সুগৃহিণী

ইতঃপূর্ব্বে আমি “স্ত্রীজাতির অবনতি” প্রবন্ধে আমাদের প্রকৃত অবস্থার চিত্র দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছি কিন্তু সত্য কথা সর্ব্বদাই কিঞ্চিৎ শ্রুতিকটু বলিয়া অনেকে উহা পছন্দ করেন নাই।১ অতঃপর “অদ্ধাঙ্গী” প্রবন্ধে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, নারী ও নর উভয়ে একই বস্তুর অঙ্গবিশেষ। যেমন একজনের দুইটি হাত কিংবা কোন শকটের দুইটি চক্র, সুতরাং উভয়ে সমতুল্য, অথবা উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতিলাভ করিতে পারিবে না। একচক্ষুবিশিষ্ট ব্যাক্তিকে লোকে কাণা বলে।

যাহা হউক আধ্যাত্মিক সমকতার ভাষা যদি স্ত্রীলোকেরা না বুঝেন, তবে উচ্চ আকাঙ্খা বা উচ্চভাবের কথায় কাজ নাই। আজি আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি? বোধ হয় আপনারা সমস্বরে বলিবেনঃ

“সুগৃহিণী হওয়া”

বেশ কথা। আশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাই। কারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি না। সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেন। পুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জ্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মত আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাই। যেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, “নবাব” “রাজা” উপাধিলাভের জন্য স্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে না। তবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental culture) করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental culture) আবশ্যক।

এই যে গৃহিণীদের ঘরকান্নার দৈনিক কার্য্যগুলি, ইহা সুচারুরূপে সম্পাদন করিবার জন্যও ত বিশেষ জ্ঞান বুদ্ধির প্রয়োজন। চিন্তা করিলে দেখা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে তাঁহারাই সমাজের হর্ত্রী কর্ত্রী ও বিধাত্রী, তাঁহারাই সমাজের গৃহলক্ষ্মী, ভগিনী এবং জননী।

ঘরকন্নার কাজগুলি প্রধানতঃ এই-
(ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা।
(খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা।
(গ) রন্ধন ও পরিবেশন।
(ঘ) সূচিকর্ম্ম।
(ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা।
(চ) সন্তানপালন করা।

এখন দেখা যাউক ঐ কার্য্যগুলি এদেশে কিরূপ হইয়া থাকে এবং কিরূপ হওয়া উচিত। আমরা ধনবান এবং নিঃস্বদিগকে ছাড়িয়া মধ্যম অবস্থার লোকের কথা বলিব।

গৃহখানা পরিস্কার ও অল্পব্যয়ে সুন্দর রূপে সাজাইয়া রাখিতে হইলে বুদ্ধির দরকার। প্রথমে গৃহনির্ম্মাণের সময়ই গৃহিণীকে স্বীয় সলিকা (taste) দেখাইতে হইবে২ কোথায় একটি বাগান হইবে, কোন স্থানে রন্ধনশালা হইবে ইত্যাদি তাঁহারই পসন্দ অনুসারে কোথায় চাই। ভাড়াটে বাড়ী হইলে তাহার কোন কামনা কিরূপে ব্যবহৃত হইবে, সে বিষয়ে সলিকা চাই। যেহেতু তিনি গৃহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কিন্তু বলি, জয় জন গৃহিণীর এ জ্ঞান আছে? আমরা এমন গৃহিণী যে গৃহব্যাপারই বুঝি না! আমাদের বিসমেল্লায়ই গলৎ!! গৃহনির্ম্মাণের পর গৃহসামগ্রী চাই। তাহা সাজাইয়া গুছাইয়া রাখার জন্যও সলিকা চাই। কোথায় কোন জিনিসটা থাকিলে মানায় ভাল, কোথায় কি মানায় না, এ সব বুঝিবার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। একটা মেয়েলী প্রবাদ আছে, “সেই ধান সেই চাউল গিন্নী গুলে আউল ঝাউল” (এলোমেলো)। ভাঁড়ার ঘরে সচরাচর দেখা যায়, মাকড়সার জাল চাঁদোয়ারূপে শোভা পাইতেছে! তেঁতুলে তণ্ডুলে বেশ মেশামিশী হইয়া আছে, কোথাও ধ’নের সহিত মৌরি পাইতেছে। চিনি খুঁজিয়া বাহির করিতে এক ঘন্টা সময় লাগে। চারি দিক বদ্ধ থাকে বলিয়া ভাঁড়ার ঘরের দ্বার খোলা মাত্র বদ্ধ বায়ুর এক প্রকার দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। অভ্যাসের কৃপায় এ দুর্গন্ধ গিন্নিদের অপ্রিয় বোধ হয় না।

অনেক শ্রীমতী পান সাজিতে বসিয়া যাঁতির খোঁজ করেন; যাঁতি পাওয়া গেলে দেখেন পানগুলি ধোওয়া হয় নাই। পানের ডিবে কোন ছেলে কোথায় রাখে তার ঠিক নাই! কখন না খয়ের ও চূণের সংমিশ্রণে এক অদ্‌ভুদ পদার্থ প্রস্তুত হইয়া থাকে। পান থাকে ঘটিতে, সুপারী থাকে একটা সাজিতে, খয়ের হয়ত থাকে কাপড়ের বাক্সে! অবশ্য “সাহেবে সলিকা” গণ এরূপ করেন না। তাঁহাদের পানের সমস্ত জিনিস যথাস্থানে সুসজ্জিত থাকে।

কেহ বা চা’র পাত্র (tea-port) মৎস্যাধাররূপে ব্যবহার করেন, ময়দা চালিবার চালনীতে পটল, কুমড়া প্রভৃতি তরকারি কুটিয়া রাখা হয়! পিতলের বাটীতে তেঁতুলের আচার থাকে! পূর্ব্বে মুসলমানেরা “মোকাবা” (পাত্র বিশেষ, যাহাতে চুল বাঁধিবার সমঞ্জাম থাকে) রাখিতেন, আজিকালি অনেকে toilet table রাখেন। ইহাদের “মোকাবায়” কিংবা টেবিলের উপর চিরুণী তৈল (toilet সামগ্রী) ছাড়া আরও অনেক জিনিষ থাকে, যাহার সহিত কেশবিন্যাস সামগ্রীর (toilet এর) কোন সম্পূর্ণ নাই।

পরিমিত ব্যয় করা গৃহিণীর একটা প্রধান গুণ। হতভাগা পুরুষেরা টাকা উপার্জ্জন করিতে কিরূপ শ্রম ও যত্ন করেন, কতখানি ঘাম পায় ফেলিয়া এক একটী পয়সার মূল্য (পারিশ্রমিক) দিয়া থাকেন, অনেক গৃহিণী তাহা একটু চিন্তা করিয়াও দেখেন না। উপার্জ্জন না করিলে স্বামীর সহিত ঝগড়া করিবেন, যথাসাধ্য কটুকাটব্য বলিবেন, কিন্তু একটু সহানুভূতি করেন কই? ঐ শ্রমার্জ্জিত টাকাগুলি কন্যার বিবাহে বা পুত্রের অন্নপ্রাশনে কেবল সাধ (আমোদ) আহ্রাদে ব্যয় করিবেন, অথবা অলঙ্কার গড়াইতে ঐ টাকা দ্বারা স্বর্ণকারের উদর-পূর্ত্তি করিবেন। স্বামী বেচারা এক সময় চাকরীর আশায় সার্টিফিকেট কুড়াইবার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া, বহু আয়াসে সামান্য বেতনে চাকরী প্রাপ্ত হইয়া প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়া যে টাকা কয়টি পত্নীর হাতে আনিয়া দেন, তাহার অধিকাংশ মল ও নুপুরের বেশে তাঁহার কন্যাদের চরণ বেড়িয়া রুণুঝুনু রবে কাঁদিতে থাকে। হায় বালিকে! তোমার চরণশোভন সেই মল গড়াইতে তোমার পিতার হৃদয়ের কতখানি রক্ত শোষিত হইয়াছে তাহা তুমি বুঝ না।

স্বামীর আয় অনুসারে ব্যয় করাই অর্থের সদ্ব্যবহার। ইউরোপীয় মহিলাদের কথার মূল্য বেশী, তাই একজন কাউনটেসের (Countess) উক্তি উদ্ধৃত করা গেলঃ

“The first point necessary to consider in the arrangemnet and ordering of a lady’s househole, is that everything should be on a scale exactly proportionate to her husband’s income.”

(ভাবার্থ-বাড়ী ঘর সাজাইবার সময় গৃহিণী সর্ব্বপ্রথমে এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখিবেন যে তাঁহার গৃহস্থালীর যাবতীয় সামগ্রী যেন তাঁহার স্বামীর আয় অনুসারে প্রস্তুত হয়। তাঁহার গৃহসজ্জা দেখিয়া যেন তাঁহার স্বামীর আর্থিক অবস্থা ঠিক অনুমান করা যাইতে পারে)।

সুশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে আমরা টাকার সদ্ব্যবহার শিখিব কিরূপে? গৃহিণীরা যে স্বামীকে ভালবাসেন না, আমি ইহা বলিতেছি না। তাঁহারা স্বামীকে প্রাণের অধিক ভালবাসে, কিন্তু বুদ্ধি না থাকাবশতঃ প্রকৃত সহানুভূতি করিতে পারেন না। কবিবর সাদী বুদ্ধিহীন বন্ধু অপেক্ষা বুদ্ধিমান শক্রকে শ্রেষ্ঠ বলিয়াছেন। বাস্তবিক স্ত্রীদের অন্ধপ্রেমে অনেক সময় পুরুষদের ইষ্ট না হইয়া অনিষ্ট সাধিত হয়।

কেহ আবার পরিমিত ব্যয় করিতে যাইয়া একেবারে কৃপণ হইয়া পড়েন, ইহাও উচিত নহে।

গৃহিণীর রন্ধন শিক্ষা করা উচিত, এ কথা কে অস্বীকার করেন? একটা প্রবাদ আছে যে স্ত্রীদের রান্না তাঁহাদের স্বামীর রুচি অনুসারে হয়। গৃহিণী যে খাদ্য প্রস্তুত করেন; তাহার উপর পরিবারস্থ সকলের জীবনধারণ নির্ভর করে। মূর্খ রাঁধুনীরা প্রায়ই “কালাই”৩ রহিত তাম্রপাত্রে দধি মিশ্রিত করিয়া যে কোর্ম্মা প্রস্তুত করে, তাহ বিষ ভিন্ন আর কিছু নহে; মুসলমানেরা প্রায়ই অরুচি, ক্ষুদামান্দ্য ও অজীর্ণ রোগে ভুগিয়া থাকেন, তাহার কারণ খাদ্যের দোষ ছাড়া আর কি হইতে পারে? এ সম্বন্ধেও সেই কাউনটেসের (Chemistry) উক্তি শুনুন,-

“Bad food, ill-cooded food, monotonous food, insufficient food, injure the physique and ruin the temper. No lady should turn to the more tempting occupations of amusements of the day till she had gone into every detail of the family commissariat and assured herself that it is as good as her purse, her cook, and the season can make it.”

(ভাবার্থ-কোন মহিলাই প্রথমে স্বীয় পরিবারস্থ ব্যক্তিবর্গের আহারের সুবন্দোবস্ত এবং রন্ধনশালা পরিদর্শন না করিয়া যেন অন্য কোন বিষয়ে মনোযোগ না করেন। তাঁহার আর্থিক অবস্থানুসারে খাদ্যসামগ্রী যথাসাধ্য সুরুচিকর হইয়া থাকে কি না এ বিষয়ে তাঁহার দৃষ্টি রাখা কর্ত্তব্য। ষড় ঋতুর পরিবর্ত্তনের সহিত আহার্য্য বস্তুরও পরিবর্ত্তন করা আবশ্যক। ভোজ্য দ্রব্য যথাবিধি রন্ধন না হইলে কিম্বা সর্ব্বদা একই প্রকার খাদ্য এবং অখাদ্য ভোজন করিলে শরীর দুর্ব্বল এবং নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে)।

সুতরাং রন্ধনপ্রণালীর সঙ্গে সঙ্গেই গৃহিণীর ডাক্তারী ও Chemistry) রসায়ন বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান আবশ্যক। কোন খাদ্যের কি গুণ, বস্তু কত সময়ে পরিপাক হয়, কোন ব্যক্তির নিমিত্ত কিরূপ আহার্যø প্রয়োজন, এ সব বিষয়ে গৃহিণীর জ্ঞান চাই। যদি আহারই যথাবিধি না হয়, তবে শরীরের পুষ্টি হইবে কিসের দ্বারা? অযোগ্য ধাত্রীর হস্তে কেহ সন্তান পালনের ভার দেন না, তদ্রূপ অযোগ্য রাঁধুনীর হাতে খাদ্য দ্রব্যের ভার দেওয়া কি কর্ত্তব্য? রন্ধনশালার চতুর্দ্দিকে কাদা হইলে সেই স্থান হইতে সতত দূষিত বাস্প উঠিতে থাকে; বাড়ীর লোকেরা দুগ্ধ এবং অন্যান্য খাদ্যের সহিত ঐ বাস্প আত্মসাৎ করে। কেবল আহারের স্থান পরিস্কৃত হইলেই চলিবে না; যে স্থানে আহার করা হয় সে জায়গায় বায়ু (Atmosphere) পর্যন্ত যাহাতে পরিস্কৃত থাকে, গৃহিণী সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখিবেন।

অনেকে শাকসবজী খাইতে ভালবাসেন। বাজারের তরকারী অপেক্ষা গৃহজাত তরকারী অবশ্য ভাল হয়। গৃহিণী প্রায়ই শিম, লাউ, শশা, কুম্মণ্ড স্বহস্তে বপন করিয়া থাকেন। যদি তাঁহারা উদ্যান প্রস্তুত প্রণালী (Horticulture) অবগত থাকেন, তবে ঐ লাউ কুমড়ার কি সমধিক উন্নতি হইবে, গৃহিণীর এ জ্ঞানটুকু ত থাকা চাই।

অনেকেই ছাগল, কুক্কুট, হংস, পারাবত ইত্যাদি পালন করেন, কিন্তু সেই সকল জন্তু পালন করিবার রীতি অনেকেই জানেন না। উহাদের নিমিত্ত নির্দ্দিষ্ট স্বতন্ত্র স্থান না থাকায় উহারা বাড়ীর মধ্যেই ঘুরিয়া চরিয়া বেড়ায়। কাজেই বাড়ীখানাকে পশুশালা বা পশুপীদের “ময়লার ঘর” বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। যাহাতে এই জন্তুগুলি রুগ্ন না হইয়া হৃষ্টপুষ্ট থাকে এবং গৃহ নোঙ্গরা করিতে না পারে, তৎপ্রতি গৃহিণীর দৃষ্টি থাকা আবশ্যক। উহাদের বাসস্থানও পরিস্কৃত উবং হাওয়াদার (airy) হওয়া উচিত। নচেৎ রুগ্ন পশুপীর মাংস খাওয়ায় অনিষ্ট বই উপকার নাই। তবেই দেখা যায়, এক রন্ধন শিক্ষা করিতে যাইয়া আমাদিগকে উদি্‌ভদবিজ্ঞান, রসায়ন ও উত্তাপ তত্ত্ব (Horticulture, Chemistry ও Theory of heat) শিখিতে হয়!!

অন্নের পরই বস্ত্র-না, মানুষ বস্ত্রকে অন্ন অপেক্ষা অধিক প্রয়োজনীয় মনে করে। শীত গ্রীস্মনুযায়ী বস্ত্র, প্রস্তুত কিংবা সেলাই করা গৃহিণীর কর্ত্তব্য। পূর্ব্বে তাঁহারা চরখা কাটিয়া সূতা প্রস্তুত করিতেন। এখন কল কারখানার অনুগ্রহে কাপড় সুলভ হইয়াছে বটে, কিন্তু নিজ taste (পসন্দ) অনুসারে সেলাই করিতে হয়। এ জন্যও সুশিক্ষা লাভ করা আবশ্যক। আপনারা হয়ত মনে করিবেন যে, আমার সব কথাই দৃষ্টিছাড়া। এত কাল হইতে নিরর দরজীরা ভালই সেলাই করিয়া আসিতেছে, সেলাইএর সঙ্গে সুশিক্ষার সম্বন্ধ কি? সেলাইএর সহিত পড়ার সাক্ষাৎ সম্বন্ধ নাই বটে, কিন্তু আনুষঙ্গিক (indirect) সম্বন্ধ আছে। পড়িতে (বিশেষতঃ ইংরাজী) না জানিলে সেলাইয়ের কল (sewing machine এর) ব্যবস্থাপত্র পাঠ করা যায় না। ব্যবস্থা না বুঝিলে মেশিন (machine) দ্বারা ভাল সেলাই করা যায় না। কেবল হাতে সেলাই করিলে লেখা পড়া শিখিতে হয় না, সত্য। কিন্তু হাতের সেলাইএর সহিত মেশিনএর সেলাইয়ের তুলনা করিয়া দেখিবেন ত কোনটি শ্রেষ্ঠ? তাহা ছাড়া মেশিন দ্বারা অল্প সময়ে এবং অল্প পরিশ্রমে অধিক সেলাই হয়। অতএব মেশিন চালনা শিক্ষা করাই শ্রেয়ঃ। এতদ্ব্যতীত ক্যানভাস (Canvas) এর জুতা, পশমের মোজা, শাল প্রভৃতি কে না ব্যবহার করিতে চাহেন? এই প্রকারের সূচিকার্য ইংরাজী (knitting ও Crochet সম্বন্ধীয়) ব্যবস্থাপত্রের সাহায্য ব্যতীত সুচারুরূপে হয় না। ঐ ব্যবস্থাপুস্তকপাঠে শিয়িত্রীর কাট সাহায্যে সূচিকর্ম্মে সুনিপুণা হওয়া যায়; কাপড়ের ছাঁট কাট সবই উৎকৃষ্ট হয়। কাপড়ের কাট ছাঁটের জন্যও ত বুদ্ধির দরকার। কাপড়, পশম, জুতা ইত্যাদির পরিমাণ জানা থাকিলে, একজোড়া মোজার জন্য তিন জোড়ার পশম কিনিয়া অনর্থক অপব্যয় করিতেও হয় না।

পরিবারভুক্ত লোকদের সেবা যত্ন করা গৃহিণীর অবশ্য কর্ত্তব্য। প্রত্যেকের সুখ সুবিধার নিমিত্ত নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগ করা রমণীজীবনের ধর্ম্ম। এ কার্য্যের জন্যও সুশিক্ষা (training) চাই। সচরাচর গৃহিণীরা পরিজনকে সুখ দিবেন ত দূরের কথা, তাঁহাদের সহিত ছোট ছোট বিষয় লইয়া কোঁদল কলহে সময় কাটাইয়া থাকেন। শাশুড়ীর নিন্দা ননদিনীর নিকট, আবার ননদের কুৎসা মাতার নিকট করেন, এইভাবে দিন যায়।

কেহ পীড়িত হইলে তাহার যথোচিত সেবা করা গৃহিণীর কর্ত্তব্য, রোগীর সেবা অতি গুরুতর কার্য্য। যথারীতি শুশ্রূষা-প্রণালী (nursing) অবগত না হইলে এ বিষয়ে কৃতকার্য্য হওয়া যায় না। আমাদের দেশে অধিকাংশ রোগী ঔষধ পথ্যের অভাব না হইলেও শুশ্রূষার অভাবে মারা যায়। অনেক স্থানে নিরর সেবিকা রোগীকে মালিশের ঔষধ খাওয়াইয়া দেয়। কেহ বা অসাবধনতাবশঃ বিষাক্ত ঔষধ যেখানে সেখানে রাখে, তাহাতে অবোধ শিশুরা সেই ঔষধ খাইয়া ফেলে। এইরূপ ভ্রমের জন্য চিরজীবন অনুতাপে দগ্ধ হইতে হয়। কেহ বা রোগীর নিদ্রা ভঙ্গ করিয়া পথ্য দান করে, কেহ অধ্যধিক স্নেহবশতঃ তিন চারি বারের ঔষধ একবারে সেবন করায়। এরূপ ঘটনা এদেশে বিরল নহে। ডাক্তারী বিষয়ে সেবিকার উপযুক্ত জ্ঞান থাকা আবশ্যক, একথা কেহ অস্বীকার করেন কি? ডাক্তারী না জানিয়া শুশ্রূষা করিতে যাওয়া যা, আর স্বর্ণকারের কাজ শিখিয়া চর্ম্মকারের কাজ করিতে যাওয়াও তাই!

কিন্তু ডাক্তারী জান বা জান, রোগীর সেবা সকলকেই করিতে হয়। এমন দুহিতা কে আছেন, যিনি অশ্রুধারায় জননীর পদ প্রক্ষালন করিতে করিতে ভাবেন না যে “এত যত্ন পরিশ্রম সব ব্যর্থ হ’ল; আমার নিজের পরমায়ুঃ দিয়াও যদি মাকে বাঁচাইতে পারিতাম। এমন ভগিনী কে আছেন, যিনি পীড়িত ভ্রাতার পার্শ্বে বসিয়া অনাহারে দিন যাপন করেন না? এমন পত্নী কে, যিনি স্বামীর পীড়ার জন্য ভাবিয়া নিজে আধমরা হন না? এমন জননী কে আছেন, যিনি জীবনে কখনও পীড়িত শিশু কোলে লইয়া অনিদ্রায় রজনী যাপন করেন নাই? যিনি কখনও এরূপ রোগীর সেবা করেন নাই, তিনি প্রেম শিখেন নাই। না কাঁদিলে প্রেম শিক্ষা হয় না।

বিপদের সময় প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব রক্ষা করা অতি আবশ্যক। এই গুণটা আমাদের অনেকেরই নাই। আমরা কেবল হায়! হায়! করিয়া কাঁদিতে জানি! বোধ হয় আশা থাকে যে, অবলার চক্ষের জলে দেখিয়া শমনদের সদয় হইবেন! অনেক সময় দেখা যায় রোগী এ দিকে পিপাসায় ছটফট করিতেছেন, সেবিকা ওদিকে বিলাপ করিয়া (নানা ছন্দে বিনাইয়া বিনাইয়া) কাঁদিতেছেন! হায় সেবিকে, এ সময় রোগীর মুখে কি একটু দুধ দেওয়ার দরকার ছিল না? এ সময়টুকু যে দুধ না খাওয়াইয়া রোদনে অপব্যয়িত হইল, ইহার ফলে রোগীর অবস্থা বেশী মন্দ হইল।

এ স্থলে পতিপ্রাণা গৃহিণীর কথা মনে পড়িল। একদা রাত্রিতে তাঁহার স্বামীদেবের বুকে ব্যথা হইয়াছিল; সেজন্য তিনি দুর্ভাবনায় সমস্ত রাত্রি জাগিয়া ছিলেন। পরদিন প্রভাতে কবিরাজ আসিয়া বলেন, “এখন অবস্থা মন্দ, রাত্রেই বুকে একটুকু সর্ষের তৈল মালিশ করিলে এরূপ হইত না।” গৃহিণী অনিদ্রায় নিশি যাপন করিলেন, একটু তৈলমর্দ্দণ করিলেন না। কারণ এ জ্ঞানটুকু তাঁহার ছিল না। ঐ অজ্ঞানতার ফলে ত্রিবিধ অনিষ্ট সাধিত হইল, (১) স্বামীর স্বাস্থ্য বেশী খারাপ হইল; (২) নিজে অনর্থক রাত্রিজাগরণে অসুস্থ হইলেন; (৩) চিকিৎসকের জন্য টাকার অপব্যয় হইল। কারণ রাত্রে তৈল মাখিলেই ব্যথা সরিয়া যাইত, চিকিৎসক ডাকিবার প্রয়োজন হইত না।

এখন যদি আমি বলি যে, গৃহিণীদের জন্য একটা “জেনানা মেডিকেল কলেজ” চাই, তবে বোধ হয় অসঙ্গত হইবে না।

সন্তানপালন।-ইহা সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর ব্যাপার। সন্তানপালনের সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানের শিক্ষা হইয়া থাকে। একজন ডাক্তার বলিয়াছেন যে, “মাতা হইবার পূর্ব্বেই সন্তানপালন শিক্ষা করা উচিত। মাতৃকর্ত্তব্য অবগত না হইয়া যেন কেহ মাতা না হয়।” যে বেচারীকে ত্রয়োদশবর্ষ বয়ঃক্রমে মাতা, ছাব্বিশ বৎসর বয়সে মাতামহী এবং চল্লিশ বৎসরে প্রমাতামহী হইতে হয়, সে মাতৃজীবনের কর্ত্তব্য কখন শিখিবে?

শিশু মাতার রোগ, দোষ, গুণ, সংস্কার সকল বিষয়েরই উত্তরাধিকারী হয়। ইতিহাসে যত মহৎ লোকের নাম শুনা যায়, তাঁহারা প্রায় সকলেই সুমাতার পুত্র ছিলেন। অবশ্য অনেক স্থলে সুমাতার কুপুত্র অথবা কুমাতারও সুপুত্র হয়, বিশেষ কোন কারণে ওরূপ হয়। স্বভাবতঃ দেখা যায় আতার গাছে আতাই ফলে, জাম ফলে না। শিশু স্বভাবতঃ মাতাকে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ভালবাসে, তাঁহার কথা সহজে বিশ্বাস করে। মাতার প্রতিকার্য্য, প্রতিকণা শিশু অনুকরণ করিয়া থাকে। প্রতি ফোঁটা দুগ্ধের সহিত মাতার মনোগত ভাব শিশুর মনে প্রবেশ করে। কবি কি চমৎকার ভাষায় বলিতেছেনঃ

“-দুগ্ধ যবে পিয়াও জননী,
শুনাও সন্তানে শুনাও তখনি,
বীরগুণগাথা বিক্রমকাহিনী,
বীরগর্ব্বে তার নাচুক ধমনী।”

তাই বটে, বীরাঙ্গনাই বীর-জননী হয়! মাতা ইচ্ছা করিলে শিশু-হৃদয়ের বৃত্তিগুলি সযত্নে রা করিয়া তাহাকে তেজস্বী, সাহসী, বীর, ধীর সবই করিতে পারে। অনেক মাতা শিশুকে মিথ্যা বলিতে ও সত্য গোপন করিতে শিক্ষা দেয়, ভবিষ্যতে সেই পুত্রগণ ঠগ, জুয়াচোর হয়। অযোগ্য মাতা কারণে প্রহার করিয়া শিশুর হৃদয় নিস্তেজ (spirit low) করে, ভবিষ্যতে তাহারা স্বেতাঙ্গের অর্দ্ধচন্দ্র ও সবুট পদাঘাতা নীরবে-অকেশে সহ্য করে। কোন মজুরের পৃষ্ঠে জনৈক গৌরাঙ্গ নূতন পাদুকা ভাঙ্গিয়া ভগ্ন জুতার মূল্য আদায় না করায় সেই কূলি, “নৌতুন জুতা মারলো-দামডী লইল না” বলিয়া সাহেবের প্রশংসা করিয়াছিল! বলা বাহুল্য যে, অনেক “ভদ্রলোকের” অবস্থাও তদ্রূপ হইয়া থাকে।

অতএব সন্তানপালনের নিমিত্ত বিদ্যা বুদ্ধি চাই, যেহেতু মাতাই আমাদের প্রথম, প্রধান ও প্রকৃত শিয়িত্রী। হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ পুত্র লাভ করিতে হইলে প্রথমে মাতার স্বাস্থ্যের উন্নতি করিতে হইবে।

কেবল কাজ লইয়াই ১৬/১৭ ঘন্টা সময় কাটান কষ্টকর। মাঝে মাঝে বিশ্রামও চাই। সেই অবসর সময়টুকু পরনিন্দায়, বৃথা কোঁদলে কিংবা তাস খেলায় না কাটাইয়া নির্দ্দোষ আমোদে কাটাইলে ভাল হয় না কি? সে জন্য চিত্র ও সঙ্গীত শিক্ষা করা উচিত। যিনি এ বিষয়ে পারদর্শিতা হইতে চাহেন, তাঁহাকেও বর্ণমালার সহিত পরিচয় করিতে হইবে। চিত্রের বর্ণ, তুলির, বর্ণনা, সঙ্গীতের স্বরলিপি সবই পুস্তকে আবদ্ধ অথবা সুপাঠ্য পুস্তক অধ্যয়নে কিংবা কবিতা প্রভৃতি রচনায় অবসর সময় যাপন করা শ্রেয়ঃ।

প্রতিবেশীর প্রতি গৃহিণীর কর্ত্তব্য সম্বন্ধেও এক্ষেত্রে দুই চারি কথা বলা প্রয়োজন বোধ করি। অতিথি সৎকার ও প্রতিবেশীর প্রতি সদয় ব্যবহারের জন্য এক কালে আরব জাতি প্রসিদ্ধ ছিলেন। কথিত আছে আরবীয় কোন ভদ্রলোকের আবাসে ইঁদুরের বড় উৎপাত ছিল। তাঁহার জনৈক বন্ধু তাঁহাকে বিড়াল পুষিতে উপদেশ দেওয়ায় তিনি বলিলেন যে বিড়ালের ভয়ে ইঁদুরগুলি তাঁহার বাড়ী ছাড়িয়া তাঁহার প্রতিবেশীদিগকে উৎপীড়ন করিবে, এই আশঙ্কায় তিনি বিড়াল পোষেন না।

আর আমরা শুধু নিজের সুখ সুবিধার চিন্তায় ব্যস্ত থাকি, অপরের অসুবিধার বিষয় আমাদের মনে উদয়ই হয় না। বরং কাহারও বিপদের দ্বারা আমাদের কিছু লাভ হইতে পারে কি না, সেই কথাই পূর্ব্বে মনে উদয় হয়! কেহ দুঃসময়ে কোন জিনিষ বিক্রয় করিতে বাধ্য হইয়াছেন, ক্রেতা ভাব্বেন এই সুযোগে জিনিষটি বেশ সুলভ পাওয়া যাইবে! ঈদৃশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থে দৃষ্টি রাখা শিক্ষিত সমাজের শোভা পায় না। অথবা এক জনে হয়ত ক্ষণিক ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া তাঁহার ভাল চাকরাণীটাকে বিদায় দিয়াছেন, তৎক্ষণাৎ অপর একজন গৃহিণী সেই বিতাড়িতা চাকরাণীকে হাত করিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আদর্শ গৃহিণী সে স্থলে সেই পরিচারিকাকে পুনরায় তাহার প্রভুর বাড়ী নিযুক্ত করিতে প্রয়াস পাইবেন। প্রতিবেশীর বিপদকে নিজের বিপদ বলিয়া মনে করা উচিত।

আর প্রতিবেশীর পরিধি বৃহৎ হওয়া চাই-অর্থাৎ প্রতিবেশী বলিলে যেন কেবল আমাদের দ্বারস্থিত গৃহস্থ না বুঝায়। বঙ্গদেশের প্রতিবেশী বলিতে পাঞ্জাব, অযোধ্যা; উড়িষ্যা-এসবই যেন বুঝায়। হইতে পারে পাঞ্জাবের একদল ভদ্রলোক কোন কারখানায় কাজ করেন; সেই কারখানার কর্ত্তৃপক্ষকে তাঁহারা বিশেষ কোন অভাবে বিষয় জানাইতে বারম্বার চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য্য হওয়ায় ধর্ম্মঘট করিতে বাধ্য হইলেন। ঐ ধর্ম্মঘটকে যেন উড়িষ্যা বা মাদ্রাজের লোকে নিজেদের কার্য্য প্রাপ্তির সুযোগ ভাবিয়া আহ্রাদিত না হন। সুগৃহিণী আপন পতি পুত্রকে তাদৃশ ধর্ম্মঘট স্থলে কার্য্য গ্রহণে বাধা দিলেন। আর স্মরণ রাখিতে হইবে, আমরা শুধু হিন্দু বা মুসলমান কিম্বা পারসী বা খ্রীষ্টিয়ান অথবা বাঙ্গালী, মাদ্রাজী, মাড়ওয়ারী বা পাঞ্জাবী নহি-আমরা ভারতবাসী। আমরা সর্ব্বপ্রথমে ভারতবাসী তারপর মুসলমান, শিখ বা আর কিছু। সুগৃহিণী এই সত্য আপন পরিবার মধ্যে প্রচার করিবেন। তাহার ফলে তাঁহার পরিবার হইতে ক্ষুদ্র স্বার্থ, হিংসা দ্বেষ ইত্যাদি ক্রমে তিরোহিত হইবে এবং তাঁহার গৃহ দেবভবন সদৃশ ও পরিজন দেবতুল্য হইবে। এমন ভারতমহিলা কে, যিনি আপন ভবনকে আদর্শ দেবালয় করিতে না চাহিবেন?

দরিদ্রা প্রতিবেশিনীদিগকে নানা প্রকারে সাহায্য করাও আমাদের অন্যতম কর্ত্তব্য। তাহাদের সূচিশিল্প এবং চরকায় প্রস্তুত সূত্রের বস্ত্রাদি উচিত মূল্যে ক্রয় করিতে তাহাদের পরম উপকার করা হয়। এইরূপে এবং আরও অনেক প্রকার তাহাদের সাহায্য করা যাইতে পারে; বিস্তারিত বলা বাহুল্য মাত্র।

আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, বালক বালিকাদিগকে ভৃত্যের প্রতি সদয় ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক। সচরাচর দেখা যায়, বড় ঘরের বালকেরা ভারী দাম্ভিক হয়, তাহারা চাকরকে নিতান্ত নগণ্য কি যেন কি মনে করে। বেতনভোগী হইলেই ভৃত্যবর্গ যে মানুষ এবং তাহাদেরও স্বীয় পদানুসারে মান অপমান জ্ঞান আছে, সুকুমারমতি শিশুদিগকে একথা বুঝাইয়া দেওয়া উচিত। অনেক গৃহিণী নিজের পুত্রকন্যার দোষ বুঝেন না, তাঁহারা চাকরকেই অযথা শাসন করেন। ওরূপে শিশুকে প্রশ্রয় দেওয়া অন্যায়।

উর্দ্দু “বানাতননাশ” গ্রন্থে বর্ণিত নবাবনন্দিনী হোসনে-আরা অন্যায় আদরে এমন দুর্দ্দান্ত হইয়া উঠিয়াছিল যে তাহার দৌরাত্মে দাসী, পাচিকা প্রভৃতি সেবিকাবৃন্দ ত্রাহি ত্রহি করিত!” যাহাতে বালিকারা বিনয়ী এবং শিষ্ট শান্ত হয়, এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি রাখা কর্ত্তব্য।

পরিশেষে বলি প্রেমিক হও, ধার্ম্মিক হও বা নাস্তিক হও, যাই হইতে চাও, তাহাতেই মানসিক উন্নতির (mental culture এর) প্রয়োজন। প্রেমিক হইতে গেলে নির্ভর ন্যায়পরতা, মাশুকের!৪ নিমিত্ত আত্মবিসর্জ্জন ইত্যাদি শিণীয়। নতুবা নিব্বোর্ধ বন্ধু হইলে কাহারই উপকার করিতে পারিবে না। ধর্ম্মসাধনের নিমিত্ত শিক্ষা দীক্ষার প্রয়োজন, কারণ “কে বে-ইলমে না তওযাঁ খোদারা শেনাখত”। অর্থাৎ জ্ঞান না হইলে ঈশ্বরকে চেনা যায় না! অন্যত্র প্রবাদ আছে “মূর্খের উপাসনা ও বিদ্বানের শয়নাবস্থা সমান”। অতত্রব দেখা যায় যে, রমণীর জন্য আজ পর্য্যন্ত যে সব কর্ত্তব্য নির্দ্ধারিত আছে, তাহা সাধন করিতেও বুদ্ধির প্রয়োজন। অর্থ উপার্জ্জনের নিমিত্ত পুরুষদের যেমন মানসিক শিক্ষা (mental culture) আবশ্যক, গৃহস্থালীর জন্য গৃহিণীদেরও তদ্রূপ মানসিক শিক্ষা (mental culture) প্রয়োজনীয়।

ইতর শ্রেণীর লোকদের মত যেমন-তেমন ভাবে গৃহস্থালী করিলেও সংসার চলে বটে, কিন্তু সেরূপ গৃহিণীকে সুগৃহিণী বলা যায় না; এবং ঐ সব ডোম চামারের পুত্রগণ যে কালে “বিদ্যাসাগর” “বিদ্যাভূষণ” বা “তর্কালঙ্কার” হইবে এরূপ আশাও বোধ হয় কেহ করেন না।

আমি আমার বক্তব্য শেষ করিলাম। এখন সাধনাদ্বারা সিদ্ধিলাভ করা আপনাদের কর্ত্তব্য। যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন।

————————————-


কেহ আবার প্রতিবাদ করিতে যাইয়া সগর্ব্বে বলিয়াছেন “ভারতে হিন্দুর আরাধ্য দেবতা নারী, তাঁহারা নারীরই উপাসক।” বেশ! বলি হিন্দুর আরাধ্য দেবতা কোন জিনিষটা নহে? পূজনীয় বস্তু বলিতে চেতন, অচেতন, উদি্‌ভদ ইহার কোন পদার্থটিকে বাদ দেওয়া যায়? হনুমান এবং গোজাতিও কি উপাস্য দেবতা নহে? তাই বলিয়া কি ঐ সকল পশুকে তাঁহাদের “উপাসক মানুষ” অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলা হইয়া থাকে?


উর্দ্দু ভাষায় “সলিকা” manner, taste নিপুণতা যোগ্যতা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। সলিকা শব্দের ন্যায় মেয়েলী ভাষায় “কাজের ছিরি” কথা চলিত আছে বটে, কিন্তু তাহাতে সলিকার সমুদয় ভাব প্রকাশ হয় না। তাই সুবিধার নিমিত্ত এ শব্দটাকে বাঙ্গালায় প্রবেশ করাইতে চাই। “আরজী” “তহবিল” “মাহসুল” (মাশুল) ইত্যাদি শব্দ বহুকাল হইতে বাঙ্গালায় প্রচলিত আছে। “সলিকা”ও চলুক। “সাহেবে সলিকা” অর্থে যাহারা সলিকা আছে (person of taste) বুঝায়।


“কালাই” শব্দের বাঙ্গালা কি হইবে? ইংরাজীতে Tinningবলে।


হোসেন-আরার বাল-সুলভ ঔদ্ধত্যের বর্ণনা বেশ আমোদপ্রদ। পাঠিকাদিগকে একটু নমুনা উপহার দিইঃ হোসেন-আরা, পিতা মাতা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভগিনী-কাহাকেই ভয় করিত না। সমস্ত বাড়ি সে মাথায় তুলিয়া রাখিত! একদিন তাহার বড় মাসী শাহজামানী বেগম তাহাদিগকে দেখিতে আসিয়াছেন। পরিচারিকার দল হয় ত ভাবিল, ছোট বেগমের (হোসেন-আরার মাতার) নিকট অভিযোগ বিশেষ কোন ফল হয় না; বড় বেগম নবাগতা, ইহাকে দেখিয়া হোসেন-আরার চপলতা কিঞ্চিৎ দমিয়া যাইবে। শাহজামানী বেগম শিবিকা হইতে অবতরণ করিবা মাত্র ক্রমান্বয়ে দুই চারি অভিযোগ উপস্থিত হইল।

নরগেস কাঁদিয়া আসিয়া বলিল, “দেখুন, ছোট সাহেবজাদী (হোসেন-আরা) এমন পাথর ছুড়িয়া মারিয়াছেন ভাগ্যক্রমে আমার চক্ষু নষ্ট হয় নাই।”

সোসন আসিয়া বলিল, “দেখুন, ছোট সাহেবজাদী আমায় বলিলেন, ‘দেখি সোসন তোর জিহবা,’ যেই আমি জিহবা বাহির করিলাম অমনি তিনি আমার চিবুকে এমন জোরে মুষ্ট্যাঘাত করিলেন যে আমার সমস্ত দাঁত রসনায় বিদ্ধ হইয়াছিল!”

গোলাপ চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “হায়! আমার কাণ রক্তাক্ত করিয়া দিলেন!”

রন্ধনশালা হইতে পাচিকা উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “এই দেখুন ছোট সাহেবজাদী তরকারির হাঁড়িতে মুঠা ভরিয়া ছাই দিতেছেন!”

ঐ সব শুনিয়া বড় বেগম ডাকিলেন, “হোসনা! এখানে আইস!” হোসনা তৎক্ষণাৎ আসিল ত; কিন্তু আসিয়া, মাসীকে নমস্কার করিবে ত দূরের কথা,-হাতে ছাই পায় কাদা-এই অবস্থায় সে হঠাৎ মাসীর গলা জড়াইয়া ধরিল। তিনি সাদরে বলিলেন, “হোসনা! তুমি বড় দুষ্ট হইয়াছ।”

হোসনা তখন উপস্থিত দাসীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, “এই সম্বেল পেত্নী বুঝি কোন কথা আপনাকে লাগাইয়াছে?” এই বলিয়াই সে মাসীর ক্রোড় হইতে লাফাইয়া উঠিয়া নির্দ্দোষ সম্বেলের কেশাকর্ষণ করিয়া প্রহার আরম্ভ করিল! “আঁ! ও কি কর! কি কর!” বলিয়া বড় বেগম বারম্বার নিষেধ করিলেন, কিন্তু সে কিছুই শুনিল না।

পরে হোসেন-আর জেনানা মকতবে (পাঠশালায়) প্রেরিত হইয়া সুশিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছিল। এতদ্বারা লেখক মহোদয় দেখাইয়াছেন যে অমন অবাধ্য অনম্য বালিকাও শিক্ষার গুণে ভাল হয়।

আমাদের বিশ্বাস সুশিক্ষা স্পর্শমণি যাহাকে স্পর্শ করে সেই সুবর্ণ হয়।


“মাশুক”- যাহাকে ভালবাসা যায়; beloved object·

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *