৪৯. চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে

চাঁদনীর হাসপাতালে শুয়ে-শুয়ে ভূতনাথ নিজের চিন্তাতেই তলিয়ে যায়।

নার্স এসে মাথার ব্যাণ্ডেজ বদলে দিয়ে যায় মাঝে-মাঝে। ক’দিন হলো জ্ঞান ফিরেছে। এ ক’দিন কেমন করে যে কেটেছে, কোথা দিয়ে দিন রাত্রির শোভাযাত্রা একে-একে চলে গিয়েছে, মিলিয়ে গিয়েছে দূরে-দূরান্তরে, খেয়াল নেই। এখন যেন আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনাটা ভাবা যায়। কলকাতার সঙ্গে তার পরিচয় ঘনিষ্ঠ বৈ-কি। একটা প্রাচীন বংশের উত্থান না হোক পতন তত দেখেছে স্বচক্ষে। মনে পড়ে যায় আর একটা দিনের কথা। তখন বুঝি মোগল রাজত্বের মাঝামাঝি। সকাল থেকে আকাশটা একেবারে মেঘে-মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। সপ্তগ্রামের পতন পুরোপুরি হয়ে গিয়েছে তখন। হুগলী তখন বেড়ে উঠছে হু-হু করে। ক’খানা জাহাজ পাল তুলে চলেছে সাঁকরেলের ঘাট থেকে। সঙ্গে কয়েকটা দেশী ছিপ, বোট আর ভাউলে নৌকো। সূতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতায় তখন সন্ধ্যে বেলা কার নামবার সাহস আছে! থাকবার মধ্যে মূতানুটিতে শুধু টিমটিম করা একটা হাট। শেঠ আর বসাকরা থাকতো সেখানে। হাটে তাদের সূতো আর কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সে-সব কিনতে বাইরে থেকে আসতো নানা লোক। ইংরেজ পর্তুগীজ আর দিনেমার। সেদিন সেই বর্ষার রাতে সাকরেল ঘাট থেকে খিদিরপুরের পাশ দিয়ে পাল তুলে জাহাজ ক’খানা এসে দাঁড়ালো সূতানুটির ঘাটে। পানসি দিয়ে ঘাটে এসে নেমে সবাই দেখে—সর্বনাশ! কোথায় তাদের কুঠি, কোথায় তাদের মাটির চালাঘর। সব সমূলে উপড়ে নিয়েছে ঝড়ে। কোনো চিহ্ন নেই কিছুর। জব চার্নক আবার ফিরলো জাহাজে। বললেন, রাতটুকু জাহাজেই কাটাতে হবে। সেদিন জব চার্নকের এতটুকু পা রাখবার জায়গা পর্যন্ত ছিল না সূতানুটির মাটিতে। কিন্তু পরদিনই একটা কোঠাবাড়ি ভাড়া হলো—শেঠ বসাকরা আদর আপ্যায়ন করে বসালো তাদের। টাকা ধার দিলে, কড়ি দিলে, জমি দিলে, বাড়ি দিলে আর তারপর শুরু হলো ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।

সে হলো ১৬৯০ সনের ২৪শে আগস্ট-এর গল্প।

সে-সব দিনের কথা কবে ভুলে গিয়েছে সবাই। আগে একএকটা বাড়ি খুলে পুরোনো কালের গাছের গুড়ি, সুদরি কাঠের সার বেরিয়ে পড়তো। কোথাও বেরোয় জল। কোথাও বেরিয়ে আসে নর-কঙ্কাল। কবে বুঝি ডাকাতি করে কারা মাটিতে পুতে রেখেছিল সেগুলো। সে-সব পুরোনো কথা ভুলে গিয়েছে সবাই। তারপর হলো শোভা সিং-এর বিদ্রোহ, ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নতুন প্রতিনিধি এল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দরবারে—উইলিয়ম মরিস। তারপর মুর্শিদকুলী খাঁ’র আমল, কোম্পানী বাহাদুরের প্রথম জমিদারী পত্তন, বৰ্গীর হাঙ্গামা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, পলাশীর যুদ্ধ, ওয়ারেন হেস্টিংস, তারপর লর্ড কর্নওয়ালিশ আর লর্ড বেন্টিঙ্ক পেরিয়ে এসে গিয়েছে লর্ড কার্জন, আর্ল মিন্টো আর লর্ড হার্ডিঞ্জ। ওদিকে কংগ্রেসের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়ে গিয়েছে। কুলী আইন পাশ হয়ে গিয়েছে। মুসলমানদের জন্যে আলাদা আসনের ব্যবস্থা হলো। দিল্লীর দরবার। বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। বোমা পড়লো দিল্লীর বড়লাট হাডিঞ্জের গায়ে। সে বুঝি ১৯১২ সালের ২৩শে ডিসেম্বর। আর ওদিকে ভূমিপতি চৌধুরী থেকে সূর্যমণি চৌধুরী, তারপর বৈদূর্যমণি, হিরণ্যমণি আর কৌস্তুভমণি আর তার শেষ বুঝি চূড়ামণি!

অনেক, অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে ভূতনাথ।

 

হাসপাতালের খাটিয়ায় শুয়ে সমস্ত ঘটনাটা ভাবতে গিয়ে ভূতনাথ কেমন যেন তলিয়ে যায়।

জবাদের বাড়ি থেকে সেদিন বড়বাড়িতে আসতেই বংশী, বললে–কী ভাবনায় ফেলেছিলেন বলুন তো-কোথায় ছিলেন সারারাত?

ভূতনাথ বলেছিল—বৌঠান কি খুঁজেছিল নাকি?

—তা খুঁজবে না? সারা রাত কেবল এপাশ ওপাশ করেছি, সারা সন্ধ্যে ঘর-বার করেছি—কী যে মানুষ আপনি—ছোটমাকে নাকি বলেছিলেন—বউ আনতে যাচ্ছি।

ভূতনাথ বললে—পান সুপুরি এনেছিস তো বংশী?

–সে তো কাল বিকেল থেকে শুকোচ্ছে আজ্ঞে।

ভূতনাথ বলেছিল—তা হলে একটা ঠিকে গাড়ি ডাকবার বন্দোবস্ত কর বংশী।

বংশী বললে—এখনি যাবেন নাকি?

—হ্যাঁ, সকাল-সকাল যাওয়াই তো ভালো।

—তা ঠিক বলেছেন শালাবাবু, বেণীর কথাটা শোনা এস্তোক ভালো লাগছে না যেন, মেজবাবু যা ক্ষেপে গিয়েছেন…তা হলে রান্না হোক, ভাতটা খেয়েই একেবারে যাবেন—এই ধরুন দুটো তিনটে নাগাদ।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু বৌঠানকে আগে থাকতে তৈরি হয়ে থাকতে বলগে তুই।

ভূতনাথও একবার ভেবেছিল—হঠাৎ যদি বৌঠান কালকের কথা ছোলে। যদি বলে—কোথায় রে, তোর বউ কই? ভূতনাথ তখন কী উত্তর দেবে?

বংশী বললে—ছোটমা আজ যেতে পারে কিনা দেখুন আগে, যা অবস্থা।

ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে—কেন?

—বার-বার আনতে হয় বলে আমি কাল আজ্ঞে একেবারে দু’ বোতল এনেছিলাম, কিন্তু কাল রাত্তিরে একেবারে সবটা খেয়ে বসে আছে, আজকে সকালেও খেয়েছে—দেখে এলুম একটু আগে, শুয়ে পড়ে আছে, কাপড়-চোপড়ের হুশ নেই—বেসামাল বেঠিক অবস্থা, সেই বরানগর পর্যন্ত অমন মানুষকে নিয়ে যাবেন কী করে শুনি?

ভূতনাথ যখন সেদিন বোঠানের ঘরে গিয়েছিল তখনও প্রায় তেমনই অবস্থা। তবে একটু যেন ভালো। নিজেই উঠে দাঁড়ালো বৌঠান। কালকের কথা আর কিছু মনে নেই।

বৌঠান বললে—কোন্ শাড়িটা পরবো আমি?

আজ যেন কোনো দিকে কোনো খেয়াল নেই বৌঠানের। চিন্তাই সাজিয়ে-গুজিয়ে দিলে। গলায় চেন-হার। চুলটা খোঁপা বেঁধে তাতে ‘পতি-পরম-গুরু’ লেখা সোনার চিরুণী গুজে দিলে। কানে তুলোয় করে আতর লাগিয়ে দিলে। কোমরে মিনেকরা সোনার গোট-ছড়া পরিয়ে দিলে।

ভূতনাথ একবার জিজ্ঞেস করেছিল—যেতে পারবে তো ঠিক বৌঠান? যদি বলো না হয় থাক আজকে।

বৌঠান বলেছিল–খুব যেতে পারবো।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়েও কিন্তু অল্প-অল্প টলছিল বৌঠান। বললে–মিয়াজানকে বলিস যেন খুব জোরে গাড়ি চালায়। যাবো আর আসবোছোটকর্তা বাড়িতে একা রইল—দেখিস বংশী। তারপর বললে–যদি জিজ্ঞেস করেন তো বলবি আমি বাড়িতেই আছি।

বংশী কানের কাছে মুখ এনে বললে—শালাবাবু, দোহাই আপনার বেশি রাত করবেন না—এখনই তো সন্ধ্যে হয়ে গেল— যদি বলেন তো আমি সঙ্গে যাই।

–না, তুমি গেলে ছোটকর্তাকে কে দেখবে আবার?

পান সুপুরির পুটলি গাড়ির এক কোণে রেখে দিয়েছিল, বংশী। খিড়কির গেট-এর ভেতরে ঠিকে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে বৌঠান গিয়ে উঠলো ভেতরে। বললে–মিয়াজানকে বলে দে বংশী যেন তাড়াতাড়ি চালায়—বাড়িতে ছোটকর্তা একলা রইল…।

কোথায় মিয়াজান! বংশী শুধু বললে-বলে দিচ্ছি, তুমি কিছু ভেবো না ছোটমা।

বৌঠান আবার বললে—চিন্তাকে বলিস যেন সন্ধ্যেবেলা ধূপধুনো গঙ্গাজল দেয় আমার ঘরে।

বৌঠান তারপর গাড়িতে উঠে বলেছিল—কোনো সাড়াশব্দ নেই বাড়িতে, রাত বুঝি অনেক হয়েছে না রে, ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি সবাই।

কিন্তু গাড়িটা চলতে আরম্ভ করার সঙ্গে-সঙ্গে একটা ঝকানি দিলে। সে ঝাঁকানিতে বৌঠান আর একটু হলেই বুঝি টলে পড়েছিল। ঠিক সময়ে ভূতনাথ ধরে ফেলেছে।

বৌঠান বললে—আজকাল মিয়াজান গাড়ি চালাতে ভুলে গিয়েছে নাকি?

ভূতনাথ কোনো কথা বললে না। বৌঠানকে দেখে যেন ভয় করতে লাগলো আজ তার। চোখ দুটো লাল। সমস্ত শরীর যেন শিথিল হয়ে গিয়েছে। দু’হাতে ধরে রেখেছে ভূতনাথ। ছেড়ে দিলেই যেন পড়ে যাবে। গাড়ি নানা রাস্তা ধরে চলেছে। কোথায় বউবাজার স্ত্রীট, কোথায় বৈঠকখানা, কোথা দিয়ে চলেছে বোঝা গেল না। গাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ। বাইরে রাত হয়ে এল। বেরোবে-বেরোবে করেও সেই রাত হলো কেবল বৌঠানের জন্যে। কিছুতেই আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শেষে স্নান করে, খানিকটা বরফ মাথায় দিয়ে তবে খাড়া হতে পেরেছে। কিন্তু আজ না গেলে কি আর কখনও যাওয়া হতো! ছোটকর্তার অসুখটা যে-রকম দিন-দিন বাড়ছে। সংসারে দিন-দিন অভাব-অনটনও বাড়ছে। ক’দিন আর টিকিয়ে রাখা যায়। ক’দিন আর পরমায়ু বাড়ানো যায় এর। বৌঠানও অনেকদিন বলে আসছিল। শেষ পর্যন্ত দৈবই তো ভরসা। হঠাৎ বৌঠান টলে পড়লো ভূতনাথের কোলে। বললে—তোর কোলেই শুলাম রে ভূতনাথ।

বৌঠানকে কোলে নিয়ে ভূতনাথ আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। বললে —তা শোও, বরানগর এলে উঠিয়ে দেবো।

বৌঠান আবার বললে—বড় ঘুম আসছে রে আমার।

ভূতনাথ বললে—তা ঘুমোও না।

—যদি আমার ঘুম না ভাঙে—আমার ডেকে দিস কিন্তু তুই!

আজও মনে পড়লে ভূতনাথ ভাবে সে-ঘুম সেদিন অমন করে চিরকালের ঘুম হবে কে জানতো! কে জানতো সে-ঘুম ভাঙাবার দায়িত্ব ভূতনাথের ছিল না। ছিল মেজবাবুর গুণ্ডাদের। তারপর যখন গাড়ি অনেকদূর চলে গিয়েছে। হঠাৎ যেন অনেক লোকের চিৎকার শোনা গেল। একটা হা-রে-রে-রে শব্দ! ডাকাত পড়লে যেমন শব্দ হয় তেমনি। গাড়িটা হঠাৎ থেমে গিয়েছে। আর সেই অন্ধকারে কারা যেন দু’পাশ থেকে দরজা খুলে ঢুকলো ভেতরে। ভূতনাথ একবার প্রতিবাদ করতেও বুঝি গিয়েছিল, কিন্তু কোনদিক থেকে যেন একটা অদৃশ্য হাত এসে তাকে এক প্রচণ্ড আঘাতে শুইয়ে দিলো…আর কিছু মনে, নেই তারপর।

 

তারপর কতদিন পরে এই চাঁদনীর হাসপাতালে জ্ঞান হয়েছে। আস্তে-আস্তে মনে পড়েছে সব কথা। কোথায় গেল বৌঠান। বৌঠান কেমন আছে! কিন্তু বংশী খবর পেয়ে এসেছিল একদিন।

বংশী বললে—শালাবাবু!

বংশীকে দেখে ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে। বললে—বংশী, তুই?

—আজ্ঞে, খবর কী পাই? চৌপর রাত বসে-বসে দেখা নেই আপনার, গাড়িও ফেরে না, কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। এমন তো হয় না! ছোটবাবু তেমনি নিঝুম হয়ে পড়ে আছে! দেখে আবার ফিরে এলাম উঠোনে, রাস্তায় বেরিয়ে চোখ বাড়িয়ে দুর পানে চেয়ে দেখি, কোথাও হদিস নেই গাড়ির। রাস্তা নিরিবিলি হয়ে এল, ওপরে চিন্তা আর নিচেয় আমি, দুজনে সমস্ত রাত ডাহা বসে। রাত যখন পোয়ালোতখন বুঝি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিলো কোথায় যেন কাছাকাছি কে শাবল দিয়ে মাটি খুড়ছে, ইট ভাঙছে, ঠুং-ঠাং ধুপ-ধাপ শব্দ, মনে হচ্ছিলো কারা বুঝি…

বংশী থামলো। তারপর হঠাৎ দু’হাত দিয়ে চোখ চাপা দিলে। তারপর আর কথা নেই একেবারে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো।

কেমন যেন সন্দেহ হলে ভূতনাথের। বললে-বংশী বংশী—

তবু মুখ তোলে না বংশী।

ভূতনাথ বললে—বৌঠান কেমন আছে বল বংশী—বল্‌।

কাঁদতে-কাঁদতে বংশী বললে-ছোটমা আর নেই হুজুর!

—বৌঠান নেই?

—না শালাবাবু, কোথাও নেই ছোটম, বেলা দেড়টা নাগাদ খালি গাড়ি আর ঘোড়া দুটোকে টানতে-টানতে পুলিশ এনে তুললে বড়বাড়ির উঠোনে। গাড়োয়ানকে নাকি কোন্ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা। গাড়ি দেখে ছুটে গেলুম। ভাবলাম–ছোটমা শালাবাবু দুজনেই বুঝি ভেতরে আছে। গিয়ে দেখি রক্ত লেগে আছে সারা গাড়িতে—দেখে মাথায় বাজ পড়লো যেন! বললাম—আমার ছোটমা কোথায়? শালাবাবু কোথায়?

-তারপর?

—তা চাকর-মানুষকে কি বলে কিছু তারা? বলে—তোমার বাবু কোথায়?

বললাম—আমার ছোটবাবু কি আর মানুষ আছে আজ্ঞে, মানুষ নেই হুজুর, ছোটবাবুকে দেখিয়ে দিলাম ঘরে নিয়ে গিয়ে। তা দেখে বুঝলল তারা সব। মেজবাবুকে খবর দিলাম, ছুটুকবাবুকে খবর দিলাম। মেজবাবু পুলিশের সঙ্গে কী গুজ-গুজ ফুসফুস করলে আমি কি বুঝি ছাই। পুলিশের দারোগাকে কী বুঝিয়ে দিলে মেজবাবু, দারোগাবাবু সব তো খাতায় লিখে নিলে, তারপর চলে গেল পুলিশের দল নিয়ে।

আমি মেজবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—আমার ছোটমা’র কী হলো গো মেজবাবু?

মেজবাবু ধমক দিয়ে উঠলল—যা, পালা এখান থেকে!

তখন কাকেই বা জিজ্ঞেস করি। কে-ই বা বলবে! আমি আর চিন্তা দুই ভাই বোনে শুধু মাথা খুড়ি ছোটমা’র যশোদাদুলালের কাছে। ঠাকুর না তো পাথর যেন! এমনি করে দিন যায়। শেষে বেণী এসেছিল বাড়িতে মেজবাবুর চিঠি নিয়ে। তার কাছেই শুনলাম আপনি আছেন এই হাসপাতালে।

—আর ছোটবৌঠান?

—ছোটমা কোথায় গেল তা জানতেই তো আপনার কাছে আসা। ভাবলাম, শালাবাবু নিশ্চয়ই জানে ছোটমা’র খবর—কিন্তু আমাকে বলে দিন শালাবাবু, কোথায় গেলে পাবো ছোটমাকে, আমার যে নিজের মা ছিল না শালাবাবু, নিজের মাকে চোখে দেখিনি কখনও, একমাস বয়েসেই মাকে হারিয়েছি, এখন কী হবে শালাবাবু?

 

তারপর কতদিন কেটে গিয়েছে! নক্ষত্ৰাকীর্ণ রাত্রের আকাশের দিকে চেয়ে-চেয়েও অনেকদিন অনেক প্রশ্ন করেছে ভূতনাথ। দিনের বেলার নীল আকাশের দিকে চেয়ে-চেয়েও প্রশ্ন করেছে। প্রশ্ন করেছে রাত্রের নিবিড় কালো অন্ধকারকে। প্রশ্ন করেছে অদৃশ্য অন্তরাত্মাকে। হাসপাতালের চারটি দেয়ালের বেষ্টনীর মধ্যে শুয়ে-শুয়ে প্রার্থনা করেছে যেখানে যত দেবতা আছে সকলকে। প্রার্থনা করেছে যেখানেই থাক বৌঠান, যেন সুস্থ থাকে, যেন সুখী। হয়, যেন কল্যাণ হয়, যেন মঙ্গল হয় তার।

তারপর থেকে বংশী মাঝে-মাঝে এক-একদিন আসতো। এসে খাটিয়ার পায়ার কাছে চুপ-চাপ বসে-বসে শুধু কাঁদতে। কিছু বলতো না মুখে। যেন কোনো অভিযোগ ছিল না কারো ওপর। আবার এক সময় ঘণ্টা বাজবার সঙ্গে-সঙ্গেই নিঃশব্দে বেরিয়ে চলে যেতো।

হাসপাতাল থেকে ভূতনাথ ছাড় পাবার দিন কতক আগে বংশী আবার হঠাৎ একদিন এসে হাজির। বংশীর চেহারা দেখে ভূতনাথও অবাক হয়ে গিয়েছিল। জামা পরেছে, ধুতিটা কোঁচা করে পরেছে। হাতে একটা টিনের রঙ-চটা বাক্স। হাউহাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে এসে ঢুকলো ঘরে। তারপর পায়ের কাছে মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলেছিল— চললাম শালাবাবু!

-কোথায় চললে বংশী?

তেমনি কাঁদতে-কাঁদতেই বংশী বললে-দেশে আজ্ঞে।

-দেশে? ভূতনাথ শুনে কম অবাক হয়নি। বললে—তা হলে ছোটকর্তাকে কে দেখবে?

বংশীর গলা যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। বললে—ছোটবাবু নেই আজ্ঞে।

–নেই?

বংশীর কাছেই শোনা সে-ঘটনা।

সকাল থেকেই বৃষ্টি সেদিন। শ্যাওলা ধরা পাঁচিলটার ওপর একটা কাক বসে-বসে এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। বংশী হঠাৎ ক্ষেপে উঠেছে এক মুহূর্তে। বলে—থাম, থাম্ হতচ্ছাড়া, আর জায়গা পেলে না, এখেনে এসেছে ডাকতে!

তখনও জানে না বংশী, জানেনা কোন্ অশুভ সংবাদ বয়ে এনেছে ও। তবু দিনের কাজ মুখ বুজে করে যাচ্ছে। চিন্তা দেখছে ছোটমার ঘরের কাজ। ঘরের কাজ আর কী! যশোদাদুলালের নিয়মিত ভোগ দেওয়া। শাড়িগুলো কুঁচিয়ে রাখা। দেরাজের, আলমারির, পালঙ-এর ধুলো ঝাড়া। ছোটমা ধুলো দেখতে পারে না। ছোটমা যদি আসে কখনও তো বলবোরে, আমি নেই বলে আমার ঘর এত নোংরা করে রাখবি তোরা—আমি কি মরেছি?

সেজখুড়ী যেমন রান্নায় ব্যস্ত থাকে তেমনি সেদিনও। একটা লোক তত খেতে। তা-ও কিছুই মুখে রোচে না তার। একটু মুখে দিয়েই বলে থুঃ থুঃ

দুটো হাতই অবশ হয়ে গিয়েছে। বংশী ভাতের থালাটা কাছে নিয়ে গিয়ে ডাকে—ছোটবাবুও ছোটবাবু—

জেগে থাকে তো ভালো। কিন্তু না-জেগে থাকলেই মুশকিল। তন্দ্রা ভাঙতেই এক ঘণ্টা। গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে হয়। তারপর একটু শুধু নিয়ম রক্ষা। কিন্তু ওইটুকুর জন্যেই বংশীর আর হেনস্থার শেষ নেই।

ছোটবাবু রেগে যায়। বলে—খাবো না আমি। ক্ষিদে নেই, যা—

বংশী বলে—খেয়ে নিন বাবু, না-খেলে শরীল টিকবে কী করে?

সত্যি যেন ছোটবাবুর শরীর টিকে আছে। কিন্তু হাসে না ছোটবাবু। দুটি মুখে দিয়ে আবার বংশী তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়।

বলে—খেয়ে উঠে ঘুমোবেন না হুজুর, শরীলে বাত হবে।

তা সেদিনও ভাতের থালা নিয়ে বংশী ঘরে গিয়েছে যেমন রোজ যায়।

গিয়ে ডাকলে—ছোটবাবু ভাত এনেছি, উঠুন—

উত্তর নেই কোনো।

আবার ডাকলে—ভাত যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল, উঠুন হুজুর–

হুজুরের তবু সাড়া নেই। বংশী তখন গায়ে হাত দিয়ে জাগিয়ে দিতে গিয়েছে। কিন্তু গায়ে হাত লাগতেই যেন দশ পা পেছিয়ে এসেছে। সমস্ত গা-টা যেন বরফ হিম। তারপর হঠাৎ নজর পড়লো একটা পিঁপড়ে যেন ছোটবাবুর ঠোটের ওপর চরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হাত থেকে ভাতের থালা ঝনঝন করে পড়ে গেল বংশীর। সে-শব্দতে ভয় পেয়ে আরো চমকে উঠেছে বংশী। সমস্ত বাড়িটা যেন ভূমিকম্পের মতো তখন কাঁপছে। বংশীর আর জ্ঞান নেই তখন।

কাঁদতে-কাঁদতে বংশী যা বললে তা বড় করুণ। বংশী বললেটেরও পেলাম না শেষটায় আমি শালাবাবু—আমারই কপাল …আর বলতে পারলো না বংশী। শব্দ করে কেঁদে উঠলো শুধু।

অনেকক্ষণ ভূতনাথও কিছু কথা বলতে পারলে না যেন। বংশী বললে-কাল পটলডাঙার বাবুরা এসেছিল–মেজবাবু এসেছিল, ছুটুকবাবুও এসেছিল—সকলকে জিনিষপতোর বুঝিয়ে দিয়ে চাবি দিয়ে দিলাম ওদের হাতে। সেজখুড়ি কাজ পেয়েছে দত্তবাড়িতে, সেখানেই চলে গেল—আর আমি চললাম দেশে…

তারপর আর একবার প্রণাম সেরে উঠে বললে—যাই শালাবাবু, ট্রেনের টাইম হয়ে যাচ্ছে আবার চিন্তাকে দাড় করিয়ে রেখে এসেছি বাইরে—যাই…

বংশী চলেই যাচ্ছিলো।

ভূতনাথ আর একবার ডাকলে-বংশী–

–আজ্ঞে।

ফিরে এল আবার বংশী। বললে—আমায় ডাকছিলেন?

ভূতনাথ বললে—আর তোমার ছোটমার কোনো খবর পেয়েছে তার পরে?

–কোথায় আর পেলাম শালাবাবু, এতদিন হয়ে গেল, কেউ কিছু জানে না, ছোটবাবুকেও জিজ্ঞেস করে কিছু জানতে পারিনি, ছোটবাবুও আশ্চর্য লোক শালাবাবু। একটু কাঁদলে না পর্যন্ত, একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না কাউকে যে, মানুষটা গেল কোথায়…

তারপর খানিক থেমে আবার বললে–কলকাতায় এসেছিলাম সুখ করতে, কিন্তু সুখ আমার কপালে নেই শালাবাবু, মা-বাপ দুই-ই হারালাম, আমি একটা লক্ষ্মীছাড়া বই আর কী বলুন…

 

বংশী চলে গেল।

ভূতনাথ হাসপাতালের বাইরে চোখ মেলে দেখলে—অনেক নিচে রাস্তার ওপর অনেক ভিড়। এলোমেলো মহাকালের মিছিল চলেছে। কে যেন অদৃশ্য হাতে চালনা করছে মহাকালের রথ। কত কলকারখানা, যুদ্ধবিগ্রহ, কত বিচিত্র কোলাহল আকাশকে মথিত করছে। তাদের ভিড়ে কোথায় বংশী আর চিন্তা হারিয়ে গেল দেখা গেল না। মনে হলো ওদেরই মধ্যে কোথায় যেন এক নিমেষে সবাই হারিয়ে গিয়েছে। অথচ এই তো সেদিনের কথা। একটা ছেলে এসে নেমেছিল নিতান্ত অসহায়ের মতো শেয়ালদ’ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-এ। তারপর মিলনে, বিচ্ছেদে, জীবনে, মৃত্যুতে কতবার আকাশ কালো হয়ে উঠলো। কতবার দুঃস্বাদ হলো জীবন, উচ্ছল হলো প্রাণ, উজ্জ্বল হলো দিন, আবার রাত্রির মতো কখনও ম্লান হয়ে এল প্রাণের দিগন্ত, ক্ষীণ হয়ে এল কণ্ঠের গান। মনে হলো তবু যেন সে মানুষের চরম সত্যকে আবিল হতে দেয়নি। ভূতনাথের সমস্ত ক্ষুধা-তৃষ্ণা, বাসনা-কামনা, অর্জন-বর্জনের মধ্যে সে যেন ভাস্বর হয়ে রয়েছে। কত ভাষায় সে কথা কইছে, কত দেশে, কত রূপে, কত কালে সে মানুষের আপাত প্রয়োজনের ওপর জাগ্রত হয়ে আছে। কত তর্ক তাকে আঘাত করছে, কত সংশয় তাকে অস্বীকার করছে, তবু সে আছে। সমস্ত মানুষের মধ্যেই সে বেঁচে আছে। সে বলছে—নিজেকে চেনো, নিজের নিজেকে খোঁজে—আত্মানং বিদ্ধিঃ–

ভূতনাথ অনেকক্ষণ ধরে তেমনি চেয়ে রইল নিচের দিকে সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো। আজ আর নিবারণের কথা মনে পড়লো না তার। ব্রজরাখাল, ননীলাল, ছুটুকবাবু কাউকেই বিশেষ করে আজ তার মনে পড়লো না। মনে পড়লো না মেজবাবু, ছোটবাবু, বেণী, শশী, গিরি, সিন্ধু—কাউকেই। আরো অনেক অসংখ্য লোককেও মনে পড়লো না। শুধু মনে পড়লো। দুজনের কথা। যেদিন তাদের সে মানুষের মহাযাত্রার মিছিলে মিশিয়ে দিতে পারবে সেদিন তার সত্যিকারের সিদ্ধি হবে। সেদিন তার ভূতনাথ নাম সার্থক হবে। ভোলানাথ নাম সার্থক হবে।

দেখতে-দেখতে আলো নিবে এল কলকাতার আকাশে।

এক ঝাঁক পায়রা উড়তে-উড়তে একটা বাড়ির ছাদের ওপর দল বেঁধে নামলো। কাদের ছাদে একটা ফণি-মনসার গাছ আকাশে ডালপালা মেলে আছে। একটা ঘুড়ি এসে উড়তে-উড়তে পড়ছে রাস্তার ওপর। তারপর শহরের ওপাশে যেদিকে চাও সেদিকে কেবল সবুজ গাছের সার। সবুজ পাতার বেষ্টনী। শহর বোধহয় শেষ হয়ে গিয়েছে ওখানে। নীল আকাশের গায়ে রেল ইঞ্জিনের এক মুঠো ধোঁয়া আটকে আছে আলগা হয়ে। আর ওপাশে কয়েকটা তালগাছ সজাগ প্রহরীর মতো মাথা উচু করে বুঝি পাহারা দিচ্ছে। কয়েকটা নিশাচর পাখী শহর থেকে অরণ্যের দিকে বুঝি চলেছে দল বেঁধে। আবার দিনের বেলা তারা বুঝি ফিরে আসবে। তারপর একটা তারা উঠলো আকাশে। তারপর আর একটা। তারপর আরো একটা। কোলাহল থেমে আসছে পৃথিবীর। প্রশান্ত আকাশ। এক টুকরো শব্দ। একঝাঁক ঘুম। তারপর আর কিছুই নেই…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *