০৫৮.সর্পযজ্ঞের উপসংহার

অষ্টপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
সর্পযজ্ঞের উপসংহার

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! অধুনা আস্তীকের আর এক অত্যদ্ভুত উপাখ্যান শ্রবণ করুন। দেবরাজ-হস্ত হইতে ভ্রষ্ট নাগরাজ তক্ষক অতিমাত্র ভীত হইয়া প্রজ্বলিত হুতাশনে পতিত হইতেছে না দেখিয়া রাজা জনমেজয় নিতান্ত চিন্তাকুল হইলেন। শোনক জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস সূতনন্দন! বল দেখি, তক্ষক কি নিমিত্ত সেই সকল মনীষী বিপ্রগণের মন্ত্রবলে হোমানলে পতিত হইল না? উগ্রশ্রবাঃ উত্তর করিলেন, মহাশয়! অলৌকিক ক্ষমতাপন্ন মহাতেজা মহর্ষি আস্তীক ইন্দ্র হইতে ভ্রষ্ট নাগরাজকে ভয়বিহ্বল দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে তিনবার ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ এই বাক্য বলিয়াছিলেন। তাহাতেই নাগেন্দ্র ভূতলে পতিত ও ভস্মীভূত না হইয়া অন্তরীক্ষে কালযাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিল।
অনন্তর রাজা সদস্যগণের প্রবর্ত্তনাপরতন্ত্র [ব্যস্থার অধীন] হইয়া আস্তীককে অভিলষিত বরদানপূর্ব্বক কহিলেন, “নিবৃত্ত হউক, সর্পকুল নিরাপদ হউক, আস্তীক ঋষি প্রসন্ন হউন এবং সেই সূতবাক্য সত্য হউক।” আস্তীককে এই বর দেওয়াতে সমাগত জনগণ মুক্তকণ্ঠে জয়ধ্বনি করিতে লাগিল এবং যজ্ঞ নিবৃত্ত হইল। রাজা প্রীতমনে ঋত্বিক্ ও সদস্যগণকে প্রার্থনাধিক অর্থদান দ্বারা সন্তুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন। পূর্ব্বে যে লোহিতাক্ষ সূত ‘এক ব্রাহ্মণ এই যজ্ঞের অন্তরায়স্বরূপ হইবেন,’ এই কথা উল্লেখ করিয়াছিলেন, ভূপতি তাঁহাকেও বিপুল ধনদান করিয়া দীক্ষান্ত-স্নান [অবভূত—যজ্ঞান্তে-স্নান] করিলেন। পরিশেষে অশন, বসন প্রভৃতি নানাবিধ দ্রব্যসামগ্রী প্রদানপূর্ব্বক আস্তীককে পরিতুষ্ট করিয়া গৃহে প্রেরণকালে অতি বিনীতভাবে নিবেদন করিলেন, “মহাশয়! আমার অশ্বমেধযজ্ঞে আপনাকে সদস্য হইতে হইবে।”
আস্তীক অতি মহৎকার্য্যের অনুষ্ঠানে সন্তুষ্ট হইয়া রাজাজ্ঞা স্বীকারপূর্ব্বক স্বগৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। তিনি প্রথমতঃ জননী ও মাতুলের সমীপে গমন করিয়া আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। সর্পগণ আপনাদিগের কুশল-সংবাদ শ্রবণে আনন্দিত হইয়া আস্তীক অগণ্য ধন্যবাদ প্রদানপূর্বক কহিল, “বৎস! অদ্য তুমি আমাদিগের জীবনদান করিলে, আমরা তোমার প্রতি অতিশয় প্রীত হইয়াছি, এক্ষণে বর প্রার্থনা কর।” তাহারা ভূয়োভূয়ঃ বলিতে লাগিল, “বৎস! আমরা তোমা কর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইয়াছি, এক্ষণে বল, তোমার কি প্রিয়কার্য্য সম্পাদন করিব?”
আস্তীক কহিলেন. “যদি আপনারা আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এইমাত্র অনুগ্রহ করিবেন যে, যে-সকল ধর্ম্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ ও অপরাপর ব্যক্তি সায়াহ্নে বা প্রাতঃকালে অসিত, আর্ত্তিমান্ ও সুনীথের নাম স্মরণ করিবেন কিংবা (যে আস্তীক মুনি জনমেজয়ের সর্পসত্র হইতে তোমাদিগকে রক্ষা করিয়াছেন, আমি তাঁহাকে স্মরণ করিতেছি, হে সর্পগণ! আমাকে হিংসা করিও না, জনমেজয়ের যজ্ঞাবসানে আস্তীকের বচন স্মরণ কর, যে সর্প আস্তীকের নাম শুনিয়াও হিংসা করিতে নিবৃত্ত না হইবে, শাল্মলী বৃক্ষের ফলের ন্যায় তাহার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হইবে 🙂 এই ধর্ম্মাখ্যান পাঠ করিবেন, আপনারা তাঁহাদিগের কোন অনিষ্ট করিবেন না।” সর্পেরা প্রসন্নমনে আস্তীকের প্রস্তাবে সম্মত হইয়া উত্তর করিলেন, “হে ভাগিনেয়! আমরা কদাচ তোমার প্রর্থিত বিষয়ের অন্যথাচরণ করিব না।”
সূত শৌনককে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, হে দ্বিজোত্তম! আস্তীক সমাগত নাগেন্দ্রগণের এই বাক্য শ্রবণে পরম প্রীতিমনে স্বভবনাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। কিয়ৎকাল পরে তিনি পুৎত্র-পৌৎত্রাদি রাখিয়া লোকযাত্রা সংবরণ করেন। হে ভৃগূত্তম! আপনার পূর্ব্বজ প্রমতি স্বীয় পুৎত্র রুরুর কৌতুকনিবৃত্তির নিমিত্ত আস্তীকোপাখ্যান যেরূপ কীর্ত্তন করিয়াছিলেন, আমি তাহা অবিকল বর্ণনা করিলাম। এই পূণ্যবর্দ্ধক আস্তীকোপাখ্যান শ্রবণ করিলে সর্পভয় বিনষ্ট হয়, অন্তঃকরণে বিশুদ্ধ সুখের সঞ্চার হয় এবং পবিত্র ধর্ম্মলাভ হয়।