কৃতবর্মা

কৃতবর্মা

সেকালের রাজসভায় তো এমন মানুষ থাকতেনই। এমনকী এখনকার কর্মস্থলে, পাড়ার ক্লাবে এবং এক একটি বৃহৎ পরিবারের মধ্যেও এমন চাপা মানুষ দেখা যায়— যাঁরা নিজের চাইতে বৃহত্তর ব্যক্তিত্বের সামনে বেশ বশংবদ ভাব দেখান, অথচ অন্তরে সেই ব্যক্তিত্বকে তেমন সহ্য করতে পারেন না, বরঞ্চ সহায় পেলেই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন। আমার পিতা-ঠাকুর প্রবাদ-প্রতিম একটি শ্লোক উচ্চারণ করে এই ধরনের মানুষকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন। তিনি বলতেন— অন্তঃশাক্তঃ বহিঃশৈবঃ সভায়াং বৈষ্ণবো মতঃ। শক্তিপূজক শাক্ত মানুষের বিশুদ্ধ সাধন প্রণালী যাই থাকুক, বাইরে তাঁদের এমন দুর্নাম আছে যে, তন্ত্রমন্ত্রের গর্জন তাঁদের খানিকটা ভীতিপ্রদ করে তোলে। পাঁঠাবলি বা মোষবলির দার্শনিক তাৎপর্য যাই থাকুক মারণ, উচাটন, বশীকরণের মতো তান্ত্রিক অনুষঙ্গ শক্তিসাধনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় জনমনে শাক্তমানুষের একটা ভীতিপ্রদ রূপ কাজ করে। পৃথিবীতেও কিন্তু এ-রকম অন্তর-চাপা মানুষ আছেন যারা অন্তরে অন্তরে মারণ, উচাটন অভিচারে প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিতে চান, কিন্তু পারেন না সবসময়।

বাইরে এঁদের শৈব-বৃওি, অর্থাৎ উদাসীন ভাবা কেউ কোনও প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান এবং তাঁর কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি চাইলে আত্মভোলা শিবের আচরণ করেন। আর পরিশেষে সকলের সামনে কিংবা মন্ত্রণাকালে তিনি বৈষ্ণব— সকলের কথা শোনেন সবিনয়ে এবং নিজের চাইতে বৃহত্তর বা বলবত্তর ব্যক্তিত্বের সামনে তিনি বিনয়ের ধমধমাধম, পরম বৈষ্ণব, অথচ অন্তরে তাঁর সেই শাক্তভাব থেকেই যায়— মানে সুযোগ এলেই সময় বুঝে মারণ-উচাটন কিছুই বাদ দেব না। মহাভারতে কৃতবর্মার চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা যে হঠাৎ ওই অন্তঃশাক্ত, বহিঃশৈব এবং সময়মতো বৈষ্ণবের চরিত্র-লিখন আরম্ভ করেছি, তার কারণ একটাই— কৃতবর্মাও অনেকটা এইরকমই।

এটা ঠিক, মহাভারতের অনেক বিশাল চরিত্রের মেলায় কৃতবর্মা তেমন পরিচিত ব্যক্তি নন, এমনকী তাঁর বীরত্ব নিয়েও নানান পরিচিত কাহিনি তৈরি হয়নি, কিন্তু তিনি ভালরকম বীর ছিলেন এবং শেষ মুহূর্তে পাণ্ডবদের সঙ্গে এমন শত্রুতা করেছিলেন, যেটা কোনওভাবে ভোলা যায় না বলেই কৃতবর্মার চরিত্র নিয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে। মহাভারতের পূর্বভাগে একবার, দু’বার কৃতবর্মার নামোল্লেখ থাকলেও একজন ব্যক্তিগত চরিত্র হিসেবে তাঁকে মহাভারতীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখি অনেক পরে, প্রথম দিকে তিনি উপস্থিত আছেন একেবারেই নামত। আদিপর্বের আদি অধ্যায়গুলিতে কৃতবর্মার নাম যে দু’-একবার পাই, সেগুলি পরবর্তী ঘটনার সূত্রোল্লেখ-মাত্র। মহাভারতে কৃতবর্মার সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় হয় কৃষ্ণের অনুগত সহায় হিসেবে এবং সেখানেই আমরা প্রথম জানতে পারি যে, তনি ভোজবংশীয় হৃদিকের ছেলে এবং কৃষ্ণার্জুনের একান্ত অনুগত সাত্যকির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি প্রায় থাকতেন— সাত্যকিঃ কৃতবর্মা চ নারায়ণমনুব্রতৌ।

আদিপর্বে এই পাত্র-পরিচয়ের পর কৃতবর্মাকে আমরা প্রথম দেখি দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভায়। বেশ বোঝা যায়, তৎকালীন প্রথামত স্বয়ংবরের নিমন্ত্রণ-রক্ষার মর্যাদা পালন করতে গিয়ে কৃষ্ণ যে তাঁর কুলের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে দ্রুপদের রাজধানীতে এসেছিলেন, তার মধ্যে কৃতবর্মাও একজন— কৃতবর্মা চ হার্দিক্যঃ পৃথুর্বিপৃথুরেব চ। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে ভোজ-খেতে-আসা, রঙ্গ দেখতে আসা এই কৃতবর্মাকে আরও দু’বার দেখি অন্য দুটি নিমন্ত্রণে এবং সে দুটিও বিবাহ-সভা। একটি তো প্রায় কৃতবর্মার নিজের ঘরেই। কৃষ্ণ-ভগিনী সুভদ্রার সঙ্গে বিয়ে হল অর্জুনের। সেই বিবাহের উৎসবে যোগ দিতে দ্বারকা থেকে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজকুলের প্রধান পুরুষেরা। অক্রূর, উদ্ধব ইত্যাদি প্রবর পুরুষের সঙ্গে কৃতবর্মাকেও আমরা উপস্থিত দেখছি ইন্দ্রপ্রস্থে, পাণ্ডবদের রাজধানীতে। এরপর অবশ্য কৃতবর্মার আগমন ঘটছে অনেক পরে। মহাভারতের বিরাটপর্বে যখন বিরাট-নন্দিনী উত্তরার বিয়ে ঠিক হল অর্জুনের ছেলে অভিমন্যুর সঙ্গে, তখন কৃষ্ণের সম্পর্কে এটা ভাগনের বিয়ে বলেই কৃতবর্মাকে আমরা বোধ হয় বরযাত্রী হিসেবে বিরাট-রাজধানীতে প্রবেশ করতে দেখছি— কৃতবর্মা চ হার্দিক্যো যুযুধানশ্চ সাত্যকিঃ।

এতাবৎ-পর্যন্ত যতটুকু কৃতবর্মাকে দেখলাম, তাতে মনে হবে যেন তিনি নেমন্তন্ন খাওয়ারই লোক, শুধু অন্য মানুষের বিয়ের সময় তাঁকে দেখতে পাই। কিন্তু মহাভারতে যেমন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি, সেটি কৃতবর্মার জীবনের একাংশমাত্র, যদিও একেবারে শেষাংশে তাঁর সঠিক চরিত্রটি বেরিয়ে আসবে— যে চরিত্র তাঁর আগেও ছিল এবং মহাভারতে সেই অংশটুকু ভাল করে বলা নেই। তবে মহাভারতের যুদ্ধকাণ্ড এবং একেবারে শেষে তাঁর যে চরিত্র উন্মোচিত হবে, তা বুঝতে গেলে কৃতবর্মাকে ধরতে হবে অনেক আগে থেকে এবং সেটাও ভাল করে বুঝতে গেলে কৃষ্ণ-বলরামের আপন দেশের রাজনৈতিক চরিত্রটাও বুঝতে হবে।

প্রথমেই এটা মনে রাখা দরকার যে, কৃষ্ণের স্বভূমি মথুরা-শূরসেন অঞ্চলের শাসন-চরিত্র রাজতান্ত্রিক ছিল না, অর্থাৎ কোনও রাজা এখানে এককভাবে বংশ-পরম্পরায় রাজত্ব চালাতেন না। এখানকার শাসন-প্রণালী ছিল খানিকটা প্রজাতান্ত্রিক, যদিও আধুনিক অর্থে সেটাকে প্রজাতান্ত্রিক না বলে মথুরা-শূরসেনের ভূমিজ কুলপ্রধানদের ‘অলিগার্কিক’ শাসন বলাই ভাল। যদুবংশ তো বিরাট বংশ; যদুর পরবর্তী প্রজন্ম সাত্বতের বংশ থেকেই এতগুলি ধারা বেরিয়েছে। যে, কৃষ্ণ-বলরামের কালে তা ফুলে-ফেঁপে অনেকগুলি কুলপ্রধানের শাসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজসূয় যজ্ঞের সময় কৃষ্ণ নিজের পূর্বজীবনের কথা জানিয়ে বলেছিলেন— মামা কংস যখন অত্যাচার করছিলেন, তখন আমাদের আঠেরোটা কুলের প্রধান পুরুষেরা আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন— মন্ত্রোহয়ং মন্ত্রিতো রাজন্ কুলৈরষ্টাদশাবরৈঃ। প্রায় একই জায়গায় কৃষ্ণ একটু আগে বলেছেন— আমাদের ভোজবংশেই অন্তত আঠেরোটা কুল— উদীচ্যাশ্চ তথা ভোজাঃ কুলান্যষ্টাদশ প্রভো।

মথুরা-দ্বারকার দেশজ শাসনের এই চরিত্র মহাভারতে গণরাজ্যের অভিধায় চিহ্নিত হয়েছে প্রায়, আর কৌটিল্য যেহেতু নির্দিষ্টভাবেই রাজনীতির গ্রন্থ লিখেছেন, তাই খুব স্পষ্টভাবেই যদু-বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজদের এই কুলগোষ্ঠীর একত্রিত শাসনকে সংঘরাজ্যের সম্মান দিয়েছেন। কৌটিল্যে একেবারে স্পষ্ট করে যদু-বৃষ্ণি-সংঘের উল্লেখ থাকায় এবং সংঘরাজ্যগুলি যে পদ্ধতিতে চলত, তার সম্বন্ধেও একটা স্পষ্ট ধারণা আমরা পাই বলে, আমরা প্রায় নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, মধুরা-দ্বারকায় কোনও একক রাজা ছিলেন না। রাজশাসন চলত বিভিন্ন কুল-প্রধানদের মন্ত্রণার ভিত্তিতে। অবশ্য এটা মানতেই হবে যে, কুল-প্রধানদের মধ্যে যদি কোনও অধিগুণসম্পন্ন ব্যক্তি থাকেন, যাঁর ব্যক্তিত্ব এবং মর্যাদা অত্যন্ত বেশি, তবে করণীয় কার্য বিষয়ে তাঁর অভিমত প্রাধান্য পেতে থাকে। একই সঙ্গে এ-কথাও সত্য যে, অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বের এই প্রাধান্য দেখে অন্য মধ্যম ব্যক্তিত্বেরা অনেক সময় হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং অনেক সময় তলায় তলায় প্রধানতম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে শত্রুতাও আচরণ করেন।

স্বয়ং কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও যে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, কৃষ্ণ তা নিজেই জানিয়েছেন মহাভারতের একাংশে এবং সেই প্রসঙ্গেই কৃতবর্মাকে আমরা প্রথম ভালভাবে চিনতে পারি। মহাভারতের শান্তিপর্ব খুললে দেখতে পাব— কৃষ্ণ তাঁর জ্ঞাতিগুষ্টির ব্যবহার নিয়ে দুঃখ জানাচ্ছেন দেবর্ষি নারদের কাছে। সেই প্রসঙ্গে যাঁর নাম খুব বেশি করে উঠে আসছে, তিনি হলেন অক্রূর, যদিও তাঁর জ্ঞাতি-শরিকদের মধ্যে অন্য যাঁরা প্রধান ছিলেন তাঁদের নাম মহাভারতেই পাওয়া যাবে অন্য প্রসঙ্গে। প্রয়াত কংসের পিতা আহুক উগ্রসেন যেমন অন্যতম প্রধান, তেমনই ছিলেন অক্রূর, সাত্যকি, বলরাম, উদ্ধব এবং অবশ্যই কৃতবর্মা। অক্রূর, উদ্ধব— এঁরা সব বয়োজ্যেষ্ঠ প্রধান পুরুষ, কৃষ্ণ-বলরাম এঁদের তুলনায় মধ্যবয়সি কিন্তু তাঁদের প্রভাব বেশি, আর সাত্যকি, কৃতবর্মা— এঁরা সব কনিষ্ঠ নেতা।

মহাভারতে কৃষ্ণ যে তাঁর জ্ঞাতিগুষ্টির ব্যবহার নিয়ে দুঃখ জানিয়েছেন নারদের কাছে, তার কারণগুলি খুব স্পষ্ট করে বলেননি, তবে সেইসব কারণগুলি আমরা অন্যান্য গ্রন্থসূত্র থেকে ধরে ফেলেছি এবং সেখানেই কৃতবর্মার প্রসঙ্গ আসবে। কৃষ্ণ নারদকে বলেছিলেন— এই যে দেখছ, আমার সব জ্ঞাতিগুষ্টি— এঁরা সব আমাকে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বলে মানে, এমনকী মুখে আমাকে ঈশ্বর বলেও সম্বোধন করে, কিন্তু আসলে এই জ্ঞাতিগুষ্টির দাসত্ব করতে হয় আমাকে– দাস্যমৈশ্বর্যবাদেন জ্ঞাতীনাং তু করোম্যহম্। ধন-সম্পত্তি, অর্থাগম যতটুকু আমার হয়েছে, তার অর্ধেক ভোগ করি আমি, আর অর্ধেক যায় আমার এই জ্ঞাতিগুষ্টির ভোগে। কিন্তু আমার লাভ আছে একটাই— যত গালাগালি আর নালিশ সব সহ্য করতে হয় আমাকে। অক্রূর বলবে— কৃষ্ণ আহুক-উগ্রসেনের পক্ষ হয়ে কথা বলছে, সেইজন্য আমাকে দেখতে পারে না, আর আহুক-উগ্রসেন বলবে ঠিক তার উলটো কথা— কৃষ্ণ অক্রূরের পক্ষ নিয়েছে, সেইজন্য আমাকে দেখতে পারে না।

কৃষ্ণ অনেকক্ষণ ধরে নিজের ঘরের কথা বলেছেন। তার মধ্যে সংঘরাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং কোন্দলগুলিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কংস এবং জরাসন্ধ মারা যাবার পর যদু-বৃষ্ণি সংঘের অনেকেই যে এখন বেশ বড় মানুষ হয়ে উঠেছেন এবং যিনি কংস-জরাসন্ধ-হত্যার রূপকার সেই কৃষ্ণকেই যে অনেকে এখন তেমন করে মানতে পারছেন না, অথচ তাঁকে অস্বীকারও করতে পারছেন না— এই সত্যটাও কৃষ্ণের বক্তব্যে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মহাভারতে। কিন্তু সবার ওপরে বারবার যাঁর নাম আসছে এবং যাঁর নাম শোনা যাচ্ছে শত্রুতার কক্ষ থেকে, তিনি কিন্তু অক্রূর। গণতন্ত্র কিংবা কুলতন্ত্রের শাসনে এটা একটা আদত বটে যে, কোনও একজন বুদ্ধিমান পুরুষ যখন আপন প্রভাবে এবং মর্যাদায় ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন, তখন মধ্যম মানের নেতারা, যাঁরা সদা-সর্বদাই আপন সম্ভাবনায় মনে মনে আতপ্ত হয়ে ওঠেন, তাঁরা অবশ্যই পূর্বোক্ত উত্তম পুরুষের প্রতি ঈর্ষা-অসূয়ায় জর্জরিত হতে থাকেন অন্তরে অন্তরে। প্রতিনিয়ত এই অন্তর-ক্ষয় বহিরঙ্গেও প্রকাশ পায় মাঝে মাঝে, যদিও ধরা পড়ে গেলেই আবার তিনি বিবরে প্রবেশ করেন, ঈর্ষা-অসূয়ার অন্তর-ক্ষয় তবু বন্ধ হয় না।

বৃষ্ণি-অন্ধক-কুলের প্রবর মন্ত্রী অক্রূরের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কৃতবর্মা। এটা মনে রাখতে হবে যে, শ্বশুর জরাসন্ধের ক্ষমতায় ক্ষমতান্বিত হয়ে যদু-বৃষ্ণিসংঘের শাসন যখন কংসের হাতে একত্র কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, তখন অন্যান্য কুলপ্রধানেরা বা সংঘমুখ্যেরা কংসের বিরুদ্ধ কক্ষে থাকলেও অক্রূর কিন্তু তবু অনেককাল কংসের বশংবদ ছিলেন। এমনকী কংসের কৃষ্ণহত্যার ষড়যন্ত্রে কংস অক্রূকেই বিশ্বাস করে পাঠিয়েছিলেন কৃষ্ণ-বলরামকে ব্রজভূমি থেকে মথুরায় নিয়ে আসার জন্য। কংসের মৃত্যুর পর থেকে নতুন যুগের নতুন নায়ক কৃষ্ণ যখন প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন, তখন আস্তে আস্তে আবারও সেই অসূয়া, সেই ঈর্ষা কিছু কিছু কুলপ্রধানদের অন্তর জুড়ে বসল। এই ঈর্ষাসূয়ার সঙ্গে কৃতবর্মা যে খুব গভীর এবং প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তা নয়। কিন্তু যিনি জড়িত ছিলেন, তাঁর সঙ্গে কৃতবর্মার স্বার্থের যোগ হয়ে যাওয়ায় তিনিও যে ওই অসূয়ার অংশীদার হয়ে উঠেছিলেন, তা বেশ বলা যায়।

ব্যাপারটা প্রথমে বেশ রোমান্টিকভাবে আরম্ভ হয়। আপনারা কৃষ্ণের প্রিয়তমা মহিষী সত্যভামার নাম শুনেছেন। কৃষ্ণের সকল মহিষীর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বিদগ্ধা এবং অভিমানিনী, এমনকী পট্টমহিষী রুক্মিণীর চাইতেও সত্যভামার আদর কৃষ্ণের কাছে বেশি। কিন্তু সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ-সম্ভাবনা ঘটেছে ঘটনা-চক্রে। তিনি যে এটা খুব ভাবতে পেরেছিলেন তাও নয়। ঘটনার চক্র অবশ্য খুবই জটিল। এটা তো মানতেই হবে যে, সংঘরাজ্যের কুলপ্রধানেরা যেখানে শাসন চালান সেখানে বিভিন্ন কুলগোষ্ঠী বা জ্ঞাতি-শরিকদের মধ্যে সম্বন্ধ দূরগত হলেও একটা সম্বন্ধ থেকেই যায়। সেইদিক দিয়ে দেখতে গেলে সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের একটা কুলসম্বন্ধ অবশ্যই আছে। কৃষ্ণের অন্তত পাঁচ-ছয় পুরুষ আগে সাত্ত্বত নামে যে প্রধান পুরুষ ছিলেন, তাঁর ছেলে বিখ্যাত বৃষ্ণির এক স্ত্রীর বংশধারায় যেমন অক্রূর, সাত্যকি এবং কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে, তেমনই সত্যভামা জন্মেছেন বৃষ্ণির আর-এক স্ত্রীর ধারায়। আবার সাত্ত্বতেরই আর-এক ছেলে অন্ধকের বংশধারায় জন্মেছেন কৃতবর্মা এবং তাঁর ভাই শতধম্বা।

বহু পুরুষের অতিক্রমে কৌলিক সম্বন্ধ খানিকটা ধূসর হয়ে যায় বলেই সত্রাজিতের অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যা সাত্রাজিতী সত্যভামা আমাদের তথাকথিত ঘটনাচক্রের নায়িকা এবং তিনিই এক সময় রোম্যান্টিকতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন; অবশ্য সত্যভামার মতো রোমাঞ্চের সঙ্গে খানিকটা ঐশ্বর্যলোভও এখানে কাজ করেছে। এবারে ঘটনাটা সংক্ষেপে জানাতেই হয়।

যাদব-কুলের সত্যভামা ঠিক অন্য রমণীদের মতো নন। সৌন্দর্যের সঙ্গে বিদগ্ধতা এবং বামতা এমনভাবেই তাঁর চরিত্রের মধ্যে মিশেছিল যে, একদিকে তিনি যেমন যদুকুলের অনেক পুরুষের কাছেই অখিল রোমাঞ্চের আধার হয়ে উঠেছিলেন, তেমনই অন্যদিকে এই বিদগ্ধতা এবং বামতাই তাঁকে সকল পুরুষের কাছে দুষ্প্রাপ্যও করে তুলেছিল। হয়তো বা তার ফলে তিনি আরও বেশি আকর্ষণীয়াও। ভোজ-যাদববংশে অক্রূর কিছু বয়স্ক মানুষ এবং অন্যান্যদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালীও বটে। তিনি সত্যভামার রূপ এবং গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করার কথা ভাবতেন মনে মনে। হরিবংশের কথকঠাকুর পরিষ্কার জানিয়েছেন যে, অনিন্দ্যসুন্দরী সত্যভামাকে অক্রুর সবসময় চাইতেন, তাঁকে কামনা করতেন মনে মনে— সদা হি প্রার্থয়ামাস সত্যভামামনিন্দিতাম্‌।

অক্রূরের এই কামনার সঙ্গে অবশ্য আরও একটা অর্থকরী কামনা মিশে ছিল। তবে তার পিছনে একটা গল্প আছে। সত্যভামার পিতা সত্রাজিৎ তাঁর ‘প্রাণসম সখা’ সূর্যের কাছ থেকে এক অলৌকিক মণিরত্ন লাভ করেছিলেন। সেই মণির নাম স্যমন্তক এবং সে-মণি প্রতিদিন আট ভরি সোনা প্রসব করত, তা ছাড়া ওই মণির প্রভাবে সন্নিহিত রাজ্যে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি কিছুই হত না, রোগভোগও না। হরিবংশ বলেছে সত্রাজিৎ মণিটি হাতে নিয়ে ভালবেসে তাঁর ভাই প্রসেনকে দিলেন, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে— অতিপ্রভাবশালী কৃষ্ণ পাছে মণিটি চেয়ে বসেন, তাই সেই ভয়েই মণিটি তিনি ভাই প্রসেনের কাছে রেখে দেন। বিশ্বস্ত পৌরাণিক সূত্রে আমরা অবশ্য এটা জানতে পেরেছি যে, এই মণিটির ওপর কৃষ্ণেরও একটা লোভ ছিল, তবে বিখ্যাত বিষ্ণুপুরাণ তাঁকে মহানুভব দেখানোর জন্য এমন কথাও বলেছে যে, কৃষ্ণ খুব গণতান্ত্রিক কারণেই মণিটি দেশের রাজ-উপাধিধারী শাসক উগ্রসেনের জন্যই চেয়েছিলেন, কারণ মণি থাকলেই দেশের উপকার। কিন্তু এই গৌরবায়নের পাশাপাশি হরিবংশ বলেছে— কৃষ্ণ প্রসেনের কাছে মণিটি একবার চেয়েও ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি সেটা পাননি এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও স্বজন-বিরোধের ভয়ে তিনি সেটা গ্রহণ করার চেষ্টাও আর করেননি— গোত্রভেদভয়াচ্চ শক্তোহপি ন জহার।

মণির ব্যাপারে কৃষ্ণের আয়াস-প্রয়াস এইটুকুতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি জানতেনও না যে, ওই অলৌকিক মণির ব্যাপারে আরও একজনের ভীষণ লোভ ছিল এবং তা রাজকন্যার সঙ্গে রাজত্বের মতো। অক্রূর সত্যভামাকে কামনা করতেন এবং মণিটিও তাঁর কাছে আসুক— এটাই তাঁর কামনা ছিল। এরজন্য তিনি একটি সহায়ক গোষ্ঠীও তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে অবশ্যই ছিলেন কৃতবর্মা এবং তাঁর ভাই শতধন্বা। মণির অধিকার নিয়ে এমন লালসা এবং লোভ দেখেই সত্রাজিতের ভাই প্রসেন মণিটি কোথাও রেখে আসতে যাচ্ছিলেন হয়তো, কিন্তু বনের পথেই তিনি অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে যদু-বৃষ্ণি-অন্ধকদের মধ্যে কানাকানি আরম্ভ হয়ে গেল। প্রচার এইরকম ছিল যে, কৃষ্ণ যেহেতু প্রসেনের কাছে মণিটি একবার চেয়েছিলেন, অতএব প্রসেনকে গুপ্তহত্যা করিয়ে মণিটি তিনিই আত্মসাৎ করেছেন— ততো বৃষ্ণ্যন্ধকাঃ কৃষ্ণং… সর্ব এব শশঙ্কিরে।

এমন চোর অপবাদ থেকে বাঁচবার জন্য কৃষ্ণ সত্য অনুসন্ধান করবার জন্য প্রসেনের যাত্রাপথ অনুসরণ করে বেরিয়ে পড়লেন। অনেক খোঁজাখুঁজি এবং অনেক লড়াই করে কৃষ্ণ মণিটি উদ্ধার করলেন— এইটুকু কথাই এখানে প্রাসঙ্গিক, কেন না মণিরত্ন উদ্ধারের এই কাহিনি অনেক বড় এবং জটিল। মণি উদ্ধার করে যদু-বৃষ্ণিকুলের সকলকে সাক্ষী রেখে সবার সামনে কৃষ্ণ মণি দিলেন সত্রাজিতের হাতে, কারণ তিনিই ওই মণির প্রকৃত অধিকারী— দদৌ সত্রাজিতে তং বৈ সর্বসাত্ত্বত-সংসদি।

কৃষ্ণের সমূহ অপবাদ মোচন হল বটে, কিন্তু মণির সত্ত্বাধিকারী সত্রাজিৎ এবার পরম লজ্জিত হলেন এবং একটু ভয়ও পেলেন। কারণ এতদিন ধরে কৃষ্ণের সম্বন্ধে যে চোর অপবাদ রটেছে, সত্রাজিৎ তার অংশীদার বটে। তিনি এই অপবাদ-প্রচারে বাধা তো দেনইনি, বরং সমর্থন জুগিয়েছেন! মহাপ্রভাবশালী কৃষ্ণের বিরুদ্ধে এই অপবাদ দিয়ে, আজকে তাঁরই হাত থেকে মণি ফিরে পেয়ে সত্রাজিৎ এবার লজ্জা-মুক্ত হতে চাইলেন অদ্ভুত উপায়ে। তিনি তাঁর অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যা সত্যভামাকে বিবাহ দিলেন কৃষ্ণের সঙ্গে। কৃষ্ণ একেবারেই ভাবেননি, কিংবা কখনও কল্পনাও করেননি কোনওদিন যে, বহু পুরুষের প্রার্থিতা সত্যভামাকে তিনি এমন আকস্মিকভাবে লাভ করবেন।

এই আকস্মিক বিবাহের ফল যে খুব ভাল হল, তা নয়। বস্তুত বিবাহের বাসররাত্রি থেকেই অন্য নাটকের প্রস্তাবনা ঘটে গেল কৃষ্ণের জীবনে। এই বিদগ্ধা রমণীটিকে, কৃষ্ণ অনেক আগে থেকেই চিনতেন নিশ্চয়, এমনকী জানতেনও হয়তো যে, অনেক পুরুষের হৃদয় মথিত করেছেন তাঁর এই নবোঢ়া বধূটি। কিন্তু এতটা বোধহয় জানতেন না যে, সত্যভামার দু’গুণা বয়েসের বুড়ো অক্রুর যেমন সত্যভামাকে কামনা করতেন, তেমনই মধ্যম বয়সের কৃতবর্মাও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিলেন দূর থেকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, কৃতবর্মা সত্যভামাকে চান জেনেও তাঁর আপন ছোট ভাই শতধন্বা— তিনি যথেষ্টই কমবয়সি তরুণ— তিনিও সত্যভামার হৃদয়লিপ্সু ছিলেন। সত্যভামা যে এতগুলি যাদব-নায়কের হৃদয়-বিন্দু হয়ে উঠেছিলেন— এ-কথা তেমন ভাল করে জানতাম না। কিন্তু বিষ্ণুপুরাণের মতো প্রাচীন পুরাণ জানিয়েছে যে, কৃষ্ণ তখন কোথায়, তিনি তো সত্যভামাকে জানলেন বিবাহের পরে, কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই অক্রূর তো বটেই এবং তাঁর সঙ্গে কৃতবর্মা এবং তাঁর আপন ভাই শতধন্বাও সত্যভামার হৃদয় কামনা করতেন— তাঞ্চ অক্রুর-কৃতবর্ম-শতধন্ব-প্রমুখ-যাদবাঃ পূর্বং বরয়ামাসুঃ।

আগেই বলেছি, কৃতবর্মা এবং তাঁর ভাই শতধন্বা দুই ভাই অন্ধক-বৃষ্ণিদের মতোই আর-এক ধারা ভজমানের বংশে জন্মেছেন। একদিকে কৃষ্ণ এবং অন্যদিকে অক্রূর দুইজনের সঙ্গেই কৃতবর্মার সম্পর্কও খুব ঘনিষ্ঠ, কিন্তু কংসের মৃত্যুর পর যদু-বৃষ্ণি-সংঘের মধ্যে যে গোষ্ঠী-রাজনীতি চলছিল, বিশেষত সত্যভামার ব্যাপারে স্বার্থ এক হওয়ার কারণে কৃতবর্মা এখন অক্রূরের দিকেই ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু সত্যভামার সঙ্গে স্যমন্তক মণি নিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ অক্রূরের যে লোভ ছিল, সেখানে কৃতবর্মা জড়িয়ে ছিলেন বলে মনে হয় না। অক্রুর যেহেতু এঁদের চাইতে অনেক বড় খেলোয়াড়, তাই তিনি সত্যভামার ওপর কৃতবর্মা এবং শতধন্বার দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগালেন অসাধারণ কৌশলে। কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ হয়ে যাবার পরেই অক্রুর কৃতবর্মাকে হাত করলেন নানান যুক্তি দেখিয়ে। কৃতবর্মার চরিত্রটাই এমন যে, তিনি খুব বীর বটে, কিন্তু বীরোচিত একান্ততা তাঁর মধ্যে নেই। মনে মনে তিনি একটু কুচুটে ধরনের মানুষ। বীরোচিত সাহসে এককভাবে নিজের ‘অথরিটি’তে তিনি কোনও কাজ করতে পারেন না, তিনি বৃহত্তর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে অবীরোচিত কাজ করে ফেলেন, যদিও অবশ্যই চরম প্রভাবশালী ব্যক্তির ওপর তাঁর অসূয়া থাকায় মধ্যম-প্রভাবী ব্যক্তির প্রভাবটুকুই তিনি সাগ্রহে মেনে নেন— আত্মযুক্তিতে তিনি মধ্যম মানের মানুষ বলেই।

আমরা এত কথা বলছি এই কারণে যে ভবিষ্যতে পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধশেষেও তিনি এই একই আচরণ করবেন, যেমন তিনি এখন করছেন। সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ের পর অক্রুর প্রথমে বশ করে ফেললেন কৃতবর্মাকে, তারপর তাঁরা একত্রে গিয়ে কৃতবর্মার ছোট ভাই শতধন্বাকে বললেন— সত্যভামার ওই বাপ্‌টা, ওই সত্রাজিৎ হল এক পাকা বদমাশ— অয়মতিদুরাত্মা সত্রাজিতঃ— আমরা তো ওর মেয়েটিকে বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম, এমনকী তুমিও তাই চেয়েছিলে। ও আমাদের দু’জনের কারও হাতে মেয়েটিকে তো দিলই না, এমনকী তোমাকেও যদি দিত, তা হলেও হত। তাও দিল না, সে মেয়ে দিল কৃষ্ণকে। আমাদের কাউকে সে গণনার যোগ্য বলেই মনে করল না— অস্মান্‌ ভবন্তং চ অবিগণয্য কৃষ্ণায় দত্তবান্‌।

অক্রূর এবং কৃতবর্মা এবার আসল কথাটা উচ্চারণ করলেন। বললেন— সত্রাজিৎ আমাদের যে অপমান-অবহেলা করেছে, তাতে ওর আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই; তা ছাড়া নিতান্তই যখন মেয়েটাকে পাওয়াই গেল না, তখন ও ব্যাটাকে মেরে স্যমন্তক-মণিটি নিতে দোষ কী! তুমি বরং সেই দিকটায় মন দাও, সত্যভামাকে পেলে না যখন, তখন মণিটা নিতে দোষ কী, অতএব মেরে ফেলো ওই দুরাত্মা সত্রাজিৎকে— ঘাতয়িত্বৈনং তন্মহারত্নং ত্বয়া কিং ন গৃহ্যতে। আমরা বেশ বুঝতে পারি— অক্রূর এবং কৃতবর্মা সত্যভামাকে যত চাইতেন, তার চেয়েও বেশি চাইতেন মণিটি, অন্তত অক্রূর তো তাইই। অবশ্য সত্যভামা হাতের বাইরে চলে গেলেন, তখন অক্রুর কৃতবর্মাকে তাঁর মতে পরিচালিত করতে পেরেছেন হয়তো, হয়তো মণির ব্যাপারে কৃতবর্মার তত আকর্ষণ ছিল না। আর বেচারা শতধন্বা— এঁদের মধ্যে তিনিই হয়তো সবচেয়ে ছোট, বালক কিশোর, হয়তো বা তিনিই বড় বেশি চাইতেন সত্যভামাকে, আর সেই দুর্বলতায় আঘাত করেই অক্রুর এবং কৃতবর্মা তাঁদের স্বার্থ-সন্ধান আরম্ভ করলেন, মনে মনে তাঁরা কষে নিলেন মণিহরণের ছক।

এখানে লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল— আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যেন এঁরা কেউ কৃষ্ণের ওপরে রাগ করছেন না, সেই কৃষ্ণ— যাঁকে সত্যভামা বিয়ে করেছেন। বরঞ্চ যেন সেই মানুষটার ওপর অক্রুর-কৃতবর্মার রাগ, যিনি কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু একটু গভীর দৃষ্টিতে বিচার করলেই দেখা যাবে— কৃষ্ণের ওপরেও তাঁদের রাগ কম নেই, কিন্তু বৃষ্ণি-যাদবদের মধ্যে তাঁর অনন্ত প্রভাব এবং ক্ষমতার নিরিখে এঁরা কৃষ্ণের কথাটা স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারছেন না, বিশেষত কৃষ্ণকে বিয়ে করার ব্যাপারে সত্যভামা এতটুকুও আপত্তি না করায় অক্রূর-কৃতবর্মার মতো ঈর্ষা-অসূয়ায়-ভোগা মানুষেরা অন্যের ওপরেই প্রতিশোধ নেন বেশি। কিন্তু তাঁরা যে মণিহরণের পরিকল্পনা করলেন, সেখানে কৃষ্ণ যে শেষ পর্যন্ত একটা ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠবেন, সেটা অক্রূর-কৃতবর্মার শেষ কথাটায় ঠিক বেরিয়ে আসে। কৃতবর্মার সঙ্গে গলা মিলিয়ে অক্রূর শতধন্বাকে অভয় দিয়ে বললেন— সত্ৰাজিৎকে মেরে ফেলার পর কৃষ্ণ যদি কোনও শত্রুতা করে, তবে আমরা তোমার সহায়তা করব— বয়মপি অভ্যুপপৎস্যামঃ যদি অচ্যুতস্তব বৈরানুবন্ধং করিষ্যতীতি।

বেচারা শতধন্বা! অক্রূরের পাল্লায় পড়ে কৃতবর্মা একবারও ছোট ভাইটার কথা ভাবলেন না। ভাবলেন না— কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন এই বালক-কিশোর উত্তীয়-প্রেমিককে। রাতের অন্ধকারে সত্যভামার পিতা সত্রাজিৎ যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তখন শতধন্বা তাঁর নিদ্রাকক্ষে প্রবেশ করে সত্রাজিৎকে হত্যা করলেন বেঘোরে এবং হাতে নিয়ে ফিরলেন অক্রূরের পরম ঈপ্সিত সেই স্যমন্তক মণি। এই হত্যার সঙ্গে একমাত্র মিল পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে যখন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা অসহায় পাণ্ডবপুত্রদের মারবেন এবং সেখানেও কিন্তু সহায় থাকবেন এই কৃতবর্মা, যিনি অক্রূরের সঙ্গে জোট বেঁধে এসেছিলেন শতধন্বার কাছে কিছু কাল আগে।

মনে রাখতে হবে— শতধন্বা যখন সত্রাজিৎকে হত্যা করলেন, তখন কৃষ্ণ রাজধানীতে ছিলেন না। তাঁর কাছে এই করুণ সংবাদ নিবেদন করলেন সত্যভামা স্বয়ং, স্বমুখে এবং কৃষ্ণ যেখানে ছিলেন, সেইখানে গিয়ে। কৃষ্ণকে নিয়ে সত্যভামা ফিরে এলেন দ্বারকায়। সত্রাজিৎকে শতধন্বাই খুন করেছেন, এ-কথা প্রকাশ হয়ে যেতেই কৃষ্ণ শতধন্বকে হত্যা করার পরিকল্পনা আরম্ভ করলেন। তাঁর সহায় হলেন বলরাম। কৃষ্ণ বলরামের মতো ভয়ংকর এবং কৌশলী বীর তাঁর পিছনে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন জেনে শতধন্বা মহাবীর দাদা কৃতবর্মার কাছে এসে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। কীরকম মহাবীর এই কৃতবর্মা, আর কীরকম দাদাই বা! যিনি কিছুদিন আগে অক্রূরের মতো লোভী মানুষের সঙ্গে সঙ্গত হয়ে নিজের ছোট ভাইকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন এবং যিনি আপন সত্তা-প্রমাণের তাড়নায় কৃষ্ণের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধতা করার কথা সদর্পে শুনিয়েছিলেন ছোটভাইকে, তিনি আজ শতধন্বার কথা শুনে সটান বলে দিলেন— আমি কৃষ্ণের মতে কিংবা বলরামের মতো বিরাট পুরুষের সঙ্গে বিরোধ করার ক্ষমতা রাখি না— নাহং বলভদ্র-বাসুদেবাভ্যাং সহ বিরোধায় অলম্‌।

শতধন্বা এরপর অক্রূরের কাছেও গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তিনিও একই কথা বলেছিলেন, যদিও স্যমন্তক মণির জন্য আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে শতধন্বা মণিটি অক্রূরের কাছেই রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন গভীর বনপথে। কৃষ্ণ অবশ্য তাঁকে হত্যা করেন পশ্চাদনুসরণ করে এবং তাঁর প্রাণনাশের জন্য আমরা একমাত্র দায়ী করব কৃতবর্মাকে— কেন না তাঁকে হাত না করলে তাঁর ছোট ভাই শতধন্বার কাছে অক্রূর পৌঁছতে পারতেন না। বিষ্ণুপুরাণে যেমন দেখেছি, তাতে কৃষ্ণ-বলরামের উচ্চতা প্রমাণ করে শতধন্বার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা নেহাতই মৌখিকতা ছিল অক্রূরের; কেন না হরিবংশ-ঠাকুর জানিয়েছেন যে, একমাত্র তাঁরই হয়তো ক্ষমতা ছিল কৃষ্ণের সঙ্গে টক্কর দেবার, কিন্তু শঠতাবশতই তিনি বড় বড় কথা বলে শতধন্বাকে সাহায্য না করার অজুহাত তৈরি করেছেন— শক্তোহপি শাঠ্যাদ্‌ হার্দিক্যমক্রূরো নাভ্যপদ্যত। তা হলে কৃতবর্মার চরিত্রটা কেমন দাঁড়াল? প্রবল প্রতাপান্বিত কৃষ্ণকে তিনি ঈর্ষা করেন বলেই অক্রূরের গোষ্ঠী-রাজনীতিতে শামিল হয়েছিলেন তিনি। অথচ সময়কালে প্রবলের বিরোধিতায় অক্ষম বলেই, অন্তত রাজনৈতিকভাবে অক্ষম বলেই তিনি কৃষ্ণের বিরোধিতা করতে পারেন না। মাঝখানে তাঁর ভাই শতধন্বাকে তিনি নিশ্চিন্ত মৃত্যুর হাতে ঠেলে দিলেন বুদ্ধির অভাবে দূরদৃষ্টির সংকীর্ণতায়।

স্যমন্তক মণি নিয়ে যদু-বৃষ্ণি-সংঘের মধ্যে যে কোন্দল চলেছিল, ঈর্ষা-অসূয়ার যে পরিণতি ঘটেছিল, তার রেশ ছিল কৃষ্ণ-জীবনের বহুদিন পর্যন্ত এবং কৃষ্ণ তা নিজেই জানিয়েছেন জীবনের শেষ পর্বে এসে। অক্রূরের সঙ্গে কৃষ্ণের মনোমালিন্য হয়তো বহুকাল ছিল প্রকটভাবেই, কিন্তু কৃতবর্মা নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন অনেকটাই, এমনকি নিজের প্রচ্ছন্ন উচ্চাশাগুলি প্রকাশ হয়ে পড়ায় খানিকটা ভীত হয়েই যেন কৃতবর্মা কৃষ্ণের প্রতি নিজের বশংবদতা প্রকট করে তুলতেন। এই প্রকট করে তোলার মধ্যে নিশ্চয়ই একটা লোকদেখানো ব্যাপার আছে এবং আমরা মনে করি— বিশেষত পরবর্তীকালে পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধকালে যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমাদের আরও মনে হয় যে, কৃতবর্মা খানিকটা লোক দেখিয়েই কৃষ্ণের বশংবদ হয়ে চলতেন। হয়তো এই কারণেই দ্রৌপদীর বিয়ে, সুভদ্রার বিয়ে, এমনকি উত্তরার বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে বারবার কৃষ্ণের সঙ্গে যাওয়া, বারবার কৃষ্ণবশ্য সাত্যকির সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ। কৃষ্ণের প্রতি কৃতবর্মার এই লোক-দেখানো বশংবদতা চলেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে উদ্যোগ-পর্ব পর্যন্ত। অবশ্য মহাভারতের যুদ্ধোদ্যোগ পর্বেই কৃতবর্মার নিজস্বতার সুযোগ চলে আসে। এখানে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু নিশ্চয়ই কোনও অলৌকিক কারণে নয়, সিদ্ধান্ত যা হয়েছে, সেটাকে অনেকটাই পূর্বগত ঘটনার পরিণতি বলে তামরা মনে করি।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে দুর্যোধন এবং অর্জুন দুজনেই কৃষ্ণের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন দ্বারকায়। সেখানে অস্ত্রধারণে অসম্মত একাকী কৃষ্ণকে বরণ করেছিলেন অর্জুন আর দুর্যোধন পেয়েছিলেন এক অর্বুদ নারায়ণী সেনা। নিঃশস্ত্র, অথচ বিশালবুদ্ধি একাকী কৃষ্ণকে স্বপক্ষে লাভ করেই অর্জুন এত আনন্দ পেয়েছিলেন যে, যাদব-বৃষ্ণিদের অন্য কারও কাছে তিনি আর যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। অন্যদিকে দুর্যোধন যেহেতু বুদ্ধির চেয়েও বলে বেশি বিশ্বাস করেন, অতএব কৃষ্ণের কাছ থেকে নারায়ণী সেনা লাভ করেই তিনি গেছেন বলরামের কাছে; বলরাম দুর্যোধনের গদা-শিক্ষার গুরু। বলরাম কোনও পক্ষেই যোগ দেবেন না জেনে দুর্যোধন এবার গেলেন কৃতবর্মার কাছে— সোহভ্যয়াৎ কৃতবর্মাণং ধৃতরাষ্ট্রসুতো নৃপঃ। কৃতবর্মাকে স্বপক্ষে যোগ দেবার জন্য অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে সেনাও চাইলেন দুর্যোধন। কৃতবর্মা দুর্যোধনকে পুরো এক অক্ষৌহিণী সেনা দিলেন বলেই বুঝতে পারি যে, কৃতবর্মা দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন— কৃতবর্মা দদৌ তস্য সেনামক্ষৌহিণীং তদা।

নারায়ণী সেনা এবং কৃতবর্মার দেওয়া এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে দুর্যোধন তো পরম খুশি হয়ে হস্তিনাপুরে চলে গেলেন, কিন্তু কৃষ্ণ যদু-বৃষ্ণি-সংঘের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হওয়া সত্ত্বেও এবং তিনি নিজে সদা-সর্বদা পাণ্ডব-পক্ষপাতী হওয়া সত্ত্বেও কেন কৃতবর্মা তাঁর ইচ্ছা এবং ভাবনা অতিক্রম করে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধপক্ষে, মানে কৃষ্ণের বিপক্ষেই যোগ দিলেন, সেটা কিন্তু বড় একটা চর্চার বিষয়। মহামতি সুখময় ভট্টাচার্য তাঁর মহাভারতের চরিতাবলীতে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন— “অনুমিত হয়, অর্জুনের উপর অভিমান করিয়াই তিনি পাণ্ডবগণকে কোনওপ্রকার সাহায্য করেন নাই।” এই অভিমানের কারণ তিনি লিখেছেন— “অর্জুন কৃতবর্মার সহিত দেখা করেন নাই, পরন্তু দুর্যোধন কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা সংগ্রহ করিয়াই কৃতবর্মার সহিত দেখা করিয়াছেন এবং তাঁহারও সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছেন।” এটা ঠিকই যে, কৃষ্ণের চাইতে বড় অথবা তাঁর পরেও অতিরিক্ত কারও সঙ্গে দেখা করতে হবে— এমন প্রয়োজন অর্জুন হয়তো অনুভব করেননি এবং তার কারণও আছে। কিন্তু পাণ্ডবরা এ-ব্যাপারে একেবারেই অবহিত ছিলেন না, এ-কথাও ঠিক নয়। কেন না বিরাটপর্বে যখন সাত্যকির প্রস্তাবে যুদ্ধের কথাটা সবার মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হল, তখন মহারাজ দ্রুপদ বিভিন্ন রাজা-রাজড়ার কাছে দূত পাঠানোর কথা বলেছিলেন। রাজ-রাজড়ার সেই লিস্টিতে অনেকের সঙ্গে কৃতবর্মার নামও ছিল। দ্রুপদ যেহেতু পৃথকভাবে কৃতবর্মার নাম বলেছিলেন মিত্রগোষ্ঠীর একজন হিসেবে— অমিতৌজসে তথোগ্রায় হার্দিক্যায়ান্ধকায় চ— তাতে অনুমিত হয়— পাণ্ডবরা তাঁর কাছেও দূত পাঠিয়েছেন, অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি এবং হয়তো তার কারণও আছে। বস্তুত যদু-বৃষ্ণি-সংঘের মধ্যে যেহেতু সংঘশাসনের বৈশিষ্ট্য বর্তমান ছিল, তাই অন্য কোনও গোষ্ঠীপ্রধান বা কুলপ্রধানের পক্ষে কৃষ্ণের বিপক্ষে যোগ দেওয়াটাও খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অন্য কেউ যেখানে কৃষ্ণের বিপক্ষে যোগ দিলেন না অথচ কৃতবর্মা দুর্যোধনের অনুরোধ শুনেই এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে তাঁর পক্ষপাতী হয়ে পড়লেন, এই ব্যাপারটা অত সহজ নয়।

অর্জুন কৃতবর্মার কাছে যাননি বলে যে অভিমানের কথা বলেছেন সুখময় ভট্টাচার্য, আমরা তাঁর সঙ্গে সহমত নই; কেন না এই ঘটনার মধ্যে পূর্বের সেই গোষ্ঠী-রাজনীতির জটিলতা আছে। অন্যদিকে দুর্যোধনকেও দেখুন— তিনি এই গোষ্ঠীকোন্দলের খবর রাখতেন কতটা! তিনি আর কারও কাছে তো গেলেন না— মহারাজ উগ্রসেনের কাছে নয়, সাত্যকির কাছে নয়, এমনকী অক্রূরের কাছেও নয়। উগ্রসেন, সাত্যকি— এঁরা তো কৃষ্ণপক্ষীয় পুরুষ, অতএব তাঁরা যে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেবেন না, সে জানা কথা। অন্যদিকে অক্রুর কৃষ্ণের বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর নেতা বলে চিহ্নিত, অথচ সোজাসুজি বিরোধিতা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই কারণে দুর্যোধনও তাঁর কাছেও যাননি এবং তিনিও আগ বাড়িয়ে কোনও প্রস্তাব দেননি। কিন্তু কৃতবর্মা সামনাসামনি যতই কৃষ্ণের বশংবদ হয়ে থাকুন, স্যমন্তক মণির সেই অবশেষ ঘটনা, যে ঘটনার জেরে তাঁর ভাই মারা গেছেন কৃষ্ণের হাতে এবং নিজেও ‘একস্‌পোজড’ হয়ে যাবার ফলে কৃষ্ণের বশংবদ হয়ে থাকতে হয় যাঁকে, সেই কৃতবর্মার দিক থেকে দুর্যোধনের পক্ষে অর্থাৎ কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবদের বিপক্ষে যোগ দেওয়াটা যথেষ্টই স্বাভাবিক ছিল। দুর্যোধন সেটা জানতেন এবং বুঝতেন বলেই যদুবৃষ্ণিসংঘের অন্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করে শুধু কৃতবর্মার সঙ্গেই দেখা করেছিলেন এবং নিজের প্রয়াসে সাফল্যও লাভ করেছিলেন।

কৃতবর্মা তাঁর সৈন্য আগেই দুর্যোধনকে দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু নিজে সঙ্গে সঙ্গে হস্তিনাপুরে যাননি। কেন না মহাযুদ্ধের জন্য তখন সৈন্য-সংগ্রহই চলছিল, রাজা-রাজড়ারা স্বয়ং যোগ দেবেন আরও কিছুদিন পরে। ফলে যদু-বৃষ্ণি-সংঘের মধ্যে এবং নিজস্ব ব্যবহারে তিনি কোনও পরিবর্তনও প্রকটভাবে দেখাচ্ছেন না, বিশেষত কৃষ্ণের সঙ্গে অথবা কৃষ্ণ-ঘনিষ্ঠ সাত্যকির সঙ্গে। তিনি যেমন সাত্যকির সঙ্গে ওঠাবসা করতেন, যেমনটি কৃষ্ণের প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যেতেন, তেমনই বশংবদভাব এখনও তিনি বজায় রেখে চলেছেন। এই দার্শনিকতা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত চলেছে এবং তার খুব বড় প্রমাণ আছে মহাভারতের উদ্যোগ পর্বেই। যুদ্ধশান্তির সমস্ত প্রক্রিয়া যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে কৃষ্ণ নিজেই শান্তির প্রস্তাব নিয়ে দৌত্য করতে এলেন হস্তিনাপুরে। দুর্যোধনের সৈন্য-সংগ্রহ তখন প্রায় সম্পূর্ণ, তিনি নিজের ক্ষমতায় সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন, এমন অবস্থায় কৃষ্ণ শান্তির প্রস্তাব নিয়ে এসে গুরুজনদের সামনে আবারও তাঁকে হেনস্থা করবেন— এই চিন্তায় দুর্যোধন একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি ঠিক করলেন— কৃষ্ণকে তিনি বন্দি করবেন। দুর্যোধনের এই বালখিল্য ভাবনার কথা কৃষ্ণ আগেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন, যদিও এই পূর্বজ্ঞতার কথা প্রকাশ করার প্রয়োজন ছিল না তাঁর। একটা সময় এল, যখন কৃষ্ণ নিজে তো দুর্যোধনকে বোঝাতে পারলেনই না, এমনকী ধৃতরাষ্ট্র এবং মাতা গান্ধারী দুর্যোধনকে ভর্ৎসনা করেও শান্তির পথে আনতে পারলেন না, বরঞ্চ এই উপরোধে দুর্যোধন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে কৃষ্ণকে বন্দি করার জন্য দুঃশাসন এবং কর্ণের সঙ্গে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণের অতি ঘনিষ্ঠ সাত্যকি এই ঘটনা টের পাওয়া মাত্রই কৃতবর্মাকে ডেকে বললেন— শিগগির সৈন্য সজ্জিত করো, কৃষ্ণকে বন্দি করবার পরিকল্পনা করছে দুর্যোধন— অব্রবীৎ কৃতবর্মাণং ক্ষিপ্রং যোজয় বাহিনীম্‌।

রাজসভার একটা মর্যাদা আছে, সেখানে রাজা-মন্ত্রীরা বসে আছেন বলে দুর্যোধনও যেমন কৃষ্ণকে সেখানে বন্দি করতে পারবেন না, তেমনই সাত্যকির পক্ষেও সেখানে সেনা প্রবেশ করানো সম্ভব ছিল না। ফলত যে পক্ষই যা করতে যাক, সেটা সভার দ্বার দিয়ে কৃষ্ণ বাইরে আসলেই তা করতে হবে। সেই কারণে সাত্যকি কৃতবর্মাকে পূর্বাহ্নেই সৈন্যসহ প্রস্তুত থাকতে বললেন সভাদ্বারে— ব্যূঢ়ানীকঃ সভাদ্বারমুপতিষ্ঠস্ব বাহিনীম্‌। সাত্যকির সঙ্গে কৃতবর্মার এই একত্র অবস্থান কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বকালেও আমরা টের পেলাম, কিন্তু একটা প্রশ্ন এখানে আসেই যে, কৃতবর্মাকে এখানে পাওয়া গেল কী করে? তিনি তো কৃষ্ণের সঙ্গে আসেননি। কেন না, বিরাট-নগরের ছোট শহর উপপ্লব্য, যেখান থেকে আলোচনা-শেষে কৃষ্ণ এসেছিলেন হস্তিনায়, সেখান থেকে আসার সময় কৃষ্ণ শুধু অতি-ঘনিষ্ঠ সাত্যকিকেই নিজের রথে চাপিয়ে নিয়ে এসেছিলেন— ততঃ সাত্যকিমারোপ্য প্রযযৌ পুরুষোত্তমঃ। কৃতবর্মাকে আমরা এখানে দেখিনি। অন্যদিকে এটাও মনে রাখতে হবে যে, কৃতবর্মা কিন্তু অভিমন্যুর বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন, বিরাটের সভায়। সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, অভিমনুর বিয়ে শেষ হতে-না-হতেই পরের দিনই পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধবিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। সেই সময় কৃতবর্মা সেখানে ছিলেন না, অথচ সাত্যকি ছিলেন— এটা আমাদের মনে হয় না।

আসলে কৃতবর্মা কখনওই খুব বেশি কথা বলেন না। সভা-সমিতি, একত্র পরামর্শে— কখনওই কৃতবর্মা সরবে মত ব্যক্ত করেন না। কিন্তু তাই বলে যে তার ভিতরে কোনও ভাব নেই, কিংবা সেই অন্তরভাবের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না, সেটা বড় ভুল। এই বিরাট রাজার সভায় এত আলোচনা হল, সেখানে সাত্যকিকে আমরা সক্রিয়ভাবে কথা বলতে দেখলাম, কিন্তু কৃতবর্মা যে সেখানে আছেন তা টেরই পাওয়া গেল না। নাকি তিনি পরের দিনই দ্বারকায় ফিরে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে গেছেন আরও এক-দু’দিন পর। করুসভায় দ্রুপদ-রাজার পুরোহিত দূত হিসেবে যাবেন— এই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পর কৃষ্ণ নিজের আত্মীয়দের নিয়ে দ্বারকায় প্রত্যাবর্তন করেছেন— এই খবর আমাদের কাছে আছে— ততো সৎকৃত্য বার্ষ্ণেয়ং বিরাটো বাহিনীপতিঃ। গৃহং প্রস্থাপয়ামাস সগণং সহবান্ধবম্‌। আমাদের বিশ্বাস এই সবান্ধব কৃষ্ণের সঙ্গে কৃতবর্মাও ছিলেন।

পরে আবার যখন বিশেষ আলোচনাসভা বসল এবং কৃষ্ণ শান্তির দূত হয়ে গেলেন কৌরবসভায়, তখন পরিস্থিতি অনেক উত্তপ্ত। পাণ্ডব-কৌরবদের সৈন্যসংগ্রহ প্রায় শেষ। শান্তির দূত হিসেবে গেলেও কৌরব-রাজধানীতে কৃষ্ণের ওপর আঘাত নেমে আসতে পারে— এমন আশঙ্কা করছেন স্বয়ং যুধিষ্ঠির। কৃষ্ণ সকলকে অভয় দিয়ে বিশ্বস্ত সাত্যকিকে নিজের রথে চাপিয়ে নিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণের পিছন পিছন অন্তত দশ জন মহাবীর অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সহায় হিসেবে গেছেন— প্রয়ান্তং দেবকীপুত্ৰং পরবীররুজো দশ— এবং সঙ্গে গেছে একটা গোটা সৈন্যের ‘রেজিমেন্ট’। এই যে দশ জন মহাবীর, এঁদের মধ্যেই কৃতবর্মা অন্যতম বলে আমাদের মনে হয়। কৃতবর্মা দুর্যোধনকে সৈন্য সহায়তা দিয়ে থাকলেও এখনও পর্যন্ত তিনি কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য যোগ দেননি। বরঞ্চ স্বয়ংশীয় কৃষ্ণ সেখানে যাচ্ছেন বলে তাঁর প্রাণের আশঙ্কা নিরসন করতে কৃতবর্মাও এসেছেন কৃষ্ণের পিছন পিছন। অনুযাত্রিক না হলে সাত্যকি তাঁকে মুহূর্তের মধ্যে সেনা সাজাতে বলতে পারতেন না এবং আমরা বিশ্বাস করি, কৃতবর্মা সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুত হয়ে গেছেন।

এটা বোঝা যাচ্ছে— কৃতবর্মা এখনও কৃষ্ণের আনুগত্য মেনে চলছেন, হয়তো বা না মেনে তাঁর উপায়ও ছিল না। কিন্তু তবু মনে হয় কৃতবর্মার এই ব্যবহারের মধ্যে একটা যান্ত্রিকতা আছে। কেন না সাত্যকির মতো কৃষ্ণের ব্যাপারে তিনি ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ নন, তাঁকে আদেশ দিতে হয়, তাঁর সহায়তা চাইতে হয়। অবশ্য সংঘরাষ্ট্রের বিভিন্ন কুলসংঘের প্রধানদের মধ্যে বেশ খানিকটাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল, অতিশয় প্রভাবশীল কৃষ্ণের আনুগত্য মানতে বাধ্য হলেও কৃতবর্মা এই স্বাতন্ত্র্যটুকু বজায় রাখতেন বলেই মনে হয়। কেন না কৃষ্ণের ওপর তিনি সর্বদা খুশি ছিলেন না। অতএব কৃষ্ণের শান্তিপ্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যেতেই কৃতবর্মা কৃষ্ণের কাছে বিনা কোনও ভণিতাতেই এক অক্ষৌহিণী স্বানুগত সৈন্য নিয়ে যোগ দিলেন দুর্যোধনের পক্ষে।

কৃতবর্মা কম বীর ছিলেন না। ফুটবল খেলার সময় যেমন প্রতিপক্ষের বড় খেলোয়াড়ের জন্য ম্যান-মার্কিং করতে হয়, তেমনই ভারতের পশ্চিম দেশস্থিত শিবি-বংশের রাজাকে কৃতবর্মা কোথায়, কীভাবে যুদ্ধ করছেন, সেটা জানার জন্য, অথবা তাঁকে প্রাথমিক বাধা দেবার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল পাণ্ডবপক্ষ থেকে— অশ্বত্থাম্নে চ নকুলং শৈব্যঞ্চ কৃতবর্মণে। অন্যদিকে দুর্যোধন যখন স্বপক্ষীয় যুদ্ধবীরদের ক্ষমতা, বীরত্ব পরিমাপ করার জন্য ভীষ্মের কাছে মতামত চাইলেন, তখন ভীষ্ম বীরত্বের পরিমাপ-সূচক রথ-অতিরথ-মহারথের পরিসংখ্যান করে কৃতবর্মাকে অতিরথের সংজ্ঞায় চিহ্নিত করেছেন, সেখানে দুর্যোধন স্বয়ং ছিলেন ‘রথে’র মানে চিহ্নিত— কৃতবর্মা ত্বতিরথো ভোজো শস্ত্রভৃতাং বরঃ। অন্যান্য অনেক মহাবীরদের গুণবর্ণনায় যেখানে অর্ধশ্লোকমাত্র ব্যয় করেছেন ভীষ্ম, সেখানে কৃতবর্মার শক্তি-নির্ধারণের জন্য অন্তত দুটি পুরো শ্লোক উচ্চারণ করেছেন। ভীষ্ম বলেছেন— কৃতবর্মা হলেন অতিরথ বীর। তিনি ভোজবংশের লোক এবং অস্ত্রবিৎ বীরদের মধ্যে তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। কোনও সন্দেহ নেই যে, এই বিরাট যুদ্ধে তিনি তোমার প্রয়োজন মেটাবেন অনেকটাই— অর্থসিদ্ধিং তব রণে করিষ্যতি ন সংশয়ঃ। তার কারণ প্রতিপক্ষের অনেক অস্ত্রধারীরা প্রায়ই কৃতবর্মার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেন না, অস্ত্রচালনায়, বিশেষত ধনুক-বাণে তাঁর এমন দৃঢ় ধারণশক্তি যে তাঁর বাণগুলি বহুদূরে গিয়েও লক্ষ্যভেদ করে— শস্ত্রবিদ্ভিরনাধৃষ্যো দূরপাতী দৃঢ়ায়ুধঃ। পাণ্ডব-সৈন্যদের অনেকটাই তিনি শেষ করে দিতে পারবেন, ঠিক যেমন দেবরাজ ইন্দ্র মেরে ফেলেন দানবদের।

আমরা এটা জানি যে, পূর্বভাবিত কল্পনা অনুযায়ী বাস্তবের যুদ্ধ চলে না। ঠিক তো ছিল, পাণ্ডবদের প্রমুখ সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্নই তো ঠিক করে দিয়েছিলেন যে শিবিবংশীয় শৈব্যই প্রধানত কৃতবর্মাকে দেখবেন, অর্থাৎ সামলাবেন। কিন্তু ভীষ্মপর্বে যখন যুদ্ধ আরম্ভ হল— তখন ভীষ্ম যেমন প্রথম ধেয়ে গেলেন অর্জুনের দিকে এবং উলটো দিকে অর্জুনও তাই, তেমনই ভোজবংশীয় সাত্যকি ধেয়ে গেলেন অপর ভোজবংশীয় কৃতবর্মার দিকে এবং কৃতবর্মাও ঠিক তাই— সাত্যকি কৃতবর্মাণং কৃতবর্মা চ সাত্যকিম্‌। দু’জনেই দু’জনকে মৌখিকভাবে হেয় করতে লাগলেন এবং দু’জনের যুদ্ধ যখন আরম্ভ হল তখন পরস্পরের অস্ত্রে দু’জনের দেহেই এমন রক্তপাত হল যে, মহাভারতের কবি অপূর্ব একটি উপমা দিয়ে বললেন— যেন বসন্তে বিচিত্রশোভার কিংশুক ফুল ফুটেছে দুটো— বসন্তে পুষ্পশবলৌ পুষ্পিতাবিব কিংশুকৌ।

একেবারে প্রথমেই অর্জুনের সঙ্গে ভীষ্মের যুদ্ধারম্ভ সূচনা করে মহাভারতের কবি যেমন দুই প্রধান যোদ্ধার মধ্যে মুখ্য প্রতিপক্ষতা স্থাপন করলেন, তেমনই সাত্যকি আর কৃতবর্মার প্রাথমিক যুদ্ধ দেখিয়ে নির্মাণনিপুণ কবি বুঝিয়ে দিলেন— এঁরা দু’জন একই বংশের লোক অথচ কোনও অদৃশ্য কারণে আজকে এরা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেছেন। সাত্যকির রাগটা বোঝা যায়। কৃষ্ণের প্রতি তাঁর চরম বিশ্বস্ততার কারণেই তিনি জানেন যে, কৃতবর্মা পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষতার জন্যই শুধু দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেননি, তিনি সেই শিবিরে গেছেন কৃষ্ণের ওপর রাগে এবং প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের কোনও ক্ষতি করতে না পারলেও কৃষ্ণ যাঁদের ভালবাসেন সেই পাণ্ডবদের যতটা ক্ষতি করা যায় কৃতবর্মা তাই করবেন। সাত্যকির রাগ হয় এই কারণে যে, একই বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও এবং ভোজবৃষ্ণিবংশে এতকাল কৃষ্ণের আনুগত্যে থাকা সত্ত্বেও কৃতবর্মা দুর্যোধনের পক্ষে থেকে যুদ্ধ করছেন কী করে? একটা পূর্বশত্রুতার বোধ, যাকে আধুনিক ভাষায় ‘পুরানা হিস্যা’ বলি, সেটাই এখানে কৃতবর্মার চালিকা শক্তি। কৃষ্ণের কাছে তাঁকে একসময় ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, কৃষ্ণের অন্যতমা স্ত্রীর প্রতি তাঁর মানসিক অনুরক্তি ছিল, এবং তাঁর নিজের ভাইটিও মারা গেছে কৃষ্ণের হাতে— অথচ ঘটনা পরম্পরার মধ্যে তিনি নিজের দোষ দেখতে পান না, শুধু নিজের যে অপমানটুকু হয়েছিল, সেই হিস্যা মেটাতেই কৃতবর্মা কৌরবপক্ষে অবতীর্ণ হয়েছেন। পাণ্ডবরা তাঁর শত্রু হয়েছেন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ কৃষ্ণের কারণে।

কৃতবর্মা মহাবীর বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইকে তিনি বড় কোনও আঘাত দিতে পারেননি, হয়তো বা বড় কোনও ক্ষতি তিনি করতে চাননি। বরঞ্চ তাঁর নজর ছিল এমন কিছু করার যাতে পাণ্ডবরা কষ্ট পান, তাঁরা যেন কষ্টে জ্বলে পুড়ে মরেন। হ্যাঁ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ধনঞ্জয় অর্জুন, কিংবা ভীমসেনের মতো মহাবীরের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়েছে, কখনও ইনি আহত হয়েছেন, কখনও বা উনি, কিন্তু তেমন কোনও ক্ষতি কারওরই হয়নি। কৌরবরা, বিশেষত কৌরবপক্ষে যাঁরা সেনাপতিত্ব করেছেন, তাঁরা সব সময় ‘কীই-পোজিশনে’ ব্যবহার করেছেন কৃতবর্মাকে। ভীষ্ম তাঁর ‘ক্রৌঞ্চব্যুহ’ নির্মাণ করে ক্রৌঞ্চাকৃতি সৈন্যসজ্জার মস্তক-প্রদেশে স্থাপন করেছিলেন কৃতবর্মাকে; একইভাবে ‘সর্বতোভদ্র’-ব্যূহেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কৃতবর্মা। ভীষ্ম শরশয্যা গ্রহণ করলে দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্ব কালেও কৃতবর্মার যুদ্ধমর্যাদা কমেনি। দ্রোণাচার্যের তৈরি ‘গরুড়-ব্যূহে’ তাঁর স্থান হয়েছিল নেত্রভাগে অর ‘সূচিব্যূহে’র ক্ষেত্রে মুখভাগে। কিন্তু দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বকালে কৃতবর্মা তাঁর পৃষ্ঠপোষক নায়ক দুর্যোধনের যে সেবা করেছেন, সেখানে দুর্যোধনের যত হৃদয়ানন্দ ঘটেছে প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে ঠিক ততটাই হৃদয়ানন্দ ঘটেছে কৃতবর্মার। যুদ্ধনীতির দিক থেকে এই জঘন্য কাজের কোনও তুলনা হয় না, কিন্তু এই জঘন্যতার সঙ্গে কৃতবর্মা নিজেকে জড়াতে কোনও দ্বিধা করেননি, কেন না এর ফলাফল কৃষ্ণকে আঘাত করবে, আঘাত করবে তাঁর প্রাণপ্রিয় সখ অর্জুনকে। কৈশোরগন্ধী তরুণ অভিমন্যু যেদিন চক্রব্যুহে প্রবেশ করে সপ্তরথীর সমবেত আঘাতে নিহত হলেন একাকী, সেই সপ্তরথীর অন্যতম রথী ছিলেন কৃতবর্মা।

একটা কথা না বলে পারছি না, সেটা হল— ভীষ্ম-দ্রেণের মতো অভিজ্ঞ সেনা-নায়কেরা যে বারবার কৃতবর্মাকে সৈন্যব্যুহের মুখ্যস্থানে রাখছেন তার কারণ শুধুমাত্র তাঁর মহাবীরের গৌরব নয়, তার সঙ্গে কিন্তু এই অনুভূতিটাও তাঁদের মধ্যে কাজ করেছে যে, হাজার হলেও কৃতবর্মা বাইরের লোক। আসলে মথুরা-শূরসেন অঞ্চলের সংঘপ্রধানেরা অনেকেই সৈন্য তৈরি করতেন ভাড়া খাটানোর জন্য। ‘মার্সেনারি’-চরিত্র থাকার কারণে কৃষ্ণ যেমন স্বরাজ্যের নারায়ণী সেনা দিয়ে দুর্যোধনকে সহায়তা করেছিলেন, ঠিক ওই একই কারণে যুদ্ধ-কুশল কৃতবর্মাকে সামনে এগিয়ে রেখে ভীষ্ম-দ্রোণ কৌরবদেরই জীবন-রক্ষায় সহায়তা করেছেন, কেন না হাজার হলেও তিনি বাইরের মানুষ, সেনামুখে বিপদ ঘটলে আগে কৃতবর্মাকে সেটা সামলাতে হবে, পরে অন্যেরা বুঝবেন। হয়তো এই একই যুক্তিতে দ্রোণাচার্যের চক্রব্যূহের মধ্যে সপ্তরথীর যে গর্ভগৃহ রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে কৃতবর্মার অবস্থান যুক্তিসহ হয়ে ওঠে।

চক্রব্যূহে প্রবিষ্ট অভিমন্যুকে যাঁরা একত্রে ঘিরে ধরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ অথবা বৃহদ্বল নামক এক যুদ্ধনায়কের অবস্থান আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না, কিন্তু এই দলের মধ্যে কৃতবর্মাও আছেন— এটা ভাবতে গেলেই কিন্তু কৃতবর্মার অন্তশ্চরিত্র এক মুহূর্তে প্রকট হয়ে ওঠে। এটা তো ভাবতেই হবে যে, অভিমন্যু শৈশব থেকে দ্বারকাতেই মানুষ হয়েছেন কৃষ্ণের কাছে। কারণে অকারণে তাঁকে কত কাছ থেকে দেখেছেন কৃতবর্মা— তাঁর শৈশব, কৈশোর এমনকী এই যৌবনসন্ধিতে তাঁর বিয়ের বরযাত্রী হয়ে বিরাট-নগরে বিয়ের ভোজ খেয়ে এসেছেন কৃতবর্মা। সেই তিনি আজ দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণের সঙ্গে অভিমন্যুকে ঘিরে ধরেছেন, তাঁকে জীবন থেকে চ্যুত করবেন বলে— কৃতবর্মা চ হার্দ্দিক্যঃ যড়্‌রথাঃ পর্যবারয়ন্‌। একসঙ্গে ছ’জন, সাত জন মহারথীর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন অভিমন্যু। একবার অশ্বত্থামাকে দশ বাণ মেরে কৃতবর্মা-কৃপের উদ্দেশে আরও ক’টা বাণ ছোড়া— এইভাবে কতক্ষণ চলতে পারে এক কিশোরপ্রায় সৈনিকের পক্ষে। এরই মধ্যে কৌরবপক্ষের সেই অখ্যাত নেতা বৃহদ্বল মারা গেছেন অভিমন্যুর হাতে। কিন্তু দ্রোণ-অশ্বত্থামা অথবা কর্ণ-কৃপ যেমন অভিমন্যুর প্রতি মায়া দেখাননি, তেমনই সুচিরকাল-পরিচিত কৃতবর্মাও এতটুকু মায়া দেখাননি অভিমনুর প্রতি। তাঁদের সকলের বাণপ্রহারে অবসন্ন অভিমন্যু নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন। কৃতবর্মা এই মৃত্যুর অন্যতম কারণ এবং এখানে শুধু ভাড়া খাটতে আসা যুদ্ধ-নায়কের নির্মমতাই ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে সেই সেই অন্তর্জাত অসূয়া-ঈর্ষা, যাতে প্রতিপক্ষ-প্রতিম কৃষ্ণ কষ্ট পান, কষ্ট পান তাঁর সখা অর্জুন। পাণ্ডবদের অন্যতম সন্তানবীজ ধ্বংস হয়ে গেল, ধ্বংস হয়ে গেল পাণ্ডববংশের সবচেয়ে উপযুক্ত ভবিষ্যৎ কৃষ্ণের ভাগিনেয়— কৃতবর্মা তার নিমিত্ত কারণ হয়ে রইলেন।

আঠেরো দিনের এই বিরাট যুদ্ধকালে অনেক যুদ্ধনায়ক, অধিনায়ক নিহত হলেন, কিন্তু কৃতবর্মার কিছু হল না, তিনি অক্ষত রইলেন। এই প্রকীর্ণ সময় ধরে পাণ্ডবপক্ষের সঙ্গে তাঁর যত যুদ্ধ হয়েছে, তাতে বোধহয় তাঁর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে সাত্যকির সঙ্গে। সেই যুদ্ধের প্রথম দিনের প্রথম মুহূর্তেই সাত্যকি কৃতবর্মার দিকে ধেয়ে গিয়েছিলেন এবং তারপরেও অনেকবার— তাতে একটাই মানে বোঝা যায়। মানে, সাত্যকি কৃষ্ণের প্রতি একান্ত আনুগত্যে কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারছেন না যে, তাঁরই বংশের মানুষটি এখানে কেন! অথবা কেন যে, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন।

বিরাট যুদ্ধের পরেও কৃতবর্মা অক্ষত থেকে গেলেন এবং তার কারণও আছে। ‘মার্সেনারি’ হিসেবে যারা যুদ্ধ করতে অন্য রাজ্যে যায়, তারা যেমন নির্মম, নির্বিকার হয়, তেমনই নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থটুকুও তারা ভালভাবেই জানে। এখানে দুর্যোধনের প্রতি বশ্যতায় কৃতবর্মা সৈন্য ভাড়া দেননি বটে, কিন্তু সংঘরাষ্ট্রীয় চরিত্রের বলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর এতটুকুও অসুবিধে হয়নি এবং সে বেঁচে থাকাও তো নিজস্ব বৃহত্তর স্বার্থে। পাণ্ডবদের কোনও বড় যোদ্ধাকে তিনি হত্যা করতে পারেননি, কিন্তু তাঁদের প্রভূত সৈন্যক্ষয় করেছেন এবং ইতোমধ্যে অভিমন্যু-বধে পরম সাহায্য করেছেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে কৌরবপক্ষে তিনজনই মাত্র বেঁচে রইলেন— কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা। দুর্যোধন তখন মৃত্যুপথের যাত্রী, তিনি ভগ্ন ঊরু নিয়ে পড়ে আছেন দ্বৈপায়ন হ্রদের পাশে। ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের শেষ খবর দিয়ে সঞ্জয় নেমে এসেছিলেন আহত ভূমিলগ্ন দুর্যোধনের কাছে।

দুর্যোধনের তেজ এতটুকু যায়নি। ভূমিশায়িত অবস্থা থেকেই তিনি মাথা উঁচু করে সাহংকারে সঞ্জয়কে বললেন— সমস্ত মহা মহা বীরেরা থাকতেও আজকে আমার এই অবস্থা হল। এই অবস্থাতেও দুর্যোধনের মনে আছে যে, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা বেঁচে আছেন। দুর্যোধন সঞ্জয়কে বললেন— আমার কথা বলে আপনি কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মাকে বলবেন যে, এইরকম অন্যায়ভাবে ভীম আমার ঊরু-দুটি ভেঙে দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই অসভ্য অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই— বিশ্বাসং সময়াঘ্নানাং ন ষূয়ং গন্তুমর্হথ। আসলে দুর্যোধন এমনই একজন প্রতিপক্ষ, যিনি কখনও হাল ছাড়েন না। একা সঞ্জয়কে বলেও তাঁর খুব বিশ্বাস হয়নি। বার্তাবহ দূতদের ডেকে তখনই তিনি আদেশ দিলেন যাতে কৃপ, অশ্বথামা এবং কৃতবর্মাকে তারা খবর দেয় এবং তাঁর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়— অশ্বত্থামা মহাভাগঃ কৃতবর্মা চ সাত্ত্বতঃ।

খানিকক্ষণের মধ্যেই দুর্যোধনের কাছে এসে উপস্থিত হলেন তিনজন বিশ্বস্ত মানুষ— কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা। দুর্যোধন ভীমের অন্যায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন অশ্বত্থামা। তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইলেন পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নকে মেরে। আনন্দিত দুর্যোধন তৎক্ষণাৎ অশ্বত্থামাকে অভিষিক্ত করলেন সেনাপতি-পদে। প্রতিশোধ-স্পৃহায় বেরিয়ে পড়লেন তিনজন, যদিও কৃতবর্মা রইলেন অশ্বত্থামার সহচর হয়ে। তিনজন বেরিয়ে এসে পাণ্ডবশিবিরের পাশ্ববর্তী অরণ্যভূমির মধ্যে এক বটবৃক্ষের তলায় রাত্রিবাসের আয়োজন করলেন। তিনজনেই এতদিনের যুদ্ধশ্রমে ক্লান্ত, তাঁদের শরীরে ইতস্তত অস্ত্ৰক্ষত তখনও মোটেই শুকোয়নি। কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মার মনে প্রতিশোধের আগুন অশ্বত্থামার মতো নয় বলেই শ্রান্তিতে সেই বটবৃক্ষের তলায় খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লেন কৃপ এবং কৃতবর্মা— ততো নিদ্রাবশং প্রাপ্তেী কৃপ-ভোজৌ মহারথৌ। শুধু জেগে থাকলেন অশ্বত্থামা তাঁর অন্তঃস্থিত ক্রোধের আগুন পোয়াতে পোয়াতে। তারপর সেই ভয়ংকর পেচক এবং কাকের দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মাকে জাগিয়ে তুললেন গভীর ঘুম থেকে। বললেন— পাণ্ডবরা কৌরবপক্ষে যে মহামারি ঘটিয়ে দিয়েছে, তাতে আমরা তিনজনই মাত্র অবশিষ্ট আছি— বয়মেব ত্রয়ঃ শিষ্টা অস্মিন্ মহতি বৈশসে! অশ্বত্থামা প্রস্তাব করলেন— তিনি সেই রাত্রেই পাণ্ডবদের পরিত্যক্ত শিবির আক্রমণ করবেন, সেখানে এখন ঘুমাচ্ছেন পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্রৌপদীর পুত্রেরা। যুদ্ধজয়ী পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করবার ক্ষমতা তাঁর নেই, কিন্তু এইভাবে ছলনায় তিনি প্রতিশোধ নেবেন পাণ্ডবদের ওপর।

কৃপাচার্য অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন অশ্বত্থামাকে। অন্তত তিনি সেই রাত্রিটা ভাল করে ঘুমিয়ে নিয়ে পরের দিন যদি যুদ্ধে যান, তবে কৃপ এবং কৃতবর্মা দু’জনেই যে তাঁর সহায় হবেন— সে-কথাও জানালেন কৃপ। লক্ষণীয়, কৃতবর্মা এতক্ষণ কোনও কথা বলছিলেন না, কিন্তু সিদ্ধান্ত যাই হবে, সেটাই যে তিনি মেনে নেবেন, সে-রকম একটা প্রস্তুতি, তিনি সব সময়েই দেখাচ্ছিলেন। কৃপাচার্যের ক্ষত্রিয়োচিত সাধু ভদ্র প্রস্তাব শুনে অশ্বত্থামা এতটাই ক্রুদ্ধ হলেন যে খানিকটা প্রতিযুক্তি দিয়েই তিনি রথে ঘোড়া যুতে নিলেন কারও অপেক্ষা না করে। কৃপাচার্য তাঁকে অনেক বুঝিয়েছিলেন, নিজের শক্তি এবং কৃতবর্মার অসম্ভব শক্তিমত্তার কথাও বুঝিয়েছিলেন— সাত্ত্বতোহপি মহেষ্বাসো নিত্যং যুদ্ধেষু কোবিদঃ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অশ্বত্থামা আর ভদ্রতা তথা ক্ষত্রিয়োচিত শিষ্টাচারের কথা মনে রাখতে চাননি। তিনি একাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিশোধ-স্পৃহায়। কিন্তু আশ্চর্য হল, মুখে ক্ষত্রিয়ের শিষ্টাচার সম্বন্ধে বক্তৃতা দিলেও কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য অশ্বত্থামার এই অযৌক্তিক প্রয়াসে শেষ বাধাটুকু দিলেন না।

অশ্বত্থামাকে রথ নিয়ে এগোতে দেখে কৃতবর্মা এবং কৃপ— দু’জনেই বললেন— তুমি কীজন্য একা একা রওনা হচ্ছ, কীই বা করতে চাইছ একা একা। আমরা তিনজনে একই উদ্দেশ্য নিয়ে দুর্যোধনের কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছি, আমাদের সুখ-দুঃখ-ভাবনা তোমার সঙ্গে একই রকম, অথচ তুমি আমাদের দু’জনকে সন্দেহ করছ— সমদুঃখসুখৌ চাপি নাবাং শঙ্কিতুমর্হসি। এইখানেই আশ্চর্য লাগে। এমনকী কৃপাচার্যের কথাটাও বুঝি, তিনি যতই ক্ষত্রিয়-আচারের কথা উল্লেখ করুন, দ্রোণাচার্যের সম্বন্ধী হওয়ার কারণে তাঁর মৃত্যুতে কৃপাচার্যেরও রাগ হতে পারে অশ্বত্থামার মতোই। কিন্তু ভোজবংশীয় কৃতবর্মার এখানে কী স্বার্থ? অথচ একক স্বার্থের কথা বলার সময় কৃতবর্মার স্বার্থ অশ্বত্থামার স্বার্থের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এতই গোপন এবং গভীর সেই প্রতিহিংসার জগৎ যে কৃতবর্মার প্রয়োজনটুকু বাইরে থেকে এবং আপাতদৃষ্টিতে বোঝাই যায় না। এই যে যুদ্ধারম্ভের মুহূর্ত থেকে এতকাল তাঁর উপস্থিতি, যার মধ্যে সর্বত্রই কৃতবর্মা ব্যবহৃত এবং শুধুই ব্যবহৃত, তবু তাঁর ভাবটা মোটেই ব্যবহার-সর্বস্ব নয়। সময়কালে তিনি কী অদ্ভুতভাবে ‘ইনভলভডড্‌’ হয়ে যাচ্ছেন হস্তিনাপুরের অন্তর-জগতে। অভিমন্যুর হত্যাকাণ্ডে কী অদ্ভুত তাঁর ভূমিকা এবং এই সময়— যখন যুদ্ধের নায়ক ভূলুণ্ঠিত মৃতপ্রায়, তখন মথুরা-শূরসেনের জাতক কৃতবর্মার কী প্রয়োজন এখানে? অশ্বত্থামার প্রয়োজন— পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে তাঁদের পরোক্ষ ক্ষতি করবেন তিনি। কৃতবর্মার প্রয়োজন— কৃষ্ণের সঙ্গে সম্মুখ-বিরোধিতায় না গিয়ে তাঁর অসম্মত কর্মে তিনি সহায় হবে। নইলে তাঁর এখনও এই অঞ্চলে থাকার কোনও প্রয়োজন ছিল না। নইলে অশ্বত্থামার সুখ-দুঃখভাবে কৃতবর্মার শামিল হবার যৌক্তিকতা কোথায়?

অশ্বত্থামা রথে আরোহণ করবার সঙ্গে সঙ্গেই কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য তাঁর অনুসরণ করলেন বাধ্য পরিচারকের মতো— তমন্বগাৎ কৃপো রাজন্‌ কৃতবর্মা চ সাত্ত্বতঃ। পাণ্ডবশিবিরে তখন যাঁরা ছিলেন, চরমুখে তাঁদের সবার খবর নিশ্চয়ই জানেন অশ্বত্থামা, কিন্তু সকলেই তাঁরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন। মধ্যরাত্র অতীত হয়ে গেছে, অশ্বত্থামা পাণ্ডবশিবিরের দ্বারে এসে দাঁড়ালেন, পাশে পাশে কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য। পাণ্ডব শিবিরের ভিতরে প্রবেশ করার পূর্বমুহুর্তে কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য, দুজনেই শিবিরের দ্বার আগলে দাঁড়িয়ে গেলেন— কৃপশ্চ কৃতবর্মা চ শিবিরদ্বাৰ্যতিষ্ঠতাম্‌। এ-এক বিকটতম যুদ্ধ, তিনজনেই এমন যুদ্ধের মুখোমুখি হননি কখনও। ক্ষত্রিয়ের সমস্ত নিয়ম-আচার লঙ্ঘন করে গোপনে হত্যা করার মন্ত্রণা। দু’জনে শিবিরের দ্বারে দাঁড়িয়ে গেছেন দেখেই অশ্বত্থামা খুশি হলেন— অশ্বত্থামা তু তৌ দৃষ্ট্বা যত্নবন্তৌ মহারথৌ। অশ্বত্থামা বললেন— আপনারা যদি যত্ন নিয়ে চেষ্টা করেন, তা হলে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের আপনারা ধ্বংস করে দিতে পারেন, সেখানে এরা তো ঘুমোচ্ছে। আমি শিবিরের ভিতরে ঢুকে যমের মতো আচরণ করব, কিন্তু একটা মানুষও যাতে আপনাদের হাত থেকে গলে বেরিয়ে বেঁচে না যায়, সেটাই আপনারা দেখবেন— যথা ন কশ্চিদপি বাং জীবন্‌মুচ্যেত মানবঃ।

পাণ্ডবশিবিরের বিরাট চত্বরের মধ্যে ছোট ছোট ছাউনি পড়েছে সেনা-নায়কদের জন্য। শিবিরের মূল দ্বার অপ্রশস্ত, অশ্বত্থামা মোটামুটি লাফিয়ে দ্বারদেশ পেরিয়ে গেলেন। এগিয়ে চললেন— পাঞ্চাল রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের গৃহের দিকে। কোথায় তাঁর ছাউনি— তিনি খুব ভালই জানেন— উদ্দেশজ্ঞশ্চ তস্য হ। ধৃষ্টদ্যুম্ন অশ্বত্থামার হাতে মারা গেছেন, মারা গেছেন শিখণ্ডী, যুধামন্যু, উত্তমৌজা। দ্রৌপদীরা ছেলেরা বাধা দিতে গিয়েও কোনও ফল পাননি। সকলেই মারা গেছেন অশ্বত্থামার শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে। নিদ্রিত অবস্থা থেকে জাগরিত হয়েই যারা মৃত্যুর মুখ দেখে, তাদের ভয় এবং শ্লথতাই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অশ্বত্থামা মহামারী লাগিয়ে দিলেন পাণ্ডবশিবিরে। অবশিষ্ট লোকেরা যখন প্রাণভয়ে ভীত হয়ে অপ্রশস্ত দ্বারদেশ দিয়ে পালাতে আরম্ভ করল, কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য তখন সেই নিরস্ত্র ভীত মানুষগুলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তরবারি নিয়ে— কৃতবর্মা কৃপশ্চৈব দ্বারদেশে নিজঘ্নতুঃ। নিরীহ, নিরস্ত্র, প্রাণভয়ে কম্পিত মানুষগুলি হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইতে চাইতেই কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্যের শাণিত তরবারিতে তারা মৃত্যুপথের পথিক হয়ে উঠল। শিবিরের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা যারা করেছিল, তাদের একটি মানুষও কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্যের হাত থেকে বাঁচল না। ভারত-যুদ্ধের নিরপেক্ষদ্রষ্টা সঞ্জয় কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্যের এই নির্মম নরহত্যা সহ্য করতে পারেননি। এই মুহূর্তে তিনি তাঁদের আখ্যা দিয়েছেন দুর্বুদ্ধি বলে— কৃপস্য চ মহারাজ হার্দ্দিক্যস্য চ দুর্মতেঃ।

সত্যিই তো দুর্মতিই বটে। যখন পূর্ণ যুদ্ধ চলল, তখন একটিও নেতৃস্থানীয় যোদ্ধা এঁদের হাতে নিহত হননি, অথচ এখন নিরীহ, নিরস্ত্র, অসহায় মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করে তাঁরা বীরত্ব দেখাচ্ছেন। নৃশংসতা এইটুকুতেই নয়। অশ্বত্থামার প্রিয়সাধন করাটা তখন এতটাই জরুরি মন্ত্র হয়ে উঠল যে, এস্তভীত লোকেরা যাতে এক দিক দিয়েই বেরোয় এবং অশ্বত্থামারও যাতে সুবিধে হয়, সেইজন্য কৃতবর্মা বুড়ো কৃপাচার্যের সঙ্গে মিলে পাণ্ডবশিবিরের তিন দিকেই আগুন দিয়ে দিলেন— ত্রিষু দেশেষু দদতুঃ শিবিরস্য হুতাশনম্।

শিবিরের ভিতরে সবাইকে শেষ করে দিলেন অশ্বত্থামা আর কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য বহির্গমনোন্মুখ সমস্ত মানুষকে। নিধন শেষে পরস্পর মিলিত হলেন তিনজন এবং তিনজনেই কীভাবে নরহত্যা করছেন সেই বর্ণনা দিয়ে পরম আনন্দ লাভ করলেন। আনন্দের উৎসাহটা এত দূর যে, বলতে বলতে নিজেরা চেঁচিয়ে উঠছিলেন এবং নিজেরাই নিজেদের কৃতিত্বে হাততালি দিয়ে উঠছিলেন মাঝে মাঝে— প্রীত্যা চোচ্চৈরুদক্রোশনংস্তথা চাস্ফোটয়ংস্তলান্‌। অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য যখন পাণ্ডবশিবিরে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন সেখানে গভীর নিদ্রার নিস্তব্ধতা ছিল, আর এখন এই খানিকক্ষণের মধ্যে সেখানে মৃত্যুর নিস্তব্ধতা ফিরে এল।

অথচ নৃশংস মৃত্যু ঘটানোর মধ্যে কৃতবর্মার ব্যক্তিগত ক্ষোভ কী মিটল? অশ্বত্থামা বা কৃপাচার্যের কথা আমরা বুঝতে পারি— দ্রোণাচার্য একজনের বাবা, অন্য একজনের ভগিনীপতি, কিন্তু কৃতবর্মার কে কী? তাঁর অপ্রত্যক্ষে আছেন কৃষ্ণ, তাঁর অপ্রত্যক্ষ ক্ষতি সাধন করেই কৃতবর্মা আপ্লুত বোধ করছেন। পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন কিংবা শিখণ্ডী, যুধামন্যু অশ্বত্থামার লক্ষ্য হতে পারেন, কিন্তু কৃতবর্মার লক্ষ্য অবশ্যই পঞ্চপাণ্ডব এবং দ্রৌপদীর পুত্রেরা। তাঁদের হত্যাকাণ্ডেও কৃতবর্মা নিজের হাত লাগাননি, ঠিক যেমন অভিমনুর হত্যাকাণ্ডেও তিনি সপ্তরথীর অন্যতম। কেউ বলতে পারবে না, ভোজবংশীয় কৃতবর্মাই ভোজবংশীয় কৃষ্ণের ভাগিনেয়কে একা বধ করেছেন, যেমন এখনও কেউ বলতে পারবে না যে, কৃষ্ণের প্রিয়া সখী দ্রৌপদীর পুত্রদের তিনিই মেরেছেন। কিন্তু দুই জায়গাতেই এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডে তিনি পরম সহায়। এই মুহূর্তে কৃতবর্মাকে পাণ্ডবরা যে অত্যন্ত ঘৃণ্য চোখে দেখবেন, তার কারণ সেই কালের জীবনদর্শনে সমস্ত বংশধরদের অবলুপ্তি ঘটায় পাণ্ডবরা একেবারে লুপ্ত-পিণ্ডোদক হয়ে গেলেন এবং কৃতবর্মা সেই অপকর্মে সহায়।

সমস্ত পাঞ্চালদের এবং দ্রৌপদীর পুত্রদের হত্যাশেষে কৃতবর্মা মৃতপ্রায় দুর্যোধনের কাছেই ফিরে এলেন অশ্বত্থামা এবং কৃপাচার্যের সঙ্গে। দুর্যোধনের রক্তসিক্ত অবস্থা দেখে তিনজনেই অনেক দুঃখ পেলেন। অশ্বত্থামা এবং কৃপাচার্য বিলাপও করলেন বহুতর। অশ্বত্থামা পিতৃহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নের নিধনবার্তা শোনানোর পর দুর্যোধনের কর্ণসুখকর সেই সংবাদ দিলেন, যাতে অন্তত এটা বোঝা যায়— পাণ্ডবরা নিজেরা কেউ মারা না গেলেও তাঁদের মরণান্তক কষ্টটুকু দেওয়া গেল— তাঁদের একটি সন্তানও বেঁচে রইল না। সম্পূর্ণ ক্রোধময় মানুষ তো দুর্যোধন, অতএব এই খবরে তাঁর মতো মরা-মানুষও জেগে উঠলেন— প্রতিলভ্য পুনশ্চেত ইদং বচনমব্রবীৎ— দুর্যোধন বললেন— কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে আপনি যে কাজ আমার করে দিয়েছেন, তা ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণও করতে পারেননি— যস্ত্বয়া কৃপ-ভোজাভ্যাং সহিতেনাদ্য মে কৃতম্‌। লক্ষণীয়, এই আনন্দের কারণ বলার সময় দুর্যোধন বলেছেন— পাণ্ডব-সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডী নিহত হওয়ায় তিনি পরম আনন্দ লাভ করেছেন, কিন্তু দ্রৌপদীর পুত্রদের উল্লেখ তিনি স্বকণ্ঠে করেননি। আমরা জানি— ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং শিখণ্ডীকে নিয়ে দুর্যোধনের এতটুকুও মাথাব্যথা ছিল না, তিনি ভীম, অর্জুন, নিদেন পক্ষে পাণ্ডব-পঞ্চকের একজনের অন্তত প্রাণ চেয়েছিলেন। আজকে যখন তিনি শুনলেন— দ্রৌপদীর পুত্রদের মেরে ফেলেছেন অশ্বত্থামা এবং তাতে সহায় হয়েছেন কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য, অতএব তাঁদের ওপর দুর্যোধনের কৃতজ্ঞতার অন্ত রইল না।

দ্রৌপদীর ছেলেদের মেরে ফেলার পর অশ্বত্থামার কী গতি হয়েছিল আমরা জানি। ভীম এবং অর্জুন তাঁকে ধরে ফেলেছিলেন। অশ্বত্থামার অপমানও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্য দু’জনেই তখন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, পরে অবশ্য মণিহীন অশ্বত্থামার সঙ্গেও তাঁদের দেখা হয়। সব শেষ হয়ে গেলে পুত্রশোকক্লিষ্ট ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী এবং কুন্তীর সঙ্গে সমস্ত কুরুকুলের বউদের নিয়ে রণভূমির দিকে যাত্রা করলেন। পাণ্ডবরা তখনও তাঁর সঙ্গে এসে জোটেননি। এই যাত্রাপথে এক ক্রোশ পথ যেতেই— ক্রোশমাত্রং ততো গত্বা— ধৃতরাষ্ট্র দেখলেন— কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন বলে একান্তে দাঁড়িয়ে আছেন— শারদ্বতং কৃপং দ্রৌণিং কৃতবর্মানমেব চ। সকলের মুখপাত্র হয়ে কৃপাচার্যই গান্ধারীকে জানালেন যে, তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পাণ্ডবদের ভয়ে। কৃতবর্মা, অশ্বত্থামা এবং তিনি নিজে কী কাণ্ড করেছেন, সে-সব কথা গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রকে জানানোর পর কৃপ গান্ধারীকে উদ্দেশ করে বললেন— আমরা পালাচ্ছি, কেন না আমরা তিন জন মাত্র পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পারব না— প্রাদ্ৰবাম রণে স্থাতুং ন হি শক্যামহে ত্রয়ঃ। ছেলেরা সকলেই মারা যাওয়ায় পাণ্ডবরা যে-রকম ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, তাতে যে কোনও উপায়ে তারা এই শত্রুতার শোধ তুলতে চাইবে এবং যে কোনও সময় তারা এ-দিকে চলেও আসতে পারে— তে হি শূরা মহেষ্বাসা ক্ষিপ্রমেষ্যন্তি পাণ্ডবাঃ। অতএব আমাদের বিদায় দিন।

এই কথা বলে রাজসম্মানপুরঃসর ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে প্রদক্ষিণ করলেন কৃতবর্মা, কৃপাচার্য এবং অশ্বত্থামা। তারপরেই তাঁরা নিজের নিজের ঘোড়াগুলি চালিয়ে দিলেন গঙ্গার দিকে। ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতেই কৃতবর্মা, কৃপ এবং অশ্বত্থামা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলেন— আমন্ত্র্যান্যোন্যমুদ্‌বিগ্না-স্ত্রিধা তে প্রযযুস্তদা— তারপর খানিকটা ভয়ে ভয়েই তিন জনে তিন দিকে রওনা দিলেন। কৃপাচার্য হস্তিনাপুরে চলে গেলেন, পূর্বের কথামতো অশ্বত্থামা চলে গেলেন ব্যাসের আশ্রমে, আর কৃতবর্মা চলে গেলেন নিজের দেশে দ্বারকায়— স্বমেব রাষ্ট্রং হার্দ্দিক্যো দ্রৌণির্ব্যাসাশ্ৰমং যযৌ। আঠেরো দিনের যুদ্ধশেষে পাণ্ডবদের সন্তান-নাশের দায় মাথায় নিয়ে কৃতবর্মা কী লাভ করলেন, তা ভাল করে বলেননি মহাভারতের কবি। তবে তিনি যে ভাড়াটে সৈন্য-সেনাপতির মতোই নির্বিকার সে-কথা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। নইলে দেখুন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর খুব বেশি দিন কাটেনি। মহামতি যুধিষ্ঠির তখন সবেই রাজা হয়েছেন এবং মন্ত্রীপুরোহিতের প্ররোচনায় অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন। এই যজ্ঞে দ্বারকা থেকে কৃষ্ণ যে স্বজন-আত্মীয়দের নিয়ে হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কিন্তু কৃতবর্মা— চারুদেষ্ণেন সাম্বেন গদেন কৃতবর্মণা। এমনকী অশ্বমেধের যজ্ঞীয় অভ্যর্থনার সময় যুধিষ্ঠির ভীমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিশেষভাবে যাতে কৃষ্ণের আত্মীয়-স্বজনদের পূজা-অভ্যর্থনা করা হয়। সেখানে চার পাণ্ডবভাই যেমন অন্যান্য দ্বারকাবাসী পরিজনদের সঙ্গে কৃতবর্মাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তেমনই কৃতবর্মাও নির্বিচারচিত্তে তাঁদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করেছেন। হয়তো এখানেও কৃষ্ণের ভদ্রাসন মথুরা-শূরসেনের সংঘরাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা আছে, যে কারণে কৃষ্ণ কৃতবর্মার প্রতি হাজারও ক্রুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দ্রৌপদীর পুত্র-হত্যায় অংশগ্রহণের কারণে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। অতএব অশ্বমেধযজ্ঞে কৃতবর্মার আগমন-অভ্যর্থনা এবং নির্গমন— সবটাই একেবারে ‘রুটিন’ ব্যাপার।

এতক্ষণ ধরে একই কথা বলছি। বলছি যে, এই আঠেরো দিনের যুদ্ধের মধ্যে কৃতবর্মার চরিত্র যতটুকু উম্নোচিত হয়, সেটা আপাতত খুব ‘ফ্ল্যাট,’ খুব বৈচিত্র্যহীন। কিন্তু এই আপাতবৈচিত্র্যহীনতার অন্তরে যে বীজটুকু লুকোনো আছে, তার কতগুলি বৈশিষ্ট্য এই আঠেরো দিনের যুদ্ধের মধ্যে ধরা পড়ে। দুর্যোধনের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এই মহাযুদ্ধে কৃতবর্মার অংশগ্রহণ ব্যাপারটা মহাকবি বাণভট্টের আলংকারিক ভাষায় এক কপট-নাটকের প্রস্তাবনা। এর মূলে আছে কৃষ্ণের প্রতি কৃতবর্মার বিরুদ্ধতা এবং সেই সূত্রেই পাণ্ডব-ভাইদের বিরুদ্ধতা। বরঞ্চ এই যুদ্ধের পূর্বকালে মথুরা-শূরসেনের সংঘরাজ্যে কুলপ্রধানদের মধ্যে যে অন্তঃকলহ চলছিল, তার একটা সামান্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই আঠেরো দিনের যুদ্ধে— যেখানে দ্রৌপদীপুত্রদের হত্যা করার পরিকল্পনার মধ্যে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে গেছেন কৃতবর্মা। তিনি অশ্বত্থামা-কৃপাচার্যের মতো দুর্যোধনের অনুভোজী ছিলেন না বলেই তাঁকে চরম আনন্দ দেবার দায়টুকুও তাঁর ছিল না। অথচ যুদ্ধের এই ভয়ংকর নির্মম পরিশিষ্ট রচনায় তাঁর দায়টুকু পরিষ্কার হয়ে যায় তাঁর পূর্বজীবনের সূত্র ধরেই। এবং এটা প্রমাণ হয়ে যায় মৌষলপর্বে তাঁর সর্বশেষ মৃত্যু-পরিণতির মধ্যে।

সে-দিনটাও বড় ভয়ংকর ছিল। অন্যায় এবং অতিক্রম এত বেশি পরিমাণে প্রকট হয়ে উঠেছিল সেদিন যে, যাদব-বৃষ্ণিদের মধ্যে কৃষ্ণের ব্যক্তিত্বও বিফল হয়ে গেল। ঘটনা ঘটছে— ছত্রিশ বছর পর, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজত্বকাল ছত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। যাদব-বৃষ্ণি-অন্ধকরা মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে প্রবল পরাক্রান্ত হলেও তাঁদের অহংকার, আত্মাভিমান এমন একটা জঘন্য মাত্রায় পৌঁছেছে যে, এখন তাঁরা কাউকেই আর তেমন আমল দেন না। এই কিছুদিন আগে শাম্বকে স্ত্রীলোক সাজিয়ে বিশ্বামিত্র-কণ্বের মতো মহর্ষিদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করেছেন তাঁরা। তারপর আজ তাঁরা ঘরের বউদের সঙ্গে নিয়ে তীর্থযাত্রা করবেন বলে যে কাণ্ডটা করলেন, তা তীর্থযাত্রিকের মানায় না। তাঁরা প্রচুর পরিমাণ মাংস, মদ এবং অন্যতর পানীয় সংগ্রহ করে প্রভাস-তীর্থে রওনা হলেন। বৃষ্ণিদের প্রবর মন্ত্রী উদ্ধব, বলরাম এবং কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে যেতে বাধ্য হলেন কালপ্রেরিত হয়ে।

তীর্থযাত্রা কীরকম হল? ব্রত-উপবাস-দেবপূজা এতটুকুও নেই। যাদব-অন্ধক-বৃষ্ণিকুলের মহান জাতকেরা তুমুল মদ্যপান আরম্ভ করলেন। মাঝে মাঝে গান-বাজনা, নট-নর্তকের উত্তেজক নৃত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মদ্যপান চলল। মহামতি উদ্ধব এসব সহ্য করতে না পেরে স্থানত্যাগ করলেন অবিলম্বে। কৃষ্ণের সামনেই যত নষ্টামি চলতে লাগল। বলরাম, কৃতবর্মা, সাত্যকি, কৃষ্ণের ছোট ভাই গদ এবং অক্রূর— এঁরা সব কৃষ্ণের সামনেই মদ্যপান আরম্ভ করলেন— কৃষ্ণস্য সন্নিধৌ রামঃ সহিতঃ কৃতবর্মণা। বলরাম কৃষ্ণের বড় ভাই, বহুকাল ধরেই তাঁর মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। কৃষ্ণের সামনে তাঁর মদ্যপানের ঘটনাটা তেমন দৃষ্টিকটু নয় কিছু, কিন্তু বিশালবুদ্ধি ব্যাসের কথা থেকে বোঝা যায়— কৃষ্ণের এতটুকু সম্মান অন্তত ছিল যে, তার সামনে কৃতবর্মা, সাত্যকি অথবা গদ মদ্যপান করতেন না। কিন্তু আজ তাঁরা বলরামের সঙ্গে একত্রে মদ্যপান করছেন এবং তাও কৃষ্ণকে প্রায় গণনা না করেই।

মদের মাত্রা যখন চড়ে ওঠে, তখন অনেক সত্য কথা বেরিয়ে আসে পেট থেকে, যে-সব কথা সহজ প্রকৃতিস্থ অবস্থায় বলা যায় না— সামাজিক তথা পারিবারিক সৌজন্যবোধেই হয়তো সে-সব কথা অনুচ্চারিত থাকে। আজকে সাত্যকি, কৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় সহচর সাত্যকি, অর্জুনের প্রিয় অস্ত্রশিষ্য সাত্যকিও তো মদ খেয়েছেন— অপিবৎ যুযুধানশ্চ গদো বভ্রুস্তথৈব চ। অতএব এতদিনের ক্ষুব্ধ চিত্ত আন্দোলিত হয়ে উঠল কথায়, শব্দে। তিনি সকলের সামনে, সাবমানে, সাপহাসে কৃতবর্মাকে বিদ্ধ করলেন পুরাতন প্রসঙ্গ উল্লেখ করে— অব্রবীৎ কৃতবর্মাণম্ অবহস্যাবমত্য চ। সাত্যকি বললেন— তুই কি ক্ষত্রিয় নাকি, কৃতবর্মা! কোনও ক্ষত্রিয়ের সামনে যদি মরণও ঘনিয়ে আসে, তবু সে মৃতের মতো অচেতন ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করে না। আর তুই সেই মানুষগুলোকে মেরে এলি যারা মরার মতো ঘুমিয়ে ছিল। তুই যা করেছিস, আমাদের যাদব-বৃষ্ণিরা কোনওদিন তা ক্ষমা করবে না— তন্ন মৃষ্যন্তি হার্দ্দিক্য যাদবা যস্ত্বয়া কৃতম্।

বেশ বোঝা যাচ্ছে— অশ্বত্থামার সমস্ত ক্রিয়াকলাপ কৃতবর্মার ঘাড়ে এসে চেপে গেছে। রাতের অন্ধকারে তিনজন একত্রে যে অন্যায় করেছেন, সেই অন্যায়ের আর ব্যবচ্ছিন্ন বিচার চলে না। কৃতবর্মার পক্ষে এমন যুক্তি সাজানো সম্ভব নয় যে,— না ভাই! আমি তাদের মারিনি, আমি দ্বারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অন্যায় করা এবং অন্যায়ের প্রত্যক্ষ সহায় হওয়া একই পর্যায়ভুক্ত। ঠিক সেই কারণেই সাত্যকি এই অপ্রিয় প্রসঙ্গ উত্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন সাত্যকিকে পুরো সমর্থন দিলেন— ইত্যুক্তে যুযুধানেন পূজয়ামাস তদ্‌বচঃ। কৃতবর্মার দিকে তাকিয়ে প্রদ্যুম্নও কৃতবর্মাকে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করে বেশ অপমানই করলেন তাঁকে। সাত্যকিকে সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে কথায় এবং আকারে প্রদ্যুম্ন একটু সরব হতেই কৃতবর্মা একেবারে চলচ্চিত্রের খলনায়কের মতো বাঁ হাতে থামিয়ে দিলেন প্রদ্যুম্নকে— নির্দিশন্নিব সাবজ্ঞং তদা সব্যেন পাণিনা। গলার স্বরে অবজ্ঞার সমস্ত সুর একত্রিত করে, বাঁ হাতের অঙ্গুলি-নিদের্শে সাত্যকিকে দেখিয়ে কৃতবর্মাও উত্থাপন করলেন পুরাতন প্রসঙ্গ। বললেন— অর্জুন ভূরিশ্রবার দুটো হাত কেটে দিয়েছিল যুদ্ধের সময়। নিজের এই অসহায় অবস্থায় ভূরিশ্রবা যুদ্ধধর্ম ত্যাগ করে সেইখানেই আমৃত্যু অনশনে মরবেন বলে ঠিক করেছিলেন। আর সাত্যকি! তুই কিনা নিজেকে খুব বীর বলে ভাবিস। তা এত বড় বীর হয়ে ওই অসহায় লোকটাকে তুই নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলি কেন— বধেন সুনৃশংসেন কথং বীরেণ পাতিতঃ।

ভারত-যুদ্ধের এত বড় বড় নায়কদের মধ্যে ভূরিশ্রবা যে হঠাৎ এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন, তা কে জানত! কৃতবর্মা সাত্যকির অন্যায় দিয়ে নিজের অন্যায় সমর্থন করার চেষ্টা করছেন বলেই হঠাৎই এখন ভূরিশ্রবার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। তবে যুদ্ধ চলছে— এই অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ শেষের শান্ত অবস্থায় নিরস্ত্র সুষুপ্তদের ওপর তরবারি চালনার তুলনা হয় কিনা— এই প্রসঙ্গ না তুলেও বলা যায়— কৃতবর্মা অন্যায়ের দ্বারা অন্যায়ের সার্থকতা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মহাভারতের বঙ্গবাসী সংস্করণ এবং আরও দু’-চারটি সংস্করণ একমাত্র এই ভূরিশ্রবা-সংক্রান্ত দোষারোপটুকুই কৃতবর্মার মুখে বসিয়েছে, মাত্র একটি-দুটি সংস্করণে ভীষ্ম-দ্রোণ এবং কর্ণ-দুর্যোধনের প্রতি অন্যায় যুদ্ধগুলিও কৃতবর্মার দোষারোপের তালিকায় এসেছে। আমার ব্যক্তিগত মতে দ্বিতীয় প্রকরণটাই ঠিক। কেন না চরম প্রতিপক্ষতায় মানুষ যখন নিজের অন্যায় কর্মগুলি সযৌক্তিক করে তুলতে চায়, তখন সে একটা মাত্র দোষ দিয়ে ক্ষান্ত হয় না। বিশেষত কৃতবর্মা এখন নিজেকে কৌরবপক্ষের সঙ্গে একাত্মক করে তুলেছেন, তাঁকে দোষারোপও করা হয়েছে সেই একাত্মতাতেই। সবচেয়ে বড় কথা— ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ-দুর্যোধনের প্রসঙ্গ তোলাটা তাঁর পক্ষে খুব স্বাভাবিক। কেন না একমাত্র এই প্রসঙ্গগুলিই তাঁর অন্তরের শত্ৰু কৃষ্ণকে আঘাত করে এবং পর্যায়ক্রমে তাঁর বন্ধু পাণ্ডবদেরও আঘাত করে। কেন না এই সমস্ত তথাকথিত অন্যায় বধগুলির সঙ্গে কৃষ্ণের বুদ্ধি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। অতিরিক্ত দোষারোপের এই সংক্রান্ত-শ্লোকগুলি যে এখানে নিতান্তই অপেক্ষিত— সে কথা খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ঠিক এর পরবর্তী শ্লোকে কৃষ্ণের প্রতিক্রিয়ায়। শুধু ভূরিশ্রবার কথা তুললে কৃষ্ণের এই প্রতিক্রিয়া হত না, কিন্তু ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ-দুর্যোধনের কথাও একত্রে আক্ষিপ্ত হওয়ায় কৃষ্ণ একেবারে সরোষে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন কৃতবর্মার দিকে— তির্যক সরোষয়া দৃষ্ট্যা বীক্ষাঞ্চক্রে স মন্যুমান্‌। অর্থাৎ ‘পড়লে কথা সবার মাঝে/ যার কথা তার গায়ে বাজে।’

কৃষ্ণ বেশ রেগে গেছেন কৃতবর্মার ওপর। তিনি অবশ্য মুখেও কিছু বলছেন না, কাজেও কিছু করছেন না। কেন না এই প্রভাস-তীর্থে এসে সকলে যে ভাবে মদ্য-মাংস, নট-নর্তক নিয়ে স্বচ্ছন্দচারিতায় মেতে উঠেছে, তিনি সেটাতে এতটুকুও বাধা দিচ্ছেন না মহাকালের প্ররোচনায় তথবা ‘ই রেজিস্ট্‌ নট্‌ ইভিল,’ এই মন্ত্রণায়। তবু এরই মধ্যে উঠে পড়ল আরও পুরাতন কথা। কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন দেখে সাত্যকি নিজের সমর্থন পেলেন। তিনি কৃতবর্মার দিকে দৃষ্টিপাতও করলেন না, তাঁর কথার কোনও উত্তরও দিলেন না। কিন্তু কৃতবর্মার ওপর কৃষ্ণকে ক্ষিপ্ত করে তোলার জন্য তিনি উত্থাপন করলেন সেই স্যমন্তক মণির প্রসঙ্গ— তাং কথাং কথয়ামাস সাত্যকির্মধুসূদনম্‌। সাত্যকি বললেন— মনে আছে কি সেই স্যমন্তক মণির কথা, সত্রাজিতের সেই মণি, যা নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর মেয়ে সত্যভামারই পাবার কথা, অথচ ওই মণিটার জন্য এই কৃতবর্মা তাঁর ভাইকে দিয়ে খুনই করিয়ে বসল সত্রাজিৎকে— মণিঃ স্যমন্তকশ্চৈব যঃ স সাত্রাজিতোহভবৎ।

দোযগুলো এখন সোজাসুজি গিয়ে কৃতবর্মার ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। অন্যায় কর্মের সহায়তা করলেই এই দোষ আসে। কৃতবর্মা নিজে দ্রৌপদীর পুত্রদের মারেননি, এবং মণিহরণ-কাণ্ডেও সত্রাজিৎ মারা পড়েছিলেন প্রধানত অক্রূরের প্ররোচনায়, কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই কৃতবর্মা জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। অন্যদিকে ভীষ্ম-দ্রোণ অথবা কর্ণ-দুর্যোধনের ক্ষেত্রে কৃষ্ণ ছিলেন বুদ্ধিদাতার ভূমিকায়। কিন্তু কৃতবর্মার ইঙ্গিত এইরকমই যে, কৃষ্ণও তা হলে সমান দোষী, সেক্ষেত্রে তাঁকে শুধু দোষারোপ করা হচ্ছে কেন? কৃতবর্মার বোঝার ভুল যেখানে, সেটা হল— ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ-দুর্যোধনের পিছনে একটা বিশাল গভীর রাজনৈতিক ইতিহাস আছে এবং আছে ধর্ম এবং অধর্মের বহুকালীন বিচার। সেখানে কৃতবর্মার ভাবনা-চিন্তা একেবারেই ব্যক্তিগত আক্রোশের পর্যায়ে পড়ে। কৃতবর্মা যে কৃষ্ণকে অনেকটাই আত্মপ্রকৃতি অনুসারে বিচার করছেন এবং রাজনীতি, ধর্মনীতি— এগুলি যে তাঁর বোঝার ক্ষমতা নেই— সেটা বোঝানোর জন্যই বোধহয় রোষান্বিত কৃষ্ণের অমন তির্যক দৃষ্টিপাত নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তাঁর ওপর।

যাই হোক, স্যমন্তক মণির পূর্ব প্রসঙ্গ সাত্যকির মুখে উঠে পড়তেই ঘটনা আরও জটিল হয়ে গেল! এই কৃতবর্মার জন্যই যেহেতু সত্যভামার পিতা সত্রাজিৎ অকাল-মৃত্যু বরণ করেছেন, অতএব স্যমন্তক মণির প্রসঙ্গ এবং এই মুহূর্তে কৃতবর্মার সরোষ অধিক্ষেপ-বাক্য শুনে কৃষ্ণভামিনী সত্যভামা ক্রোধে, অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে একেবারে কৃষ্ণের কোলের ওপর আছড়ে পড়লেন— তচ্‌শ্রুত্বা কেশবস্যাঙ্কম্‌ অগমদ্‌ রুদতীস্তদা। সত্যি বলতে কী, এই বিদগ্ধা রমণীর ওপর দিয়ে কম ধকল যায়নি সেই সময়। একদিকে তিনজন প্রৌঢ়-যুবক মানুষের তৃষাতুর চোখ তাঁর দিকে, অন্যদিকে স্যমন্তক মণির অধিকার নিয়ে ওই তিনজনের অন্যায় আবদার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তাতে সত্যভামার পিতা খুনই হয়ে গেলেন। মনে পড়ে, পিতা খুন হয়ে যাবার সময় কৃষ্ণ রাজধানীতে ছিলেন না। তিনি বারণাবতে গিয়েছিলেন, জতুগৃহে পাণ্ডব-ভাইদের পুড়ে মরার খবর শুনে। সেখানেই সত্যভামা ছুটে গিয়েছিলেন একা, শুধু রথের সারথি সহায়ে। সেদিনও সাত্যকি এই সত্যভামার রোদনধ্বনির সাক্ষী ছিলেন।

কাজেই স্যমন্তক-মণি নিয়ে অক্রূর-কৃতবর্মা আর শতধন্বার ক্রিয়া-কলাপ সাত্যকি পুনরায় উচ্চারণ করতেই সত্যভামা নিজেও যেমন ক্ষিপ্ত হলেন, ঠিক তেমনই খেপিয়ে তুললেন জনার্দন কৃষ্ণকে— সত্যভামা প্রকুপিতা কোপয়ন্তী জনার্দনম্‌। কিন্তু কৃষ্ণ যেন কেমন বিহ্বল আজ, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের সীমাহীন ধৃষ্টতা দেখে আজ তিনি কেমন নির্বিকার ভাব ধারণ করেছেন। কিন্তু সাত্যকি যেহেতু এই সমস্ত ঘটনার সাক্ষী, বিশেষত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে কৃতবর্মা যেহেতু পাণ্ডবদের বংশধ্বংসে সহায়তা করে এসেছেন, সেই হেতু সাত্যকি কৃতবর্মার সমারোপ-অধিক্ষেপে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন— আজ আমি এই সত্য-প্রতিজ্ঞা করে বলছি— আমি যদি তোর সেই দুষ্কর্মের প্রতিকার না করতে পারি, তবে আমিও দ্রৌপদীর ছেলেদের মতো, কিংবা ধৃষ্টদ্যুম্ন-শিখণ্ডীর মতো মরতে রাজি আছি— এষ গচ্ছামি পদবীং সত্যেন চ তথা শপে। সাত্যকি কৃতবর্মার ক্লীব ব্যবহারে এতটাই রেগে রয়েছেন, পাণ্ডবদের নিঃশেষিত পরিণতিতে তিনি এতই ক্ষুব্ধ যে, তিনি সত্যভামার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বলতে আরম্ভ করলেন— এই বদমাশটা, এই কৃতবর্মা অশ্বত্থামার মতো একটা লোককে সহায় করে ঘুমন্ত অবস্থায় যাদের মেরে ফেলল, ঠিক সেই রকমই ওরও আজ আয়ুও শেষ হয়ে গেছে, শেষ হয়ে গেছে এতকালের বীরোচিত যশও— সমাপ্তমায়ুরস্যাদ্য যশশ্চৈব সুমধ্যমে।

সাত্যকি অর্জুনের প্রিয়তম অস্ত্রশিষ্য, কৃষ্ণেরও তিনি সদা-সহচর। বিশেষত আজকে এই প্রভাস-তীর্থে যাদব-বৃক্ষিদের মদ্য-মাংস, নৃত্যগীতের ব্যসনিতায় মহাকালের কালান্তক সুর বেজেছে সকলের শিরায়-উপশিরায়। কৃষ্ণ আজ সাক্ষী-চৈতন্যের মতো বসে আছেন বিনা প্রতিবাদে, তবু কৃতবর্মার সদোষ উচ্চারণে কষ্ট এবং ক্রোধ আক্রান্ত করছে তাঁর হৃদয়। আর সাত্যকি— তিনিও আজ মদ্যপান করে মদ-পাটলিত চক্ষু দুটি ঘোরাতে ঘোরাতে কৃতবর্মার কৃতকর্মের হিসেব মিটিয়ে দিতে চাইছেন আজ। দোষারোপ-আক্ষেপোক্তির রসনা বন্ধ করে সাত্যকি হাতে তুলে নিলেন উন্মুক্ত খড়্গ— কৃষ্ণের সামনেই— ইত্যেবমুক্ত্বা খড়্গেন কেশবস্য সমীপতঃ। হতচকিত কৃতবর্মা কোনও বাধা দেবার আগেই— মদ্যপান করে তিনিও তো বিহ্বল, অপ্রস্তুত— কিছু করবার মতো উদ্যোগই তাঁর ছিল না— অতএব কোনওরকম বাধা দেবার আগেই সাত্যকি দৌড়ে গেলেন তাঁর দিকে। উদ্যত খড়্গের এক কোপে তাঁর মাথাটি আলাদা করে দিলেন ধড় থেকে— অভিদ্রুত্য শিরঃ কোপাচ্চিচ্ছেদ কৃতবর্মণঃ।

কৃতবর্মা মারা গেলেন। এ বড় হীন মৃত্যু হল তাঁর। এই মৃত্যুতে কাউকে শোকগ্রস্ত হতে দেখিনি, কাউকে দেখিনি বিলাপ করতে। বীরশয্যায় শায়িত করে তাঁকে নিয়েও যাওয়া হয়নি অনন্ত যাত্রার পথে, not a drum was heared, not a funeral note. মহাবীরের এই অপমৃত্যু আমাদের মনে ব্যথা দেয়। সত্যি বলতে কী, মহাভারতের মৌষলপর্বে অনেক মহাবীরেরই এমন নিঃশব্দ মৃত্যু ঘটেছে। যেমন, যে সাত্যকি কৃতবর্মাকে মারলেন, তিনি নিজে এমনকী কৃষ্ণপুত্র মহাবীর প্রদ্যুম্নও মারা গেছেন মৃত কৃতবর্মার সমর্থকদের হাতে মদবিহ্বলতায়। সে-বাবদে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু তবু মহাভারতের মর্মস্থল থেকে যে নির্দেশ ভেসে আসে, মহাকাব্যের কবির বিশাল বিশদ হৃদয় থেকে কৃতবর্মার প্রতি যে ইঙ্গিত ভেসে আসে, তাতে কৃতবর্মার প্রতিতুলনায় সাত্যকি অনেক বেশি মহান হয়ে ওঠেন।

বলতে পারেন, কৃতবর্মা পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষে ছিলেন বলেই তিনি তেমন মহনীয় নন, বিশেষত কৃষ্ণের বিপক্ষতাতেই তাঁর চরিত্রের উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে গেছে। আমরা অবশ্য এই যুক্তি মানি না। লক্ষ করে দেখবেন, সংঘরাজ্যের প্রস্তুতিতে এবং সংস্কৃতিতে বড় হয়ে উঠেছিলেন বলেই কৃষ্ণ কিন্তু কোনওদিন কৃতবর্মাকে আঘাত করেননি, কোনও কুবাক্যও তাঁকে বলেননি কোনওদিন। স্যমন্তক মণির অধিকার নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেখানে অক্রূর কিংবা কৃতবর্মার উদাহরণ তো পরশ্রীকাতরতার। মণি তো তাঁদের নিজের নয়, অন্যের সম্পত্তি তাঁরা অধিকার করতে চাইছেন লোভে, ঈর্ষায়। তাও কৃতবর্মা অত লোভীও নন, তিনি কোনওদিন মণিগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহও দেখাননি। অথচ তিনি লুব্ধ অক্রূরের সহায়তা করছেন। সেই অক্রূরের জন্যই তিনি নিজের ভাইটিকে পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আসলে এক অতিরথ বীর হওয়া সত্ত্বেও কৃতবর্মার মধ্যে মহাবীরের ব্যক্তিত্ব ছিল না এবং তা ছিল না বলেই অদ্ভুত হীনম্মন্যতায় কৃষ্ণের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি ঈর্ষা-অসূয়ায় ভুগেছেন চিরকাল। এত বড় ব্যক্তিত্ব তিনি সহ্য করতে পারতেন না বলেই কৃষ্ণের চেয়ে লঘুতর অথচ বিপক্ষ ব্যক্তিত্ব অক্রূরের সহায়তা করছেন তিনি। একই মনোবৃত্তি কাজ করেছে— দুর্যোধনের পক্ষে তিনি পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসায়, বিশেষত পুনরায় সেই লঘুতর ব্যক্তিত্ব অশ্বত্থামার সহায়তায়।

এই সব মানুষ পৃথিবীতে অনেক আছেন, তাঁরা নিজেদের কী মনে করেন বলতে পারব না, কিন্তু সব সময় তাঁরা এই হীনম্মন্যতায় ভোগেন যে, জীবনে তাঁদের অনেক কিছু হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু অমুক লোকটাই সব বড় বড় জায়গা দখল করে নিল। কৃতবর্মার মতোই তাঁরা এটা বোঝেন না যে, বীরত্ব, বিদ্যা, ঐশ্বর্য— এই ধরনের এক একটি একতম গুণ নিয়েই বড় মানুষ হওয়া যায় না। বড় হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটা হল ব্যক্তিত্ব এবং সেই ব্যক্তিত্বের মধ্যেও চাই ‘ব্যালান্স’। এটা ছিল না বলেই ব্যক্তিগত কোনও কারণ না থাকা সত্ত্বেও তিনি অক্রূর-অশ্বত্থামার মতো গুণসাম্যহীন ব্যক্তিত্বের সহায়তা করেন, অথচ কৃষ্ণকে তিনি অতিক্রম করতে পারেন না। অতি ন্যায্য কারণে ছোট ভাই শতধন্বাকে হত্যা করেছেন কৃষ্ণ, কিন্তু সেই অবস্থাতেও কৃতবর্মা কৃষ্ণের গুরুত্ব মেনে নেননি, ওপর ওপর তাঁকে মানতে বাধ্য হচ্ছেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রতিপক্ষতাটুকু জীইয়ে রাখছেন মনের মধ্যে অনন্তকাল ধরে। কিছু মানুষ এইরকম বিক্ষুব্ধ থেকে যান আজীবন— মনের মধ্যে অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষা নিয়ে বিক্ষুব্ধ থেকে যান আমৃত্যু। রাজনীতি, পরিবার, পরিজনের মধ্যে কত শত আছে এই উদাহরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কৃতবর্মা

কৃতবর্মা

যদু বংশীয় হৃদিকের পুত্র। কৃষ্ণের অনুগত হওয়া সত্বেও দুর্যোধনের অনুরোধে ইনি কৌরবদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। কৌরব ও পাণ্ডবদের শক্তি বিচারের সময়ে, ভীষ্ম এঁকে যোদ্ধা হিসেবে অতিরথ (শ্রেষ্ঠ শ্রেনীর যোদ্ধা) বলে গণনা করেছেন। যুদ্ধশেষে কৌরব পক্ষের যে তিন বীর জীবিত ছিলেন, তাঁরা হলেন অশ্বত্থমা, কৃপ এবং কৃতবর্মা। মহাযুদ্ধের পঁয়ত্রিশ বছর পরে যদুবংশীয় বীররা যখন পানমত্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছেন, তখন নিদ্রিত পাণ্ডব ও পাঞ্চাল বীরদের হত্যাকাণ্ডে অশ্বত্থমাকে সাহায্য করেছিলেন বলে সাত্যকি কৃতবর্মাকে তিরস্কার করেন। কৃতবর্মাও সাত্যকির অন্যায়ভাবে ভুরিশ্রবা-বধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বচসা চরমে উঠলে সাত্যকি অসি দিয়ে কৃতবর্মার শিরশ্ছেদ করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *