ত্রীলোকের দাপট কিছু কম ছিল? এই যে পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদী! তিনি স্বামীদের সঙ্গে ঝগড়া করে এমন কথাও বলেছিলেন— দরকার নেই তোমাদের। দুর্যোধনের সভাস্থলে যে অপমান আমি সয়েছি, তার প্রতিশোধ যদি তোমরা না নিতে পারো, তা হলে আমার ভাই আর আমার বুড়ো বাপকে নিয়ে যুদ্ধ করবে আমার ছেলেরা— পিতা মে যোৎস্যতে বৃদ্ধঃ সহ পুত্রৈর্মহারথৈঃ।

বন্ধু তর্কযুদ্ধে ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়ে বললেন— দ্রৌপদীর কথাটা কি খুব নরম-নাজুক মনে হচ্ছে? ভীম-অর্জুনের মতো বীরস্বামীর সামনে বাপের বাড়ির লোকদের নিয়ে দ্রৌপদী যে মাথায়-তোলা কথাটুকু বললেন, সেটার মধ্যে কি স্ত্রীলোকের দাপট কিছু কম দেখছেন? আর পাণ্ডবদের মতো বীরস্বামীরা কী করলেন? উদ্যোগপর্বে বিশাল একটা মিটিং ডেকে দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নকে মহাযুদ্ধের সেনাপতি নির্বাচন করলেন। তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? স্ত্রীলোকই তো সব। তা ছাড়া ধৃষ্টদ্যুম্নের এই নির্বাচনটাই বড় কথা নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ‘প্রপোজার’ আর ‘সেকন্ডার’ দু’জন কে বলতে পারেন? ‘প্রপোজার’ স্বয়ং অর্জুন আর ‘সেকন্ডার’ হলেন তাঁর মহামান্য শ্যালক সুভদ্রার ভাই কৃষ্ণ। তিনি সবার শেষে মত দিলেন— হ্যাঁ ধৃষ্টদ্যুম্নই সবচেয়ে ভাল সেনাপতি হবেন— ধৃষ্টদ্যুম্নমহং মন্যে সেনাপতিমরিন্দম। শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল, আর শালার সাক্ষী শালা। আর এই কৃষ্ণই কি কম কিছু? তিনিও তো অৰ্জুনের শ্যালক। তিনি তো সারা মহাভারত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।

আমি একটু সন্দিগ্ধ মনে প্রশ্ন করলাম— দেখুন, শালা হলেও ধৃষ্টদ্যুম্ন অথবা কৃষ্ণ কি পাণ্ডবদের খারাপ করছেন কিছু? তাঁরা তো নিজের জীবন সংশয় করে পাণ্ডবদের জন্য লড়ে গেছেন। বন্ধু বললেন— দেখুন, সেটা অন্য কথা। এঁরা শ্যালক হোন আর যাই হোন, এঁরা আধার হিসেবে ভাল, এঁদের বুদ্ধিও ভাল, তাই এঁরা ভাল কাজ করেছেন। আমি সুযোগ পেয়ে বললাম— তা হলে দেখুন, স্ত্রীর ভাই মাত্রেই খারাপ নয়, শালা-শালিরা যদি মানুষ হিসেবে, আধার হিসেবে নিজেরা ভাল হন, তা হলে খুব একটা সমস্যা হয় না। স্ত্রীরাও সে ক্ষেত্রে নিন্দনীয় হন না।

বন্ধুবর এবারে একটু দমলেন মনে হল। এতক্ষণে তাঁকে যেন একটু নরম দেখাল। আমি বললাম— সংসারের অর্ধাতিরিক্ত মানুষটি একটি মানুষকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকেন। তিনি তাঁর স্বামী। ভারতবর্ষের সংসারে ওই একটি জায়গাতেই তাঁর যত প্রতাপ। তাঁর বাইরের কোনও জগৎ নেই, বাইরের কোনও রসাবেশ নেই, জীবনের যত সুখ-দুঃখ, আমোদ-প্রমোদ সব ওই স্বামীকে ঘিরেই। এখন মুশকিল হল, স্বামী যদি বড় মানুষ, রাজা-রাজড়া কী মন্ত্রীমশাই হন, তবে তাঁকে ঘিরে নানান চক্র গড়ে ওঠে। হ্যাঁ, কখনও সেটা মধুচক্রও বটে। সেখানে গিন্নির বাপ-ভাইরাও বা বাদ যাবেন কেন? অন্যেরা মধু খাচ্ছে, তাঁরাও খান। তবে ওই যে কথাটা, আধার যদি ভাল হয়, তাঁরা যদি মানুষ হিসেবে নিজেরাই ভাল হন, তবে সংসারনীতি, রাষ্ট্রনীতি অন্য চেহারা নেয়। আর মানুষ হিসেবে খারাপ হলে সংসার এবং রাষ্ট্র দুইই ছারখার হয়ে যায়।

আমি এবার উদাহরণ দিয়ে বললাম— আপনি তো খুব ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা বললেন, কৃষ্ণের কথাও বললেন এবং প্রমাণ করে ছাড়লেন যে, হ্যাঁ দ্রৌপদীর খুব দাপট ছিল। কিন্তু মশাই গান্ধারীর কথা খেয়াল করেছেন কখনও? তাঁর মতো মানুষ দ্বিতীয় একটা পাবেন নাকি মহাভারতে! তিনি তো একবারও বলেননি যে, তাঁর ভাই শকুনি খুব ভাল মানুষ, অথবা তিনি কৌরবকুলের খুব উন্নতি ঘটাচ্ছেন। গান্ধারী কোনওদিন, কোনও সময় শকুনিকে প্রশ্রয় দেননি, চিরকাল তাঁর সম্বন্ধে নিজের স্বামীর কাছে গালমন্দও করেছেন। কিন্তু কী বলব, গান্ধারীর ভাই শকুনির কুবুদ্ধির সঙ্গে তাঁর স্বামী-পুত্র ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের কুবুদ্ধির মিল হয়ে গেছে। শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি হয়েছে। ফল কী হয়েছে? সমস্ত কৌরব-সংসার উচ্ছন্নে গেছে, কুরুরাজ্যও ধ্বংস হয়ে গেছে।

অনেকে বলেন এবং আমিও শুনি যে, শকুনি নাকি মানুষ খারাপ ছিলেন না, কিন্তু তিনি নাকি তাঁর বাপ-ভাইদের ওপর দুর্যোধনের অন্যায়-ব্যবহারের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ঠান্ডা মাথায় দুর্যোধনের সর্বনাশ করে ছাড়েন। আসলে এইরকম একটা গল্প লোক-মুখে চলে এবং একজন প্রবীণ ব্যক্তি আমাকে বলেছেন— গল্পটা নাকি দক্ষিণদেশীয় একটি পুরাণে বর্ণিত আছে। আমি সে পুরাণ দেখিনি এবং দেখলেও কিছু বুঝতে পারতাম না। তবে পুরাণে যাই থাক, লোকশ্রুতি যেমনটি আছে, জানাই। লোককথা আরও দুই বা তিনরকমভাবে প্রচলিত আছে, অতএব ঘটনার বিস্তারে কোথাও কোথাও ভিন্নতা থাকতেই পারে। আমার এই কাহিনিটি পণ্ডিত অনন্তলাল ঠাকুরের কাছে শোনা।

শোনা যায়, কোনও একসময় যুবকবয়সি দুর্যোধন নিজের পাদুটির ছিরি দেখে বড় ক্ষুন্ন বোধ করেন। তাঁর সমস্ত শরীরের মধ্যে তাঁর পা দুটি ছিল ভীষণ খারাপ। সর্বাঙ্গসুন্দর শরীরে অমন বেমানান বিসদৃশ দুটি পা দেখে দুর্যোধন মনে মনে বড় বিষন্ন বোধ করেন, মাঝে মাঝে তাঁর খুব রাগ হয় এই জন্য। একদিন রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে দুর্যোধন আপন জননী গান্ধারীকে জিজ্ঞাসা করেন— তুমি এর কোনও কারণ বলতে পারো, মা! কেন আমার এই পা দুটো এমন পাখির ঠ্যাং-এর মতো দেখতে হয়েছে? কোনও পাপে এমন বেমানান পা হয়েছে আমার?

গান্ধারী পুত্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন— এতে তোমার কোনও দোষ নেই, বাবা! দোষটা আমারই। ছোটবেলায় আমাদের গণকঠাকুর গুনে বলেছিলেন— আমার নাকি বৈধব্য যোগ আছে। তিনি আরও বলেছিলেন— কোনও মানুষের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে একটি বৃক্ষ অথবা একটি পক্ষীর সঙ্গে যদি আমার বিয়ে দেওয়া যায়, তবে আমার বৈধব্যদোষ কেটে যাবে। গণকঠাকুরের কথা শুনে আমার পিতা গান্ধাররাজ সুবল একটি পারাবত-পক্ষীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিছুদিন গেল, তারপর একদিন পারাবতটি মৃত্যুমুখে পতিত হল। আমার সঙ্গে পারাবতটির ভাগ্য জড়িয়ে যাওয়ার ফলেই যে পারাবতটির আয়ু অকালে শেষ হয়ে গেল, সে কথা আমি জানতাম বলে পারাবতটিকে তা বলেওছিলাম। শেষমুহুর্তে আমার কথা শুনে পারাবতটি আমায় অভিশাপ দিয়ে বলল— আমার জীবন নিয়ে তোমরা যখন এমন জঘন্য খেলা খেলেছ, তখন আমিও আমার স্বামিত্বের চিহ্ন রেখে যাব। ভবিষ্যতে তোমার ছেলে হয়ে যারা জন্মাবে, তাদের সবার পাদুটি হবে আমারই মতো। মনুষ্যদেহে কবুতরের পদদ্বয় অন্যের দৃষ্টিতে লাগবে কুৎসিত এবং বেমানান।

গান্ধারী দুর্যোধনকে বললেন— এই অভিশাপের জন্যই তোমাদের সবার পাদুটো এমন খারাপ দেখতে লাগে। গান্ধারীর কথা শুনে দুর্যোধন মোটেই শান্ত হলেন না। তিনি দ্বিগুণ রেগে বললেন— এর জন্য তুমিও দায়ী নও, জননী! দায়ী তোমার বাপ-ভাইরা— যাঁরা ওই মূর্খ গণকঠাকুরের কথা শুনে একটি পারাবতের সঙ্গে তোমার বিবাহ ঠিক করেছিলেন। এরজন্য আমিই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।

গান্ধারীর পিতা এবং তাঁর একশো ছেলে, যাদের মধ্যে শকুনিও আছেন— এঁদের সবাইকে দুর্যোধন কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। বন্দিশালায় তাঁদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও হল অদ্ভুত। দুর্যোধন সবার জন্য এক মুঠি করে ধান আর সামান্য জলের ব্যবস্থা করলেন। অর্থাৎ একটি পারাবত যেটুকু ধান আর জল খেয়ে বাঁচতে পারে, গান্ধারীর পিতা সুবল এবং গান্ধারীর একশো ভাইয়ের জন্য দুর্যোধন ততটুকু করে ধান-জলের ব্যবস্থা করলেন।

দিন যেতে লাগল। খাবারের বরাদ্দে প্রত্যেকেরই শরীর শুকিয়ে যেতে লাগল। প্রত্যেকেই তখন চিন্তা করতে লাগলেন— কারাগার থেকে মুক্তি যখন নেই, তখন প্রতিহিংসা নিতে হবে দুর্যোধনের ওপর। পিতা-পুত্র সবাই মিলে ঠিক করলেন— প্রত্যেকের খাওয়ার জন্য যতটুকু ধান পাওয়া যায়, তাতে কারওরই পেট ভরে না। অতএব প্রত্যেকেই আহার ত্যাগ করে নিজের বরাদ্দ ধানটুকু জমিয়ে রাখবেন। সেই জমানো খাবার একজনকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, মাত্র একজনকে, যে সবার হয়ে প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করবে। এখন সমস্যা— কাকে বাঁচানো হবে? বৃদ্ধ পিতা সুবল নিজের আয়ুর কারণেই রাজি হলেন না। রাজি হলেন না অন্য ভাইরাও। সকলেই অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন জ্যেষ্ঠ শকুনির দিকে, কারণ তাঁর বুদ্ধি জটিল এবং লক্ষ্য স্থির। সকলে মিলে ধান বাঁচিয়ে খাওয়াতে লাগলেন শকুনিকে। তিনি বেঁচে রইলেন, অন্য সকলে মারা গেলেন। তারপর কৌরবদের সঙ্গে পাণ্ডবদের গণ্ডগোল আরম্ভ হল এবং শকুনি ভাগনে দুর্যোধনকে সাহায্য করার অজুহাতে বেরিয়ে এলেন কারাগার থেকে। লোকে বলে— শকুনি নাকি বৃদ্ধ পিতা সুবলের হাড় দিয়ে পাশার ঘুঁটি বানিয়েছিলেন এবং সে ঘুঁটিগুলির দান পড়ত তাঁর ইচ্ছে অনুসারে। শকুনির ইচ্ছামাত্রে পিতা সুবলের প্রেতাত্মা সেই ঘুঁটির মধ্যে জেগে উঠত এবং শকুনির কার্য সম্পন্ন করত।

গল্পটা মন্দ নয় এবং কেউ যদি মূল মহাভারতের ঘটনা-পরম্পরায় শকুনির চাতুরীপূর্ণ ব্যবহার ভাল করে খেয়াল করেন, তা হলে শকুনির চরিত্রটা উপরি-উক্ত উপাখ্যানের সঙ্গে কিছুই সামঞ্জস্যহীন হবে না। শকুনি চিরটা কাল দুর্যোধনকে কুমন্ত্রণা দিয়ে গেছেন। এবং এই কুমন্ত্রণাটা যদি শকুনির দিক থেকে পূর্বপরিকল্পিত এবং সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতও ধরে নেওয়া যায়, তা হলেও কিন্তু মহাভারতে মূল কাহিনিতে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হয় না। বরঞ্চ তাতে শকুনির চরিত্র আরও কুটিল হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো শকুনির চরিত্রে আরও কুটিলতা আনবার জন্যই অথবা দুর্যোধনের চরিত্রে আরও কঠিন হিংস্র আচরণ আমদানি করার জন্যই এই লোকশ্রুতির অবতারণা।

বস্তুত মহাভারতের বিশাল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কীভাবে শকুনির প্রবেশ ঘটেছিল, মহাভারতের কবি তা বলেননি। এমনকী কবে, কখন, কীভাবে হস্তিনাপুরের রাজপরিবারের মধ্যে শকুনি নিজের জায়গা করে নিলেন, সে কথাও কবি পরিষ্কার করে কিচ্ছুটি বলেননি। শুধু এইটুকু জানি যে, হস্তিনাপুরের জ্যেষ্ঠ রাজকুমার ধৃতরাষ্ট্র যেদিন গান্ধার রাজ্যে গিয়ে গান্ধারীকে বিবাহ করলেন, সেদিন গান্ধারী যেমন স্বামীর সম্মানে চোখে পট্টবস্ত্র বেঁধে হস্তিনাপুরের পথে রওনা দিলেন, তেমনই তাঁর ভাই শকুনিও একই সঙ্গে পা বাড়িয়েছিলেন হস্তিনার পথে— ততো গান্ধাররাজস্য পুত্রঃ শকুনিরভ্যয়াৎ।

শকুনির এই অনুগমনের পিছনে কারণও ছিল যথেষ্ট। গান্ধার রাজ্যটা ছিল ভারতবর্ষের উত্তরেরও উত্তরে। হেরোডোটাস এক কলমের খোঁচায় লিখে দিলেন ‘গান্ডারাই’ জায়গাটা প্রাচীন হিন্দুস্থানের অন্তর্গত ছিল না, কিন্তু ঋগ্‌বেদ-অথর্ববেদের প্রমাণে আমরা গান্ধার দেশকে ভারতবর্ষের অন্তর্গত বলেই জানি। একটাই কথা— ঋগ্‌বেদ-অথর্ববেদে গান্ধার রাজ্যের মানুষদের তত সুনাম শোনা যায়নি। পরবর্তীকালে অবশ্য সমগ্র গান্ধার দেশ নামিদামি পণ্ডিতে ছেয়ে গিয়েছিল। উপনিষদের যুগে লোকে গান্ধারকে বিদ্যাবত্তা এবং জ্ঞানের অবধিস্থল বলে জানত। কিন্তু গান্ধারের এই মহিমা বেশিদিন টেকেনি। খোদ মহাভারতেই গান্ধারের মানুষেরা কম্বোজ-কিরাত আর বর্বরদের সঙ্গে একই পংক্তিতে এসে দাঁড়িয়েছেন— যৌন-কাম্বোজ-গান্ধারাঃ কিরাতা বর্বরৈঃ সহ। পরবর্তীকালে এই জায়গাটার একটা সাধারণ নাম তৈরি হয়, এই নাম হল উত্তরাপথ। উত্তরাপথের বাসিন্দা বলতে বোঝায় আধুনিক রাওয়ালপিন্ডি ছাড়িয়ে যেসব জায়গা সিন্ধু নদীর দুই পাড় জুড়ে ছিল, সেইখানকার মানুষ, এবং তাঁদের খুব সুখ্যাতি নেই ইতিহাসে পুরাণে।

তা ছাড়া ভাবুন, জায়গাটা পার্বত্য অঞ্চল, মানুষজন তথাকথিত কিরাত-বর্বরদের সমগোত্রীয়, সেই পার্বত্য পথ বেয়ে সুদূর হস্তিনাপুরের পথে যাবেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর অনুগামিনী প্রায়ান্ধ গান্ধারী। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন— শকুনি তাঁর বোনটির পিছন পিছন চললেন। কেমন বোন? না, বয়স্থা, যৌবনবতী, বড় লক্ষ্মীমতীও বটে— স্বসারং বয়সা লক্ষ্ম্যা যুক্তামাদায় কৌরবান্‌। নববিবাহিতা নবযৌবনবতী ভগিনীকে এই পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে কুরুদের দেশে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। শকুনি তাই যাচ্ছেন হস্তিনাপুরে।

কারণ আছে আরও একটা। ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারে এসেছেন, অনুমতা রমণীকে স্ত্রী হিসেবে মনোনীতও করেছেন। কিন্তু বিবাহের বিধিনিয়ম সব পালিত হবে হস্তিনাপুরে। বৃদ্ধ সুবলের রাজ্য ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। অতএব মেয়ের পক্ষ থেকে শকুনি গেলেন কার্য সমাধা করার জন্য। দেখছি— হস্তিনাপুরে এসে সুবলপুত্র শকুনি সাদরে সসম্মানে গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিচ্ছেন এবং বর-বধূর যোগ্য জামাকাপড় হাতি-ঘোড়া যৌতুক দিয়ে গান্ধাররাজ সুবলের সম্মান রক্ষা করছেন। দুই পক্ষের কুটুম্বিতা সম্পূর্ণ হলে পিতামহ ভীষ্ম শকুনিকে হস্তিনাপুরের যোগ্য মর্যাদা দিয়ে তুষ্ট করলেন এবং প্রতিপূজিত শকুনিও পুনরায় ফিরে গেলেন উত্তরাপথের সেই প্রত্যন্ত দেশ গান্ধারে— পুনরায়াৎ স্বনগরং ভীষ্মেণ প্রতিপূজিতঃ।

তার মানে এটা জলের মতো পরিষ্কার যে শকুনি ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর পিছন পিছন এলেও শকুনি তখন-তখনই থেকে যাননি হস্তিনাপুরে, কিংবা হস্তিনাপুরের জ্ঞাতি-রাজনীতিতেও তিনি প্রবেশ করেননি। তিনি গান্ধারের ছেলে গান্ধারেই ফিরে গেছেন। এরপর কবে শকুনির শুভাগমন ঘটল হস্তিনাপুরে, মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে বলেননি। কুন্তীর বিয়ে হয়েছে, পাণ্ডু রাজত্ব করে গেছেন, বনে গেছেন, পাণ্ডু মারা গেছেন, তাও আমরা শকুনির খবর পাইনি একটুও। হঠাৎই দেখলাম, সেই যখন মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবার পরিকল্পনা করছেন দুর্যোধন, এবং সে পরিকল্পনা যেভাবে হোক বিফলও হয়ে গেছে, ঠিক তখনই দুর্যোধন-কর্ণ-শকুনিকে আমরা পাণ্ডবদের বিপক্ষে কুমন্ত্রণা করতে দেখছি— এবং দুর্যোধনঃ কর্ণঃ শকুনিশ্চাপি সৌবলঃ।

আমাদের দৃঢ় অনুমানের কথাটা একটু বিস্তৃত করে বলি— পাণ্ডু তাঁর দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনবিহার করতে গেলে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সেই রাজ্য চালানোর ভার পেলেন কার্যনির্বাহী রাজা হিসেবে। কিছুদিন হয়তো এইভাবেই চলেছে। বনস্থলী থেকে পাণ্ডু ফিরে আসেননি। এদিকে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা জন্মেছেন, ওদিকে জন্মেছেন পাণ্ডুর পুত্রেরা। বন থেকে তখনও প্রতিনিয়ত পাণ্ডুর খবর পাওয়া যেত। কিন্তু দুর্যোধন যখন একটু বড় হয়েছেন এবং পঞ্চপুত্রের জনক পাণ্ডুর খবর যখন আর বেশি পাওয়া যাচ্ছে না— আমাদের ধারণা— ঠিক তখনই কোনও এক সময়ে স্বার্থলোভী শকুনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি নিজে গান্ধার-রাজপুত্র হলেও তাঁর সময়ে কুরুদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। এমন একটি বড় মাপের রাজবাড়িতে, যেখানে কার্যনির্বাহী রাজা স্বয়ং অন্ধ, সেখানে ধৃতরাষ্ট্রের প্রয়োজনের সুযোগ নিয়েই শকুনি প্রথমে রাজবাড়িতে ঢুকেছিলেন, তারপর ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রের সঙ্গে মিশে কুরুদের রাজনীতিতে অপরিহার্য হয়ে যান।

শকুনির প্রথম কুরুবাড়িতে আগমনের বিষয়ে বেশি আলোচনার অবকাশ নেই, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বিশেষত নাটকগুলির বিচার করলে দেখবেন, নাট্যকারেরা নিজেদের রচনায় বৈচিত্র্য আনার জন্য প্রায়ই রাজার শালার একটি পার্ট রাখেন, যাকে পারিভাষিক শব্দে বলে ‘শকার’। শকারের চরিত্রের মধ্যে সব সময়েই এক ধরনের প্রশ্রয় থাকে। মাছের বাজার থেকে আরম্ভ করে রাজা পর্যন্ত তাঁর যাতায়াতের পরিধি। সকলে তাঁকে চেনে জানে। অন্যায়, অত্যাচার, ঘুষ খাওয়া এবং সুন্দরী মেয়েদের পিছনে লাগা রাজশ্যালকের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। কেউ তাঁকে কিছু বলতে সাহস পায় না। কারণ, তিনি রাজার শালা। কখনও বা তিনি রাজশাসনে বড় কোনও দফতরের বড় কর্মী। আমাদের বিশেষ ধারণা— সংস্কৃত নাটকগুলিতে রাজশ্যালকদের এই চরিত্রের আমদানি হয়েছে মহাকাব্যের নজিরে। বিরাট-রাজার শ্যালক কীচক এবং ধৃতরাষ্ট্রের শ্যালক শকুনিই পরবর্তী নাট্যকারদের উদ্দীপিত করেছেন।

এখানে বলে রাখা ভাল— কীচকের চরিত্রে স্ত্রীলোকের দোষ থাকলেও শকুনির চরিত্রে তা ছিল না। কিন্তু কুরুবাড়ির রাজপুত্র দুর্যোধনকে তিনি এমন সুন্দর বশে রেখেছিলেন যে কৌরব রাজনীতির প্রধান রূপকার হয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। শকুনির সবচেয়ে বড় ক্ষমতা— তিনি মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারতেন একজন জ্যোতিষীর চেয়েও ভাল করে। শুধু ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধন নয়, পাণ্ডবদের মনস্তত্ত্বও তাঁর ভাল করেই জানা ছিল। এতগুলি গুণ নিয়ে একটি লোক গান্ধারদেশের মতো ছোট্ট একটি পার্বত্য রাজ্যে বসে বসে আপন বুদ্ধির আগুন পোয়াবেন— এমন তো হয় না। কাজেই কুরুবাড়ির রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন তিনি।

পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানো হল জতুগৃহের আগুনে পুড়িয়ে মারার জন্য। এই ষড়যন্ত্রের পিছনেও শকুনি ছিলেন জতুগৃহ-সংক্রান্ত কুমন্ত্রণার প্রসঙ্গে। শকুনি, দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন এই দুষ্টচতুষ্টয়ের প্রথমে যাঁর নাম করতে হয়েছে, তিনি হলেন শকুনি— ততঃ সুবলপুত্রশ্চ রাজা দুর্যোধনশ্চ হ। ..দুষ্টং মন্ত্রম্ অমন্ত্রয়ন্‌। কুমন্ত্রণা একটা নয়, অনেক। কীভাবে পাণ্ডবদের পিছনে লেগে, তাঁদের দু’-একজনকে মেরে ফেলা যায়, এই মন্ত্রণার প্রথম পুরুষই হলেন শকুনি। কৌরবের রাজসভায় কখনওই তিনি এতটা নির্লিপ্ত থাকেননি, যাতে তাঁর নাম উচ্চারিত না হয়। বস্তুত জতুগৃহের আগুন শুধু নয়, সামগ্রিক জ্ঞাতি বিরোধের আগুন যেটা ছিল, সেটা ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের মধ্যেই যথেষ্ট ছিল। শকুনি এবং কর্ণ— এই দুটি বহিরাগত শক্তি, তাঁরা এই আগুনের ইন্ধন।

দুর্যোধন যখনই পাণ্ডবদের সম্বন্ধে সন্দেহান্বিত হয়েছেন এবং সেই সন্দেহ যখনই প্রকাশ করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, তখনই আমরা লক্ষ করেছি— ধৃতরাষ্ট্রও মনে মনে ওই একই সন্দেহ পোষণ করেন। এমনকী দুর্যোধন পাণ্ডবদের কোনও ক্ষতি করতে চাইলেও ধৃতরাষ্ট্র প্রথমে ভীষ্ম, দ্রোণ কিংবা বিদুরের সমস্যা উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু তারপরেই মত দিয়েছেন পুত্রের অনুকূলে। শকুনির ভূমিকাটা অবশ্য অনেক আগে। দুর্যোধন যখন একটা কিছু করবেন বলে স্থির করেছেন, ক্ষতিসাধনের মন্ত্রণা যখন দানা বাঁধছে, ঠিক সেই অপরিপক্ক মুহুর্তে নেমে আসত শকুনির পরামর্শ। মন্ত্রণা যখনই হয়েছে, তখনই মহাভারতের কবি দুর্যোধন, দুঃশাসন-কর্ণ এবং শকুনি এই দুষ্ট-চতুষ্টয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু আমরা হলফ করে বলতে পারি পাণ্ডবদের বনবাসের আগে পর্যন্ত যতগুলি ‘প্লট’ তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে কর্ণের কোনও অবদান ছিল না। কেন, তা পরে বলব। দুঃশাসন দুর্যোধনের ঢাকের কাঠিমাত্র। অতএব দুর্যোধনের অসদিচ্ছার আগুনে হাওয়া লাগানোর লোক রইল একটিই। তিনি শকুনি।

লক্ষ করে দেখবেন— মহাভারতে বিদুর-যুধিষ্ঠিরের মতো লোকের মুখ দিয়ে শকুনির বিশেষণ হিসেবে প্রায় সবসময় একটি বিশেষণ লাগানো হয়েছে— ‘শকুনিঃ পাৰ্বতীয়ঃ’— অর্থাৎ ওই পাহাড়ি মানুষটা। আসলে শকুনি যেখানে থাকতেন, সেই গান্ধার রাজ্যটা ছিল ছোট ছোট পাহাড় আর নদীতে ভর্তি। এখানে যুদ্ধ মানেই পাহাড়ের আড়াল আর ঘন বনের আড়াল থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ। সংস্কৃতিগতভাবে গান্ধার রাজ্যে উন্নতি এক সময় অন্যান্য ছোট ছোট রাজ্যের ঈর্ষার কারণ ছিল। কিন্তু ইতিহাসের দু’-একটি বিশেষ সময় ছাড়া গান্ধার-রাজ্যের অধিবাসীদের পরিচয়ে আভিজাত্যের ছায়া ফুটে ওঠেনি কখনও। শক, কিরাত, কম্বোজ, পারদ— এইসব তথাকথিত হীন জাতির সাহচর্যে গান্ধার রাজ্যের আর্য-পুরুষেরাও চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। ফলত শকুনির পারিবারিক আভিজাত্য এবং সভ্যতার থেকেও তাঁর মধ্যে অনুস্যূত হয়েছিল পার্বতীয় স্বভাব। অর্থাৎ আক্রমণ কখনও সামনাসামনি নয়, তা করতে হবে লুকিয়ে-চুরিয়ে, চোরাগোপ্তা পথে। বিষ খাওয়ানো, অথবা বিশ্বস্ততার ভাব দেখিয়ে পুড়িয়ে মারা— এগুলি শকুনির স্বভাব। শকুনির সাফল্য— তিনি দুর্যোধনের মতো একজন মহাবীরের হৃদয়েও এই সভ্যেতর আচরণ এবং পার্বতীয় আক্রমণ-পদ্ধতি প্রবেশ করাতে পেরেছিলেন। হয়তো খুব ছোট থেকেই দুর্যোধনের সঙ্গে শকুনির অন্তরঙ্গতা ঘটে যাওয়ায় শকুনি তাঁর নিজস্ব চোরা-গোপ্তা স্বভাবটি দুর্যোধনের বীরস্বভাবকে অতিক্রম করেও তাঁর হৃদয়ে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জতুগৃহের আগুন থেকে বাঁচার পর পাণ্ডবরা মাকে নিয়ে পাঞ্চাল রাজ্যে লুকিয়ে ছিলেন। ইতিমধ্যে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর উপস্থিত হল। সেখানে কুরুরাজ্যের বড় বড় বীরদের মধ্যে আমরা শকুনিকেও দেখতে পাই। অবশ্য শুধুই শকুনি নয়, তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাইরাও ছিলেন। স্বয়ংবরে সমবেত রাজাদের নাম-কীর্তনের সময় ধৃষ্টদ্যুম্ন শকুনির সঙ্গে তাঁর আর দুই ভাইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন— শকুনিঃ সৌবলশ্চৈব বৃষকোহথ বৃহদ্‌বলঃ। যদিও মহাভারতের অন্যত্র দেখা যাবে শকুনিরা ছয় ভাই। সে যাই হোক, পরিষ্কার বোঝা যায়, শকুনিরা স্বয়ংবরসভায় মজা দেখতেই গিয়েছিলেন, স্বয়ংবরসভার মৎস্যচক্ষু ভেদ করার ব্যাপারে শকুনির কোনও উৎসাহ আমরা দেখিনি।

কৌরবরা সকলেই পাঞ্চাল রাজ্য থেকে ফিরেছিলেন খালি হাতে। স্বয়ংবরসভায় দ্রোপদী যে ব্রাহ্মণবেশীকে বরণ করেছিলেন, তাঁকে যুদ্ধে জেতা কৌরবদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু ব্রাহ্মণবেশীর সত্য পরিচয় যখন উদ্‌ঘাটিত হল, তখন কুরু-জনপদে সকলে ছি ছি করতে লাগল। জতুগৃহদাহের ভার যার ওপরে ন্যস্ত ছিল, সেই পুরোচনের ওপর যত দোষ গিয়ে পড়ল। অন্যদিকে বিদুর যথেষ্ট ব্যঙ্গোক্তি করে ধৃতরাষ্ট্রকে পাঞ্চাল-পাণ্ডবদের বৈবাহিক সংযুক্তির কথা শুনিয়ে গেলেন। পাণ্ডবদের রাজ্যপ্রদানের প্রসঙ্গও উঠে পড়ল কৌরবদের রাজবাড়িতে। বিদুরের সামনে পাণ্ডবদের প্রশংসা করে ধৃতরাষ্ট্র লোক দেখানো কিছু কথা বললেন বটে। কিন্তু সেটা তাঁর মনের কথা নয়। দুর্যোধন এবং কর্ণ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দরবার করতে এলেন। এখানে অবশ্য আমরা শকুনিকে দেখছি না। কিন্তু দুর্যোধন এখানে যা বলেছিলেন, কর্ণ তা মানেননি এবং এই বাদ-প্রতিবাদ থেকেই পরিস্কার হয়ে যাবে শকুনি এখানে সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও দুর্যোধনের বক্তব্য এবং কৌশলের মধ্যে তিনি উপস্থিত।

দুর্যোধন গুপ্তচর পাঠিয়ে পাণ্ডব-ভাইদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। অথবা চেয়েছিলেন যাতে পাঞ্চালী কৃষ্ণার বিদ্বেষ উৎপন্ন হয় পাণ্ডবদের ওপর। এইভাবে নতুন বৈবাহিক সম্বন্ধী দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে পাণ্ডবদের মতপার্থক্য তৈরি করার প্রস্তাবও ছিল দুর্যোধনের মনে। দুর্যোধন আরও চেয়েছিলে— পাণ্ডবদের নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে মাঝরাস্তায় ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে ভীমকে মারা হোক। অথবা সুন্দরী সুন্দরী বেশ্যা পাঠিয়ে পাণ্ডবভাইদের প্রলুব্ধ করা হোক। কিন্তু এইসব প্রস্তাব মহামতি কর্ণ সমর্থন করেননি।

পরিষ্কার বোঝা যায়— দুর্যোধন যা বলেছিলেন, তার প্রতিটি অক্ষর-ক্ষেপে শকুনির মানসিকতা লুকানো আছে। একমাত্র মাথা খারাপ না হলে মহাবীর দুর্যোধনের মুখ দিয়ে ওই ধরনের ইতর এবং কুচুটে প্রস্তাব বেরনোর কথা নয়। কর্ণ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন এবং ভদ্রভাবে বলেছেন— ওইসব সূক্ষ্ম উপায় অবলম্বন করে পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করার অনেক চেষ্টা তুমি করেছ— পূর্বমেব হি তে সূক্ষ্মৈরুপায়ৈর্যতিতাস্ত্বয়া। কিন্তু তুমি কিছুই করতে পারনি পাণ্ডবদের। এখানে কর্ণ ‘সূক্ষ্ম উপায়’ বলতে খুব গৌরব বোধ করছেন না। ভীমকে বিষ দেওয়া, পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা— এই উপায়গুলিকে তিনি সোজাসুজি নোংরা কিংবা কুচুটে বুদ্ধি বলে স্পষ্ট করে বলে দিতে পারেননি, কারণ এই ধরনের লুকোচুরি খেলা বা ঘুরিয়ে ক্ষতি করার বুদ্ধি প্রধানত শকুনির কাছ থেকেই আসত। কর্ণ সোজাসুজি প্রত্যাঘাত করায় বিশ্বাসী। তিনি চান পাণ্ডবরা দ্রুপদ-পাঞ্চালদের সংসর্গে মহাবলী হয়ে ওঠার আগেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হোক।

কর্ণ দুর্যোধনকে বলেছিলেন— পাণ্ডবদের যখন পাখা গজায়নি, সেইরকম শিশু অবস্থা থেকে তুমি নানা উপায়ে তাদের মারার চেষ্টা করেছ, কিন্তু জেনে রেখো, আমার বদ্ধমূল ধারণা— ওইসব ক্ষুদ্র উপায়ে তাদের তুমি কিছুই করতে পারবে না— নোপায়সাধ্যাঃ কৌন্তেয়া মমৈষা মতিরচ্যুতা। কর্ণের তীক্ষ্ণ ভাষা থেকেই বোঝা যায়— ওইসব ক্ষুদ্র কৌশল তাঁর পছন্দও হয়নি। আমরা ধরে নিতে পারি, দুর্যোধনও নয়, এই ক্ষুদ্র কৌশলগুলি সবই ছিল শকুনির মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু এতাবৎ পর্যন্ত তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। এরপরে যখন পাণ্ডবদের রাজ্যভাগ দেওয়ার প্রসঙ্গ খুব জোরদারভাবে কৌরবসভায় আলোচিত হতে থাকল, তখন বিদুর অবশ্য সামগ্রিকভাবে দুর্যোধন-কর্ণের সঙ্গেই ধৃতরাষ্ট্রের কাছে নাম উচ্চারণ করলেন শকুনির— দুর্যোধনশ্চ কর্ণশ্চ শকুনিশ্চাপি সৌবলঃ। বললেন— এদের কোনও নীতিবোধ নেই মহারাজ! এদের বুদ্ধি বালকের মতো। এদের কথা শুনবেন না মহারাজ।

॥ ২ ॥

শকুনির দুর্বুদ্ধি খুব একটা কাজে লাগল না। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের রাজ্য দিতে বাধ্য হলেন, যদিও সে রাজ্য পাণ্ডবদের তৈরি করে নিতে হল খাণ্ডবপ্রস্থে। খাণ্ডববন দহন করে নতুন রাজ্যের পত্তন করলেন অর্জুন। রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দিলেন ময়দানব, তখনকার দিনের সবচেয়ে বড় বাস্তুশিল্পী। এইসব সময় শকুনির কুবুদ্ধির মন্ত্রণা এতটুকু কমে গেল বলে মনে করার কারণ নেই। তবে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুর্যোধন প্রস্তাব রাখার সময় কর্ণের যুক্তিতে যেভাবে প্রতিহত হয়েছিলেন, তাতে বোঝা যায়, শকুনি কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কুবুদ্ধি মোটেই প্রতিহত হয়নি। শকুনি কেমন ঠান্ডামাথায় দুর্যোধনের অন্তরে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে ঈর্ষা-অসূয়া জাগিয়ে তুলেছিলেন, তা খুব ভাল করে টের পাওয়া যাবে পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে।

রাজসূয় যজ্ঞে শকুনির ভূমিকা খুব নিস্তরঙ্গ। পাণ্ডবদের তখন বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। ভীম-অর্জুন নানা দেশে যুদ্ধ জয় করে ধনৈশ্বর্য নিয়ে এসেছেন। হাতি-ঘোড়া-রথ আর সমাগত রাজা-রাজড়াদের উপহারে যুধিষ্ঠিরের রাজসভা ভরে গেছে। আর সবার ওপরে ময়দানবের বানানো ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়ির নির্মাণ-নৈপুণ্য হস্তিনাপুরের পুরাতন ঐতিহ্যময় রাজবাড়িটিকে ম্লান করে দিয়ে পাণ্ডব-ভাইদের নির্মল যশের মতোই বর্ণনার অতীত হয়ে উঠেছিল।

পুরাতন রাজবাড়ি থেকে ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরের মতো কুরু-প্রবীণদের সঙ্গে দুর্যোধন-দুঃশাসনের মতো নবীনরাও যেমন ইন্দ্রপ্রস্থে নিমন্ত্রণ লাভ করেছিলেন, তেমনই গান্ধাররাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে শকুনি এবং তাঁর ভাইদের সঙ্গে অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি কর্ণও নিমন্ত্রণ লাভ করেছিলেন। যুধিষ্ঠির সকলকে কাজকর্ম ভাগ করে দিয়েছিলেন। দুর্যোধনকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন আগন্তুক করদ রাজাদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করে জমিয়ে রাখার জন্য। আপনাদের খেয়াল থাকতে পারে— বিবাহ-বাসরে বধূর হাতে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা একেক করে উপহার তুলে দেন; সেই উপহারগুলি একত্র সাবধানে জমিয়ে রাখে অন্তরঙ্গা অন্য কোনও যুবতী। অন্যের জন্য নিশ্চিত মহামূল্য বিচিত্র উপহারগুলি জমিয়ে রাখতে রাখতে অন্যতরা যুবতীর মন কোনও কারণে বিষন্ন হয়ে ওঠে কি না, সে খবর আমরা নিই না বটে, তবে বিষণ্ণতা ছাড়াও পরের পর উপহার গ্রহণের কিছু ক্লান্তি নিশ্চয়ই আছে এবং সেই ক্লান্তির মধ্যে আর যাই থাকুক নির্বিণ্ণতা থাকে না। দুর্যোধনের ক্ষেত্রে নির্বিণ্ণতা তো নয়ই, বিষণ্ণতাও নয়, রাজার জন্য আনা বহুমূল্য উপহার দেখে দেখে তাঁর মনে যুধিষ্ঠির এবং পাণ্ডবভাইদের ওপর চরম ঈর্ষা জেগে উঠল।

রাজসূয় যজ্ঞের শেষে সমাগত অতিথিরা সকলেই একে একে চলে গেলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, দুঃশাসন সবাই চলে গেলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে থেকে গেলেন শুধু দুটি লোক— দুর্যোধন ও শকুনি। হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির একটা মানমর্যাদা আছে। সমাগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজাদের সামনে দুর্যোধন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়ির নির্মাণ-কৌশল ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে দেখতে পারেন না। লোকে গ্রাম্য ভাববে। ভাববে, কোনওদিন এমন দেখেনি, তাই আদেখ্‌লের মতো দেখছে। কিন্তু সবাই যখন চলে গেল, তখন দুর্যোধন মামা শকুনিকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপ্রাসাদ দেখতে বেরুলেন— শনৈর্দদর্শ তাং সর্বাং সভাং শকুনিনা সহ।

ইন্দ্রপ্রস্থের স্ফটিকগৃহ দুর্যোধনের জন্য অনেক অপমান জমিয়ে রেখেছিল, কিন্তু সে সবের চেয়েও রাজবাড়ির চরম ঐশ্বর্য দুর্যোধনকে চরম বিষন্ন, চরম ঈর্ষাকাতর করে তুলল। কোনও কিছুতে দুর্যোধনের মন নেই। রাজসভায় চলার পথে কতবার শকুনি তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দুর্যোধন কোনও জবাব দিলেন না— নাভ্যভাষৎ সুবলজং ভাষমানং পুনঃপুনঃ। আমরা জানি— শকুনি বারবার কেন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। যেন ভীষণ ‘স্মার্ট’, এরকম সভা যেন অনেক দেখেছি— এমনই একটা হালকা চাল বজায় রেখে খোশগল্প করতে করতে সভাগৃহের মাঝখান দিয়ে সহজভাবে এগিয়ে যেতে চান শকুনি। তাঁর মনের ভাব মুখে প্রকাশ পায় না। কিন্তু দুর্যোধন! তাঁর মুখ-চোখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। একদিকে যাওয়ার কথা ভাবছেন, কিন্তু যাচ্ছেন অন্যদিকে। তাঁর মনের মধ্যে ভেসে উঠছে শুধু যুধিষ্ঠিরের বিপুল ঐশ্বর্য।

পার্বতীয় শকুনি, যার বিকার বলতে কিচ্ছুটি নেই, তিনিও আর থাকতে পারলেন না। বললেন— হচ্ছেটা কী দুর্যোধন? বিনা কারণে এমন দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে কোথায় চলেছ তুমি— দুর্যোধন কুতোহমূলং নিঃশ্বসন্নিব গচ্ছসি? দুর্যোধন এবার উত্তর দিলেন। দুঃখ, ঈর্ষা, মাৎসর্য, ক্রোধ— সব একসঙ্গে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। একে একে মনের কথা সব বললেন শকুনিকে। বললেন— পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে— অমর্ষেণ তু সম্পূর্ণো দহ্যমানো দিবানিশম্। এসব দেখার চেয়ে আমার বিষ খেয়ে মরাও ভাল অথবা আমার উচিত আগুনে পুড়ে মরা।

দুর্যোধনের উদ্বেল হৃদয় থেকে অবিরাম ক্রোধোদগার পাণ্ডব-সভায় দাঁড়ানো শকুনিকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। আগ্নেয়গিরির গহ্বর থেকে উঠে আসা গলন্ত লাভার স্রোতের মতো বইতে লাগল দুর্যোধনের ক্ষোভ, শোক, অভিমান। একসময় তাঁর ক্রোধ পরিণত হল আত্মধিক্কারে। মনে মনে চলল অনুসন্ধান, আর আক্ষেপোক্তি— সবই কপাল, মামা! সবই কপাল। পৌরুষ দিয়ে কিছুই হয় না। নইলে দেখো, পাণ্ডবদের মেরে ফেলার চেষ্টা আমি তো কম করিনি— কৃতো যত্নো ময়া পূর্বং বিনাশে তস্য সৌবল। কিন্তু মজা দেখো— পুকুরের সমস্ত পাঁক ম্লান করে দিয়ে যেমন সুন্দর পদ্ম ফুলটি ফুটে ওঠে, তেমনই আমার ছল, কপট, প্রতারণা— সব অতিক্রম করে যুধিষ্ঠির যেন পদ্মফুলটির মতো ভেসে উঠেছেন ইন্দ্রপ্রস্থের সরোবরে— তচ্চ সর্বমতিক্রম্য সমৃদ্ধোহপ্সু ইব পঙ্কজম্‌। দুর্যোধন শেষপর্যন্ত মামা শকুনিকে অনুনয় করে বললেন— তুমি আমার এই ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ মনের অবস্থাটা পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে একটু জানাবে?

শকুনি দুর্যোধনের কথার জবাবে যে উত্তরটা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে তাঁর চরম খল স্বভাব, চরম বুদ্ধি এবং চরম কৌশল লক্ষ করা যায়। তাঁর কথার সমস্ত ব্যঞ্জনাটাই বিপরীতার্থক, প্রশংসার ছলে দুর্যোধনের অন্তর্দাহ আরও বাড়িয়ে তোলা। শকুনি বললেন— যুধিষ্ঠিরের ওপর এত রাগ দেখানোর কোনও কারণ নেই তোমার। তাদের কপালে তারা করে খাচ্ছে, তাতে তোমার কী? কম চেষ্টা তো করা হয়নি। কত কৌশল, কত চেষ্টা করেও ওদের ফাঁদে ফেলা যায়নি, কপালের জোরে ঠিক ওরা বেরিয়ে গেছে— বিমুক্তাশ্চ নরব্যাঘ্রা ভাগধেয়-পুরষ্কৃতাঃ।

শকুনি এইটুকু বলেও থামতে পারতেন। পাণ্ডবদের ভাগ্য সম্বন্ধে তাঁর যদি এতই জ্ঞানোদয় হয়ে থাকে, তবে সেই পরম বাস্তবই তাঁর মেনে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাণ্ডবদের তথাকথিত সৌভাগ্য-বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে শকুনি সুকৌশলে দুর্যোধনের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছেন।

এতক্ষণ ধরে দুর্যোধনের ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতা সম্পূর্ণ চেতিয়ে তুলেছেন তিনি। এখন তাঁকে নিজের পথে আনা দরকার। দুর্যোধন একটু আগেই একবার অভিমান করে শকুনিকে বলেছিলেন— আমার মরাই উচিত। এ দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। আমি একা। এবং একা একা আমার পক্ষে যুধিষ্ঠিরের এই বিশাল রাজ্য-সম্পদ অধিকার করা সম্ভব নয়। আমার সহায় বলতে কেউ নেই, তাই বলছি— আমার মরাই ভাল— সহায়াংশ্চ ন পশ্যামি তেন মৃত্যু বিচিন্তয়ে।

দুর্যোধনের কথার এই সূত্র ধরেই শকুনি বললেন— যুধিষ্ঠিরের ওপর অনর্থক রাগ করে কী লাভ হবে, ভাগনে! ওদের কপাল, ওরা ভোগ করছে। তুমি তো আর চেষ্টার ত্রুটি রাখনি। কত রকমভাবে পাণ্ডবদের তুমি হেনস্থা করার চেষ্টা করেছ— তথাভ্যুপায়ৈর্বহুভিঃ ত্বয়ারব্ধাঃ পুরাসকৃৎ। কিন্তু কপাল, কপাল ওদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। তারপর দেখো, দ্রৌপদী! তিন ভবনের সেরা সুন্দরী। তাকেও ওরাই পেল। মাঝখান দিয়ে লাভ হল— দ্রুপদ রাজার মতো একটা বড় সহায় ওদের জুটে গেল শুধু বৈবাহিক সূত্রে। তাদের সঙ্গে আবার কৃষ্ণের মতো ধুরন্ধর এক মানুষ। তুমি কোন দিকে যাবে? অবশ্য পাণ্ডবরা তো আর তোমার কোনও ক্ষতি করেনি। তারা তোমার রাজ্যে ভাগও বসায়নি, হস্তিনাপুরও গ্রাস করেনি। বাপের সম্পত্তির একটা অংশ মানুষ পায়ই, তাইই ওরা পেয়েছে— লব্ধশ্চানভিভূতার্থৈঃ পিত্র্যোংহশঃ পৃথিবীপতে। তবে হ্যাঁ, নিজের রাজ্যটাকে তারা নিজের শক্তিতে বাড়িয়েছে, সমস্ত রাজারা এখন যুধিষ্ঠিরের হাতের মুঠোয়— কৃতা বশে মহীপালাঃ। আর আছে ময়দানবের তৈরি ওই রাজসভা! তা এই নিয়ে তো তোমার কেঁদে মরবার কিছু নেই— বিবৃদ্ধস্তেজসা তেষাং তত্র কা পরিবেদনা!

মাতুলের কথাগুলি শুনলে মনে হবে— কী সুন্দর নিরপেক্ষ বক্তব্য। এর মধ্যে যেন কোনও কুটিলতা নেই, কোনও অসূয়া নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন— অসূয়াপরায়ণ ব্যক্তি যার ওপর রাগ করছে, সেই শত্রুপক্ষের প্রশংসা করা মানে তার রাগ আরও চেতিয়ে তোলা। শকুনির কথার মধ্যে কোনও শুদ্ধ অভিসন্ধি নেই। তিনি দুর্যোধনের অসূয়া এবং পরশ্রীকাতরতার ক্ষতস্থানে কন্ডূয়ন করছেন আস্তে আস্তে। শকুনি বললেন— তুমিই বা নিজেকে এত অসহায় ভাবছ কেন? দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, কর্ণ, কৃপাচার্য— এঁরা সবাই তোমার সহায়। এঁরা সহায় থাকতে পৃথিবী জয় করতেই বা তোমার ভাবনা কোথায়?

কে না বুঝবে— শকুনির এ কথাটাও সরল নয়। কারণ দুর্যোধন সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন— তা হলে এঁদের সবাইকে সহায় করে আমি পাণ্ডবদেরই জয় করার চেষ্টা করি? তুমি বলো মাতুল— ঠিক বলছি না? শকুনি বললেন— অত সহজ নয়, ভাগনে! পাণ্ডবরা পাঁচ ভাই— প্রত্যেকেই মহাধনুর্ধর। তাঁদের সঙ্গে দ্রুপদ। তার ওপরে বাসুদেব কৃষ্ণ। অত সহজ নয়, ভাগনে! স্বর্গের দেবতারাও ওঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভয় পাবেন। তার চেয়ে আমি একটা উপায় বলি শোন। যে উপায়ে স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকে জিতে নেওয়া যায়, সেটাই তোমায় বলছি শোন। আমাদের এই চেষ্টাই করতে হবে— যুধিষ্ঠিরং স্বয়ং রাজন্‌ তন্নিবোধ জুষস্ব চ। দুর্যোধন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে বললেন— আমাদের আত্মীয়-বন্ধুদের যাতে বিপদ না হয়, সেই দিকটা ভেবে আমাকে শুধু বলো— কীভাবে পাণ্ডবদের আমি জয় করতে পারি?

শকুনি এতক্ষণ ধরে পাণ্ডবদের অনর্থক স্তুতি করে যে কূট-কৌশলের ফাঁদ পেতেছিলেন, দুর্যোধন এতক্ষণে তাতে পা দিলেন। বীরত্ব নয়, ক্ষাত্রতেজ নয়, রাজনৈতিক কৌশল নয়, একেবারে আদিম এক কৌশল। শকুনি বললেন— দুর্যোধন! যুধিষ্ঠির বড় পাশা খেলতে ভালবাসে কিন্তু পাশাখেলার কৌশল সে জানে না— দ্যূতপ্রিয়শ্চ কৌন্তেয়া ন স জানাতি দেবিতুম্‌। তাকে যদি পাশা খেলতে ডাকা যায়, তবে সে না এসে পারবে না। তাকে আসতেই হবে। অন্য দিকে আমার দিকে তাকাও। আমি পাশাখেলাটা এতটাই ভাল জানি যে, এই তিন ভুবনে এমন কেউ নেই যে পাশাখেলায় আমাকে হারাবে— দেবনে কুশলশ্চাহং ন মেহস্তি সদৃশো ভুবি। অতএব যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলার নিমন্ত্রণ কর— তার রাজ্যপাট, রাজলক্ষ্মী সব তোমায় জিতে এনে দেব। তুমি শুধু তোমার বাবা ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করাও। তার পরে সব ভার আমার।

শকুনি যে বুদ্ধিতে পাশা খেলেন, তাতে প্রতিপক্ষের মনস্তত্ত্ব জানাটা সবচেয়ে জরুরি। সেই মনস্তত্ত্ব শকুনি এতটাই জানেন যাতে যুধিষ্ঠিরকে পড়ে ফেলতে তাঁর এতটুকু অসুবিধে হয়নি। তিনি তাঁর সমাজবোধে প্রথমত জানেন যে, পাশাখেলা বা যুদ্ধে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানালে ক্ষত্রিয়েরা সবসময় সাড়া দেন— আহুতশ্চৈষ্যতি ব্যক্তং দ্যূতাদপি রণাদপি। সেখানে যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে ভালবাসেন, তিনি আসবেনই এবং যেহেতু তিনি পাশাখেলাটা ভাল জানেন না, অতএব খেলতে এসে হারবেন। আর উলটো দিকে শকুনি বলেছেন— আমি যে দান ফেলব, তার জয়-পরাজয়ের ক্ষমতাটা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি এবং সেই বুঝেই ডাক দিতে পারি সঙ্গে সঙ্গে— হৃদয়জ্ঞঃ পণজ্ঞশ্চ বিশেষজ্ঞশ্চ দেবনে। অর্থাৎ অক্ষের চাল বুঝেই তিনি জেতার জন্য প্রয়োজনীয় ডাকটি দিতে পারেন এবং পাশাখেলার চরম সমস্যার সময়ে তিনি তাঁর বিশেষ দ্যূত-জ্ঞানও প্রয়োগ করতে পারেন। এইজন্যই তিনি বিশেষজ্ঞ। শকুনি নিজের মুখে নিজের গুণ প্রকট করে দুর্যোধনকে বললেন ধৃতরাষ্ট্রকে সব জানাতে। দুর্যোধন বীর। তিনি কী করে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এই প্রস্তাব করবেন। কিন্তু ঈর্ষা, অসূয়া আর পরশ্রীকাতরতা তাঁকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, ছলে-কৌশলে যেভাবে হোক যুধিষ্ঠিরের রাজ্য আর ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভাটা তাঁর চাই-ই চাই। দুর্যোধন শকুনিকে বললেন— তুমিই পিতাকে রাজি করাও। আমি পারব না। শকুনি তাতেও রাজি হলেন| গান্ধারের পার্বত্য অঞ্চলে শত্ৰুহত্যা করতে হলে যেমন পাহাড়ের আড়ালে প্রচ্ছন্ন থেকে অস্ত্র হানতে হয়, তেমনই শক্ৰহননের জন্য শকুনি দুর্যোধনের আড়ালে দাঁড়ালেন।

বলতে পারেন— হস্তিনাপুরের রাজদরবারে শকুনি তো পানে-ভোজনে, দানে-মানে ভালই ছিলেন। কী তার এত প্রয়োজন— পাণ্ডবদের সর্বনাশ করার। পাণ্ডবরা অন্তত শকুনির পাকা ধানে কেউ তো মই দিচ্ছিলেন না। কথাটা ভাববার মতো। এক হতে পারে— ভাগনে দুর্যোধনকে তিনি সত্যিই বড় ভালবাসতেন। রাজবাড়িতে থেকে, রাজার শ্যালকের মতো শুধু শুয়েবসে দিন কাটাতে রাজি নন তিনি। শকুনি নিজেকে কাজে লাগাতে চান দুর্যোধনের স্বার্থে এবং তা এমনভাবেই, যাতে শত শত পরাশ্রয়ী রাজশ্যালকের জঘন্য চরিত্র থেকে তিনি পৃথক মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, খলের স্বভাব। সংস্কৃতের শাস্ত্রে তথা সাহিত্যে খলের প্রকৃতি হল— বিনা কারণে, বিনা প্ররোচনায় পরের ক্ষতি করে আনন্দ পাওয়া। স্বার্থ নয়, নিজের কোনও উন্নতি নয়, নিজের কোনও ভোগ নয়, শুধু পরের ক্ষতি করার মধ্যে অনাবিল এক আনন্দ খুঁজে পায় খলস্বভাব মানুষ। এরকম মানুষ সমস্তকালে, সমস্ত সমাজেই আছে, শকুনি তাদের পুরাতন প্রতিনিধিমাত্র।

যাই হোক শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পৌঁছলেন প্রস্তাব পেশ করার জন্য। অপরের মনস্তত্ত্ব বুঝে কথা বলা, কিংবা কাজ করার মধ্যে যদি কোনও শিল্প থাকে, তবে শকুনি মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। হৃদয়ের কোন কোমল তন্তুতে ঘা দিলে পরে মস্তিস্কের মধ্যে তার ঝটিতি প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে, সেটা শকুনি খুব ভাল করেই জানেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে শকুনি বললেন— ছেলেটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, মহারাজ! চিন্তায় চিন্তায় ছেলেটা একেবারে রোগা হয়ে গেছে। গায়ের রং হয়েছে মলিন, পাণ্ডুর— দুর্যোধনো মহারাজ বিবর্ণো হরিণঃ কৃশঃ। বংশের বড় ছেলে বলে কথা। শত্রুদের জ্বালায় তার দুঃখ-কষ্ট অসহ্য হয়ে গেছে, আপনি সেটা একটু ভাল করে তলিয়ে দেখুন।

ব্যাস্‌। এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। শকুনি খেই ধরিয়ে দিতেই ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে দুর্যোধনের খবর নিতে আরম্ভ করলেন। দুর্যোধন একে একে সব কথা জানালেন পিতাকে। যুধিষ্ঠিরের রাজ-ঐশ্বর্য, ময়দানবের তৈরি স্ফটিক-সভা, রাজসূয় যজ্ঞের ঘটা— সব একেবারে অনুপুঙ্খভাবে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ব্যক্ত করলেন। আর তাঁর সর্বশেষ প্রস্তাব হল— যুধিষ্ঠিরের এই ঐশ্বর্য আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। মামা শকুনি বলেছেন— তিনি পাশা খেলে পাণ্ডবদের এই সমৃদ্ধি হরণ করবেন,— অয়মুৎসহতে রাজন্‌ শ্রিয়মাহর্তুমক্ষবিৎ— এবং আমার সমৃদ্ধি এনে দেবেন। শকুনির বক্তব্য এইভাবে জানানোর মধ্যে, এই বলার মধ্যে কতটা পরিকল্পনা ছিল, কতটা প্রত্যয় ছিল, তা দুর্যোধনই জানতেন সবচেয়ে ভাল করে। শকুনি দুর্যোধনকে বলেছিলেন— তুমি একবার শুধু ডেকে আন যুধিষ্ঠিরকে, তারপর দেখবে যুদ্ধ কাকে বলে, আর বিজয় কাকে বলে। কোনও সৈন্য-সামন্তের সামনে না দাঁড়িয়েও এমন প্রত্যয়ের সঙ্গে আমি যুদ্ধ করব— যাতে আমার শরীরে একটি ক্ষতের দাগও থাকবে না, অথচ যুদ্ধটা আমি ঠিক জিতে যাব— অগত্বা সংশয়মহমযুদ্ধা চ চমূমুখে— শুধু পাশার দান ফেলব আর জিতব। এই অদ্ভুত যুদ্ধে আমি যে পণ ডাকব, সেটাই আমার ধনুক, আমি যে ঘুঁটি চালাব, সেগুলোই আমার বাণ। এই ধনুকের ছিলা হল আমার পাশার চাল, আর ওই চাল যেখানে ফেলব, সেটাই আমার রথ— অক্ষাণাং হৃদয়ং মে জ্যাং রথং বিদ্ধি সমাস্ফুরম্‌। অনেকে ভাবেন— শকুনির পাশার হৃদয়েই গণ্ডগোল, তার মধ্যে হয় তার বাপের অস্থি, অথবা গুবরে পোকা, অথবা অন্য কিছু। কিন্তু শকুনি বলেছেন— আমার অক্ষের হৃদয় হল ধনুকের ছিলা। ধনুকের ছিলার টানের ওপরেই যেমন বাণের তীব্রতা, ক্ষিপ্রতা এমনকী মন্দতাও নির্ভর করে, তেমনই পাশার চালের ওপরেই একজন ভাল পাশাড়ের জয়-পরাজয় নির্ভর করে। শকুনি এই পাশার চাল দেওয়াটা এতই ভাল জানেন, এমনকী এটাও হতে পারে যে এই চালের মধ্যে তাঁর কৌশল এবং কপটতা এমন করেই মিশে ছিল, যা অন্যের পক্ষে ধরা সম্ভব ছিল না, সরল-হৃদয় যুধিষ্ঠিরের পক্ষে তো নয়ই।

যাই হোক, ধৃতরাষ্ট্র এত সহজে কথা দিতে পারলেন না। এত বড় একটা ব্যাপার! পাণ্ডবরা তাঁর আপন ভ্রাতুষ্পুত্র! তাঁদের রাজ্য হরণ করা হবে, তাও যুদ্ধ করে নয়, ক্ষাত্রতেজে নয়, পাশা খেলার কৌশলে। ধৃতরাষ্ট্র এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। তিনি বললেন— ঠিক আছে, মহামতি বিদুরের সঙ্গে একটু আলোচনা করে দেখি, তারপর বলব। দুর্যোধন সাভিমানে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন— আপনি ওই বিদুরকে নিয়েই থাকুন। আমি মরি, তারপর আমার মরা মুখ দেখে আপনি বিদুরকে নিয়ে সুখে কাল কাটান— স ত্বং ময়ি মৃতে রাজন্ বিদুরেণ সুখী ভব।

একবার নয়, অন্তত দু’বার ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদুরের আলোচনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে এই দুরাগ্রহ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের কথা ভেবে পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করতে বলেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের আহ্বান জানানোর জন্য স্বয়ং বিদুরই প্রেরিত হয়েছেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। বিদুর এসে যুধিষ্ঠিরের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের নিমন্ত্রণ ব্যাখ্যা করেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের ভাষার মধ্যে ফাঁকি ছিল। তিনি বলেছিলেন— বাছারা সব! হস্তিনাপুরে এসো। পাশাখেলা হবে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে, খুব মজা হবে— সুহৃদ্‌-দ্যূতং ক্রিয়তাং রম্যতাঞ্চ। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের ফাঁকি যুধিষ্ঠিরকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন— যে সমস্ত জুয়াড়ি পাশাখেলার জন্য বসে আছে রাজসভায়, সেই সব ধূর্তদের তুমি গিয়ে দেখতেই পাবে। যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করেছিলেন— কারা সেই জুয়াড়িরা? বিদুর বলেছিলেন— গান্ধাররাজ শকুনিই প্রথম। তিনি অক্ষনিপুণ, শিক্ষিতহস্ত এবং পাশা খেলতে তিনি ভালবাসেন।

বিদুর আরও কয়েকটা নাম করেছিলেন এবং যুধিষ্ঠির শুনে বুঝেছিলেন যে, খেলাটা অত সহজ হবে না। তাঁর নিজের ভাষায়— এরা ভয়ংকর ধূর্ত এবং ছলপরায়ণ দ্যূতকর অর্থাৎ জুয়াড়ি— মহাভয়াঃ কিতবাঃ সন্নিবিষ্টা মায়োপধা দেবিতারোহত্ৰসন্তি। এঁদের মধ্যে শকুনিই প্রধান। যুধিষ্ঠির বিদুরকে বলেছিলেন— শকুনির সঙ্গে আমি খেলতেও চাই না, আর ধৃতরাষ্ট্র না ডাকলে আমার খেলার প্রশ্নও নেই, কিন্তু কখনও-সখনও জেতার জন্যই তো সভায় ডাকা হচ্ছে সবার সামনে। আর ডাকা যখন হচ্ছে, তখন যে পরিণতিই হোক, আমি যাব, নইলে লোকে তো আমাকে কৃপণ ভাববে। অতএব যুধিষ্ঠির রাজি হলেন দ্যূত-সভায় যেতে, কারণ এটা ধৃতরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ এবং একজন রাজাকে যদি সুহৃদ্‌-দ্যুতের আমন্ত্রণ জানানো যায়, তবে রাজধর্মের সাধারণ নিয়মে ‘না’ বলা যায় না। যুধিষ্ঠির বিদুরের অনিচ্ছা জেনেও রাজি হলেন নিজের ইচ্ছেতে।

হস্তিনাপুরের রাজসভায় ঢুকে যুধিষ্ঠির দেখলেন— রমরমা ব্যবস্থা। পাকা জুয়াড়িরা সব বসে আছে চারদিকে, কুরুসভার সভ্যরা একদিকে বসে আছেন, মাতুল শকুনি, তিনি পাশা নিয়ে প্রস্তুত। যুধিষ্ঠিরকে দেখেই শকুনি বলে উঠলেন— সভা প্রস্তুত, সমবেত সভ্যেরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। অতএব আরম্ভ করা যাক। যুধিষ্ঠির শকুনিকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়েছেন। শকুনিকে তিনি বললেন— মাতুল! পাশাখেলায় অনেক ছল আছে— নিকৃতির্দেবনং পাপং— এর মধ্যে ক্ষত্রিয়ের তেজ দেখানোর মতোও কিছু নেই, সুনীতির তো প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া পাশা খেলার মধ্যে যে শঠতা আছে, ভদ্রলোকেরা তার প্রশংসাও করেন না। কাজেই, মাতুল! আপনি নৃশংসের মতো অন্যায়ভাবে আমাদের জয় করার চেষ্টা করবেন না— শকুনে মৈব নো জৈষীরমার্গেণ নৃশংসবৎ।

শকুনি বললেন— পাশাখেলায় যে দান পড়বে তা আগেই যিনি বুঝতে পারেন,— যো বেত্তি সংখ্যাং নিকৃতো বিধিজ্ঞঃ— পাশায় যদি শঠতা হয়েও যায়, তবে সেটা যিনি প্রতিকার করতে পারেন এবং দান ফেলার ব্যাপারে যে কুশলী, সে পরের শঠতা সহ্যও করতে পারবে। সত্যি কথা বলতে কী, পাকা জুয়াড়ির পাশাখেলার ক্ষমতাই অন্যপক্ষকে পরাজিত করে, অন্য কিছু নয়।

॥ ৩ ॥

যুধিষ্ঠির আর শকুনির কথাটা যে জায়গায় এসে দাঁড়াল, তাতে শকুনির পাশাখেলার কায়দা সম্বন্ধে দু’-চার কথা না বললেই নয়, কারণ এই কায়দা যুধিষ্ঠির জানতেন না। প্রথমেই বলি অক্ষক্রীড়া বা দ্যূতক্রীড়া— এই শব্দগুলো যতই গালভরা হোক না কেন, এগুলো জুয়াখেলার ভদ্র নাম। বাস্তবিকপক্ষে এই খেলা কীভাবে খেলতে হত— মহাভারত থেকে তা পরিষ্কার হয় না; অন্য দিকে সেটা না বুঝলে শকুনির পাশাখেলার ক্ষমতাও পরিমাপ করা যাবে না।

মনে রাখতে হবে— বৈদিক যুগে পাশার ঘুঁটি বানানো হত বিভীতকের ফল দিয়ে। বিভীতক এক ধরনের গাছ যার বাংলা নাম বহেড়া বা বয়ড়া— ত্রিফলার এক ফল— আমলকী, হরিতকি, বয়ড়া। এই ফলের কোনও দিকই সমান নয় বলে এর একেক দিকে যে একেকটি সংখ্যা লেখা থাকবে তাও সম্ভব নয়। পণ্ডিতেরা তাই সন্দেহ করেন যে, বিভীতকের খেলা হল আসলে জোড়-বিজোড়ের খেলা। মহাভারতের আমলে এই খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন এসেছে এবং তা বুঝতে হলে আগে দুটি শব্দ ভাল করে জানতে হবে। এই শব্দদুটি হল— দুরোদর এবং গ্লহ। পরবর্তী কবিরা ‘দুরোদর’ শব্দটিকে পাশাখেলা অক্ষক্রীড়ার পর্যায় শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যেমন মহাকবি ভারবির লেখায়— দুয়োদর-ছদ্মজিতাং সমীহতে। এখনকার পণ্ডিতেরা বলেন— দুরোদর শব্দের অর্থ হল— জুয়াড়ির যতগুলি ঘুঁটি আছে, তার সমূহসংখ্যাটি। এই ঘুঁটিগুলি একটি পাত্রে রাখা হত, যার নাম ‘অক্ষাবাপন’। আর দান ফেলবার আগে জুয়াড়ি যে ডাকটি দিত, তার নাম ‘গ্লহ’, যা পরবর্তী সংস্কৃতে ‘গ্রহ’। শকুনি যুধিষ্ঠিরকে এই ডাকের কথাই বলেছেন— পাশাখেলায় নিপুণ ডাকের ক্ষমতাই অন্যকে পরাজিত করে, আর কিছু নয়— অক্ষগ্রহঃ সোহভিভবেৎ পরং নঃ।

মোটামুটি যা বোঝা যায়, তাতে খেলাটি দাঁড়াত এইরকম। একজন হাঁক দিয়ে তার ‘গ্রহ’টি বলল, তারপর ‘অক্ষাবাপন’ থেকে ঘুঁটি নিয়ে ‘অধিদেবন’ বা ‘ইরিণ’— অর্থাৎ দান ফেলার জায়গায়, অর্থাৎ একটুকরো কাপড়ের ওপর বা মাটিতেই দান ফেলল। তারপর পূর্বের ‘গ্রহ’ বা ডাক অনুযায়ী সে যদি জোড়-দান ডেকে থাকে এবং সেই জোড়-দানই যদি পড়ে, তবে সে জিতল। না জিতলে প্রতিপক্ষের পালা। ঋগ্‌বেদের অক্ষসূক্তে ‘ত্রিপঞ্চাশৎ’মানে, তিপান্নটা ঘুঁটি নিয়ে পাশাখেলার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ‘ত্রিপঞ্চাশৎ’ মানে তিপান্ন— এটা সায়নাচার্যের অর্থ। আধুনিক পণ্ডিতেরা বলেন— ‘ত্রিপঞ্চাশৎ’ মানে অন্তত তিন-পঞ্চাশং— দেড়শোখানা ঘুঁটি। তাঁদের বক্তব্য, রাজসূয় যজ্ঞে, সবার ওপরে হাজারটা সবার নীচে অন্তত একশোটা ঘুঁটি নিয়ে পাশাখেলা হত, অগ্ন্যাধেয় যাগেও কমসে কম একশোখানা ঘুঁটি লাগত। মোট কথা, এই ধরনের পাশাখেলায় ঘুঁটি যে প্রচুর লাগত, তার প্রমাণ অন্যত্রও আছে। মহাভারতে বিদুর যখন ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে যুধিষ্ঠিরকে পাশাখেলার জন্যে ডাকতে গেছেন তখন বিদুর বললেন ধৃতরাষ্ট্র গাদা গাদা ঘুঁটি সাজিয়ে বসে আছেন তোমার জন্য— দুরোদরা বিহিতা যে তু রাজন্‌ মহাত্মনা ধৃতরাষ্ট্রেণ রাজ্ঞা।

এই শ্লোকে নীলকণ্ঠ ‘দুরোদরাঃ’ মানে করেছেন পাশা-খেলোয়াড়েরা— দ্যূতকরাঃ। আপাতদৃষ্টিতে এই অর্থ এমন কিছু ভুল নয়, দুরোদর মানে পাশাড়ে হতেই পারে। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতেরা বলেন, নীলকণ্ঠ ভুল করেছেন। কোষকারেরা বলেছেন, ‘দুরোদর’ শব্দটি যখন পুংলিঙ্গ হবে, তখন মনে হবে দ্যূতকর, নীলকণ্ঠও সরল বিশ্বাসে সেই মানে ধরেছেন। কিন্তু কোষকার অমর কিংবা নীলকণ্ঠের সময়ে ‘দুরোদর’ শব্দটির আসল অর্থ হারিয়ে গেছে— ‘দুরোদর’, মানে আসলে সেই বহুসংখ্যক ঘুঁটির সংখ্যা। এই কথাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে মহাভারতের বিরাট পুরুষ কৃষ্ণের কথা থেকে— তিনি পাণ্ডবদের বনবাসে দুঃখ করে বলেছেন— ইস্‌, আমি যদি অনাহূত হয়েও কৌরবদের সভায় যেতাম, তা হলে এই অন্যায়টি হতে পারত না। যদি ভাল কথায় কাজ না হত— ন চেৎ স মম রাজেন্দ্র গৃহ্নীয়াৎ মধুরং বচঃ— তা হলে ধ্বংস করে দিতাম সেই দুরোদরগুলিকে— তাংশ্চ হন্যাৎ দুরোদরান্‌। প্রতিপক্ষ পন্ডিতেরা অবশ্য বলতেই পারেন যে, এখানেও দুরোদর অর্থ দ্যূতকর। মানে, সেই পাশাড়ে জুয়াড়ি, যাদের মারতে চেয়েছেন কৃষ্ণ। তবু প্রথম অর্থটাই এখানে খাটে বেশি, কেননা পাশার ঘুঁটি ধ্বংস করে দেবার কাজটাই ধৃতরাষ্ট্রের সভায় সম্ভাবিত কৃষ্ণকে মানায় বেশি।

আগে যে ‘দুরোদর’ কথাটা বললাম, তার একটা অন্য অর্থও করা যায়। ‘দুঃ’ অর্থ খারাপ আর উদর মানে পেট। তার মানে কী, পাশার ঘুঁটির মধ্যে এমন কিছু কি পুরে দেওয়া যেত, যাতে জুয়াড়ির ইচ্ছেমতো দানটি পড়ে। লোকেও তো সেই নিন্দাই করে যে, শকুনিমামা ছল করে, তাঁর পাশার ঘুঁটির মধ্যে ধাতু পিণ্ডের সঞ্চয় পুরে দিয়েছিলেন, কেউ বা বলেন— তাঁর ঘুঁটির ভিতর পোরা ছিল গুবরে পোকা, অথবা তাঁর পিতার অস্থি যাতে শকুনির ইচ্ছেমতো দান পড়ত। সত্যি কথা শুনুন, মূল সংস্কৃত মহাভারতে এই সব আজগুবি গপ্পো নেই এবং পড়ে যাওয়া দানও শকুনির ইচ্ছেমতো উলটে পড়ছে— এ সব কথা মহাভারতে কোথাও নেই। আর ‘দুরোদর’ মানেও তাই অমন কোনও সৃষ্টিছাড়া অর্থে ব্যবহৃত নয়। আসলে পাশাখেলায় যাদের হার হত— সন্দেহ নেই প্রত্যেকেরই কোনও-না-কোনও সময় হার হত— তারাই পাশাখেলার নাম দিয়েছিল ‘দুরোদর’ অর্থাৎ পাশার ঘুঁটির মধ্যে ‘কু’ আছে, সে যে কখন কষ্ট দেবে তা শুধু জানে ওই ঘুঁটির চিত হয়ে পড়া পেটটি, যার ওপরে কোনও সংখ্যা লেখা থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

শকুনির মতে তাঁর আসল ক্ষমতা হল তার জোড়-বিজোড়ের ডাকটি, যাকে তিনি গর্ব করে বলেছেন, সৈনিক হিসেবে ওইটিই আমার ধনুক— গ্লহান্‌ ধনূংষি মে বিদ্ধি— আর অক্ষগুলি হল আমার শর— শরান্ অক্ষাংশ্চ ভারত। এখানে ‘অক্ষ’ মানে যে সেই ‘দুরোদর’ পাশার ঘুঁটি যা শরের মতো সংখ্যায় অনেক থাকে, তা বোঝা যাবে অন্য এক সময়ে— অর্জুনের আত্মশ্লাঘায়। কর্ণকে মারবার আগে শকুনির কথাগুলিই ফিরিয়ে দিয়েছেন অর্জুন এবং এখানে ‘অক্ষ’ শব্দটির বদলে ‘দুরোদর’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি আমাদের সিদ্ধান্ত পাকা করে দিয়েছেন। অর্জুন বললেন— আজকে শকুনি আমার শরগুলিকেই তার পাশাখেলার উলটো ডাক ‘গ্লহ’ বলে বুঝতে পারবে আর আমার গাণ্ডীবটি দেখলেই বুঝতে পারবে ‘দুরোদর’ কাকে বলে— অদ্যাসৌ সৌবলঃ কৃষ্ণ গ্লহান্‌ জানাতু বৈ শরাণ্‌/দুরোদরঞ্চ গাণ্ডীবং…। ‘গান্ডীব’ এখানে সেই দুরোদর যা অজস্র শর-সন্ধান করে।

শকুনি কীভাবে ঠিক যুধিষ্ঠিরকে ছলনা করেছেন, তা মহাভারতে পরিষ্কার করে বলা নেই। কিন্তু প্রচুর গবেষণা করে আমরা তা আন্দাজ করতে পেরেছি। আসল কথা হল— পাশাখেলায় শকুনির মতো ধুরন্ধর এবং অভিজ্ঞ লোক তাঁর সময়ে অন্তত একজনও ছিল না। তাঁর কালে শকুনিই ছিলেন ‘গ্র্যান্ড-মাস্টার’। যুধিষ্ঠির যখন বলেছিলেন— তুমি অন্যায়ভাবে আমাদের জেতার চেষ্টা কোরো না,— তখন শকুনি যা উত্তর দিয়েছিলেন, তার মধ্যেই তাঁর পাশাখেলার অসম্ভব ক্ষমতাটি ধরা আছে। শকুনি যে কথাগুলি বলেছিলেন, যুধিষ্ঠিরের মাথায় তা ভাল করে ঢোকেনি। তাঁর চিত্ত চঞ্চল ছিল, শকুনির সঙ্গে খেলতে হবে বলে তিনি খানিকটা ‘নার্ভাস’ও ছিলেন। অতএব ‘বিধিশ্চ বলবান্‌ রাজন্‌’— ‘যা আছে কপালে’ বলে খেলতে আরম্ভ করলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু শকুনির কথার মধ্যেই— খেলায় তিনি কী করে জিতবেন— তার ইঙ্গিত ছিল।

পণ রেখে পাশাখেলায় ছল-জুয়াচুরি চিরকাল আছে, চিরকাল থাকবে। কিন্তু সে ছলের মধ্যেও শিল্প আছে, যা যুধিষ্ঠির জানেন না, শকুনি জানেন। শকুনি তিনটি কথা বলেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। প্রথম, যিনি গণনায় চতুর— যো বেত্তি সংখ্যাং— তার মানে দান দেওয়ার পর ঘুঁটিগুলি যে যত তাড়াতাড়ি গুনে ফেলতে পারে, ততই তার সুবিধা। কেন না তাড়াতাড়ি গোনার সময় সে যদি চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারে যে, তার হার হবে, তবে সে নিজস্ব ধূর্ততার রীতি-পদ্ধতি কাজে লাগাবে— নিকৃতৌ বিধিজ্ঞঃ। এই ধূর্ততা বা ছলনা করার সময় আলস্যহীনতা বা ক্ষিপ্রতাই হল একমাত্র অস্ত্র। এই ক্ষিপ্রতার দরকার তখনই, যখন ধূর্ত জুয়াড়ি পূর্বাহ্নেই তার দানের ফল বুঝে ফেলে এবং ঘুঁটি সরিয়ে নিয়ে কাজ হাসিল করে— চেষ্টাসু অখিন্নঃ কিতবোক্ষহজাসু। খেয়াল করে দেখবেন যুধিষ্ঠির পণ ধরার সঙ্গে সঙ্গে শকুনির চাল ফেলতে কখনও দেরি হয়নি এবং চাল দেওয়ার অব্যবহিত পরের মুহুর্তেই শকুনির খেলা শেষ হয়ে যেত এবং প্রত্যেকবারই সেই অবধারিত শব্দটি— এই-ই-ই-জি-তে-ছি— ‘জিতমিত্যেব’ অর্থাৎ এর মধ্যেই তার চাল দেওয়া এবং ঘুঁটি গোনা শেষ।

পাশাখেলার মধ্যে হাতের এই ক্ষিপ্রতাই শকুনির সবচেয়ে বড় কৌশল, যা যুধিষ্ঠিরের নেই। তিনি পাশাখেলাটা খুব ভালবাসেন বটে, কিন্তু দিনরাত ধর্মভাবনা করে শকুনির এই হস্তলাঘব তিনি আয়ত্ত করতে পারেননি। জিজ্ঞাসা করতে পারেন— এই ক্ষিপ্রতায় কী ফল হয়? উত্তরে বলি— হাতের ক্ষিপ্রতা থাকলে দান ফেলেই অনেকগুলি ঘুঁটি ক্ষিপ্র হাতে গুনে নিয়ে একটু এ দিক-ও দিক করে জোড় দানকে বিজোড় আর বিজোড় দানকে জোড় প্রতিপন্ন করা যায়।

পাশাখেলায় শকুনির এই হস্তলাঘবের প্রক্রিয়াটি শুধু ভারতবর্ষের এই গ্র্যান্ড-মাস্টার সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়। এই ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র প্রচলিত। যাঁরা ‘লাস্ট ডেইজ অব পম্পেই’ পড়ে পুলকিত হন, তাঁদের জানাই— উনআশি খ্রিস্টাব্দে পম্পেই শহরের অনেক কিছু পুড়ে গেলেও একটি পানশালায় টাঙানো দু’খানি অবিকৃত চিত্র পাওয়া গেছে। চিত্রটিতে দুই অক্ষশৌণ্ড মুখোমুখি বসে আছে টুলের ওপর। আর তাদের মাঝখানে আছে একটি ‘বোর্ড’— যার বৈদিক নাম পূর্বে বলেছি ‘অধিদেবন’। অবশ্য শকুনির মহাভারতীয় ভাষায় এর নাম ‘আস্তরম্‌’। পানশালার সেই চিত্রে বাঁ-পাশের লোকটি একটি হলদে রঙের পাত্র থেকে ঘুঁটি ফেলছে। হয়তো এই পাত্রটিই আমাদের পুরনো ভাষায় ‘অক্ষাবাপন’। প্রথম লোকটি দান ফেলার পরেই সানন্দে চিৎকার করছে— বেরিয়ে গেছি, বেরিয়ে গেছি অর্থাৎ— জিতমিত্যেব— EXSL.। প্রতিপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল শক্ত করে জবাব দিচ্ছে— কোথায় বেরিয়ে গেছ বাপু! মোটেই তোমার তিন হয়নি। হয়েছে দুই— Non tria, dvas est— সংস্কৃতের ভগিনীভাষায় এর রূপান্তর–ন ত্রয়ম্‌, দ্বয়মস্তি।

পম্পেই শহরের এই জুয়াড়ি দুটিও অনেকগুলো ঘুঁটি নিয়ে খেলছিল এবং সংখ্যাগণনার ক্ষিপ্রতায় একজন আরেকজনকে ধোঁকা দিতে চাইছিল। কিন্তু তা হতে পারেনি। এর পরের চিত্রে দুই জুয়াড়িতে মারামারি লেগেছে এবং পানশালার মালিক দু’জনেরই ঘাড় ধরে বলছে— বেরিয়ে যাও এখান থেকে— forax rixsatis. দান ফেলার পর জুয়াড়ির এই হাতের ক্ষিপ্রতা যে কত দূর যেতে পারে, তার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ আছে বৌদ্ধ জাতকে। সেখানে এক জুয়াড়িকে দান গোনার সময় জোড় অথবা বিজোড় দান প্রতিপন্ন করার জন্য ঘুঁটি গিলে ফেলতে পর্যন্ত দেখেছি।

ঘটনাটি আছে জাতকে। জাতক গল্পমালা বুদ্ধের জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনি। এক জন্মে, যখন রাজা ব্রহ্মদত্তের রাজত্ব চলছে তখন বুদ্ধ জন্মেছিলেন এক বড় মানুষের ঘরে। যুবক বয়সেই তিনি জুয়াড়ি হয়ে উঠলেন। একবার তিনি অন্য এক জুয়াড়ির সঙ্গে পাশা খেলছেন কিন্তু সে জুয়াড়ি ছিল জুয়োচোর। খেলার সময় সে যখন দেখত বিপদে পড়েছে, সে বলত— এ দানটি হবে না, একটি ঘুঁটি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে বুদ্ধ ভেবেছিলেন দান ফেলার সময় হয়তো একটি ঘুঁটি এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে, এমনটি হতেই পারে। কিন্তু সে জুয়াড়ি দান ফেলার পর গুণেগেঁথে যখনই বুঝত বিপদ, তখনই একটি ঘুঁটি সে টপ করে গিলে ফেলত। বুদ্ধ এ চালাকি ধরে ফেললেন, তারপর তিনি ঘুঁটিগুলিকে বিষ মাখিয়ে বেশ করে শুকিয়ে পাশা খেলতে এলেন। জুয়াড়ি নিজের কৌশলমতো ঘুঁটি গিলে ফেলল এবং বিষের যন্ত্রণায় মূৰ্ছিত হল। শেষপর্যন্ত বুদ্ধ তাকে লতাপাতার আয়ুর্বেদিক ঔষধ খাইয়ে বমি করালেন এবং বাঁচিয়ে তুললেন।

এই গল্প থেকে বেশ বোঝা যায় ক্ষিপ্রতা থাকলে একজন পাকা জুয়াড়ি কী করতে পারে। স্বীকার করে নিতে পারি যে, মহাভারতের গ্র্যান্ড-মাস্টার শকুনি নিশ্চয়ই ঘুঁটি গিলে ফেলতেন না, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে কিছু না করা সত্ত্বেও তাঁর ওপরে বার বার যে কপটতার আরোপ করা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় হাত-সাফাই করে ঘুঁটি সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ ছিল। মহাভারতের দ্যূতপর্বে যতগুলি পণ ধরা হয়েছে এবং যত তাড়াতাড়ি প্রত্যেকটি খেলা শেষ হয়েছে, তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারি— বহুসংখ্যক ঘুঁটি নিয়েই শকুনি পাশা খেলেছেন এবং সে খেলায় তাঁর ‘নিকৃতি’ বা ধূর্ততার পদ্ধতিই হল ক্ষিপ্রতা— যাকে শকুনি নিজেই বলেছেন— ‘চেষ্টাস্বখিন্ন’— সেটা তার এতই বেশি ছিল যে, ধর্মশুদ্ধ যুধিষ্ঠির তা ধারণাও করতে পারেননি।

শকুনির কথা বললে, শকুনির পাশাখেলার কৌশলের প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে এসে পড়ে বলেই এতগুলো কথা বললাম। সঙ্গে এও বলে রাখি— শুধু এই একরকমই নয়, সেইকালে প্রচলিত আরও এক ধরনের পাশাখেলাতেও ওস্তাদ ছিলেন শকুনি। অর্থাৎ এখানেও তিনি গ্র্যান্ড-মাস্টার। সে কথায় পরে আসছি। তার আগে পরপক্ষের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে শকুনির নিপুণ পর্যবেক্ষণ শক্তির আরও একটু ব্যাখ্যা দরকার। শকুনি খুব ভালভাবে জানতেন যে, যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে খুব ভালবাসেন, কিন্তু পাশাখেলার ক্ষমতা তাঁর নেই এবং প্রয়োজনীয় ধূর্ততাও তাঁর আয়ত্ত নয়। এ দিকে যুধিষ্ঠির শকুনিকে সন্দেহও করছেন যে, ধূর্ততা এবং ছলের দ্বারাই পণ জিতবেন শকুনি। বার বার তিনি বলছেন— মাতুল! আপনি পাশা না খেলুন সেও ভাল, কিন্তু ছল করে অন্যদের জয় করার চেষ্টা করবেন না— তদ্‌ বৈ শ্রেয়ো মাস্ম দেবীৰ্মা জৈষীঃ শকুনে পরাণ্‌।

শকুনি বললেন— দেখ বাবা যুধিষ্ঠির! এক পণ্ডিত যখন আরেক পণ্ডিতের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক অথবা বাদ-বিতণ্ডায় নামেন, তখন তর্ক-যুক্তির ফাঁকিতেই তিনি পরপক্ষকে জয় করেন। এখন এই তর্কযুক্তির কৌশলকে কি তুমি ছল বলো না অন্যায় বলো? এই রকম, সমস্ত কাজের মধ্যেই কিছু কৌশল আছে, সেই কৌশলেই মানুষ জয়ী হয়— এবং কর্মসু সর্বেষু নিকৃত্যৈব যুধিষ্ঠির! এর পরেই শকুনি এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক চাপে বশীভূত করলেন যুধিষ্ঠিরকে। বললেন— দেখ বাপু। তুমি এখানে না আসলেই পারতে। এখানে এই দ্যূতসভায় এসে সবার সামনে আমাকে যদি তুমি শঠতার দুয়ো দাও, তা হলে তোমায় খেলতে হবে না বাপু, ছেড়ে দাও— দেবনাদ্‌ বিনিবর্তস্ব যদি তে বিদ্যতে ভয়ম্‌।

শুধু পাশাখেলাই নয়, পরপক্ষের দুর্বল মনস্তত্ত্ব বুঝে তাকে পাশাখেলায় সুপ্রবৃত্ত করার জন্য শকুনি এবার কথার চাল দিয়ে বললেন— দেখ বাছা যুধিষ্ঠির! পাশাখেলা যে ভাল জানে, সে পাশার চালেই বিপক্ষকে পরাজিত করার চেষ্টা করে। সে ক্ষেত্রে আমাদেরই তো পরাজয়ের আশঙ্কা আছে। তবুও আমরা খেলব তো। অতএব তুমিও কোনও আশঙ্কা কোরো না, তুমি খেলতে নামো, দেরি কোরো না।— দীব্যামহে পার্থিব মা বিশঙ্কীঃ/কুরুষ্ব পাণঞ্চ চিরঞ্চ মা কৃথাঃ। শকুনির মতো মানুষকেও যুধিষ্ঠির ধর্মকথা শুনিয়ে বললেন— দেখুন মাতুল! মুনিশ্রেষ্ঠ অসিতদেবল বলেছেন ধূর্ত পাশাড়েদের সঙ্গে পাশা খেললে পাপ হয়, আর যুদ্ধ করলে ধর্ম অনুসারে জয় হয়। অতএব পাশাখেলার চেয়ে যুদ্ধ করা অনেক ভাল। আমরা ক্ষত্রিয় মানুষ, আমরা বরং যুদ্ধ করে মরব, পাশা খেলতে যাব কেন শুধু শুধু। আমরা শঠতা করে কোনও ধন-ঐশ্বর্য লাভ করতে চাই না— নিকৃত্যা কাময়ে নাহং সুখান্যুত ধনানি বা।

যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষ কেন যুদ্ধের কথা বলছেন শকুনি বোঝেন। ভীম-অর্জুন— এঁদের পরিহার করে ভাগনে দুর্যোধনকে রাজ-ঐশ্বর্য পাইয়ে দেবেন— এই তো প্রতিজ্ঞা ছিল শকুনির। যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে তিনি বেশ দার্শনিক সুরে বললেন— আরে ভাগনে! যুদ্ধ-যুদ্ধ করছ কেন, এই দুনিয়ায় সবই তো যুদ্ধ। এই দেখ না— বেদজ্ঞ শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণেরাও বাদ-বিতণ্ডায় অন্য শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণকে জয় করার চেষ্টা করেন, তার মধ্যেও তো শঠতা আছে। কিন্তু লোকে তাকে শঠতা বলে না। একজন বিদ্বান মানুষ যে আর এক বিদ্বান মানুষকে অথবা কোনও অজ্ঞ ব্যক্তিকেও কথার ছলনায় প্রভাবিত করেন, তার মধ্যেও তো শঠতা আছে— শ্রোত্রিয়ঃ শ্রোত্রিয়ানেতি নিকৃত্যৈব যুধিষ্ঠির। তাই বলছি, তুমি যদি সেই ভাবে দেখ, তা হলে দেখবে সব যুদ্ধের মধ্যেই এক ধরনের শঠতা আছে। সেখানে শুধু পাশাখেলার মধ্যেই ছলনা আছে, এ-সব কথা একেবারেই বাজে কথা। সব চেয়ে বড় বাস্তব হল— তুমি এখানে পাশা খেলতেই এসেছ এবং তাও আবার নিমন্ত্রিত হয়ে। এখন এই পাশার আসরে এসে আমাকেই যদি তুমি ছলনা-কপটতার দোষ দিতে থাক, সে কেমন ধারা কথা— এবং ত্বং মাম্ ইহাগত্য নিকৃতিং যদি মন্যসে! পাশা খেলতে এসে এত যদি ছলনার ভয় থাকে বাপু, তা হলে আর তোমায় পাশা খেলতে হবে না, তুমি চলে যাও, ধর্মে মন দাও, — দেবনাদ্‌ বিনিবর্তস্ব যদি তে বিদ্যতে ভয়ম্‌।

মহাভারতের শকুনির মাহাত্ম্য এবং ক্ষমতা একটাই। তিনি পাকা জুয়াড়ি, তিনি পাশা খেলে পাণ্ডবদের হারিয়ে দুর্যোধনের কার্যসিদ্ধি করেছেন। শঠতা আর কপটতার চূড়ান্ত ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি দুর্যোধনের মন জয় করেছেন। আর কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, বারে বারে এবং শেষবারের মতো আবারও যেটা স্বীকার করতে হবে, সেটা হল তাঁর পাশাখেলার দক্ষতা এবং এই দক্ষতা কোন স্তরে পৌঁছেছিল!

আমরা নিঃসন্দেহেই বলতে পারি— সভাপর্বে পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে শকুনি যে কায়দায় পাশা খেলেছিলেন, সেখানে অনেকগুলি ঘুঁটি নিয়েই খেলা হয়েছিল এবং ঘুঁটি গোনার ক্ষিপ্রতা এবং সেই সঙ্গে ঘুঁটি সরানো বা জোগানোর ধূর্ততার মধ্যেই ছিল শকুনির সাফল্য। অনেকগুলি ঘুঁটি নিয়েই খেলা হয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল— দ্বিতীয়বার যখন বনবাসের পণ রেখে খেলতে নামেন শকুনি, তখন তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন— পাশার ঘুঁটি উলটে-পালটে নতুনভাবে নিক্ষেপ করে (উপত্বা-ক্ষিপত্বা) আরও একবার খেলো তুমি— অক্ষানুপত্বা পুনর্দ্যূতম্ এহি দীব্যস্ব ভারত। অনেকগুলি ঘুঁটি নিয়ে এই খেলাটা দেখার পরেও মনে হচ্ছে— আরও একরকম পাশাখেলার নিয়ম সে যুগে চালু ছিল এবং তাতেও শকুনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। কথাটা একটু পরিষ্কার করে বলতেই হবে, কারণ মহাভারতের শকুনির চরিত্রবল সেখানেই।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে— আর্যদের ভারত-প্রবেশের অনেক আগে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মৃতভূমিতে আমরা পোড়ামাটির তৈরি কতকগুলি চতুষ্কোণ ঘুঁটি পেয়েছি, যা দেখতে আধুনিক লুডোখেলার ছক্কার মতো। ঘুঁটিগুলির উল্টো-সোজার সংখ্যাগুলি এইরকম— ১:২; ৩:৪; ৫:৬। কিন্তু ব্রাহ্মণাবাদ থেকে একটি পোড়া মাটির ছক্কার মধ্যে আমরা একেবারে আধুনিক ছক্কাটি পেয়েছি, যেখানে উলটো-সোজার যোগফল সাত।

এই ছক্কার প্রমাণ দিয়ে আমরা আর কিছুই বোঝাতে চাই না। শুধু বলতে চাই— বিন্দুচিহ্নিত এমন একটা কিছু ছিল, যা নিক্ষেপ করে পাশাখেলার দান দেওয়া হত। এ বারে প্রশ্ন হল— পাশাখেলার ছকটি নিয়ে। বৈদিক যুগে যেটাকে ‘অধিদেবন’ বা ‘ইরিন’ বলা হত সেটা কি নেহাতই পাশাখেলার জায়গা? নাকি সেখানে কোনও পাশাখেলার ছক কাটা হত সাময়িকভাবে— কারণ ঋষিরাও তো পাশা খেলতেন। আমরা কিন্তু সেই মহেঞ্জোদরো-হরপ্পা থেকে একটি তিন-তিন ছক কাটা ইষ্টকখণ্ড পেয়েছি। অন্যদিকে বৌদ্ধগ্রন্থ দীঘ্‌ঘনিকায়ের ব্রহ্মগালসূত্তে— ‘অট্‌ঠপদ’ এবং ‘দসপদ’ বলে দুটি শব্দ পাওয়া যায় যাকে সংস্কৃতে আমরা অষ্টাপদ বা দশপদ বলি। এগুলি কিন্তু আট-আট বা দশ-দশ ছকের নকশা। বৌদ্ধগ্রন্থ সেকালের ব্রাহ্মণদের গালাগালি দিয়ে বলেছে— ব্রাহ্মণেরা অষ্টাপদ আর দশপদের খেলায় অহেতুক সময় নষ্ট করতেন।

এই যে আট-আট বা দশ-দশ খেলার একটা নকশা পাওয়া গেল এবং আধুনিক ছক্কার মতো একটি বিন্দুচিহ্নিত ছক্কাও পাওয়া গেল, তাতে সন্দেহ করি— পাশাখেলার তলায় প্রচ্ছন্ন আরও একটি অতি আধুনিক খেলারও ওস্তাদ আমাদের গ্র্যান্ড-মাস্টার শকুনিই কিনা! এ বারে ঘুঁটির কথা বলি। মহারাজ যুধিষ্ঠির যখন বিরাট রাজার বাড়িতে ছদ্মবেশে কাল কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তিনি নিজের মুখে বলেছিলেন— আমি বিরাট রাজার সভাসদ সাজব, আমার নাম হবে কঙ্ক। বৈদূর্য মণির মতো নীল রং, সোনার মতো রং, কালো রং এবং লাল রঙের পাশার ঘুঁটিগুলি চালিয়ে চালিয়ে আমি বিরাট রাজার মনোরঞ্জন করব— নির্বর্ত্‌স্যামি মনোরমান্‌। ‘নির্বর্ত্‌স্যামি’ শব্দের অর্থ নীলকণ্ঠ করেছেন ‘চালয়িষ্যামি’ মানে চালিয়ে চালিয়ে খেলব।

তা হলে কি নীল, হলুদ আর লাল, কালো ঘুঁটির চার রকমের শারি চালিয়ে চতুরঙ্গ খেলার অভ্যাস করেছিলেন যুধিষ্ঠির। এই চার শারি আসলে রাজার হাতি, ঘোড়া, নৌকো আর রথের চতুরঙ্গ বাহিনীর মতোই তো লাগছে। হতেই পারে। কেননা ভারহুতের ভিত্তিভূমিতে এবং নাগার্জুনকোণ্ডের ভিত্তিভূমিতে ছয়-ছয় অথবা আট-আট ছকের নকশা যেমন পাথরে খোদাই করা আছে, তেমনই খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে হরিবংশের প্রমাণে বলতে পারি— কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরাম অষ্টাপদ অর্থাৎ আট-আট ছকের একখানি ‘গেমবোর্ড’-এর ওপর পাশা (নাকি দাবা?) খেলতে খেলতে সেই ‘গেমবোর্ড’-এর বাড়ি কষিয়েই কৃষ্ণের শালা রুক্মিণীর ভাই রুক্মীকে মেরেই ফেলেছিলেন— জঘানাষ্টাপদেনৈব প্রমথ্য যদুনন্দনঃ।

হরিবংশে চতুরঙ্গ খেলার একটা বোর্ডের খবরই শুধু পাওয়া যায়নি, খেলার সময় বলরাম যে দান ফেলেছিলেন সেই দানের মান ছিল ‘চার’ এবং সেই দানেই বলরাম বিরাট পণে জিতে গিয়েছিলেন— চাতুরক্ষে তু নির্বৃত্তে নির্জিতঃ স নরাধিপঃ। এখন এই ‘চার’ ফেলার দানটা মহাভারত এবং অবশ্যই শকুনির দৃষ্টান্তেও প্রমাণ করা যায়। মহাভারতে ওই ছক্কার মতো জিনিসটায় চার রকমের দান দেওয়া যেত এবং এই দানগুলির নাম ছিল আমাদের চতুর্যুগের নামের মতো। চতুর্যুগ যেমন— সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, তেমনই ছক্কা ফেলে পাশার দানও কৃত (সত্যযুগের পর্যায় শব্দ), ত্রেতা, দ্বাপর, এবং কলি। কৃতদানের মান চার, ত্রেতায় তিন, দ্বাপরে দুই আর কলিদানের মান এক। পাশাখেলায় কৃতদান পড়লেই মোক্ষম জয়, ত্রেতা-দ্বাপরে মাঝারি অবস্থা, আর কলিদানে কখনই জয় হয় না। টীকাকার নীলকণ্ঠের ভাষায়— কলিপাতে জয়ো নাস্তি।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল— মহাভারতে সেই বিখ্যাত খেলাটির আগে শকুনির সম্বন্ধে বিদুর বলেছিলেন— কৃতহস্তো মতাক্ষঃ। অর্থাৎ শকুনি দান ফেললেই কৃতদান অর্থাৎ চার পড়ে। এই চার পড়ার ব্যাপারেও শকুনির কোনও হস্তলাঘব জানা ছিল কি না, তা আমরা পরিষ্কার করে বুঝতে পারিনি। তবে কৃতদান ফেলে কৃতহস্ত শকুনি যে ‘গেমবোর্ড’-এ চতুরঙ্গও খেলতেন, সেটা আমাদের ধারণায় আসে খানিকটা। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন— কলিদান ছাড়া দ্বাপর কিংবা ত্রেতা দানে উত্তরোত্তর জয় বোঝাত— দ্বাপরাদিপাতে উত্তরোত্তরবৃদ্ধ্যা জয়োহস্তি। কিন্তু শকুনির কৃতদান বা বলরামের চাতুরক্ষ চালটাই অক্ষক্রীড়ার মোক্ষম চাল।

অনেকগুলি ঘুঁটি নিয়ে পাশাখেলা অথবা ছক্কার মতো বস্তুর দান দিয়ে কৃতদান ফেলা— এই দুই কিসিমের পাশাখেলাতেই যে শকুনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন— সেটা বোঝা যাবে মহাভারতের বিরাটপর্বে। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় কৌরবরা যখন বিরাট রাজার গোধন চুরি করতে গিয়েছিলেন, তখন শেষপর্যন্ত মহাবীর অর্জুনেরই মুখোমুখি হতে হয় কৌরবদের। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা এই সময় অর্জুনকে দেখে শকুনির সঙ্গে ঠাট্টা করে বলেছিলেন— মনে রেখো বাপু। অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু কিন্তু পাশার ঘুঁটি ছোড়ে না— নাক্ষান্‌ ক্ষিপতি গাণ্ডীবম্। এটা হল সেই অসংখ্য ঘুঁটি নিয়ে পাশাখেলার ইঙ্গিত। অশ্বত্থামা আরও বলছেন— সে গাণ্ডীব কৃত দানও ফেলে না, দ্বাপর দানও ফেলে না— ন কৃতং দ্বাপরং ন চ। গাণ্ডীব থেকে বেরিয়ে আসে শুধু কাটা কাটা বাণ। কৃত এবং দ্বাপরের উল্লেখে বুঝি, এটা শকুনির আরেক রকম পাশাখেলা— হয়তো সেটা চতুরঙ্গ। নীল, হলুদ, লাল আর কালো ঘুঁটির শারি চালিয়ে অষ্টাপদ ছকে চতুরঙ্গ খেলা, যেখানে দান ফেলতে হত চার দানের বিন্দুচিহ্নিত ছক্কা দিয়ে।

বিন্দুচিহ্নিত কোনও বস্তু দিয়ে যে দাবা-পাশাখেলার চল মহাভারতের কালে ছিল, সে সম্বন্ধে টীকাকার নীলকণ্ঠ কিছু আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে কলি-দানের মান এক, আর কৃতদানের মান চার হলেও এই কৃত আর কলি-দানের মধ্যে একটা আঙ্কিক হিসেব আছে। বেদে উল্লিখিত ত্রিপঞ্চাশৎ বা দেড়শো গুটির খেলাই হোক অথবা চতুরঙ্গ খেলাই হোক, কৃতদান যখন পড়ে, তখন গুটিগুলি গোনার পর চার দিয়ে ভাগ করলে যদি ভাগশেষ শূন্য হয়, তবে সেই দানটা মোক্ষম দান অর্থাৎ কৃত দান। চার দিয়ে ভাগ করার পর ভাগশেষ তিন থাকলে ত্রেতা দান, ভাগশেষ দুই থাকলে দ্বাপর, আর ভাগশেষ এক হলে কলি দান অর্থাৎ একেবারে নিকৃষ্ট জয়। অনেকগুলি গুটি নিয়ে খেলার সময় অঙ্কের এই হিসেবটা বেশি কাজে লাগে বলে আমাদের ধারণা এবং বেশির ভাগ পণ্ডিতেরাই এই মত পোষণ করেন। কিন্তু ছক্কার মতো কোনও বস্তু দিয়ে দান ফেলে চতুরঙ্গ খেলায় কীভাবে শারি চালিয়ে গুটিগুলি আগুপিছু করা হত, সে ব্যাপারে আমরা খুব নিশ্চিত নই। মহাভারতের বিরাট-পর্বে কৃত-ক্রেতা-দ্বাপর এবং কলি দানের হিসেব দেবার সময় টীকাকার নীলকণ্ঠ এক ধরনের ছক্কার কথা বলে একটা অদ্ভুত পাশাখেলার বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা মনে করি— নীলকণ্ঠ যে দেশের এবং যে সময়ের মানুষ তাতে ওইরকম একটা পাশাখেলা তাঁর সময়ে চলত, যেটাকে তিনি জুয়াখেলার আদলেই বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ঘটনা হল— এখানেও একটা ছক্কার মতো বস্তু আছে। নীলকণ্ঠ লিখছেন— চারদিকে এক-দুই-তিন-চার চিহ্ন দেওয়া জিনিসটাকেই পাশা বলে। সেখানে এক পড়লে কলি, দুইয়ে দ্বাপর, তিনে ত্রেতা আর চার পড়লে কৃত দান। নীলকণ্ঠ আরও বলছেন— এইরকম পাশাখেলায় দুই পক্ষ পাঁচ-পাঁচটি দীনার বাজি রেখে খেলে— তত্র দ্যূতে পঞ্চ স্বীয়াঃ পঞ্চ পরকীয়াশ্চ দীনারাদয়ঃ স্থাপ্যন্তে। ধরা যাক, একপক্ষ দান ফেলার পর যদি পাশার দানে এক সংখ্যাটি ওপরে আসে, তা হলে— নীলকণ্ঠ বলছেন— নিজের পাঁচ দীনারের মধ্যে এক দীনার জেতা হয়। যদি দুই ওঠে তা হলে পরপক্ষের দুই দীনার আর নিজের এক দীনার জেতা হয়। যদি তিন ওঠে, তা হলে নিজের তিন দীনার, পরের তিন দীনার জেতা হয়। আর চার, মানে, কৃত-দান পড়লে পরের পাঁচ দীনার এবং নিজের পাঁচ দীনার সবটাই জেতা হয়ে যায়। আর কলি-দান পড়লে এ-পক্ষের সব গেল।

শকুনি এইরকম কোনও ছক্কা দিয়েই পাশার দান চালতেন কিনা, সে-ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহ নই। কিন্তু যা কিছুই নিয়ে তিনি খেলুন, সে ব্যাপারে জুয়োচুরি করা বা জুয়োচুরি করে জেতাটায় তাঁর যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল।

শকুনিকে বুঝতে হলে তাঁর পাশাখেলার ছকটাও বোঝা উচিত বলে আমি খানিক প্রাসঙ্গিক জ্ঞান দান করছি নিরুপায় হয়ে। এ-বিষয়ে সবশেষের কথাটা হল— আমাদের আধুনিক দাবাখেলার পিতৃপুরুষ হল চতুরঙ্গ। বিখ্যাত আর. সি. বেল সাহেব তাঁর ‘বোর্ড অ্যান্ড টেবল গেমস’-এর বইখানাতে ‘চেস গ্রুপ’ বিভাগটি লিখতে গিয়ে প্রথমেই লিখেছেন— About the fifth century A.D. the Astapada board was used for a new game Shaturanga…। এখানে শকুনির চরিত্র লিখতে গিয়ে দাবা নিয়ে গবেষণা করতে চাই না। তবে প্রমাণ দিয়ে বলতে পারি বেল-কথিত পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের অনেক আগে এবং অবশ্যই খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে শারি চালিয়ে চতুরঙ্গ খেলার নিয়ম ভারতবর্ষ জানত এবং শুধু তাই নয়— ঘুঁটি চালিয়ে ঘুঁটি খেয়ে ফেলা বা কিস্তি দেওয়ার মতো একটা দানও অন্তত খ্রিস্টপূর্বাব্দেই ভারতবর্ষে চালু হয়ে গেছে। তার নির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। বাড়তি ব্যাপার হল— চতুরঙ্গের মতো গেম বোর্ডে শারি চালিয়ে অক্ষক্রীড়ার সময়েও ছক্কার মতো একটা জিনিস ব্যবহার হত এবং ছক্কার দানে চার ফেলার ব্যাপারে শকুনি ছিলেন কৃতহস্ত বা সিদ্ধহস্ত।

ঐতিহাসিক এ এল ব্যাশম স্বীকার করেছেন— ভারতবর্ষের চতুরঙ্গ খেলাই পরবর্তীকালে পাচার হয়ে যায় পারস্যে এবং পারস্য যখন আরবদের কাছে হেরে গেল তখন এই খেলাটাই সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তথা চতুরঙ্গের আপভ্রংশিক পরিবর্তন ঘটে ‘শতরঞ্জ’ নামে। কিন্তু সাহেব যেটা বলেননি, সেটা হল— মহাভারতের শকুনিই ছিলেন আধুনিক দাবাখেলার প্রথম পিতৃপুরুষ। শকুনির চরিত্র তাই মহাভারতের রাজনৈতিক চেতনায় না দেখে, দেখা উচিত দাবাখেলার প্রথম গ্র্যান্ড-মাস্টার হিসেবে অথবা রাজনৈতিক কূটবুদ্ধিটাও যদি শকুনির অক্ষক্রীড়ার মধ্যে অনুস্যূত হয়েও থাকে, তবে শকুনির নাম-করণ করতে হবে অন্যভাবে, অতি আধুনিক ভাষায় সেটা হল— মহাভারতের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’।

॥ ৪ ॥

যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে বসে গেলেন। আমরা বলব— শকুনির কথার প্যাঁচেই তিনি খেলতে বসে গেলেন এবং বোধহয় খেলায় হারের সম্ভাবনা প্রবল জেনেই যুধিষ্ঠির বললেন— আমি খেলতে যখন এসেছি তখন খেলবই, তারপর সব কপাল, কপালের ফেরেই এই খেলা— বিধিশ্চ বলবান্‌ রাজন্‌ দিষ্টস্যাস্মি বশে স্থিতঃ। আরও একবার প্রতিবাদ করলেন যুধিষ্ঠির— যখন দুর্যোধন বললেন— খেলার পণ-টন সব আমিই দেব, কিন্তু আমার হয়ে খেলবেন মামা শকুনি— মদর্থে দেবিতা চায়ং শকুনির্মাতুলো মম। যুধিষ্ঠির বললেন— টাকা দেবে একজন, পাশা খেলবে আরেকজন, এটা তো অদ্ভুত কথা— অন্যেনান্যস্য বৈ দূতং বিষমং প্রতিভাতি মে। তুমি নিজে পাশা হাতে নাও। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মৃদুভাষিত প্রতিবাদ শকুনি এবং দুর্যোধনের মৌনতায় অবহেলিতই রয়ে গেল। হেনকালে ধৃতরাষ্ট্র এসে উপস্থিত হলেন দ্যূতসভায়, যুধিষ্ঠিরের প্রতিবাদ রাজাগমনের আড়ম্বরেই ভেসে গেল। খেলা আরম্ভ হল।

প্রথমে তো— আমার এই গলার মণিটা পণ রাখছি, তোমার কী পণ— এইভাবে খেলা আরম্ভ হল। প্রথম চাল থেকেই শকুনি দান জিততে আরম্ভ করলেন বলে-বলে— এই জিতলাম— এই রকম ভাষায়— জিতমিত্যেব শকুনি যুধিষ্ঠিরম্‌ অভাষত। প্রথম দান পড়ার পর যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— মামা! আপনি কিন্তু সেই ছল করেই দান জিতলেন— মত্তঃ কৈতবকেনৈব যজ্জিতোহসি দুরোদরম্‌। তবুও আমরা পরস্পর পণ রেখেই পাশা খেলব। শকুনি এ-কথার উত্তরই দিলেন না। এবং তাঁর এই ‘অ্যাটিটুড’ থেকে বোঝা যায় যে, শঠতার খেলাটাও তিনি যুধিষ্ঠিরের সম্মত করে নিয়েছেন। পরের পর দান হারতে লাগলেন যুধিষ্ঠির। ধন-রত্ন, দাস-দাসী, হাতি-ঘোড়া— সব একে একে গেল। এই খেলা যখন মত্ততার দিকে পৌঁছচ্ছে, তখন একবার মাত্র বিদুরের সাবধান-বাণী শোনা গেছে। তিনি দুর্যোধনের অসদ্ভাবনা নিয়ে তিরস্কার করেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে এবং শকুনির সম্বন্ধে স্পষ্ট অপবাদ দিয়ে বলেছেন— আমরা জানি, শকুনি কী ধরনের পাশা খেলে; সে পার্বত্য গান্ধার দেশের মানুষ, ছলনা তার পার্বতীয় স্বভাবে— জ্ঞানীমহে দেবিতং সৌবলস্য। বেদ দ্যূতে নিকৃতিং পার্বতীয়ঃ। আপনি এই লোকটাকে নিজের দেশে পাঠিয়ে দিন। এ-সব কথা শোনার পরেও কী অসম্ভব সহ্যশক্তি শকুনির! এত কথা শুনেও তিনি একটি কথারও উত্তর দেন না, কেন না তিনি জানেন যে, এ-সব কথার তীব্রতম উত্তর দুর্যোধনের কাছ থেকেই আসবে এবং সত্যিই তো দুর্যোধন বিদুরকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই। ধৃতরাষ্ট্রের নির্বিকার স্বভাবের সুযোগে শকুনিও নির্বিকার চিত্তে পাশাখেলা আরম্ভ করলেন। তাঁর ধীরতায় এতটুকুও আঘাত লাগল না। তিনি আবারও খেলতে বসলেন।

ধন-রত্ন, রাজ্যপাট সব চলে গেল যুধিষ্ঠিরের। এবার একে একে ভাইদের পালা। নকুল এবং সহদেবকে পণ রেখে হারলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু নকুল সহদেবকে আজ্ঞাপালক দাস হিসেবে পেয়ে শকুনির মন ভরল না এবং তা না ভরারই কথা। কেন না ভীম এবং অর্জুন যদি কোনওভাবে যুধিষ্ঠিরের পণবৃত্তের বাইরে থাকেন, তা হলে একদিকে যেমন যুদ্ধের সময় দুর্যোধনের আশঙ্কা থেকে যায়, তেমনই পাণ্ডবদের রাজ্যপাট লাভের পরিকল্পনাটাও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। অতএব অসাধারণ কৌশলে যুধিষ্ঠিরের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে শকুনি বললেন— তুমি বললে— নকুল-সহদেব তোমার বড় প্রিয় দুটি ভাই, তা আমি তাদের জিতে নিয়েছি। কিন্তু প্রিয়ত্বের কথা যদি বল, তবে ভীম আর অর্জুন তো আরও বেশি প্রিয়। তা হলে…?

ব্যস। এইটুকু বলেই শকুনি ছেড়ে দিয়েছিলেন, কেন না তিনি জানেন যে, যুধিষ্ঠিরের ধন-সম্পত্তি, রাজ্যপাট সব গেছে, এখন তিনি মানব-সম্পদের কথা বলছেন প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে। এই অসম্ভব প্রমত্ততার সময়ে নকুল-সহদেবের মতো ক্ষীণ-প্রাপ্তির চেয়ে ভীমার্জুনের মতো বীর-যুগলকে স্বাধিকারে নিয়ে আসাটা অনেক বেশি জরুরি। বিশেষত শকুনির কথা শুনে যুধিষ্ঠির উত্তেজিত হয়ে গেছেন। আপাতত এতই তিনি বিভ্রান্ত যে, ভীমার্জুনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন— আমাদের ভাইদের মধ্যে কতটা ভালবাসা আছে, তা না বুঝেই আপনি অধর্মের কথা বলছেন, শুধু শুধু ভেদ সৃষ্টি করতে চাইছেন আমাদের ভাইদের মধ্যে। শকুনি দেখলেন— এ তো উলটো বিপদ হল, এখন যদি ভীমার্জুনের পণটা চেপে যান যুধিষ্ঠির! অতএব শকুনি অসাধারণ বাক্‌পটুতায় নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়ে বললেন— দেখো যুধিষ্ঠির! মোদো-মাতাল মানুষেরা খানাখন্দে পড়ে, আর জুয়োখেলায় মত্ত জুয়াড়িরা বেশি বেশি বকে— গর্তে মত্তং প্রপততে প্রমত্তঃ/কিতবা যানি দীব্যন্তঃ প্রলপন্ত্যুৎকটা ইব। থাক এ-সব কথা, তুমি রাজা বটে, আর এদের সকলের চেয়ে বয়সেও বড় বটে, তুমি আমার কথা ধোরো না। পাশাখেলায় মত্ত হয়ে জুয়াড়িরা আজেবাজে বকে, আমিও তাই বকে যাচ্ছি, আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে— জ্যেষ্ঠো রাজা বরিষ্ঠোহসি নমস্তে ভরতর্ষভ।

শকুনির কথার চালে আবারও ফাঁদে পড়লেন যুধিষ্ঠির। শকুনি এতটাই কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যে, সামান্য কথায় যুধিষ্ঠিরকে চেতিয়ে দিয়েই আবারও নতি স্বীকার করতে তাঁর বাধে না। শকুনি শুধু খেলার জুয়াড়ি নন, কথারও জুয়াড়ি। তাঁর কথার মধ্যেও পাশার চাল আছে। যে যুধিষ্ঠির একটু আগে ভাইদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার দায় শকুনির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছিলেন, সেই যুধিষ্ঠির শকুনির কথার বশীকরণ-মন্ত্রে নিমেষের মধ্যে গলে গিয়ে মহাবীর অর্জুনকে বাজি ধরে বসলেন এবং বাজি ধরলেন মহাবলী ভীমকেও। দু’জনকেই বাজিতে হেরে যাবার পর যুধিষ্ঠির নিজেকেই দাসত্বের পণে বিকিয়ে দিলেন সবার সামনে। শকুনি মৃদু স্বরে— ‘এই জিতলাম’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারত। কিন্তু না, সমস্ত উত্তেজনাই এখনও বাকি রয়ে গেছে এবং যুধিষ্ঠির সে-কথা ভুলেই গেছেন, কিন্তু শকুনি ভোলেননি।

আসলে শকুনি জানেন দুর্যোধনের সন্তাপ কখন থেকে আরম্ভ হয়েছে। সেই যে পঞ্চাল দেশ থেকে পাঁচ ভাই পাণ্ডব জিতে আনলেন দ্রৌপদীকে, সেই থেকে দুর্যোধনের প্রয়াস চলছে কীভাবে পাণ্ডবভাইদের বিযুক্ত করা যায় দ্রৌপদীর সাহচর্য থেকে। দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীকে পাণ্ডবরা কেন পাবেন— এই অদ্ভুত ধর্ষকামিতা দুর্যোধন-কৰ্ণ সবার মধ্যেই ছিল। শকুনি সেটা খুব ভালভাবে জানেন বলেই তিনি ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছেন। ভীম আর অর্জুনের মতো মহাবীর অবিজিত তথা আপন স্বতন্ত্রতায় অধিষ্ঠিত থাকলে দ্রৌপদীকে লাভ করার ব্যাপারে অসুবিধে হবে জেনেই শকুনি তাঁদের আগেভাগে জিতে নিয়েছেন। তাঁরা এখন কৌরবদের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত। এই অবস্থায় শকুনি দ্রৌপদীকে জেতার কথা ভাবছেন।

পাশাখেলার উত্তেজনায় দ্রৌপদীর কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। অথবা বাড়ির কুলবধূকে যে পণ রাখা যায় এ-কথা যুধিষ্ঠির হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু সেই অভাবিত অশ্রদ্ধেয় আচরণেও যে যুধিষ্ঠিরকে প্রবৃত্ত করলেন অথবা প্রবৃত্ত করতে পারলেন শকুনি, সেখানেই তাঁর কূটবুদ্ধির মুনসিয়ানা। আসলে শকুনি বুঝেছিলেন যে, প্রত্যেকবারেই যুধিষ্ঠির ভাবছেন— তিনি শেষ বাজিটা জিতে যাবেনই। হারুয়া পাশাড়ের এই ভয়ংকর উত্তেজনাতেই যুধিষ্ঠির ভীম-অর্জুনকে বাজি রাখার পর নিজেকেও বাজি রেখে হেরে বসে আছেন। ঠিক এই অবস্থায় কী অদ্ভুত কৌশলে শকুনি তাঁকে বললেন— এটা একেবারেই খারাপ কাজ করলে যুধিষ্ঠির। একেবারেই গর্হিত কাজ করলে। নিজেকে কি কেউ এইভাবে বাজি রাখে নাকি? তাও বুঝতাম— যদি তোমার ধন-সম্পত্তি কিছু না থাকত অথবা না থাকত পণ রাখার মতো আর কোনও জিনিস। বাজি রাখার জিনিস থাকতেও নিজেকে বাজি রেখে পাশাখেলার দফা রফা করে দেওয়াটা তো পাশাড়ের ধর্মে একান্তই পাপ— শিষ্টে সতি ধনে রাজন্‌ পাপ আত্মপরাজয়ঃ। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অন্যায় করছেন, পাপ করছেন— কথাটা শুনেই তিনি অবহিত, সতর্ক হয়ে বসলেন। আর ঠিক সেই আত্মারাম মুহূর্তেই শকুনির কূটশব্দ নেমে এল— একটা পণ এখনও তো বাকি আছে যুধিষ্ঠির। তুমি তো তোমার পরম প্রিয়া কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে এখনও পণ রাখোনি। তুমি তাঁকে বাজি রেখে নিজেকে মুক্ত করে নাও এখনই— পণস্ব কৃষ্ণাং পাঞ্চালীং তয়াত্মানং পুনর্জয়। দিগ্‌বিদিগ্‌জ্ঞানশূন্য যুধিষ্ঠির বাজি রাখলেন কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে, কৌরবসভায় ধিক্কার শব্দ উচ্চারিত হল চারিদিকে। আর তারই মধ্যে শকুনি জিতে নিলেন দ্রৌপদীকে।

শকুনি দুর্যোধনকে কথা দিয়েছিলেন— রাজ্য এবং রাজলক্ষ্মী দুটোই তোমায় এনে দেব একসঙ্গে— রাজ্যং শ্রিয়ঞ্চ তাং দীপ্তাং ত্বদর্থং পুরুষর্ষভ। শকুনি সব জিতে দীপ্তা রাজলক্ষ্মী-স্বরূপিনী দ্রৌপদীকেও শকুনি জিতে নিলেন।

ভারী আশ্চর্য, শকুনির এই সাংঘাতিক পণজয়ের পরও তাঁকে কিন্তু আমরা কথঞ্চিং উদাসীনই দেখতে পাই। পাশাখেলার পরবর্তী পর্বে দ্যূতসভার রাশ প্রধানত চলে গেছে দুর্যোধন, দুঃশাসন এবং কর্ণের হাতে। শকুনিকে মাঝে মাঝে দুর্যোধন-কর্ণের দুষ্কার্য সমর্থন করতে দেখেছি, একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে আসার পর দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণের উদ্দাম হাসির সঙ্গে গলা মিলিয়ে কখনও বা তাকে হাসতেও দেখেছি। কিন্তু মামার জেতা খেলায় দুর্যোধন-দুঃশাসনরা যেরকম বাঁধনহীন উদ্দাম ব্যবহার করেছিলেন, এমনকী পরের দেওয়া জয়ে কৌরবসভার অন্যতর পরভৃৎ কর্ণও যে নির্লজ্জ ব্যবহার করেছিলেন, শকুনি কিন্তু সেই তুলনায় অনেক উদাসীন। পরিষ্কার বোঝা যায়, পাশাখেলাটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় কথা ছিল। খেলায় জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিবৃত্ত, খানিকটা উদাসীনও বটে। হয়তো বা খানিকটা সংকোচও এখানে কাজ করেছে।

অবশ্য পাশাখেলার শঠতা এবং ধূর্ততা যাই থাক, শকুনি যে গান্ধার দেশ থেকে এসে জামাইবাবুর বাড়িতে সারাজীবনের জন্য থেকে গেলেন— এর জন্য শত্রুপক্ষের নানা লোকের কাছে যথেষ্ট কথা শুনতেও হয়েছে তাঁকে। কিন্তু আশ্চর্য, এইখানে তাঁর কোনও লজ্জা নেই। খেলা যখন পুরোদমে চলছে, যুধিষ্ঠির একের পর এক বাজি হারছেন, তখন সর্বদর্শী বিদুর একটা স্মরণীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিদুর বুদ্ধিমান লোক। দ্যূতসভার সমস্ত প্রক্রিয়াটির জন্য তিনি সম্পূর্ণ দায়ী করেছেন দুর্যোধনকে, কারণ তাঁর হাতে রাজযন্ত্র। কিন্তু অনুযোগ-আক্ষেপের শেষে দুর্যোধনের দুষ্কর্মসিদ্ধির উপায়ভূত শকুনিকে তিনি গালাগালি দিয়ে বলেছেন— আমরা শকুনির খেলা জানি— জানীমহে দেবিতং সৌবলস্য। সে, পার্বত্যভূমি গান্ধারের অধিবাসী। পাশাখেলার শঠতা এবং ধূর্ততা সম্পূর্ণ তার করায়ত্ত। আমরা চাই সে যেখান থেকে এসেছিল, সেখানেই সে চলে যাক— যতঃ প্রাপ্তঃ শকুনিস্তত্র যাতু।

কিন্তু এসব কথায় শকুনির কিছু হয় না। এসব গালাগালি তাঁর গা-সওয়া। কৌরবসভার সমৃদ্ধি এবং রাজসিক ক্ষমতাভোগের নেশা এমনভাবেই তাঁকে পেয়ে বসেছিল যে, এইসব গালাগালিতে তাঁর কিছু হয় না। আবার অন্যদিকে তাঁরই আনা জয়ে দুর্যোধন দুঃশাসন-কৰ্ণরা যখন রাজসভার মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ আরম্ভ করলেন, সেখানেও শকুনিকে আমরা খুব অতিহৃষ্ট জয়োন্মত্ত অবস্থায় দেখিনি। আসলে এইটাই খলের স্বভাব। অতি ক্রূর ব্যবহার করেও, শঠতার চূড়ান্ত পরিচয় দিয়েও খলস্বভাব ব্যক্তি যেমন ঠান্ডা মাথায় ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে শকুনিও সেইভাবেই কুরুসভায় দাঁড়িয়েছিলেন।

একবার নয়, দু’বার পাশা খেলেছিলেন শকুনি এবং দ্বিতীয়বারের পণও শকুনি জিতে নেওয়ায় পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠাতে দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের কোনও অসুবিধেই হয়নি। আমাদের ধারণা, দ্বিতীয়বারের এই পাশাখেলাতে যে সর্বগ্রাসী পণ ধরা হয়েছিল সেখানেও শকুনির বুদ্ধি ছিল। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের জিতবস্তু সব ফিরিয়ে দিলে তাঁরা যখন অর্ধেক পথ চলে গেছেন, তখনই দুঃশাসন এসে এই দুঃসংবাদ দিলে আবারও দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ-শকুনির গুপ্তসভা বসেছে— অথ দুর্যোধনঃ কর্ণঃ শকুনিশ্চাপি সৌবলঃ। এই সভায় কে কীভাবে মন্তব্য উপস্থাপন করলেন, অথবা কেই বা বিশেষভাবে ঠিক বনবাসের পণ রাখার কথাটা বললেন, তা স্পষ্ট করে বলা নেই। কিন্তু পূর্বে শকুনিই যেহেতু একটা একটা করে সব জিতে নেবার পরিকল্পনা দুর্যোধনকে জানিয়েছিলেন, তাই এবারে একটাই পণ এবং তা বনবাস— একথা শকুনিরই মস্তিষ্ক-প্রসূত হবার কথা। কারণটাও খুব সহজবোধ্য। একটার পর একটা পণ জিতে শকুনির মনোবল এখন তুঙ্গ-বিন্দুতে পৌঁছেছে। কুড়ি-পঁচিশবার পণ রেখে একবারও যিনি হারেননি, তাঁর পক্ষে শূন্যহৃদয় বিধ্বস্ত যুধিষ্ঠিরকে আরেকবার পণে জেতা নিতান্তই সাধারণ হস্তচালনার কাজ। সংক্ষিপ্ত-সভার ঐকান্তিক মতের কথা দুর্যোধনই ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়েছেন বটে এবং পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনার কাজটাও ধৃতরাষ্ট্রকে করতে হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি, কিন্তু পুনর্বার দ্যুতসভায় পণের শর্তটা আর দুর্যোধনের মুখে উচ্চারিত হয়নি। কেন না এ তো ধন নয়, ঐশ্বর্য নয়, মণিমুক্তো-রাজলক্ষ্মী কিছু নয়, শুধু একটা ভয়ংকর সর্বনাশা পণ রাখা। তাও কার কাছে, যিনি এতবার হেরে এসেছেন এবং একটু আগে যাঁর চোখের সামনে পাণ্ডব-কুলবধূর ধর্ষণোচিত অপমানটুকু হয়ে গেল। এমন একটা মানুষ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ মান্য করতে গিয়ে যেই না সভায় এসে উপস্থিত হলেন, তার আগেই কিন্তু যুধিষ্ঠির হেরে বসে আছেন। তিনি জানেন— শকুনি খেলার সময় কাউকে না বুঝতে দিয়েই অদ্ভুতভাবে গুটি সরিয়ে নিজের বলা চাল ঠিক করে রাখবেন— জানংশ্চ শকুনের্মায়াং পার্থো দ্যূতমিয়াৎ পুনঃ। যুধিষ্ঠির দ্যূতসভায় এসে বসতেই শকুনিই কথা বলছেন এবার, দুর্যোধন নয়। শকুনি বললেন— মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যে তোমাদের ধনৈশ্বর্য সব ফিরিয়ে দিয়েছেন— এটা খুব ভাল কাজ করেছেন। তবে কিনা এবারের পণটা হবে অন্যরকম এবং পণ রাখব একবারই, মাত্র একবার— মহাধনং গ্লইং ত্বেকং শৃণু মে ভরতৰ্ষভ। পণ রাখার সময় প্রথমে শকুনি নিজেদের কথা বলতে আরম্ভ করলেন। বললেন— তোমরা যদি আমাদের পাশায় হারাতে পারো, তা হলে আমরা বারো বছরের জন্য বনবাসে যাব এবং এক বছর অজ্ঞাতবাস করব। অজ্ঞাতবাসের সময় তোমরা যদি আমাদের সংবাদ জেনে যাও, তা হলে আবার বারো বছরের জন্য বনে যাব আমরা। আর আমরা যদি তোমাদের ওপর জয়লাভ করি, তা হলে দ্রৌপদীর সঙ্গে তোমরাও মৃগচর্ম পরিধান করে বনে যাবে বারো বছরের জন্য। অজ্ঞাতবাসের সময় তোমাদের খবর যদি আমরা জানতে পারি, তবে আবারও বারো বছরের বনবাস। এইভাবে তেরো বছরের মাথায় তোমরা বা আমরা আবারও রাজ্য ফিরে পাবো বা পাবে— স্বরাজ্যং প্রতিপওব্যম্‌ ইতরৈরথবেতরৈঃ।

শকুনি এমন সুন্দর পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে দুর্যোধন ভেবেছিলেন— পাণ্ডবরা আর কোনওদিনই রাজ্যে ফিরতে পারবেন না। শকুনির পণ শুনে দ্যূতসভার ভদ্রসভ্যজনেরা কিছু প্রতিবাদ করলেন বটে, কিন্তু ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কথা অমান্য করবেন না এবং ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুসরণ করে তিনি পাশা খেলতে বাধ্য— অক্ষদ্যূতে সমাহ্বানং নিয়োগাৎ স্থবিরস্য চ। লক্ষণীয়, অতিধীর যুধিষ্ঠিরও কোনও মহৎ সম্বোধনের বদলে ধৃতরাষ্ট্রকে এখন স্থবির বলছেন, কেন না তিনি শকুনি-দুর্যোধনের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। যুধিষ্ঠির বিনা বাক্যব্যয়ে পাশা খেলতে বসলেন এবং প্রায় এক মুহূর্তের মধ্যে তিনি হেরে গেলেন। হারবেন— সে-কথা তিনি জানতেনও। এক মুহূর্তের মধ্যে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানী এবং সবই চলে গেল শকুনির খল-পাশার চালে।

পাশা খেলতে গিয়ে শকুনি যত কৌশল, যত কূটবুদ্ধিই প্রকাশ করে থাকুন— তবু সেটা সমূহ অস্ত্ৰমৃত্যু ঘটায় না, কিন্তু এই পাশা খেলতে গিয়েই বিনা কারণে নিজের মৃত্যু ডেকে আনলেন শকুনি এবং সেটাই তাঁর পাশাখেলার শেষ ‘সিন্‌’। সরল হৃদয় ভীম অপমানের চরম সীমায় পৌঁছে এই মন্তব্য করেছিলেন যে, ওই চারজন— দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি এবং দুঃশাসন— এই চারজনের রক্ত খাবে এই রাজ্যের মাটি— ভূমিঃ পাস্যতি শোণিতম্‌। ভীম জানেন শকুনিকে মারবার জন্য শারীরিক শক্তি বা অস্ত্রকৌশল কোনওটাই বেশি প্রয়োজন নেই, সে-কাজ কনিষ্ঠ সহদেবই সাঙ্গ করে দেবেন এবং ভীম সে-কথা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে সহদেব তাঁর বাহু বিস্ফোটিত করে শকুনিকে বধ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছেন। বলেছেন— পাশার যে গুটিগুলিকে আশ্রয় করে আজকে তুই যে কাজ করলি, সেগুলি আমার বাণ হয়ে তোর বুকে এসে বিঁধবে— ন তেহক্ষা নিশিতা বাণাস্ত্বয়ৈব সমরে বৃতাঃ।

॥ ৫ ॥

শকুনির কোনও লজ্জা হয়নি এতে। কর্ণ-দুর্যোধনের ক্ষমতায় বিমোহিত শকুনি এতটুকু লজ্জা পাননি। আসলে এটাই বোধহয় খল মানুষের স্বভাব। নীতিশাস্ত্রজ্ঞ মানুষেরা অসংখ্যবার খলস্বভাব মানুষের নিন্দা করেছেন এবং সেই নিন্দার একটা বড় দিক হল এই যে, খল তথা দুর্জন বিনা কারণেই স্বভাববশত অন্যের ক্ষতি করে। এক কবি লিখেছেন— হরিণেরা ঘাস খেয়ে সুখে থাকে, জলের মধ্যে মাছও কারও ক্ষতি করে না, আর সজ্জন মানুষ আপনাতে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন। কিন্তু ব্যাধ যেমন বিনা কারণেই স্বভাববশত তৃণভোজী হরিণ শিকার করে, ধীবর যেমন স্বভাববশতই জলের মাছ ধরে আনে, তেমনই খলস্বভাব ব্যক্তি বিনা কারণেই আপন স্বভাবে স্বধন-সন্তুষ্ট সজ্জনের ক্ষতিসাধন করে। পাশা খেলে পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়েও শকুনির সন্তষ্টি হয়নি। যুধিষ্ঠির সপরিবারে পরম সন্তোষে বনবাস করছেন, এই আত্মারাম সজ্জন-স্বভাব শকুনির ভাল লাগে না। খলস্বভাব শকুনির খলতা কমে না। পাণ্ডবরা তখন বনবাসে আছেন, এদিকে দুর্যোধন-দুঃশাসনরাও নিশ্চিন্তে রাজ্যের সমৃদ্ধি ভোগ করছেন। কিন্তু শকুনি— দুর্যোধনকে খুশি করার জন্যই হোক অথবা খলস্বভাব মানুষের মতো নিজের আত্ম-বিনোদনের জন্য— শকুনি কর্ণকে সঙ্গে নিয়ে সমস্বরে দুর্যোধনকে বললেন— বলছি বটে সমস্বরে কর্ণের সঙ্গে শকুনি বললেন, কিন্তু মহাভারত বলেছে— শকুনিরুবাচ— অর্থাৎ শকুনিই সব বললেন। শকুনি বললেন— বেশ তো আছ, ভাগনে! তুমি নিজের ক্ষমতায় পাণ্ডবদের বনে তাড়িয়ে দিয়ে স্বর্গসুখেই তো আছ ভাগনে। পুব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সবদিকের সব রাজারাই এখন তোমাকে কর দেয়। যে রাজলক্ষ্মী একসময় ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের সেবা করতেন, তিনি এখন তোমার সেবায় উপস্থিত— সাদ্য লক্ষীস্ত্বয়া রাজন্ অবাপ্তা ভ্রাতৃভিঃ সহ। এই গ্রাম, নগর, উপবন, ঐশ্বর্য, বিলাস— সবকিছু এখন তোমারই অধিকারে। ব্রাহ্মণরা তোমার স্তুতি করেন, রাজারা তোমাকে মেনে চলেন, আর তোমার উলটোদিকে পাণ্ডবদের দেখো— কোনওদিন তারা তোমার আদেশের তোয়াক্কা করত না, কোনওদিন তোমার শাসন মানত না— যৈঃ স্ম তে নাদ্রিয়েতাজ্ঞা ন চ তে শাসনে স্থিতাঃ— সেই পাণ্ডবরা এখন শ্রীহীন, সমৃদ্ধিহীন বনবাসে পচে মরছে।

শকুনি যা এতক্ষণ ধরে বললেন, সেটা কিন্তু ভণিতা। ভণিতার সময় তিনি শুধু তথ্যালাপ করেন, অর্থাৎ যেমনটি আছে, যেমনটি ঘটেছে, তার বর্ণনা দেন, ঠিক যেমন আগে ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধি দেখে প্রথমে তিনি সত্য কথা বলে দুর্যোধনের ক্রোধ চাগিয়ে তুলেছিলেন। আজকের ভণিতা আরও খারাপ, এখন ক্রোধ উদ্দীপিত করার কোনও কারণ নেই, কারণ পাণ্ডবরা শ্রীহীন বনবাসী। কিন্তু কতখানি খলস্বভাবের মানুষ এই শকুনি যে, পাণ্ডবদের এই দৈন্যদশার মধ্যেও কীভাবে তাঁদের আরও কষ্ট দেওয়া যায়, সেই ব্যাপারে এবারে তিনি দুর্যোধনকে উদ্দীপিত করছেন। আমাকে এক ভদ্রলোক— তিনি তত খল নন মোটেই, তবুও আমার প্রতি অনুকম্পাবশত তিনি খলের স্বভাবসরসতা জানিয়ে আমাকে বলেছিলেন— দেখো ভাই, তোমার সুনাম শুনে যদি না তোমার শত্রু-মিত্র কেউই না জ্বলে মরল, তা হলে বুঝতে হবে, তোমার কোনও সমৃদ্ধিই হয়নি। আমার তখন শকুনির কথা মনে এল।

শকুনি দুর্যোধনের সমৃদ্ধির নানা প্রশংসা করে আস্তে আস্তে বললেন— শোনো ভাগনে! পাণ্ডবরা কোনওদিন তোমার কথা শোনেনি, তারা এখন ঋদ্ধিহীন। অতিকষ্টে তারা বনবাসে কাল কাটাচ্ছে। শুনতে পাই— ওরা নাকি দ্বৈতবনে বাস করছে আজকাল। তাই বলছিলাম— একটা কাজ করলে হয় না? তোমার এত বড় রাজ্য, আর ওরা রাজ্যহীন। তোমার এই সমৃদ্ধি, আর ওরা ঋদ্ধিহীন। এই অবস্থায় পাণ্ডবদের সঙ্গে একবার তোমার দেখা করা উচিত— অসমৃদ্ধান্‌ সমৃদ্ধার্থঃ পশ্য পাণ্ডুসুতান্‌ নৃপ।

কথাটা শুনলে আপাতত ভাল করে বোঝা যায় না, শকুনি ঠিক কী বলতে চাইছেন। কিন্তু খলস্বভাব ব্যক্তি আস্তে আস্তে ঠান্ডা মাথায় পরের ক্ষতি করে আনন্দ পায়। শকুনি বললেন— তোমার যে অনেক আছে, তোমার যে অনেক ক্ষমতা এটা যদি না দেখানো যায়, তবে এই ঋদ্ধি-শক্তির কোনও মানেই নেই। সত্যি কথা বলতে কী— ঘরে যদি প্রথম ছেলেপিলে হয়, তবে সেই পুত্রলাভের আনন্দও তেমন কিছু নয়, রাজ্যলাভ করেও তেমন কোনও আনন্দ নেই, যতখানি আনন্দ হয় শত্রুকে কষ্টক্লিন্ন অবস্থায় দেখলে।

তুমি ভাবো— কী আরামটাই না হবে— যখন তুমি দ্বৈতবনে গিয়ে গাছের বাকল পরা মহাবীর অর্জুনকে দেখবে— কিং নু তস্য সুখং ন স্যাদাশ্রমে যো ধনঞ্জয়ম্‌। একই সঙ্গে কুরুবাড়ির বউদের তুমি কিন্তু গা ভর্তি করে গয়না পরিয়ে দামি দামি শাড়ি পরিয়ে নিয়ে যাবে, যাতে তাঁদের দেখে গাছের বাকল পরা দ্রৌপদীর চোখ টাটায়। আসল কথা, পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থেকে সমভূমির লোকগুলোকে দেখতে যেমন ছোট্ট আর মজা লাগে, সমৃদ্ধিহীন অবস্থায় বনবাসী পাণ্ডবদের একবার দেখে আসলেও সেইরকম আরাম হবে— জগতীস্থান্‌ ইবাদ্রিস্থঃ কিমতঃ পরমং সুখম্‌।

শকুনি বলেছিলেন— একটা কথা বোঝবার চেষ্টা করো, ভাগনে! গাছের বাকল পরে অথবা মৃগচর্মের পরিধান গায়ে নিয়ে দ্রৌপদী যখন সালংকারা কৌরব-বধূদের দেখবে, তখন নিজের ধনবিহীন জীবনকে ধিক্কার দেবে দ্রৌপদী— বিনিন্দতাং তথাত্মানং জীবিতঞ্চ ধনচ্যুতম্। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের দ্যূতসভায় ওর কাপড় টানাটানি করার ফলেও ও যে দুঃখ পায়নি, সেই দুঃখ আজ পাবে, যদি দ্রৌপদী তোমাদের বউদের প্রচুর গয়না পরা অবস্থায় দেখে— বৈমনস্যং যথা দৃষ্ট্বা তব ভার্য্যাঃ স্বলঙ্কৃতাঃ। শকুনি সবসময় পরিষ্কার কথা বলেন না, তবে দ্রৌপদীর ব্যাপারে দুর্যোধন-ভাইদের তথা কর্ণের কতটা দুর্বলতা আছে, তা তিনি জানেন এবং সেইজন্যেই ভাব-ব্যঞ্জনায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, কৌরববধূদের সালংকার, সমৃদ্ধ সৌন্দর্য দেখে নিজের স্বামীদের ওপর ঘেন্না হবে দ্রৌপদীর। স্বামী হিসেবে তখন বরঞ্চ দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণদের পছন্দ হয়ে যেতে পারে। আমাদের ধারণা— শকুনির কথার মধ্যে এই ইঙ্গিতটুকু ছিল বলেই হয়তো কর্ণও শকুনির মত সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন। আর একটু সময়ের মধ্যেই দুর্যোধনকে আমরা শকুনির প্রস্তাবে উচ্ছ্বসিত হতে দেখছি। মৃগচর্ম পরিধানে পাণ্ডবদের দেখে যে আনন্দ হবে অথবা গেরুয়া পরা দ্রৌপদীকে দেখে যে আমোদ দুর্যোধন লাভ করবেন, তা যে পার্থিব কোনও সুখের সঙ্গেই তুলনীয় নয়, সে-কথা শকুনির কুরুচিতেই প্রথম আবিষ্কার করলেন দুর্যোধন। কিন্তু এই প্রস্তাব নিয়ে পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাঁর যাবার সাহস ছিল না। ফলে কীভাবে সে কাজটা করা যায়, সেটা শকুনি, দুঃশাসন এবং কর্ণ মিলেই যেন ঠিক করেন— এটাই ছিল দুর্যোধনের নিবেদন| লক্ষণীয়, কর্ণ এবং দুঃশাসন আলাদাভাবে যা ঠিক করেছিলেন, শকুনি সেটা একাই চিন্তা করেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলার সময় যেহেতু ভীষ্ম সেখানে উপস্থিত থাকবেন, তাই যুক্তি-সাহায্যের জন্য শকুনিকে প্রয়োজন হবে ভেবেই শকুনিকে সঙ্গে নিয়েই ধৃতরাষ্ট্রের সভায় উপস্থিত হলেন দুর্যোধন।

প্রথম কথা বললেন শকুনি এবং কর্ণ। অর্থাৎ সেই দ্বৈতবনের কাছে যে ঘোষপল্লী আছে, সেখানে কৌরবদের গোধন থাকে। যেহেতু সেটা গোপ্রজনন কেন্দ্র, অতএব গোরু এখন সংখ্যায় কত হল, তাদের দেখভাল কেমন হচ্ছে, সেসব কৌরবরা বুঝে আসতে চান। পাণ্ডবদের কাছে দেমাক দেখানোর কথাটা কেউ বললেন না। ধৃতরাষ্ট্র পাকামাথার লোক এবং তাঁর স্বভাবের মধ্যেও কিছু ছলনা আছে বলে, ছলনা বুঝতে পারেন ভাল। তবে স্বকীয় বুদ্ধিতে তিনি এইটুকু বুঝেছেন যে, বনবাসী পাণ্ডবদের দুর্বল ভেবে দুর্যোধনেরা তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে নিতে পারেন। এইবারে এককভাবে মুখ খুললেন শকুনি। কত বিশ্বাসযোগ্যভাবে যুধিষ্ঠিরের ওপর কত শ্রদ্ধায় যেন শকুনি বললেন— মহারাজ! যুধিষ্ঠির ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি। আমরা দ্বৈতবনে গিয়েছি বলেই তিনি এবং তাঁর ভাইরা আমাদের আক্রমণ করবেন, এমন অন্যায় ক্রোধ যুধিষ্ঠিরের নেই। বারো বছর বনবাস-পর্ব শেষ না হলে এই অন্যায় তিনি করবেন না। তা ছাড়া আমরা তো আপন মনে সেখানে মৃগয়া করব আর সেই সঙ্গে আমাদের গোধনের সংখ্যাও নির্ণয় করে আসব। শকুনির কথায় কাজ হল। ধৃতরাষ্ট্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনুমতি দিলেন এবং দুর্যোধন মহানন্দে কর্ণ-শকুনিকে সঙ্গে নিয়ে দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের পর্ণকুটিরের কাছাকাছি ছাউনি ফেললেন।

দেখলেন তো! কোনও কারণ লাগে না শকুনির শঠতার জন্য। কিন্তু শকুনির বুদ্ধিতে পাশা খেলে দুর্যোধন যেমন জিতেছিলেন এবারে সেই জেতাটুকু আর হল না। দ্বৈতবনে কৌরবদের অনেক আগেই থানা গেড়েছিলেন গন্ধর্ব চিত্রসেন। তিনি অর্জুনের বন্ধু। দুর্যোধনের অসভ্যতা আঁচ করেই তিনি কৌরবদের সঙ্গে বিবাদ আরম্ভ করলেন এবং যুদ্ধে হারিয়ে দুর্যোধন-দুঃশাসন, এমনকী তাঁদের সকলের স্ত্রীদেরও বন্দি করে নিয়ে গেলেন চিত্রসেন। অবশেষে পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের করুণায় এবং অর্জুনের বীরত্বে দুর্যোধনের জীবন বাঁচল, সেখানে শকুনির কুচুটে বুদ্ধি একেবারেই মাঠে মারা গেল। কিন্তু তবু তাঁর খলতা গেল না।

বনবাসের অরণ্যকুটিরে পাণ্ডবরা যেখানে দুঃখে-দৈন্যে দিন কাটাচ্ছিলেন, সেখানে গিয়ে। নিজেদের সমৃদ্ধি প্রকাশ করার গ্রাম্য পরিকল্পনাটা শকুনিরই ছিল। দুর্যোধন-কর্ণের মতো ক্ষত্রিয় বীরেরাও যে এই পরিকল্পনায় নেচে উঠেছিলেন, তার কারণ অন্তরে অন্তরে তাঁদের মধ্যেও এই গ্রাম্যতা ছিল, যাতে পাণ্ডবদের ক্লিষ্ট দেখলেই আনন্দ পাওয়া যায়। কিন্তু আনন্দ পেতে গিয়ে দুর্যোধন যেমন ঠান্ডা মাথায় অপমানিত হলেন, তাতে লজ্জায় তিনি মাটিতে মিশে যেতে চাইলেন। হয়তো উপযুক্ত ক্ষাত্র-তেজ তাঁর মধ্যে ছিল বলেই তাঁর এই লজ্জা, যে লজ্জায় তিনি প্রায়োপবেশনে জীবন বিসর্জন দিতে চাইলেন। এই অবস্থায় কর্ণের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। কর্ণ নিজে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এবং তাতে তাঁরও কোনও লজ্জা হয়নি। পাণ্ডব যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে যে বন্দি-দশা থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সেই ঘটনায় তাঁর যুক্তি হল— পাণ্ডবরা এটা ঠিক কাজই করেছে। তুমি রাজা বলে কথা, রাজার বিপদে রাজ্যবাসী প্রজারা তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, তোমার প্রজা হিসেবে এটাই তো পাণ্ডবদের কর্তব্য ছিল। তারা কর্তব্য করেছে, এতে তোমার লজ্জা কীসের— কর্তব্যং হি কৃতং রাজন্‌ পাণ্ডবৈস্তব মোক্ষণম্।

কর্ণ যতই যুক্তি দিন, যেভাবে নিজের ঘরের বউ-ঝিদের গন্ধর্ব চিত্রসেন ধরে নিয়ে গেলেন এবং যেভাবে পাণ্ডবরা দুর্যোধন তথা তাঁর অন্তঃপুরবাসিনী স্ত্রীলোকদের মুক্ত করেছিলেন, সে-লজ্জা দুর্যোধন লুকোতে পারছেন না। তিনি কিছুতেই হস্তিনায় ফিরতে চাইলেন না এবং প্রায়োপবেশনে আত্মহত্যা করার সংকল্পে অটুট রইলেন। এই অবস্থায় মামা শকুনি এলেন দুর্যোধনের সঙ্গে কথা বলতে, কারণ পাণ্ডবদের সামনে আপন সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে তাঁদের বিমর্ষ বাড়িয়ে তোলার বুদ্ধি তো তাঁরই দেওয়া। শকুনির কথা বলার ক্ষমতা অসাধারণ— যুক্তির সঙ্গে ইমোশন মিলিয়ে তিনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেন, যাতে উত্তরপক্ষ বশীভূত না হয়ে পারে না। বিশেষত তিনি ক্ষাত্রতেজের ধার ধারেন না, তেজহীন নির্লজ্জ কৌশলেও তাঁর কোনও অরুচি নেই, অতএব কর্ণের কথাগুলি তিনি আরও নিবিড় কৌশলে উপস্থিত করলেন। শকুনি বললেন— তুমি কেন এত কষ্ট পাচ্ছ দুর্যোধন! এটা তো নিতান্তই মূর্খতা। শোক-কষ্ট পেতে থাকলে শোক কখনও যায় না— ন শোকঃ শোচমানস্য বিনিবর্তেত কৰ্হিচিৎ। এমনভাবে কখনও কষ্ট পেয়ো না যাতে তোমার শত্রুর আনন্দ হয়। একটা কথা তোমায় বলে রাখি— কর্ণ যেটা বলেছে, সেটা একশো ভাগ ঠিক। পাণ্ডবরা তো সত্যিই তাদের কর্তব্য করেছে, এতে লজ্জা পাবার কী আছে, তোমাকে রক্ষা করাই তো তাদের কর্তব্য ছিল— সম্যগুক্তং হি কর্ণেন তচ্‌ছ্রুতং কৌরব ত্বয়া।

শকুনি এবার তির্যক ব্যঞ্জনায় দুর্যোধনকে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন— যে ক্ষাত্ৰতেজে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুর্যোধন লজ্জায় প্রাণত্যাগ করতে চাইছেন, সেই ক্ষাত্র মহিমায় যুদ্ধ করে তিনি রাজ্য লাভ করেননি। শকুনি বললেন— আমি পাশার চালে তোমাকে এই বিশাল রাষ্ট্র এবং সম্পদ এনে দিয়েছি, কিন্তু কোন মোহে, কোন নির্বুদ্ধিতায় আজ সেই সম্পদ তুমি অবহেলা করে প্রাণ দিতে চাইছ— ময়াহৃতাং শ্রিয়ং স্ফীতাং তাং মোহাদপহায় কিম্‌। একটা কথা কী জানো, বাছা! যে মানুষ আনন্দ আর দুঃখ জিনিসটাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না, সে হল কাঁচা মাটির সদ্য-ঘট, জলে পড়লেই গলে যাবে। তুমি যেমন করছ, এতে প্রজারা তো তোমাকে কোনও শ্রদ্ধাই করতে পারবে না। তোমাকে এবং কুরুকুলের স্ত্রীদের সম্মান বাঁচিয়ে পাণ্ডবরা তোমারই গৌরব বাড়িয়েছে, অতএব যেখানে তোমার আনন্দ হওয়া উচিত, সেখানে তোমার শোক হচ্ছে। এ তো উলটো ভাবনা— সৎকৃতস্য হি তে শোকো বিপরীতে কথং ভবেৎ!

শকুনি তো বুঝতে পারছেন যে, দুর্যোধনের কোথায় ব্যথা লাগছে। সঙ্গে এটাও তিনি বোঝাতে চাইছেন যে, যারা যুদ্ধ করে রাজ্যপাট জেতেনি, তাদের ‘প্রেস্টিজ’-এর বোধটাও অন্যরকম হওয়া উচিত। ক্ষাত্র-তেজের ‘ইগো’ নিয়ে বসে থাকাটা শকুনির কাছে নিতান্ত আড়ম্বর বলেই শকুনি এবার দুর্যোধনের চরম দুর্বলতার স্থান বুঝে মোক্ষম ঘা দিলেন তাঁকে। বোঝাতে চাইলেন— এতই যদি লজ্জা, এতই যদি ‘প্রেস্টিজ’, তা হলে পাণ্ডবদের রাজ্যটা তাদের ফিরিয়ে দাও না বাপু! কিন্তু কথাটা শকুনি বললেন অসামান্য কৌশলে। বললেন— আমি তো মনে করি যে, পাণ্ডবরা তোমাকে বাঁচিয়েছে বলে তোমার যেমন খুশি হওয়া উচিত, তেমনই পাণ্ডবদের প্রশংসাও করা উচিত তোমার— যত্র হর্ষস্ত্বয়া কার্যঃ সৎকর্তব্যাশ্চ পাণ্ডবাঃ। আমি এটাও বলব যে, পাণ্ডবরা যখন তোমার এতই উপকার করেছে, তখন তাদের রাজ্যপাট, ধনসম্পত্তিও তাদের ফিরিয়ে দাও। এতে তোমার যশও হবে, ধর্মও হবে, ভাইতে ভাইতে সৌহার্দ্যও বাড়বে— প্রযচ্ছ রাজ্যং পার্থানাং যশো ধর্মমবাপ্নুহি।

ভাইতে ভাইতে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য— সৌভ্রাত্রং পাণ্ডবৈঃ কৃত্বা— এই কথাটা শুনলেই দুর্যোধনের ক্রোধ কোথায় পৌঁছতে পারে শকুনি সেটা জানেন এবং এই এখন থেকেই দুর্যোধনের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। মহাভারতের এই জায়গাটা দেখলে বুঝতে পারবেন— আর সময় বেশি লাগেনি। এরপরেও দুর্যোধন খানিকক্ষণ আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন বটে, তবে আর বেশি সময় লাগেনি, অচিরেই তিনি আত্মগ্লানি ভুলে হস্তিনায় ফিরে গেছেন। কোথা থেকে নতুন এক সুখস্বপ্ন এসে আবারও তাঁকে উদ্‌বুদ্ধ করে তুলল। দুর্যোধন ভাবলেন— তাঁর বন্ধুরাই তাঁকে অভীষ্ট জয় এনে দেবে। দুর্যোধন এই স্বপ্ন-বৃত্তান্ত কাউকে বললেন না— ন চাচচক্ষে কস্মৈচিদ্‌ এতদ্‌ রাজা সুযোধন— তিনি হস্তিনায় ফিরে এলেন কর্ণের হাতে অর্জুন-বধের স্বপ্ন পোষণ করে।

আমরা মনে করি— শকুনিই তাঁর কথার জাদুতে এমন সুখস্বপ্ন দেখাতে পারেন দুর্যোধনকে। দুর্যোধনকে তিনি কতটা ভালবাসতেন সেটা খুব পরিমাপ করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু প্রত্যেক ভালবাসার মধ্যেও মানুষের নিজের মনোবৃত্তি এবং চরিত্র কাজ করে। শকুনি পাশা খেলেন, সেই খেলায় কপটতা করেন এবং সেই কপটতার মাধ্যমে যেটুকু সাফল্য আসে, সেটাকেই তিনি এতটাই চরম সাফল্য ভাবেন, যাতে এই অহমিকার শব্দ অনায়াসে তাঁর মুখে উচ্চারিত হয়— আমি তোমাকে যে স্ফীত রাজলক্ষ্মী আহরণ করে এনে দিয়েছি, তোমার মূর্খতায় সেই রাজলক্ষ্মী তুমি হারাবে— ময়াহৃতাং শ্রিয়ং স্ফীতাং/তাং মোহাদ্‌ অপহাসি কিম্। বলা বাহুল্য, শকুনি এই পাশার কেরামতিটুকুই বোঝেন, আর কিছুই বোঝেন না। ক্ষত্রিয়ের তেজ বোঝেন না, রাজনীতির কূট বোঝেন না, রাজধর্ম তো বোঝেনই না। যারা এমন কথা বলেন যে, পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষীয় রাজনীতিতে শকুনিই হলেন অন্যতম প্রধান চরিত্র এবং পাণ্ডবপক্ষীয় কৃষ্ণের বিপরীতে তাঁর অসামান্য ভূমিকা, তাঁরা মহাভারত কিছু বোঝেননি। মহামতি কৃষ্ণের রাজনৈতিক বুদ্ধি, তাঁর দূরদর্শিতা এবং তাঁর পরিশীলিত রাজনৈতিক চেতনার প্রতিপক্ষে শকুনি কীটমাত্র। তাঁর কোনও রাজনৈতিক বুদ্ধিই নেই, তিনি দুর্যোধনের একটি ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ মাত্র, যেমন কর্ণ, অশ্বত্থামা অথবা জয়দ্রথও তাই, এমনকী স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রও সেই ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’। লক্ষ করে দেখবেন, পাণ্ডবদের বনবাসের কালে ওই যে ঘোষযাত্রার বুদ্ধিতে দুর্যোধন চরম নাকাল হলেন, তার পর থেকে শকুনির প্রায় ভূমিকাই নেই কোনও। ওই যে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে আসল আর তাঁদের খুঁজে বার করার জন্য নানান মন্ত্রণা আরম্ভ হল, সেখানে একবারের তরে শকুনিকে দেখা যাবে। অথবা শান্তির দৌত্য করতে কৃষ্ণ আসছেন কৌরবদের রাজসভায়, অতএব তাঁকে বন্দি করার ষড়যন্ত্র করলেন দুর্যোধন, আমরা সেই দুর্মন্ত্রণায় শকুনিকে শুধু সমর্থক হিসেবে দেখছি একবার।

আমরা বলতে চাই, মহাভারতের ওই বিশাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শকুনির এইসব ওপরচালাকি কথাবার্তার কোনও মূল্য নেই। এমনকী মূল্য নেই যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে সেই সামান্য ঘটনাটিরও, যখন শকুনির ছেলেকেই পাণ্ডবদের কাছে পাঠানো হল তাঁদের গালাগালি দিয়ে উত্তেজিত করার জন্য। আর যুদ্ধের আগে শকুনি কৌরবপক্ষের এক অক্ষৌহিণী সেনার অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন, সেটা এতটাই অকিঞ্চিৎকর ঘটনা যে, সেটাকে মহাকাব্যিক যৌক্তিকতায় একটা আড়ম্বর বলাই ভাল। এমনকী পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেবের হাতে শকুনির মৃত্যুটাও এতই অনাড়ম্বর যে, সেটা নিয়ে মহাকাব্যের কবিও কোনও মহাকাব্যিক মাত্রা সৃষ্টি করতে চাননি।

স্বীকার করে নেওয়া গেল যে, মহাকাব্যে ক্ষত্রিয়-জাতির বিশাল মাহাত্মের নিরিখে শকুনি তেমন কোনও চন্দনচর্চিত চরিত্র নন। কিন্তু তবু শকুনির কী অমানুষী ক্ষমতা। সেই কোন বয়সে গান্ধারীর পিছন পিছন এসে তিনি রাজবাড়িতে প্রবেশ করলেন। তারপর জামাইবাবুর অন্ধতার সুযোগ নিয়ে হস্তিনাপুরের রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে ক্ষত্রিয়ের মহত্ত্ব থেকে মুক্ত করে কপটতার অন্ধকারে ডুবিয়ে দিলেন পাশাখেলার নোংরামিতে। দুর্যোধনের মতো এক বিরাট বীরকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন যাতে তিনি তাঁর বীর-স্বভাব থেকে চ্যুত হয়ে পরপর কতগুলি কুচুটে অন্যায় করে গেছেন।

॥ ৬ ॥

এত বড় একজন পাশাড়ে, যিনি পাশা খেলেই কৌরব-পাণ্ডবদের রাজনীতির ধারাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে গেলেন কতকাল ধরে, তিনি কিন্তু প্রাণ দিলেন রাজনীতির সততার কাছেই। মুশকিলটা হল, শকুনি সারা জীবন ধরে দুর্যোধনের মনোরথ সাধন করে গেছেন এবং সেই মনোরথ সাধনের জন্য তিনি রাজনীতির মধ্যে পাশার চাল ব্যবহার করেছেন, কিন্তু রাজনীতি জিনিসটা এমনই, যেটা অশ্বত্থামা বলেছিলেন কৃত দানও নয়, দ্বাপর দানও নয়। আর অর্জুনের তূণ থেকে পাশার দান বেরোয় না, বেরোয় বাণ। শকুনি বোধহয় ভাবতেও পারেননি যে, এমন দিন কোনওদিন আসবে, যেদিন তাঁকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। বিশেষত রাজনীতি জিনিসটা যে তিনি কত কম বুঝতেন সেটা বোঝা যায়, যখন তিনি শান্তিদৌত্যে নিযুক্ত কৃষ্ণকে বন্দি করার উপদেশ দেন দুর্যোধনকে। যেখানে কুরুবাড়ির সমস্ত প্রধান পুরুষেরা, এমনকী ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত কৃষ্ণ আসবেন বলে তটস্থ হয়ে আছেন, সেখানে দুর্যোধন যদি বা নিজস্ব অহংমানিতায় কৃষ্ণকে বন্দি করতে চানও, তাতে বুঝি দুর্যোধনের চরিত্রটাই ওই রকম, কিন্তু শকুনি তাঁকে সমর্থন করেন কোন ভরসায়! নাকি তিনি এখন বেভরসা হয়েই দুর্যোধন যা করতে চাইছেন, তাতেই মদত দিচ্ছেন।

একটু আগে যখন কুরুসভায় দাঁড়িয়ে পাণ্ডবদের বনবাসের জন্য দুর্যোধনকে দায়ী করছিলেন কৃষ্ণ, তখন প্রতিপক্ষে অদ্ভুত একটা উত্তর দিয়েছিলেন দুর্যোধন। দুর্যোধন বলেছিলেন— আপনি এবং অন্যান্য কুরুপ্রধানেরা সমস্ত সময় আমাকে যে দুষছেন, সেটা ভীষণ অন্যায়। পাণ্ডবদের কোনও ক্ষতিতে আমার তো এতটুকুও দোষও নেই। এই যে যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে, সে তো তিনি খেলতে ভালবাসেন বলেই এসেছিলেন এবং তিনি খেলতে স্বীকৃতও হয়েছিলেন নিজেই। তারপর পাশার চালে তাঁর রাজ্য জয় করে নিলেন আমার শকুনি-মামা। সেখানে আমি কী দোষটা করলাম— জিতাঃ শকুনিনা রাজ্যং তত্র কিং মম দুষ্কৃতম্‌। তারপর এটাও দেখতে হবে যে, শকুনি-মামা বাজিতে যত ধনরত্ন জিতেছিলেন, সে সবই তো আমার পিতাঠাকুর ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। তারপরে আবার পাশাখেলা হল শকুনির সঙ্গে। যুধিষ্ঠির আবারও হারলেন শকুনিরই কাছে, তিনি বনবাসে গেলেন বাজিতে হেরে। তাতেও আমার কোনও অপরাধ ছিল বলে মনে হয় না— অপরাধো ন চাস্মাকং যত্তে দ্যূতপরাজিতাঃ।

দুর্যোধনের কথা শুনলে মনে হবে যেন সবটাই যুধিষ্ঠিরের দোষ, তারপর দোষ যদি দিতে হয়, তবে দিতে হবে শকুনিকে, যেহেতু তিনি ভাল পাশা খেলেন। দুর্যোধন যেন শিশুসুলভভাবে দুটি ব্যাপারকে আলাদা করে দিতে চাইলেন। যেন পাশাখেলার দায় তাঁর নয়, এবং এখন রাজ্য ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারটা যদি বা তাঁর দায় হয়ও, কিন্তু সেটা তিনি দেবেন না। কৃষ্ণের মতো বিশালবুদ্ধি মানুষের কাছে দুর্যোধনের এই যুক্তি এক ফুঁয়ে উড়ে গেল। তিনি পরিষ্কার বলে দিলেন— পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞে তাঁদের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েই তুমি পাশাখেলার কুমন্ত্রণা করেছিল শকুনির সঙ্গে— ত্বয়া দুর্মন্ত্রিতং দ্যূতং সৌবলেন চ ভারত। অতএব দায়টা তোমারই।

কৃষ্ণের এই কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, রাজনীতি ব্যাপারটা রাষ্ট্রের অধিকার নিয়েই আবর্তিত হয়। পাশাখেলার কুটিলতা বা কূটনীতিতে যে জয় সাময়িকভাবে আসে, তাকে স্থিরতার ভিত্তিতে দাঁড়াতে হলে স্পষ্ট এবং সুস্থ রাজনীতির সামনে তার বৃহত্তর পরীক্ষা দিতে হয়। শকুনি এবার বিপন্ন বোধ করছেন। এক সময় যেমন দুর্যোধনের মনোবৃত্তি সাধনের জন্য তিনিই পাশাখেলার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন এবং দুর্যোধন তাঁকে গৌণভূমিকায় সমর্থন করেছিলেন, তেমনই আজ তিনি এতটাই নিরুপায় যে, দুর্যোধন যা বলছেন শকুনি তাতেই সমর্থন দিচ্ছেন। রাজ্য ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে কৃষ্ণ, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র এমনকী গান্ধারীর কথাও যখন বিফলে গেল, তখন দুর্যোধন ক্রোধে, হতাশায় আবারও আঁকড়ে ধরলেন সেই বন্ধুদের কাছে, যাঁরা মহাভারতের প্রশস্ত রাজনৈতিক অভিধায়— ‘অশিক্ষিত’ বলে চিহ্নিত হয়েছেন— সকাশম্‌ অকৃতাত্মনাম্‌। অর্থাৎ প্রথমত সেই শকুনি, যিনি পাশা বোঝেন, কিন্তু রাজনীতির কিছুই বোঝেন না। দুর্যোধন তাঁর সঙ্গেই মন্ত্রণা করতে বসলেন— সৌবলেন মতাক্ষেণ রাজ্ঞা শকুনিনা সহ। রাজসভায় ভীষ্ম-দ্রোণ-ধৃতরাষ্ট্রেরা কৃষ্ণের সঙ্গে একমত হয়ে কথা বলেছিলেন বলেই দুর্যোধন ধরে নিলেন— এঁরা তাঁকে এখনই হেনস্থা করতে পারেন, এখনই বন্দি করতে পারেন। শকুনি-দুঃশাসন-কর্ণের মতো লোকেরা একবারও ভাবলেন না যে, এমন আকস্মিক বুদ্ধিতে কৃষ্ণ বা ভীষ্ম কোনও কাজ করতে পারেন না। কিন্তু নিজের মধ্যেই নিজের সাজানো এই প্রতিযুক্তির উত্তরে দুর্যোধন কিন্তু আকস্মিকভাবেই ঠিক করে ফেললেন যে, সর্ববন্দ্য কৃষ্ণকে তিনি বন্দিই করে ফেলবেন এবং তাঁর এই মন্ত্রণায় সহায়কদের মধ্যে অন্যতম হলেন শকুনি।

আসলে, সুস্থ রাজনৈতিক বোধ এবং মর্যাদার বোধ কোনওটাই শকুনির নেই। সব কাজটাই তিনি জুয়োচুরির বুদ্ধিতে পিছনে করে থাকেন। দুর্যোধন যে তাঁকে বন্দি করতে চাইছেন— এই খবর কৃষ্ণের কাছে সেই মুহূর্তেই এসে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন— এই দুর্যোধন এবং তাঁর হিতৈষী বন্ধুদের আমি একাই বন্দি করে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখি, কিন্তু আপনার সামনে এই ক্রোধজ এবং পাপবুদ্ধিজাত কর্মটি আমি করতে রাজি নই— সন্নিধৌ তে মহারাজ ক্রোধজং পাপবুদ্ধিজম্‌। কিন্তু দুর্যোধনের এমন মর্যাদা বোধ নেই, কেন না ক্রোধ এবং অহংকার তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর শকুনি যেহেতু দুর্যোধনের দুর্ব্যসনের ওপরেই বেঁচে থাকেন, অতএব তাঁকে সমর্থন করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই তাঁর।

পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধের উদ্যোগ শুরু হয়ে গেল, কুরুক্ষেত্রে কৌরব এবং পাণ্ডবদের সেনা-ছাউনি পড়ে গেল। এই সময়ে শুধুমাত্র যুদ্ধটাকে খানিকটা তরান্বিত করার জন্য দুর্যোধন শকুনির ছেলে উলূককে পাণ্ডব-শিবিরে পাঠালেন। বৃদ্ধদের সঙ্গে আলোচনা করে নয়, দুর্যোধন শকুনি-দুঃশাসন-কর্ণের সঙ্গে আলোচনা করেই উলূককে পাঠালেন যাতে বেশ খানিকটা গালাগালি দিয়ে পাণ্ডবদের উত্তেজিত করতে পারেন তিনি। বেচারা উলূক! শকুনির ছেলে বেচারা উলূক! তাঁর পিতাঠাকুর সারা জীবন ধরে পিছনে কূটনীতির চাল চেলে গেলেন, অথচ কোনওদিন রাজনীতির প্রশস্ত রাজপথে না হেঁটেই আজ হঠাৎ তিনি এক বিরাট যুদ্ধের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এখন দুর্যোধনের মতে মত দিয়ে নিজের ছেলেকেই তিনি পাঠাচ্ছেন পাণ্ডবদের কাছে— সিংহদের উত্তেজিত করার জন্য— সৌবলেন চ রাজেন্দ্র মন্ত্রয়িত্বা নরর্ষভ।

বস্তুত নিজের এবং পিতার ভবিষ্যৎ-মরণ নিশ্চিত করবার জন্যই উলূক পাণ্ডব-শিবিরে উপস্থিত হল এবং দুর্যোধনের শেখানো গালাগালি নির্ভুলভাবে উচ্চারণ করল পাণ্ডবদের সামনে। পাণ্ডবদের ক্রোধ চরম-সীমায় পৌঁছল, সরল ভীম আবারও পূর্ব-প্রতিজ্ঞাগুলি স্মরণ করিয়ে দিতে থাকলেন এবং শেষমেশ পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব উলূককে শকুনি-চরিত্রের সার কথাটি শুনিয়ে দিয়ে তাঁকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করলেন।

সহদেব উলূককে বললেন— তুই ফিরে গিয়ে তোর বাবাকে এই কথা বলিস যে, তোর সঙ্গে যদি ধৃতরাষ্ট্রের কোনও সম্বন্ধ না হত, তবে কৌরবদের সঙ্গে আমাদের এই ভেদাভেদ ঘটত না— ধৃতরাষ্ট্রস্য সম্বন্ধো যদি না স্যাত্ত্বয়া সহ। তুই ধৃতরাষ্ট্রের বংশটাকেও ধ্বংস করলি, নিজের বংশেরও সর্বনাশ করলি। সেই কোন কাল থেকে তোর বাবা আমাদের পিছনে লেগেছে বল। আমাদের জন্ম হওয়া ইস্তক তোর বাবা আমাদের সারা জীবন কষ্ট দিয়ে গেল— জন্ম প্রভৃতি চাস্মাকং পিতা তে পাপপূরুষঃ।

সহদেবের এই কথা থেকে বোঝা যায়— শকুনি পাণ্ডবদের জন্মের আগে থেকেই গান্ধার ছেড়ে হস্তিনায় চলে এসেছিলেন। এমনকী মহারাজ পাণ্ডু যে আকস্মিকভাবে রাজ্যপাট ছেড়ে দুই রাজরানিকে নিয়ে বনবাসী হলেন, তার পিছনেও শকুনির পরোক্ষ অবদান ছিল কিনা, তা মহাভারতে স্পষ্ট করে বলা নেই বটে, তবে ধৃতরাষ্ট্রের শ্যালক হিসেবে তিনি যে খুব অস্থানে ছিলেন, তা মনে হয় না। বরঞ্চ ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যবিষয়িনী লালসা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনও মদতই ছিল না— এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।

শকুনির সমস্ত জীবন এবং শঠতার অনুপূর্ব স্মরণ সহদেবকে এতটাই উত্তেজিত করেছিল যে, দূতরূপে গালাগালি দিতে আসা উলূকও তাঁর কোপ থেকে বাদ পড়লেন না। সহদেব বললেন— তোর বাপকে গিয়ে বলিস— তার সামনেই আগে আমি তোকে মারব— অহমাদৌ নিহত্য ত্বাং শকুনেঃ সম্প্রপশ্যতঃ। আমরা বুঝি— এই রাগ তো হবারই কথা। মহাভারতের সমাজে দূত অবধ্য বটে, কিন্তু যার হয়ে সে কথা বলতে এসেছে, সেই মানুষটির ভাবের ভাবী না হলে কী করে দুর্যোধনের মতোই সে গালাগাল দেয়। মনে রাখা দরকার সঞ্জয়ও দূত হয়ে এসেছিলেন পাণ্ডব-শিবিরে, কৃষ্ণও দূত হয়ে গিয়েছিলেন কৌরব-শিবিরে, কিন্তু প্রেরকের ভাবের ভাবী হলেও তাঁদের নিজস্বতা আছে। উলূক দুর্যোধনের প্রেরণায় পাণ্ডব-শিবিরে যে-ভাবে কথা বললেন, তাতে এই তার সদ্যপ্রাপ্তি হল যে, বাপের সামনেই ছেলেকে মারবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন সহদেব। আবার ছেলেকেও তিনি জানিয়ে দিলেন— তোর পরেই তোর বাপের পালা। সমস্ত মানুষের চোখের সামনে তোর বাপকেও হত্যা করব আমি— ততোহস্মি শকুনিং হন্তা মিষতাং সর্বধন্বিনাম্‌।

বলে রাখা ভাল, শকুনির ছেলে উলূক পাণ্ডবদের দেওয়া তিরস্কার-বাক্যগুলিও দুর্যোধনের কাছে এসে বলেছিল। ফলে যুদ্ধের আগুনে দুই পক্ষের তিরস্কার-শব্দের যে ঘৃতাহুতি পড়ল, তাতে পরের দিনই দুই পক্ষ যুদ্ধের সজ্জায় সজ্জিত হল। কী অদ্ভুত লাগে শুনতে— এই বিশাল যুদ্ধ, যেখানে ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মতো অথবা ভীম-অর্জুন-সাত্যকির মতো যোদ্ধা রয়েছেন, সেখানে শকুনি এক অক্ষৌহিণী সৈন্যের অধিনায়ক— স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম জানাচ্ছেন এই খবর, যদিও যোদ্ধা হিসেবে শকুনি যে মহারথ, অতিরথ ইত্যাদি বিশিষ্ট কোনও সংজ্ঞার মধ্যে পড়েন না, বড় জোর তিনি যে এক মাঝারি কিসিমের যোদ্ধা, সেটা ভীষ্ম বলেই দিয়েছেন তাঁকে ‘রথ’ হিসেবে বর্ণনা করে। বস্তুত শকুনির এই উপাধি এবং সৈন্যসংখ্যা দুয়ের মধ্যেই কিঞ্চিৎ অতিকথন আছে বলে মনে হয়। দুর্যোধন পিতামহের কাছে তাঁর দলের প্রধান পুরুষদের বলাবল এবং বৈশিষ্ট্য জানতে চাইছেন, সেখানে ভীষ্ম দেখলেন শকুনি পূর্বাহ্নেই এক অক্ষৌহিণী সেনার নায়কত্বে প্রতিষ্ঠিত। এই অবস্থায় দুর্যোধনের নৈকট্যের সম্বন্ধ মনে রেখেই শকুনিকে খুব কম করে হলেও ‘রথ’ না বলে পারেননি, কেন না এর চেয়ে কম আর হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, শকুনির এক অক্ষৌহিণী সৈন্যও মহামতি ভীষ্মের কাছে একটু অদ্ভুত লাগছে। তিনি বলছেন— শকুনির তত্ত্বাবধানে যে সৈন্যরা আছে, তারা সকলেই ‘বিকৃতায়ুধ ভূয়িষ্ঠা বায়ুবেগসমা জবে’, অর্থাৎ হাওয়ার বেগে ওরা চলতে পারে, আর তাদের অস্ত্রগুলি এখানে-দেখা প্রচলিত অস্ত্রের মতো নয়।

আমাদের ধারণা, শকুনি যে এক অক্ষৌহিণী সৈন্যের নায়ক নির্বাচিত হয়েছেন, এই সৈন্য তাঁর নিজের রাজ্য গান্ধার-কান্দাহার থেকে এসেছে এবং এই পার্বত্যভূমির যোদ্ধারা হয়তো ভারতীয় প্রদেশগুলির ধনুঃশর-তরবারি-গদার চেয়ে দেশজ অস্ত্র-ব্যবহারেই পটু ছিল এবং সেই দেশজ অস্ত্রগুলি ভীষ্মের চোখে বিকৃত গোছের অস্ত্র। শকুনির সৈন্য এবং তাদের অস্ত্র নিয়ে বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই, তাঁর সম্বন্ধে ভীষ্মের সবচেয়ে বড় ‘অবজারভেশন’ হল— শকুনি যথাসাধ্য যুদ্ধ করবেন দুর্যোধনের জন্য, কেন না যুদ্ধ না করে তাঁর উপায় নেই, যেহেতু পাণ্ডবদের সঙ্গে এই ভীষণ শত্রুতার প্রধান ঘটক তো তিনিই— প্রযুজ্য পাণ্ডবৈর্বৈরং যোৎস্যতে নাত্র সংশয়ঃ।

তবু সারা যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে এবং যুদ্ধের আঠেরোটা দিন ধরে শকুনির যুদ্ধক্ষমতার কোনও নমুনা আমরা দেখিনি। ওই এখানে ওখানে তিনি এক-আধবার ধনুক-বাণ ব্যবহার করছেন, ওকে চারটে বাণ মেরে রথের ধ্বজা কেটে দিলেন— এর বেশি বীরত্ব শকুনি দেখাতে পারেননি এবং সবচেয়ে আশ্চর্য হল— কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আঠেরোটা দিন ধরে কত বড় বড় রথী-মহারথী ভূমিশায়িত হলেন অথচ শকুনি বেঁচে থাকলেন ওই পুরো সময় আঠেরো দিন। বুঝতে পারি, এখানেও সেই পাশার চাল আছে, তিনি তেমন করে পাণ্ডবদের কারও সামনে আসেনইনি, সুন্দর গা বাঁচিয়ে চলেছেন আঠেরো দিন ধরে। লক্ষ করে দেখবেন শকুনি এবং তাঁর ছেলের সঙ্গে যখন সহদেবের যুদ্ধ লাগছে, তখন কৌরবপক্ষের শেষ যুদ্ধ-নায়ক শল্য পর্যন্ত মারা গিয়েছেন এবং বাঁচার মধ্যে বেঁচে রয়েছেন শুধুই দুর্যোধন— যিনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বৈপায়ন হ্রদে গিয়ে লুকিয়ে থাকবেন।

শল্যপর্বের যুদ্ধে আঠেরো দিনের দিন শল্যও মারা গেছেন, রণক্ষেত্রে মানুষ, অশ্ব, হাতি একাকার খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ে আছে, সেই অবস্থায় শকুনি আর দুর্যোধন ছাড়া আর কেউ নেই পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করার। তখন দেখছি— শকুনি সহদেবের দিকে ধেয়ে আসছেন— শকুনিঃ সৌবলো রাজন্‌ সহদেবং সমভ্যয়াৎ। জনান্তিকে বলি— এখানে সহদেবের কাছাকাছি ভীমও আছেন। তবুও যে শকুনি যুদ্ধ করতে এগোলেন, সেটা বুঝি দুর্যোধনকে দেখেই। যুদ্ধের অধিনায়ক শল্য মারা গেছেন, হতাবশিষ্ট সৈন্যদের কোনওক্রমে পালানো থেকে নিবৃত্ত করছেন দুর্যোধন। এই অবস্থাতেও যুদ্ধ না করলে কেমন দেখায়, সেইজন্যই হয়তো শকুনির এই অপপ্রয়াস। আমরা দেখেছি— সহদেব আর ভীমের ভয়ে শকুনির সৈন্যরাও সব পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন দুর্যোধনই তাদের ক্ষাত্র-তেজ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর গরিমা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শকুনির যুদ্ধযাত্রায় সাহায্য করেন।

সহদেবের সঙ্গেই প্রধানত শকুনির যুদ্ধ লাগল, কেন না শকুনিকে মারার ভার তাঁর ওপরে প্রথম থেকেই ন্যস্ত ছিল। সঙ্গে ছিলেন ভীমও। এই শেষযুদ্ধে ইনি পাঁচটা বাণ মারলেন আর উনি দশটা বাণ ছাড়লেন, এই বর্ণনার মধ্যে সহদেবের মাথায় একবার ব্যথা লাগল— শকুনির এই বীরত্বটুকু প্রতিপক্ষের যুদ্ধগৌরবেই বর্ণনা করেছেন মহাভারতের কবি। কিন্তু আর বেশি নয়, খানিকপরেই সহদেবের ভল্লের আঘাতে শকুনির ছেলে উলূক একেবারে ছিন্নমুণ্ড হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন— উলূকস্য মহারাজ ভল্লেনাহরচ্ছিরঃ।

প্রিয় পুত্রকে এইরকম নৃশংসভাবে নিহত হতে দেখে শকুনি একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। এই প্রথম তাঁর বিদুরের শিষ্ট উপদেশ বাক্যগুলি মনে পড়ল। চোখের জলে সিক্ত হয়ে উঠল তাঁর এতদিনের খলতা-নিষ্ঠুর মুখমণ্ডল। মনে পড়ল— কতবার নিষেধ করেছেন মহামতি বিদুর, আর সে-সব সময় তিনি তাঁর কথার উত্তর পর্যন্ত দেননি অবহেলায়। আজ সেই বিদুরের বাক্য অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। শকুনি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চরম হতাশায় এবার বিদুরের বক্তব্য স্মরণ করছেন— সাশ্রুকণ্ঠো বিনিঃশ্বস্য ক্ষত্তুর্বাক্যমনুস্মরন্‌।

কিন্তু শেষের দিন যখন ঘনিয়ে আসে তখন আর সংশোধনের সময় থাকে না। বস্তুত শকুনি সংশোধনের অযোগ্য ছিলেন এবং ক্ষত্রিয়ের কোনও গুণ তাঁর মধ্যে না থাকায় যুদ্ধের আঠেরো দিন প্রায় অনুল্লিখিত থেকে শেষ দিনে নিরুপায় মৃত্যু বরণ করতে এসেছেন। সহদেবের সঙ্গে তাঁর অনেক যুদ্ধ হল এবং সেই যুদ্ধের মধ্যে সে-কালের ক্ষাত্রশক্তির চরম প্রকাশ কিছু ঘটেনি। কারণ যোদ্ধা হিসেবে সহদেবও যেমন ভীম কিংবা অৰ্জুন নন, তেমনই শকুনিও কর্ণ কিংবা দুর্যোধন নন। অতএব তুমুল যুদ্ধ হলেও সেটা মাঝারি দুই যোদ্ধৃ-পুরুষের মাঝারি মানের যুদ্ধ। অনেক যুদ্ধের পর সহদেবের ভল্লের আঘাতে শকুনির মাথাটি তাঁর শরীর থেকে ছিন্ন হয়ে পড়ে গেল মাটিতে— শিরঃ শরীরাৎ প্রমমাথ ভূয়ঃ। সঙ্গে সঙ্গে শকুনির কর্তিত শরীরটিও রথ থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। শকুনি মারা গেলেন।

শকুনির এই মৃত্যুদশা দেখে মহাভারতের যুদ্ধ-দ্রষ্টা সাংবাদিক সঞ্জয় মন্তব্য করলেন— বাণ এবং ভল্ল দিয়ে সহদেব যে মাথাটি কেটে মাটিতে ফেলে দিলেন এইমাত্র— এই হল সেই মাথা যা কৌরবদের সমস্ত অন্যায়ের মূলাধার— স তচ্ছিরো বেগবতা শরেণ।… যত্তৎ কুরূণামনয়স্য মূলম্‌। সত্যি কথা বলতে কী, এই পংক্তিটিই শকুনি-চরিত্রের সবচেয়ে ‘ফোকাল পয়েন্ট’— অর্থাৎ শকুনির সেই মাথাটি। সারা জীবন এই মাথা দিয়েই শকুনি কাজ করেছেন, শুধু মাথা খাটিয়েই তিনি বিনা রক্তপাতে এক বিশাল জয় এনে দিয়েছিলেন দুর্যোধনের হাতে। তবু একথা বলতে বাধা নেই যে, এই মাথায় সুস্থ রাজনীতির কোনও কূট-নীতি প্রবেশ করে না, সুস্থ-শুভ্র ক্ষত্রিয় তেজের কোনও মর্যাদা এই মাথার মধ্যে নেই। এ মাথা শুধুই কপটতার অঙ্ক কষে দিন-রাত, ফলত এই মাথা দিয়েই শকুনি অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ উচ্চাশাগুলিকে পথ করে দিয়েছেন এবং এই মাথা দিয়েই তিনি ভাগনে দুর্যোধনের মাথাটি খেয়ে ফেলেছেন। সেই দুর্মূল্য মাথাটি এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

শকুনি-চরিত্রের শেষ কল্প হিসেবে যে কথাটা বোঝাতে চাই, তা হল— রাজনীতির মধ্যে, সে এখনকার রাজনীতিই হোক অথবা প্রাচীন, সব রাজনীতির মধ্যেই দুটো স্তর থাকে। তার একটি পরিশীলিত স্তর যেখানে ভব্য, সভ্য, অভিজন ব্যক্তিদের পদচারণা চলে। আর অন্যটি হল অপরিশীলিত স্তর, সেখানে উচ্চাকাঙক্ষী সুযোগ-সন্ধানীরা আপন আপন খলতায় বিনা কারণে মানুষের ক্ষতি করে। এ-বিষয়ে উচ্চতরের গোপন মদত থাকে কখনও কখনও। কখনও বা তা থাকেও না। শকুনি এই অপরিশীলিত বর্গের মানুষ এবং সৌভাগ্যবশত তিনি এমন একটা জায়গা থেকে প্রশ্রয়-অনুমোদন পেয়েছেন যেখানে রাজারই কোনও পরিশীলন নেই। আমাদের আশ্চর্য লাগে দুর্যোধনের মতো ক্ষাত্রবীর্য-সম্পন্ন অহংকারী ব্যক্তি কী করে তাঁর মামার খলতা এবং কপটতা আত্মসাৎ করেছিলেন। নাকি এই কথাটাই বলব যে, শকুনির ব্যক্তিত্ব দুর্যোধনের থেকেও বেশি, তা নইলে নিছক কথাবার্তা, চালচলন এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে কীভাবে তিনি কৌরব রাজসভার সর্বপ্রধান ব্যক্তিত্ব দুটিকে আত্মসাৎ করে ফেলেছিলেন। আমরা তাই মহাকাব্যের বীর পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকেও শকুনির মাথাটাকে শুধু নমস্কার করি, যে মাথাটা সাময়িকভাবে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের অভীষ্টপূরণ করেছিল এবং এমনভাবেই তা করেছিল, যাতে দীর্ঘ তেরো বছর ধরে ধর্ম, সত্য এবং প্রেমকে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। অবশ্য শকুনির মাথার ক্ষমতা এইটুকুই, এর বেশি নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শকুনি

শকুনি

গান্ধাররাজ সুবলের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও গান্ধারীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। গান্ধারীর বিবাহের পর থেকে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের সংসারেই থাকতেন এবং ভাগিনেয় দুর্যোধনের সঙ্গে ওঁর বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। দুর্যোধনকে তিনি নানান কুবুদ্ধি দিতেন। কালকূট বিষ প্রয়োগ করে ভীমকে হত্যা, জতুগৃহে কুন্তি সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা,ইত্যাদি ষড়যন্ত্রে শকুনির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দ্যূতক্রীড়ায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্থ। যুধিষ্ঠির দ্যূতপ্রিয় হলেও, ক্রীড়া পটু ছিলেন না। তাই তাঁকে পণ-দ্যূতে আমন্ত্রণ করে সর্বস্বান্ত করার পরামর্শটা তিনিই দুর্যোধনকে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির খেলতে এলে কৌরবদের পক্ষ হয়ে দুইবার তিনিই খেলেন। যুদ্ধ শুরু হবার আগে শকুনির পুত্র উলূক দুর্যোধনের দূত হিসেবে দুর্যোধনের শিখিয়ে দেওয়া অভদ্র অশ্লীল কথাগুলো পাণ্ডব পক্ষকে গিয়ে শোনালেন। সহদেব সেই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে শপথ করলেন যে, শকুনির সামনে প্রথমে উলূককে হত্যা করে,তারপর তিনি শকুনিকে বধ করবেন। যুদ্ধের শেষ দিনে সহদেবের হাতেই শকুনি-পুত্র উলূক ও শকুনির মৃত্যু হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *