০৬৭.নৃপগণের জন্ম ও কর্ম্ম । কৌরবকুলের বিবরণ । পাণ্ডববংশবর্ণন । যদুবংশবর্ণন

সপ্তষষ্টিতম অধ্যায়
নৃপগণের জন্ম ও কর্ম্ম

জনমেজয় বৈশম্পায়নকে কহিলেন, হে ভগবন্! দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, রাক্ষস, সিংহ, ব্যাঘ্র, মৃগ, সর্প, বিহঙ্গম প্রভৃতি সমুদয় জীবগণ কি উদ্দেশে মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন ও তাঁহারা মনুষ্যলোকে জন্মিয়া কি কি কর্ম্ম করিয়াছেন, এই সমুদয় আনুপূর্ব্বিক শ্রবণে আমার সাতিশয় বাসনা হইতেছে, মহাশয়! অনুগ্রহ করিয়া কীর্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মনুষ্যলোকে যে যে দেবগণ ও দানবগণ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, অগ্রে তাঁহাদের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ করুন। বিপ্রচিত্তি নামে যে দানবেন্দ্র ছিলেন, তিনি মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিয়া জরাসন্ধ নামে বিখ্যাত হয়েন। হিরণ্যকশিপু নামে যে দিতির পুৎত্র তিনি নরলোকে জন্মিয়া শিশুপাল নামে বিখ্যাত হয়েন। প্রহ্লাদের অনুজ ভ্রাতা সংহ্লাদ পৃথিবীতে জন্মিয়া শল্য নামে বাহ্লীক দেশের অধীশ্বর হয়েন। অনুহ্লাদ নামে প্রহ্লাদের অপর এক অনুজ নরলোকে জন্মিয়া মহারাজ ধৃষ্টকেতু নামে বিখ্যাত হয়েন। শিবি নামে দিতিপুৎত্র ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া মহারাজ দ্রুম নামে বিখ্যাত হয়েন। বাষ্কলনামা অসুররাজ ভূতলে জন্মিয়া ভগদত্ত নামে বিখ্যাত হয়েন। অয়ঃশিরা, অশ্বশিরা, অয়ঃশঙ্কু, গগনমূর্দ্ধা ও বেগবান্ এই পাঁচ মহাবল-পরাক্রান্ত মহাসুর কেকয়-দেশে জন্মিয়া অতি প্রধান প্রধান ভূপতি হয়েন। কেতুমান নামে মহাপ্রতাপবান্ অসুর ভূমণ্ডলে জন্মিয়া অমিতৌজাঃ নামে অতি নির্দ্দয় নরপতি হয়েন। স্বর্ভানু-নামা সুবিখ্যাত দানব উগ্রসেন নামে অতি নৃশংস ভূপতি হয়েন। ভুবনবিখ্যাত অশ্ব নামে মহাসুর অবনীমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া অশোক নামে বিখ্যাত হয়েন। ইনি অসাধারণ বলশালী ছিলেন। কোন ব্যক্তি কখন ইঁহাকে পরাজিত করিতে পারেন নাই। অশ্বপতি নামে অশ্বের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূমণ্ডলে হার্দ্দিক্য ভূপতি নামে বিখ্যাত হয়েন। বৃষপর্ব্বা নামে সুবিখ্যাত মহাসুর দীর্ঘপ্রজ্ঞ-নামা ভূপতি হয়েন। বৃশপর্ব্বার অনুজ অজক শাল্ব নামে সুবিখ্যাত মহীপাল হয়েন। যে বীর্য্যবান্ মহাসুর অশ্বগ্রীব নামে বিখ্যাত, তিনি অবনীমণ্ডলে রোচমান নামে সুবিখ্যাত নৃপতি হয়েন। সূক্ষ্ম-নামে অসুর ভূতলে বসুধাধিপ বৃহদ্রথ নামে বিখ্যাত হয়েন। দানবেন্দ্র তুহুণ্ড সেনাবিন্দু নামে মহীপতি হয়েন। ইযুপ নামে মহাবল-পরাক্রান্ত মহাসুর নগ্নজিৎ নামে প্রভুত প্রতাপশালী নরপতি হয়েন। একচক্র-নামা যে মহাসুর ছিলেন, তিনি ভূতলে জন্মগ্রহণ করিয়া প্রতিবিন্ধ্য নামে বিখ্যাত হয়েন। বিরূপাক্ষ নামে চিত্রযোধী দানবাগ্রণী ভূতলে জন্মিয়া চিত্রধর্ম্মা নামে সুবিখ্যাত নৃপতি হয়েন। শত্রুপক্ষক্ষয়কারী সুহরনামা দানব অবনীতলে সুবিখ্যাত বাহ্লীক নামে ভূপতি হয়েন। নিচন্দ্র নামে পরম সুন্দর দানব ভূতলে মহারাজ মুঞ্জকেশ নামে বিখ্যাত হয়েন। দিনকুম্ভ নামে যে মহাবলপরাক্রান্ত দানব ছিলেন, তিনি নরলোকে ভূপতিশ্রেষ্ঠ দেবাধিপ নামে বিখ্যাত হয়েন। শরভনামা মহাদানব রাজর্ষি পৌর নামে বিখ্যাত হয়েন। কুপদ নামে মহাবল পরাক্রান্ত মহাসুর সুপার্শ্ব নামে সুবিখ্যাত ভূপতি হয়েন। ক্রম নামে মহাসুর ধরাতলে জন্মিয়া পার্ব্বতেয় নামে বিখ্যাত হয়েন। ইঁহার কলেবর সুমেরু-পর্ব্বতের সদৃশ ছিল। শলভ নামে মহাসুর বাহ্লীকদেশে প্রহ্লাদ নামে নরপতি হয়েন। চন্দ্রসদৃশ রূপবান্ চন্দ্রনামক অসুর মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিয়া কাম্বোজ-দেশাধিপতি চন্দ্রবর্ম্মা নামে সুবিখ্যাত ভূপতি হয়েন। অর্ক নামে যে সুবিখ্যাত দানবশ্রেষ্ঠ ছিলেন, তিনি মর্ত্ত্যলোকে রাজর্ষি ঋষিক বলিয়া বিখ্যাত হয়েন। মৃতপা নামে দানবেন্দ্র ভূতলে পশ্চিমানুপক নামে প্রথিত হয়েন। গরিষ্ঠ নামে ত্রিভুবন-বিখ্যাত মহাবল-পরাক্রান্ত মহাসুর নরলোকে দ্রুমসেন নামে বিখ্যাত নৃপতি হয়েন। ময়ুরনামা শ্রীমান্ মহাসুর ধরাতলে বিশ্ব নামে ভুপতি হয়েন। সুপর্ণ নামে তাঁহার সহোদর অবনীমণ্ডলে কালকীর্ত্তি নামে মহীপাল হয়েন। অসুরপ্রধান চন্দ্রহন্তা রাজর্ষি শুনক নামে বিখ্যাত হয়েন। যে দানব বিনাশন বলিয়া বিখ্যাত ছিলেন, তিনি ভূতলে জানকি নামে বিখ্যাত ভূপাল হয়েন। দীর্ঘজিহ্ব নামে দানবশ্রেষ্ঠ পৃথিবীতে কাশীরাজ নামে বিখ্যাত হয়েন। চন্দ্রসূর্য্য মর্দ্দনকারী যে ক্রুরগ্রহ সিংহিকাগর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনি ক্রাথ নামে বিখ্যাত ভূপতি হয়েন। অনায়ুর চারি পুৎত্রের মধ্যে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ বিক্ষরনামক অসুর ভূমণ্ডলে বসুমিত্র নামে বসুধাধিপ হয়েন। দ্বিতীয় পাণ্ড্যরাষ্ট্রাধিপ নামে বিখ্যাত ভূপতি হয়েন। বলীন নামে সুবিখ্যাত অসুর ভূতলে পৌণ্ড্র মৎস্যক নামে ভূপতি হয়েন। মহাসুর বৃত্র রাজর্ষি মণিমান্ নামে প্রথিত হয়েন। মণিমানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্রোধহন্তা দণ্ড নামে বিখ্যাত নৃপতি হয়েন। ক্রোধবর্দ্ধন নামে যে অসুর ছিলেন, তিনি দণ্ডাধার নামে সুবিখ্যাত নৃপতি হয়েন। কালেয়দিগের ব্যাঘ্রতুল্য বিক্রমশালী যে আট পুৎত্র ভূমণ্ডলে জন্মেন, তাঁহাদিগের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ মগধদেশে জয়ৎসেন নামে সুবিখ্যাত নৃপতি হয়েন। দ্বিতীয় ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী ছিলেন, তিনি অপরাজিত নামে নৃপাল হয়েন। মহাতেজাঃ মহাবল-পরাক্রান্ত মহামায়াবী তৃতীয় নিষাদ দেশের অধিপতি হয়েন। চতুর্থ শ্রেণিমান্ নামে বিখ্যাত নৃপতি হয়েন। পঞ্চম মহৌজাঃ নামে শত্রুকুলান্তক নৃপতি হয়েন। তাঁহাদিগের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান ষষ্ঠ মহাসুর অভীরুনামে সুবিখ্যাত রাজর্ষি হয়েন। সপ্তম সমস্ত অবনীমণ্ডলে সুবিখ্যাত সমুদ্রাসন নামে নরপতি হয়েন। কালেয়দিগের অষ্টম বৃহৎ নামে দানব ভূতলে সর্ব্বলোক-হিতৈষী পরমধার্ম্মিক ভূপতি হয়েন। কুক্ষি নামে মহাবল-পরাক্রান্ত মহাসুর ক্ষিতিতলে পার্ব্বতীয় নামে বিখ্যাত ভূপতি হয়েন। ইঁহার কলেবর কাঞ্চন-পর্ব্বতের সমান ছিল। মহাবীর্য্যসম্পন্ন মহাসুর ক্রথন সূর্য্যাক্ষ নামে বিখ্যাত হয়েন। সূর্য্য নামে পরম-সুন্দর মহাসুর বাহ্লীকদেশে দরদ নামে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ভূপতি হয়েন। হে রাজন! গণ নামে যে ক্রুদ্ধস্বভাব দানবের নাম পূর্ব্বে উল্লেখ করা গিয়াছে, তাঁহা হইতে অনেকানেক মহাবল-পরাক্রান্ত মহীপতি মহীতলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। মদ্রক, কর্ণবেষ্ট, সিদ্ধার্থ, কীচক, সুবীর, সুবাহু, মহাবীর, বাহ্লীক, ক্রথ, বিচিত্র, সুরথ, নীল, চীরবাসাঃ ভূমিপাল, দন্তবক্র, দুর্জ্জয়, রুক্মী, আষাঢ়, বায়ুবেগ, ভূরিতেজা, একলব্য, সুমিত্র, বাটধান, গোমুখ, কারুষক, ক্ষেমমূর্ত্তি, শ্রুতায়ুঃ, উদ্বহ, বৃহৎসেন, ক্ষেম, অগ্রতীর্থ, কুহর, মতিমান্ ও ঈশ্বর এই সমস্ত মহাবীর্য্য, মহাযশাঃ ভূপতিগণ ক্ষিতিতলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। মহাবল-পরাক্রান্ত মহাসুর কালনেমি উগ্রসেনের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া কংস নামে বিখ্যাত হয়েন। দেবরাজতুল্য দেবক নামে দানব ধরাতলে গন্ধর্ব্বপতি নামক প্রধান ভূপতি হয়েন।

কৌরবকুলের বিবরণ

হে ভরতকুল-তিলক! পবিত্রকীর্ত্তি দেবর্ষি বৃহস্পতির অংশে ভরদ্বাজবংশাবতংস অযোনিজ দ্রোণাচার্য জন্মেন। এই মহাত্মা অসাধারণ ধনুর্দ্ধর, অদ্বিতীয় পরাক্রমশালী, অতুল যশস্বী এবং বেদ ও ধনুর্ব্বেদে সুনিপুণ ছিলেন। মহাদেব, যম, কাম ও ক্রোধ এই চারি জনের সমষ্টিভূত অংশ হইতে মহাবীর অশ্বত্থামার জন্ম হয়। অষ্টবসুগণ বশিষ্ঠের শাপে নিয়ন্ত্রিত হইয়া ইন্দ্রের আদেশানুসারে শান্তনু রাজার ঔরসে গঙ্গাগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ভীষ্ম তাঁহাদের সর্ব্বকনিষ্ঠ। ইনি কুরুকুলের অভয়প্রদ, বুদ্ধিমান, বিদ্বান, সদ্বক্তা, শত্রুপক্ষক্ষয়কারী ও সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ ছিলেন। মহাত্মা ভীষ্ম জমদগ্নিনন্দন পরশুরামের সহিত যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করেন। অসাধারণ পুরুষকারসম্পন্ন যে ব্রহ্মর্ষি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কৃপ নামে বিখ্যাত হয়েন, তিনি একাদশ রুদ্রের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। শত্রুকুলান্তক মহারথ শকুনি দ্বাপরের অংশে জন্মেন। সত্যপ্রতিজ্ঞ, অরাতিকুলনাশক, বৃষ্ণিকুলতিলক সাত্যকি বায়ুদেবতাদিগের অংশে জন্মগ্রহণ করেন। সর্ব্বশাস্ত্রবেত্তা রাজর্ষি দ্রুপদ, ক্ষৎত্রিয়সত্তম নরনাথ কৃতবর্ম্মা ও পররাজ্য-প্রপীড়ক শত্রুনাশক ভূপতি বিরাট এই তিন ভূপতিও বায়ুর অংশে জন্মগ্রহণ করেন। অরিষ্টার পুৎত্র হংস কুরুকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া গন্ধর্ব্বগণের রাজা হয়েন। দীর্ঘবাহু, মহাতেজাঃ, প্রজ্ঞাচক্ষু ভূপতি ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ঔরসে জন্মেন। ইনি মাতৃদোষজন্য কৃষ্ণদ্বৈপায়নের কোপে জন্মান্ধ হয়েন। তৎকনিষ্ঠ পাণ্ডু, মহাবল, সত্যনিষ্ঠ ও ধর্ম্মপরায়ণ ছিলেন। ধীমান্ বিদুর অত্রি মুনির পুৎত্র। দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন কলির অংশে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি অতি পাপাশয়, ক্রুর ও কুরুকুলের কলঙ্কস্বরূপ ছিলেন। যে কলি সমস্ত জগতের বিদ্বেষাস্পদ এবং যিনি জীবমাত্রের সংহারকর্ত্তা, তিনিই দুর্য্যোধনরূপে অবনীতলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। এই দুর্য্যোধন হইতেই ভয়ঙ্কর বৈরাগ্নি উত্তেজিত হয়। পৌলস্ত্যেরা দুর্য্যোধনের ভ্রাতারূপে জন্মেন। দুঃশাসন, দুর্ম্মুখ, দুঃসহ প্রভৃতি দুর্য্যোধনের শত ভ্রাতা। ইঁহারাও অতিশয় ক্রুরকর্ম্মা। এই শত পুৎত্র ব্যতীত ধৃতরাষ্ট্রের বৈশ্যাগর্ভসম্ভূত অপর এক পুৎত্র জন্মেন। তাঁহার নাম যুযুৎসু।

জনমেজয় কহিলেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুৎত্রদিগের মধ্যে কাহার কি কি নাম ও তাঁহারা কাহার পর কে জন্মেন, আনুপূর্ব্বিক কীর্ত্তন করুন। বৈশম্পায়ন কহিলেন, দুর্য্যোধন, যুযুৎসু, দুঃশাসন, দুঃসহ, দুঃশল, দুর্ম্মুখ, বিবিংশতি, বিকর্ণ, জলসন্ধ, সুলোচন, বিন্দ, অনুবিন্দ, দুর্দ্ধর্ষ, সুবাহু, সুপ্রধর্ষণ, দুর্ম্মর্ষণ, দুর্ম্মুখ, দুষ্কণ, কর্ণ, চিত্র, উপচিত্র, চিত্রাক্ষ, চারুচিত্র, অঙ্গদ, দুর্ম্মদ, দুষ্প্রহর্ষ, বিবিৎসু, বিকট, সম, ঊর্ণনাভ, পদ্মনাভ, নন্দ, উপনন্দ, সেনাপতি, সুসেন, কুণ্ডোদর, মহোদর, চিত্রবাহু, চিত্রবর্ম্মা, সুকর্ম্মা, দুর্ব্বিরোচন, অয়োবাহু, মহাবাহু, চিত্রচাপ, সুকুণ্ডল, ভীমবেগ, ভীমবল, বলাকী, ভীমবিক্রম, উগ্রায়ুধ, ভীমশর, কনকায়ুঃ, দৃঢ়ায়ুধ, দৃঢ়কর্ম্মা, দৃঢ়ক্ষৎত্র, সোমকীর্ত্তি, অনুদর, জরাসন্ধ, দৃঢ়সন্ধ, সত্যসন্ধ, সহস্রবাহু, উগ্রশ্রবাঃ, উগ্রসেন, ক্ষেমমূর্ত্তি, সেনানী, অপরাজিত, পণ্ডিতক, বিশালাক্ষ, দুরাধন, দৃঢ়হস্ত, সুহস্ত, বাতবেগ, সুবর্চ্চাঃ, আদিত্যকেতু, বহ্বাশী, নাগদত্ত, অগ্রযায়ী, কবচী, নিষঙ্গী, দণ্ডী, দণ্ডাধার, ধনুগ্রহ, উগ্র, ভীমরথ, বীর, বীরবাহু, অলোলুপ, অভয়, রৌদ্রকর্ম্মা, দৃঢ়রথ, অনাধৃষ্য, কুণ্ডভেদী, বিরাবী, দীর্ঘলোচন, দীর্ঘবাহু, মহাবাহু, ব্যূঢ়োরু, কনকাঙ্গদ, কুণ্ডজ ও চিত্রক, এই একশত পুৎত্র ও দুঃশলানাম্নী কন্যা ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসে জন্মেন। এতদ্ভিন্ন বৈশ্যার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের যে পুৎত্র জন্মেন, তাঁহার নাম যুযুৎসু। ধৃতরাষ্ট্রের পুৎত্রগণের আনুপূর্ব্বিক নাম কীর্ত্তন করিলাম, ইঁহারা সকলেই বেদবেত্তা, রাজনীতি পারদর্শী ও যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ এবং সকলেই স্বস্বানুরূপ দারপরিগ্রহ করিয়াছিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র সৌবলের অনুমতিক্রমে যথাকালে সিন্ধুদেশাধিপতি জয়দ্রথের সহিত দুঃশলার উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন করিয়াছিলেন।

পাণ্ডববংশবর্ণন

হে নরনাথ! রাজা যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের অংশে জন্মগ্রহণ করেন; ভীমসেন বায়ুর অংশে, অর্জ্জুন দেবরাজ ইন্দ্রের অংশে এবং সর্ব্বভূতমনোহর, অপ্রতিম রূপশালী নকুল ও সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের অংশে জন্মেন। সুবিখ্যাত সোমতনয় বর্চ্চাঃ অর্জ্জুন-পুৎত্র অভিমন্যুরূপে জন্মগ্রহণ করেন। বর্চ্চার পৃথ্বীতলে অবতীর্ণ হইবার পূর্ব্বে ভগবান্ সোম দেবগণকে কহিলেন, “হে দেবগণ! এই পুৎত্র আমার প্রাণ হইতেও প্রিয়তর; অতএব ইহাকে দিতে আমি সম্মত নহি। তবে যদি তোমরা এই নিয়ম কর, তাহা হইলে প্রিয়পুৎত্রকে তোমাদিগের হস্তে সমর্পণ করিতে পারি। অসুরবধ কেবল দেবগণের কার্য্য নহে, উহাতে আমাদিগেরও সাহায্য করা কর্ত্তব্য। এই নিমিত্ত অগত্যা ইহাকে দিতে স্বীকৃত হইলাম, কিন্তু এই বর্চ্চাঃ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া চিরকাল থাকিতে পারিবেন না। হে অমরগণ! ইন্দ্রের অংশে পাণ্ডু রাজার অর্জ্জুন নামে অতি প্রতাপশালী যে পুৎত্র জন্মিবেন, বর্চ্চাঃ তাঁহারই পুৎত্র হইয়া পৃথ্বীতলে জন্মগ্রহণ করিবেন ও প্রসিদ্ধ অতিরথ গণনায় পরিগণিত হইয়া ষোড়শ বৎসর পৃথিবীতে অবস্থান করিবেন। হে দেবগণ! তোমরা অংশাবতার হইয়া যে সংগ্রামে অসুরনিপাত করিবে, উঁহার ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রম পূর্ণ হইবার অনতিকালপূর্ব্বেই ঐ যুদ্ধ উপস্থিত হইবে; কিন্তু সেই যুদ্ধে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন থাকিবেন না, কেবল তোমরা চক্রব্যূহ (দুর্গম-রণক্ষেত্র) সংস্থাপন করিয়া অসুরগণের সহিত যুদ্ধ করিবে। আমার এই পুৎত্র সমস্ত শত্রুপক্ষীয় সৈন্যগণকে বিমুখ করিবেন। ইনি দুর্ভেদ্য ব্যূহ ভেদ করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক দিনার্দ্ধভাগের মধ্যে সংগ্রামনিপুণ অতিরথ ও মহারথগণ এবং বিপক্ষপক্ষীয় চতুর্থাংশ সৈন্য শমনসদনে প্রেরণ করিবেন। তৎপরে দিবাবসানসময়ে সংগ্রামে নিহত হইয়া পুনরায় আমার সমীপে আগমন করিবেন। অভিমন্যুরূপী মদীয় পুৎত্রের যে পুৎত্র জন্মিবে, সেই পুৎত্র প্রনষ্টপ্রায় ভরতবংশের পুনরুদ্ধার করিবে।” দেবগণ ভগবান্ সোমের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বীকার করিলেন এবং তাঁহার যথোচিত পূজা করিলেন। হে নরনাথ! তোমার পিতামহ এইরূপে অবনীমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন।
হে মহারাজ! মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন অগ্নির অংশে জন্মেন। রাক্ষসের অংশে স্ত্রীপূর্ব্বরূপী (পুরুষলক্ষণহীন) শিখণ্ড উৎপন্ন হন। দ্রৌপদীর গর্ভে যে পঞ্চপুৎত্র জন্মেন, তাঁহারা পূর্বজন্মে বিশ্ব নামে দেবগণ ছিলনে। এই পঞ্চপুত্রের মধ্যে প্রতিবিন্ধ্য যুধিষ্ঠিরের ঔরসে, শ্রুতসোম ভীমের ঔরসে, শ্রুতকীর্ত্তি অর্জ্জুনের ঔরসে, শতানীক নকুলের ঔরসে ও শ্রুতসেন সহদেবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। যদুবংশাবতংস শূর নামক রাজা বসুদেবের পিতা। তাঁহার পৃথানাম্নী এক পরম-রূপবতী কন্যা ছিল। শূর স্বীয় পিতৃস্বস্রীয়পুৎত্র অনপত্য কুন্তীভোজের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ‘আমার প্রথম সন্তান তোমাকে প্রদান করিব।’ তিনি পূর্ব্বকৃত প্রতিজ্ঞানুসারে সেই সর্ব্বাগ্রজাতা কন্যাটি তাঁহাকে প্রদান করিলেন। পৃথা কুন্তীভোজের গৃহে শশিকলার ন্যায় দিন দিন পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ ও অতিথিগণের সেবায় নিযুক্ত থাকিতেন। একদা জিতেন্দ্রিয় উগ্রতপস্বী মুনিপ্রবর দুর্ব্বাসা কুন্তীভোজের আলয়ে আতিথ্য স্বীকার করেন। অতিথি সৎকারনিপুণ পৃথা সাতিশয় যত্নসহকারে তাঁহার যথোচিত পরিচর্য্যা করিলেন। মুনিবর পৃথার শুশ্রূষায় পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে এক মন্ত্র প্রদান করিলেন এবং কহিলেন, “বৎস! এই মন্ত্র দ্বারা তুমি যে দেবতাকে আহ্বান করিবে, তিনি তৎক্ষণাৎ আগমন করিয়া তোমার গর্ভে স্বানুরূপ পুৎত্র উৎপাদন করিবেন।” দুর্ব্বাসা বিদায় হইলে কুমারী পৃথা বালসুলভ চপলতাপ্রযুক্ত সেই মন্ত্র দ্বারা সূর্য্যদেবকে আহ্বান করিলেন। ভগবান্ ভাস্কর সেই মন্ত্রপ্রভাবে পৃথা-সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার গর্ভাধান করিলেন। সেই গর্ভ হইতে সর্ব্বশাস্ত্রদক্ষ, বিচিত্রকুণ্ডলধারী, কবচী, সূর্য্যসম তেজস্বী এক পুৎত্র যথাকালে ভূমিষ্ঠ হইল। কুন্তী কন্যাকাবস্থায় সন্তান হইয়াছে বলিয়া লোকাপবাদভয়ে সেই সদ্যঃ-প্রসূত পুৎত্রকে জলে নিক্ষেপ করিলেন। যশস্বী রাধাভর্ত্তা সেই সুকুমার নব-কুমারকে জল হইতে গ্রহণ করিয়া স্বীয় সহধর্ম্মিণী রাধাকে প্রদান করিলেন। অনন্তর তাঁহার ঐ পুৎত্রের বসুষেণ নাম দিয়া লালন-পালন করিতে লাগিলেন। বসুষেণ কিয়দ্দিনমধ্যেই অত্যন্ত বলবান্, অস্ত্রবিদ্যা বিশারদ ও বেদাঙ্গবেত্তা হইয়া উঠিলেন। এই সত্যপরাক্রম, ধীশক্তিসম্পন্ন বসুষেন যখন জপ করিতে বসিতেন, তখন যে-কোন ব্রাহ্মণ তাঁহার নিকট যাহা প্রার্থনা করিতেন, তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা দিতেন। একদা ভগবান্ ইন্দ্র ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করিয়া তাঁহার সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক আপন পুৎত্রের নিমিত্ত তাঁহার কুণ্ডলদ্বয় ও কবচ প্রার্থনা করিলেন। বসুষেণ তৎক্ষণাৎ স্বীয় শরীর হইতে কবচ ও কুণ্ডল উন্মোচন করিয়া তাঁহাকে প্রদান করিলেন। ইন্দ্র তাঁহার এই অসামান্য বদান্যতা দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া তাঁহাকে একপুরুষঘাতিনী এক শক্তি প্রদান করিলেন এবং কহিলেন, “হে দুর্দ্ধর্ষ! তুমি দেব, দানব, মনুষ্য, গন্ধর্ব্ব, উরগ (সর্প) ও রাক্ষস প্রভৃতি যাহার প্রতি এই শক্তি-অস্ত্র নিক্ষেপ করিবে, তাহার অবশ্যই মৃত্যু হইবে সন্দেহ নাই।” এই বলিয়া ইন্দ্র তিরোহিত হইলেন। তদবধি বসুষেণের নাম বৈকর্ত্তন ও কর্ণ হইল। যে মহাত্মা বসুষেণ নামে বিখ্যাত ছিলেন, তিনিই কর্ণ নামে প্রথিত হইয়া সূতকুলে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। হে নরনাথ! এই কর্ণকে সর্ব্বাস্ত্র বিশারদ নরশ্রেষ্ঠ দুর্য্যোধনের প্রধান সচিব এবং সূর্য্যের অংশ বলিয়া জানিবেন।

যদুবংশবর্ণন

হে রাজন! প্রতাপশালী বাসুদেব দেবদেব নারায়ণের অংশ। মহাবল বলভদ্র শেষনাগের অংশ। মহৌজাঃ প্রদ্যুম্ন সনৎকুমারের অংশ। এইরূপে বসুদেববংশে দেবগণের অংশে বহুতর নরেন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। হে মহারাজ! পূর্ব্বে যে-সমস্ত অপ্সরাগণের কথা কহিয়াছি, তাঁহাদের অংশে ইন্দ্রের আদেশানুসারে ষোড়শ সহস্র দেবীগণ ভূতলে জন্মগ্রহণ করিয়া ভগবান্ বাসুদেবের পরিগ্রহ (পত্নী) হয়েন। রুক্মিণী নারায়ণের প্রীতিসাধনার্থ লক্ষ্মীদেবীর অংশে ভীষ্মক রাজার কুলে সমুৎপন্ন হয়েন। সর্ব্বলক্ষণসম্পন্না দ্রৌপদী দ্রুপদ রাজার কুলে শচীর অংশে জন্মেন। এই কন্যা বেদীমধ্য হইতে বিনির্গত হয়েন। ইনি নাতিহ্রস্বা ও নাতিদীর্ঘা। ইঁহার গাত্রে নীলোৎপলগন্ধ চক্ষু পদ্মপত্রের ন্যায় বিশাল, নিতন্ব অতি মনোহর ও বর্ণ বৈদূর্য্যমণির ন্যায় ছিল। ইনি পাঁচ প্রধান পুরুষের চিত্তপ্রমোদ জন্মাইয়াছিলেন। সিদ্ধি ও ধৃতির অংশে কুন্তী ও মাদ্রী জন্মেন। ইঁহারা পঞ্চপাণ্ডবের মাতা। মতিনাম্নী কন্যা সুবলের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন। হে নরনাথ! দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা ও রাক্ষসদিগের অংশাবতার কীর্ত্তন করিলাম। যে-সমস্ত সংগ্রামলোলুপ মহাত্মা ভূপতিগণ বিশাল যদুকুলে জন্মগ্রহণ করেন এবং যে-সকল ব্রাহ্মণ, ক্ষৎত্রিয় ও বৈশ্যগণ ঐ উপলক্ষে ধরাতলে জন্মেন, তাঁহাদিগেরও নাম কীর্ত্তন করিলাম। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি অসূয়া-শূন্য হৃদয়ে এই পরমোৎকৃষ্ট অংশাবতরণ [স্ব স্ব অংশে পৃথিবীতে দেবগণের জন্ম] বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলে তাঁহাদিগের আয়ুঃ, যশঃ, বংশবর্দ্ধন ও সর্ব্বত্র বিজয়লাভ হয়। ইহা শ্রবণ করিলে লোকে দেবাসুর প্রভূতির উৎপত্তি ও বিনাশ অবগত হইয়া অত্যন্ত ক্লেশদায়ক অবস্থায়ও অবসন্ন হয় না।