নিরীহ বাঙ্গালী

আমরা দুর্ব্বল নিরীহ বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালী শব্দে কেমন সমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ হয়। আহা! এই অমিয়াসিক্ত বাঙ্গালী কোন বিধাতা গড়িয়াছিলেন? কুসুমের সৌকুমার্য্য, চন্দ্রের চন্দ্রিকা, মধুর মাধুরী, যূথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলে তরলতা-এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিদ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত হইয়াছে! আমাদের নামটি যেমন শ্রুতিমধুর তদ্রুপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সরল।

আমরা মূর্ত্তিমতী কবিতা-যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজী ধরণের একটি অট্রালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা (drawing room) এবং বাঙ্গালী তাহাতে সাজসজ্জা (drawing room suit)! যদি ভারতবর্ষকে একটি সরোবর মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহাতে পদ্মিনী! যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা!!১ অত্রএব আমরা মূর্ত্তিমান কাব্য।

আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি,-পুঁইশাকের ডাঁটা, সজিনা ও পুঁটি মৎস্যের ঝোল-অতিশয় সরস। আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি-ঘৃত, দুগ্ধ, দধি, ছানা, নবনীত, ক্ষীর, সর, সন্দেশ ও মধুর। অতত্রব আমাদের খাদ্যসামগ্রী ত্রিশুণাত্মক-সরস, সুস্বাদু, মধুর।

খাদ্যের গুণ অনুসারে শরীরের পুষ্টি হয়। তাই সজিনা যেমন বীজবহুল, আমাদের দেহে তেমনই ভুঁড়িটি স্থুল। নবনীতে কোমলতা অধিক, তাই আমাদের স্বভাবের ভীরুতা অধিক। শারীরিক সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে অধিক বলা নিস্প্রয়োজন; এখন পোষাক পরিচ্ছদের কথা বলি।

আমাদের বর অঙ্গ যেমন তৈলসিক্ত নবনিগঠিত সুকোমল, পরিধেয়ও তদ্রূপ অতি সূক্ষ্ম শিমলায় ধূতি ও চাদর। ইহাতে বায়ু সঞ্চলনের (Ventilation এর) কোন বাধা বিঘ্ন হয় না! আমরা সময় সময় সভ্যতার অনুরোধে কোট শার্ট ব্যবহার করি বটে, কারণ পুরুষমানুষের সবই সহ্য হয়। কিন্তু আমাদের অর্দ্ধাঙ্গী-হেমাঙ্গী, কৃষ্ণাঙ্গিগণ তদনুকরণে ইংরাজললনাদের নির্লজ্জ পরিচ্ছদ (শেমিক জ্যাকেট) ব্যবহার করেন না। তাঁহার অতিশয় সুকুমারী ললিতা লজ্জাবতী লতিকা, তাই অতি মসৃণ ও সূক্ষ্ম “হাওয়ার সাড়ী” পরেন! বাঙ্গালীর সকল বস্তুই সুন্দর, স্বচ্ছ ও সহজলব্ধ।

বাঙ্গালীর গুণের কথা লিখিতে হইলে অনন্ত মসী, কাগজ ও অকান্ত লেখকের আবশ্যক। তবে সংক্ষেপে দুই চারিটা গুণের বর্ণনা করি।

ধনবৃদ্ধির দুই উপায়, বাণিজ্য ও কৃষি। বাণিজ্য আমাদের প্রধান ব্যবসায়। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা (আরব্যোপন্যাসের) সিন্ধবাদের ন্যায় বাণিজ্যপোত অনিশ্চিত ফললাভের আশায় অনন্ত অপার সাগরে ভাসাইয়া দিয়া নৈরাশ্যের ঝঞ্জাবাতে ওতপ্রোত হই না। আমরা ইহাকে (বাণিজ্য) সহজ ও স্বল্পায়াসসাধ্য করিয়া লইয়াছি। অর্থাৎ বাণিজ্য ব্যবসায়ে যে কঠিন পরিশ্রম আবশ্যক, তাহা বর্জ্জন করিয়াছি। এই জন্য আমাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিষ নাই, শুধু বিলাসদ্রব্য-নানাবিধ কেশতৈল ও নানাপ্রকার রোগবর্দ্ধক ঔষধ এবং রাঙা পিত্তলের অলঙ্কার, নকল হীরার আংটী, বোতাম ইত্যাদি বিক্রয়ার্থ মজুদ আছে। ঈদৃশ ব্যবসায়ে কায়িক পরিশ্রম নাই। আমরা খাঁটী সোণা রূপা জওয়াহেরাৎ রাখি না, কারণ টাকার অভাব। বিশেষতঃ আজি কালি কোন জিনিষটার নকল না হয়?

যখনই কেহ একটু যতন্‌ পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক “দীর্ঘকেশী” তৈল প্রস্তুত করেন, অমনই আমরা তদনুকরণে “হ্রস্বকেশী” তৈল আবিস্কার করি। যদি কেহ “কৃষ্ণকেশী” তৈল বিক্রয় করেন, তবে আমরা “শুভ্রকেশী” বাহির করি। “কুন্তলীনের” সঙ্গে “কেশলীন” বিক্রয় হয়। বাজারে “মস্তিঙ্ক স্নিগ্ধকারী” ঔষধ আছে, “মস্তিঙ্ক উষ্ণকারী” দ্রব্যও আছে। এক কথায় বলি, যত প্রকারের নকল ও নিস্প্রোজনীয় জিনিষ হইতে পারে, সবই আছে। আমরা ধান্য তণ্ডুলের ব্যবসায় করি না, কারণ তাহাতে পরিশ্রম আবশ্যক।

আমাদের অন্যতম ব্যবসায়-পাশ বিক্রয়। এই পাশ বিক্রেতার নাম “বর” এবং ক্রেতাকে “শ্বশুর” বলে। এক একটি পাশের মূল্য কত জান? “অর্দ্ধেক রাজত্ব ও এক রাজকুমারী”। এম, এ, পাশ অমূল্যরত্ন, ইহা যে সে ক্রেতার ক্রেয় নহে। নিতান্ত সস্তা দরে বিক্রয় হইলে, মূল্য-এক রাজকুমারী এবং সমুদয় রাজত্ব। আমরা অলস, তরলমতি, শ্রমকাতর, কোমলাঙ্গ বাঙ্গালী কিনা তাই ভাবিয়া দেখিয়াছি, সশরীরে পরিশ্রম করিয়া মুদ্রালাভ করা অপেক্ষা Old fool শ্বশুরের যথাসর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করা সহজ!

এখন কৃষিকার্য্যের কথা বলি। কৃষি দ্বারা অন্নবৃদ্ধি হইতে পারে। কিন্তু আমরা ভাবিয়া দেখিয়াছি কৃষিবিভাগের কার্য্য (Agriculture) করা অপেক্ষা মস্তিঙ্ক উর্ব্বর (Brain culture) করা সহজ। অর্থাৎ কর্কশ উর্ব্বর ভূমি কর্ষণ করিয়া ধান্য উৎপাদন করা অপো মুখস্থ বিদ্যার জোরে অর্থ উৎপাদন করা সহজ। এবং কৃষিকার্য্যে পারদর্শিতা প্রদর্শন করা অপেক্ষা কেবল M.R.A.C পাশ করা সহজ! আইনচর্চ্চা কথা অপেক্ষা কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চ্চা করা কঠিন। অথবা রৌদ্রের সময় ছত্র হস্তে কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শন জন্য ইতস্ততঃ ভ্রমণ করা অপেক্ষা টানাপাখার তলে আরাম কেদারায় বসিয়া দুর্ভি সমাচার (Famine Report) পাঠ করা সহজ। তাই আমরা অন্নোৎপাদনের চেষ্টা না করিয়া অর্থ উৎপাদনে সচেষ্ট আছি। আমাদের অর্থের অভাব নাই, সুতরাং অন্নকষ্টও হইবে না! দরিদ্র হতভাগা সব অন্নাভাবে মরে মরুক, তা’তে আমাদের কি?

আমরা আরও অনেক প্রকার সহজ কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া থাকি। যথাঃ
(১) রাজ্য স্থাপন করা অপেক্ষা “রাজা” উপাধি লাভ সহজ।
(২) শিল্পকার্য্যে পারদর্শী হওয়া অপেক্ষা B. Sc. I D. Sc. পাশ করা সহজ।
(৩) অল্প বিস্তর অর্থব্যয়ে দেশে কোন মহৎ কার্য্য দ্বারা খ্যাতি লাভ করা অপেক্ষা “খাঁ বাহাদুর” বা “রায় বাহাদুর” উপাধিলাভ জন্য অর্থ ব্যয় করা সহজ।
(৪) প্রতিবেশী দরিদ্রদের শোক দুঃখে ব্যথিত হওয়া অপেক্ষা বিদেশীয় বড় লোকদের মৃত্যুদুঃখে “শোক সভার” সভ্য হওয়া সহজ।
(৫) দেশের দুর্ভি নিবারণের জন্য পরিশ্রম করা অপেক্ষা আমেরিকার নিকট ভিক্ষা গ্রহণ করা সহজ।
(৬) স্বাস্থ্যরক্ষায় যত্নবান হওয়া অপেক্ষা স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া ঔষধ ও ডাক্তারের হস্তে জীবন সমর্পণ করা সহজ।
(৭) স্বাস্থ্যের উন্নতি দ্বারা মুখশ্রীর প্রফুল্লতা ও সৌন্দর্য্য বর্দ্ধন করা (অর্থাৎ health ও cheerful হওয়া) অপেক্ষা (শুঙ্কগণ্ডে!) কালিডোর, মিল্ক অভ রোজ ও ভিনোলিয়া পাউডার (Kalydore, milk of rose ও Vinolia powder) মাখিয়া সুন্দর হইতে চেষ্টা করা সহজ।
(৮) কাহারও নিকট প্রহারলাভ করিয়া তৎণাৎ বাহু বলে প্রতিশোধ লওয়া অপেক্ষা মানহানির মোকদ্দমা করা সহজ ইত্যাদি।

তারপর আমরা মূর্ত্তিমান আলস্য-আমাদের গৃহিণীগণ এ বিষয়ে অগ্রণী। কেহ কেহ শ্রীমতীদিগকে স্বহস্তে রন্ধন করিতে অনুরোধ করিয়া থাকেন। কিন্তু বলি, আমরা যদি রৌদ্রতাপ সহ্য করিতে না পারি, তবে আমাদের অর্দ্ধাঙ্গীগণ কিরূপে অগ্নির উত্তাপ সহিবেন? তাঁহারা কোমলাঙ্গ-তাঁহারা কোমলাঙ্গী; আমরা পাঠক, তাঁহারা পাঠিকা; আমরা লেখক, তাঁহারা লেখিকা। অতএব আমরা পাচন না হইলে তাঁহারা পাচিকা হইবেন কেন? সুতরাং যে লক্ষ্মীছাড়া বিদ্যাঙ্গনাদিগকে রন্ধন করিতে বলে, তাহার ত্রিবিত্র দণ্ড হওয়া উচিত। যথা তাহাকে (১) তুষানলে দগ্ধ কর, অতঃপর (২) জবেহ্‌ কর, তারপর (৩) ফাঁসী দাও!!

আমরা সকলেই কবি-আমাদের কাব্যে বীররস অপেক্ষা করুণরস বেশী। আমাদের এখানে লেখক অপেক্ষা লেখিকার সংখ্যা বেশী। তাই কবিতার স্রোতে বিনা কারণে অশ্রুপ্রবাহ বেশী বহিয়া থাকে। আমরা পদ্য লিখিতে বসিলে কোন বিষয়টা বাদ দিই? “ভগ্ন শূর্ণ”, “জীর্ণ কাঁথা”, “পুরাতন চটীজুতা”-কিছুই পরিত্যজ্য নহে। আমরা আবার কত নূতন শব্দের সৃষ্টি করিয়াছি; যথা-“অতি শুভ্রনীলাম্বর”, “সাশ্রুসজলনয়ন” ইত্যাদি। শ্রীমতীদের করুণ বিলাপ-প্রলাপপূর্ণ পদ্যের পদ্যের “অশ্রুজলের” বন্যায় বঙ্গদেশ ধীরে ধীরে ডুবিয়া যাইতেছে! সুতরাং দেখিতেছেন, আমরা সকলেই কবি।

আর আত্মপ্রশংসা কত করিব? এখন উপসংহার করি।২

নবনূর, মাঘ ১৩১০

********************

“নায়িকা” বলিয়া আমি ব্যাকরণের নিয়মভঙ্গ করি নাই। কারণ অনেকে বাঙ্গালী পুরুষকে “বেচারী” বলে। উর্দ্দু ভাষায় পুরুষকে “বেচারা” ও স্ত্রীলোককে “বেচারী” বলে। যদি আমরা “বেচারী” হইতে পারি, তবে, “পদ্মিনী”, “নায়িকা” ও “পুরুষিকা” হইতে দোষ কি?


গত ১৩১০ সালে ‘নিরীহ বাঙ্গালী’ লিখিত হইয়াছে। সুখের বিষয় বর্ত্তমান সালে আর বাঙ্গালী ‘পুরুষিকা’ নহেন। এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে এমন শুভ পরিবর্ত্তন হইবে, ইহা কে জাতিন? জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ, এখন আমরা সাহসী বাঙ্গালী।

1 Comment
Collapse Comments
প্রেমময় দাশ January 20, 2022 at 11:35 am

পাঠ্যবইতে পড়া

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *