৫.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শেষ

মোবারকের মৃত্যুর পরদিন প্রাতেই দেবেন্দ্রবিজয় সহর্ষমুখে বৃদ্ধ অরিন্দম বাবুর বাসায় উপস্থিত হইলেন| বগলে অরিন্দম-প্রদত্ত সেই বাক্স|
অরিন্দম বাবু তঁহাকে আনন্দোৎফুল্ল দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হে, কার্য্যোদ্ধার হইল?”
দে| হইয়াছে|
অ| খুনী ধরা পড়িয়াছে?
দে| ধরা পড়িয়াও সে পলাইয়া গিয়াছে-সে আর ধরা পড়িবে না|
অ| কেন-মরিয়াছে না কি?
দে| হাঁ|
অ| খুনী কে?
দে| মোবারক!
অ| (সবিস্ময়ে) মোবারক! কিরূপে জানিতে পারিলে মোবারক খুনী?
দেবেন্দ্রবিজয় তখন আনুপূর্ব্বিক সমুদয় ঘটনা অরিন্দম বাবুকে বলিলেন| শুনিয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাই ত! কপ্লিত গল্পের অপেক্ষা এক-একটা সত্য ঘটনা অধিকতর বিস্ময়কর হইয়া দাঁড়ায়|
যাহ হউক, মোবারক শেষে হত্যাকরীতে পরিণত হইল, দেখিতেছি|”
দে| হাঁ, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যপার! মোবারককে আমি একবারও সন্দেহ করি নাই|
অ| আশ্চর্য্য ব্যাপার আর কি, মোবারককে সন্দেহ না করাই তোমার অন্যায় হইয়াছে|
দে| কিন্তু তাহাকে সন্দেহ করিবার কোন সূত্র এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই|
অরিন্দম একটু উষ্ণভাবে বলিলেন, “অন্ধ তুমি! অনেক সূত্র ছিল| তুমি দেখিয়াও দেখ নাই-সেজন্য চেষ্টাও কর নই| ঘটনাস্রোতে, তোমাকে যখন যেদিকে টানিয়া লইয়া গিয়াছে, তুমি তখনই সেইদিকে ভাসিয়া গিয়াছ| ইহা তোমার একটা মহৎ দোষ| এখন হইতে সর্ব্বাগ্রে ইহার সংশোধনের চেষ্টা করিবে| এই দেখ, আমি তোমাকে এমন একটা সূত্র বলিয়া দিই, যাহাতে তুমি অবশ্য প্রথম হইতেই মোবারকের উপর সন্দেহ করিতে পারিতে| তোমার মুখেই শুনিয়াছি, ডাক্তার লাস পরীক্ষা করিয়া রাত বারটার সময়ে মৃত্যুকাল নির্দ্ধারণ করেন| তাহা হইলে রাত বারটা হইতে মৃতদেহটা সেই গলির ভিতরেই পড়িয়াছিল| রাত দুইটার পর মোবারক গিয়া প্রথমে সেই মৃতদেহ দেখিতে পায়| রাত বারটা হইতে দুইটার মধ্যে আর কেহ সে পথে যায় নাই, ইহা কি সম্ভব? অবশ্যই এই সময়ের আরও দুই-চারিজন সেই গলিপথে যাতায়াত করিয়া থাকিবে| সেই মৃতদেহ আর কাহারও চোখে না পড়িয়া তেমন কুয়াশার অন্ধকারে একেবারে মোবারকের চোখে যে পড়িল-ইহার অর্থ কি? এইখানেই কেমন একটু গোলযোগ ঠেকিতেছে না? তাহার পর আরও দেখ, মোবারক মজিদ খাঁকে ঐ গলির ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল| তখন মোবারক মজিদ খাঁর যে ভাব দেখিয়াছিল, সে ভাবে মজিদ খাঁকে খুনী বুঝায় কি? কিছুতেই নয়| যদি মজিদ খাঁ নিজে খুনী হইত, সে মোবারকের সহিত অন্যরূপ ব্যবহার করিত| হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে মোবারক তখন কিছু না জানিতে পারে, সেইজন্য মজিদ খাঁ কি মোবারককে সেই গলিপথে না যাইতে দিয়া প্রকারান্তরে তাহাকে অন্যদিকে কি নিজের বাসাতে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিত না? এরূপ স্থলে অতি নির্ব্বোধেরও মাথায় এ বুদ্ধি যোগায়; কিন্তু মজিদ খাঁ প্রকৃত খুনী নহে, সেজন্য সে এরূপ কোন চেষ্টাও করে নাই| আর মজিদ খাঁ সেই গলির মধ্যে যদি এরূপভাবে অরক্ষিত অবস্থায় স্ত্রীলোকের একটা লাস পড়িয়া থাকিতে দেখিত, তাহা হইলে সে অবশ্যই সে কথা মোবারকের নিকটে প্রকাশ করিত|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কিন্তু মজিদ খাঁ যদি ভয়ে সে কথা প্রকাশ না করিয়া থাকে?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ইহাতে ভয়ের বিশেষ কারণ কি? যদি ভয়ের কোন কারণ থাকিত, তাহা হইলেও মজিদ খাঁ মোবারক যাহাতে তখন সে গলির ভিতরে না যায়, সেজন্য কোন উপায় অবলম্বন করিত; কিন্তু মজিদ সেজন্য চেষ্টামাত্রও করে নাই| ইহাতে বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে, মজিদ খাঁ গলির ভিতরে সেই মৃতদেহ দেখে নাই, অথচ ঠিক পথের উপরে মৃতদেহ এরূপভাবে পড়িয়াছিল যে, সেখান দিয়া কাহাকেও যাইতে হইলে, হয় মৃতদেহ বেড়িয়া, না হয় পদদলিত করিয়া যাইতে হইত| এরূপ স্থলে মৃতদেহ মজিদের লক্ষ্য না হওয়াই আশ্চর্য্য; কিন্তু পরক্ষণেই মোবারক সেই গলির ভিতর প্রবেশ করিয়া মৃতদেহ আবিষ্কার করিয়া ফেলিল, পাহারাওয়ালাকে ডাকিল-লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল-ব্যস্| আমার বোধ হয়, মোবারক পূর্ব্বে খুন করিয়া ঐ লাস কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিল| তাহার পর একটা বুদ্ধি খাটাইয়া সেই লাস্টা পাহারাওয়ালাদের স্কন্ধে চাপাইয়া দিয়াছিল|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, তাহাই ঠিক, মৃত্যুকালে মোবারক সে কথা নিজেই স্বীকার করিয়াছে; কিন্তু মোবারক যে খুনী, ইহা একবারও আমার মনে হয় নাই, কি আশ্চর্য্য! যাহা হউক, এখন কার্য্যোদ্ধার হইয়াছে, আপনার সেই বাক্স আমি লইয়া আসিয়াছি, একবার চাবিটা চাই, দেখিতে হইবে-”
দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ হইতে কথাটা লুফিয়া লইয়া অরিন্দম বাবু বলিলেন, “-কে হত্যাকারী| এই না? এখন আর তাহা দেখিয়া লাভ?”
দেবেন্দ্রবিজয় কোন উত্তর করিল না| অরিন্দম বাবু বালিশের নীচে হইতে বাক্সের চাবিটা বাহির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বাক্স খুলিয়া ফেলিলেন| দেখিলেন, তন্মধ্যে একখানি কাগজে লিখিত রহিয়াছে- “মোবারক|”
দেবেন্দ্রবিজয় থ হইয়া গেলেন|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *