০৭১.দুষ্মন্তের শকুন্তলা-সাক্ষাৎকার

একসপ্ততিতম অধ্যায়
দুষ্মন্তের শকুন্তলা-সাক্ষাৎকার

বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর রাজা মন্ত্রী ও পুরোহিতকে আশ্রমের বাহিরে রাখিয়া একাকী তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, আশ্রম শূন্য রহিয়াছে, মহর্ষি কণ্ব তথায় নাই। তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, “কুটীরের অভ্যন্তরে কে আছ, বহির্গত হও।” তাঁহার সেই বাক্য শ্রবণমাত্র তাপসীবেশধারিণী লক্ষ্মীর ন্যায় এক কন্যা কুটীর হইতে বহির্গত হইলেন। তিনি রাজাকে সমাগত দেখিয়া পাদ্য-অর্ঘ্য, আসন দ্বারা তাঁহার যথোচিত আতিথ্যবিধানপূর্ব্বক স্বাগত প্রশ্ন ও কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন। অনন্তর ঐ কন্যা বিনীতভাবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! এ স্থানে কি উদ্দেশে আপনার আগমন হইয়াছে? আজ্ঞা করুন, আপনার কোন্ কার্য্য সম্পাদন করিতে হইবে?” রাজা সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী মধুভাষিণী কন্যার বাক্য শ্রবণানন্তর তাঁহাকে কহিলেন, “ভদ্রে! আমি মহর্ষি কণ্বের উপাসনা করিতে এস্থানে আসিয়াছি। মহর্ষি কোথায়?” কন্যা কহিলেন, “পিতা ফল আহরণার্থ বনান্তরে গমন করিয়াছেন, তিনি শীঘ্রই প্রত্যাগমন করিবেন; আপনি ক্ষণকাল অপেক্ষা করিলেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিবেন।”

রাজা ঋষিকে আশ্রমে অনুপস্থিত দেখিয়া এবং সেই মধুরহাসিনী, রূপযৌবনবতী, লোকলালমভূতা ললনার অলোকসামান্য রূপলাবণ্য সন্দর্শন করিয়া মুগ্ধপ্রায় হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, “সুন্দরি! তুমি কে? কাহার রমণী? কি নিমিত্তই বা এই মহারণ্যে আসিয়াছ? আর তুমি কি প্রকারেই বা এরূপ রূপবতী হইয়াছ? তুমি দর্শনমাত্রই আমার মন হরণ করিয়াছ।” রাজার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া কন্যা মধুরস্বরে কহিলেন, “মহারাজ! আমি ধৃতিমান্ ধর্ম্মজ্ঞ মহাত্মা কণ্ব তপোধনের কন্যা, আমার নাম শকুন্তলা।” রাজা কহিলেন, “হে বরবর্ণিনি! সর্ব্বলোকপূজিত ভগবান্ কণ্ব ঊর্দ্ধ্বরেতাঃ। ধর্ম্মও কদাচিৎ বিচলিত হইতে পারেন. কিন্তু ঊর্দ্ধ্ব তপস্বীরা কখনই বিচলিত হয়েন না; তবে তুমি কিরূপে তাঁহার দুহিতা হইলে? আমার এ বিষয়ে অত্যন্ত সন্দেহ হইতেছে। তুমি অনুগ্রহ করিয়া সন্দেহভঞ্জন করিয়া দাও।” শকুন্তলা কহিলেন, “মহারাজ! একদা এক ঋষি পিতাকে আমার জন্মবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে পিতা তাঁহার সমীপে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করেন। আমি সেই সময়ে তাঁহার নিকটবর্ত্তিনী ছিলাম, সমস্তই শ্রবণ করিয়াছি, বলিতেছি, শ্রবণ করুন।”

রাজার নিকট শকুন্তলার পরিচয়

“মহর্যি কহিয়াছিলেন, পূর্ব্বকালে মহাতপাঃ বিশ্বামিত্র ঘোরতর কঠোর তপস্যা আরম্ভ করেন। তাঁহার তপঃপ্রভাবে ত্রিলোক তাপিত হইল। দেবরাজ ইন্দ্র, ‘তপোবীর্য্যসম্পন্ন বিশ্বামিত্র এই কঠোর তপস্যা দ্বারা পাছে আমার ইন্দ্রত্বপদ গ্রহণ করেন’ এই ভয়ে ভীত হইয়া অপ্সরা মেনকাকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, ‘মেনকে! অপ্সরাদিগের মধ্যে তুমিই সর্ব্বপ্রধান, অতএব তুমি আমার কিঞ্চিৎ উপকার কর। সূর্য্যসদৃশ তেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, মহাতপাঃ বিশ্বামিত্র কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহার তপোনুষ্ঠান দর্শনে আমার হৃৎকম্প হইতেছে। অতএব তোমাকে আমি এই ভার অর্পণ করিতেছি, যাহাতে সেই দুর্দ্ধর্ষ বিশ্বামিত্র তপস্যা দ্বারা আমাকে পদচ্যুত করিতে না পারেন, এমন কোন উপায় উদ্ভাবন কর। হে বরারোহে! রূপ, যৌবন, মধুর বাক্য, অঙ্গভঙ্গী, কটাক্ষ, হাব, ভাব, হাস্য প্রভৃতি প্রলোভন দ্বারা তোমাকে ঐ মহর্ষির তপোবিঘ্ন করিতে হইবে।’

মেনকা ইন্দ্রের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে দেবরাজ! আপনি ত] জানেন, ভগবান্ বিশ্বামিত্র অতিশয় তেজস্বী, তপস্বী ও ক্রুদ্ধস্বভাব। দেখুন, আপনি ত্রৈলোক্যের অধিপতি হইয়াও যাঁহার তপস্যা, তেজঃ ও কোপে ভীত হইতেছেন, আমি অবলা জাতি, কি প্রকারে তাঁহার অনিষ্ট-সাধন করিতে সাহস করিব? যে মহর্ষি মহাভাগ বশিষ্ঠের প্রাণসম শত পুৎত্রের প্রাণ সংহার করিয়াছেন, যিনি ক্ষিৎত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াও বলপূর্ব্বক ব্রাহ্মণ হইয়াছেন, যিনি অভিষেক-ক্রিয়া-সম্পাদনার্থ পরমপবিত্র অগাধসলিলা এক মহানদীকে স্বীয় আশ্রম-সমীপে আনয়ন করিয়াছেন, যাঁহার মহিমায় ঐ নদী অদ্যাপি কৌশিকী নামে বিখ্যাত আছে, যিনি ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক অন্য এক নক্ষত্রলোক ও নক্ষত্রসমুদয় সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি গুরুশাপগ্রস্থ ত্রিশঙ্কুকে অভয়দান করিয়াছেন, হে বিভো! যিনি এই সমস্ত অলৌকিক কার্য্য করিয়াছেন, আমি কোন সাহসে তাঁহার তপস্যা ভঙ্গ করিতে যাইব? আপনি যদি আমাকে এরূপ বর প্রদান করেন যে, তিনি ক্রোধাগ্নি দ্বারা আমাকে দগ্ধ করিতে পারিবেন না, তবে আমি যাইতে সাহস করিতে পারি। হে সুরেশ্বর! যিনি তেজোদ্বারা ত্রিলোকী দগ্ধ করিতে পারেন, যিনি পদাঘাতে মেদিনী প্রকম্পিত করিতে পারেন, যিনি সুমেরু উৎক্ষেপণ ও দশদিক্ আবর্ত্তন [দশ দিকে ঘুরান] করিতে পারেন, আমি কিরূপে সেই তপঃপ্রভাবসম্পন্ন প্রজ্বলিত হুতাশনাকার তপোধনকে স্পর্শ করিব? যাঁহার মুখ সাক্ষাৎ প্রদীপ্ত হুতাশন, যাঁহার অক্ষিতারা [নয়নের তারা-চক্ষুগোলক] মূর্ত্তিমান চন্দ্র ও সূর্য্য, যাঁহার জিহ্বা স্বয়ং কৃতান্ত, মাদৃশ লোক কিরূপে সেই মহাত্মাকে স্পর্শ করিবে? যম, সোম, মহর্ষিগণ, সিদ্ধ, সাধ্য, বিশ্বদেব ও বালখিল্য প্রভৃতি ঋষিগণ যাঁহাকে ভয় করেন; আমি অবলা হইয়া কিরূপে তাঁহার সমীপে গিয়া ক্রীড়া ও অঙ্গভঙ্গাদি করিব? হে দেবরাজ! আপনি আজ্ঞা করিতেছেন, অতএব আমাকে অবশ্যই সেই ঋষির নিকট যাইতে হইবে, কিন্তু আপনি এমত কোন উপায় নির্দ্দেশ করিয়া দিন, যাহাতে আমি তৎসমীপে নির্ব্বিঘ্নে বিচরণ করিতে পারি এবং তাঁহা হইতে পরিত্রাণ পাই। হে দেবরাজ! আমি যে সময়ে সেই উগ্রতপাঃ মুনির সমীপে গিয়া ক্রীড়াকৌতুক করিব, তৎকালে বায়ু যেন আমার বসন উড্ডীন করেন; ভগবান্ মন্মথ যেন আমার সহায়তা করেন এবং বন হইতে যেন সুগন্ধ গন্ধবহ মন্দ-মন্দভাবে বহিতে থাকে।’ ইন্দ্র ‘তথাস্তু’ বলিয়া মেনকাবাক্য স্বীকার করিলেন। মেনকাও তৎক্ষণাৎ বিশ্বামিত্রের আশ্রমে যাত্রা করিলেন।’