৫.১০ দশম পরিচ্ছেদ – নিজের বিষে

মোবারক ভয় পাইয়া একটা অব্যক্ত চীৎকার করিয়া উঠিল| মুন্সী সাহেব স্তম্ভিত হইয়া গেলেন| রাগে, দুঃখে, বিস্ময়ে তাঁহার সর্ব্বশরীর কাঁপিতে লাগিল| মোবারক সমূহ বিপদ্ দেখিয়া পলাইবার উপক্রম করিল – ঘর হইতে বাহির হইবার জন্য দ্বারের দিকে সবেগে ছুটিয়া গেল| মুন্সী সাহেব ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের মত তাহার উপরে লাফাইয়া পড়িলেন; এবং দুই হাতে তাহার গলদেশ বেষ্টন করিয়া ধরিলেন| মোবারক তাঁহাকে এক ধাক্কা দিয়া, সবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহার ললাটপার্শ্বে এক প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিল, মুন্সী সাহেব সে দারুণ আঘাত সহ্য করিতে পারিলেন না|-তখনই মৃতবৎ ধরাশায়ী হইলেন| ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে জোহেরাও সংজ্ঞা হারাইল, টলিতে টলিতে মাটিতে পাড়িয়া যাইবার উপক্রম করিল; পার্শ্বে বৃদ্ধা হরিপ্রসন্ন বাবু ছিলেন, তিনি জোহেরাকে ধরিয়া ফেলিলেন| দেবেন্দ্রবিজয়ও এতক্ষণ নিশ্চিন্ত ছিলেন না; মুন্সী সাহেবকে মুষ্ট্যাঘাত করিতে দেখিয়া তিনি পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া মোবারকের দিকে ছুটিয়া গেলেন| মোবারক দেবেন্দ্রবিজয়ের দিকে সেই তীরের ফলাটা দক্ষিণ হস্তে উদ্যত করিয়া নিকটস্থ একখনা চেয়ারে বসিয়া পড়িল|
দেবেন্দ্রবিজয় মোবারকের মস্তক লক্ষ্যে পিস্তলটা উদ্যত করিয়া কহিলেন, “এক পা নড়িলে এই পিস্তলের গুলিতে তোমার মাথার খুলি উড়াইয়া দিব| নারকি, সাবধান! উঠিবার চেষ্টা করিলেই মরিবে-কিছুতেই আমাদের হাত হইতে আর পলাইতে পারিবে না|”
“আর কি-আর উপায় নাই!” বলিয়া মোবারক একান্ত হতাশভাবে সেই বিষাক্ত তীরের ফলাটা ভূতলে নিক্ষেপ করিল| কহিল, “দেবেন্দ্রবিজয়! আমি নিশ্চয়ই পলাইব! তুমি কি মনে করিয়াছ, মোবারককে আর ধরিয়া রাখিতে পারিবে? কখনও তাহা পারিবে না| কিছুতেই না|”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত কঠিন কণ্ঠে কহিলেন, “তোমাকে শীঘ্রই ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলিতে হইবে-সহজে পরিত্রাণ পাইবে না|”
ভ্রুভঙ্গি করিয়া, পৈঁশাচিক হাসি হাসিয়া মোবারক কহিল, “ভুল-ভুল-একান্ত ভুল| আর তোমরা কেহই মোবারককে ফাঁসীর দড়িতে ঝুলাইতে পারিবে না| মোবারক তোমাদের হাত ছাড়াইয়া এখন অনেক দূরে গিয়া পড়িয়াছে-সে আর এখন কাহাকেও কিছুমাত্র ভয় করিবার পাত্র নহে| এই দেখিতেছ না-এ কি হইয়াছে?” বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিসম্মুখে বাম হস্ত প্রসারিত করিয়া দিল| দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, মোবারকের হাত কাটিয়া গিয়া রক্ত ঝরিতেছে|
মোবারক বলিল, “যখন মুন্সী সাহেব আমাকে অক্রমণ করেন, সেই সময়ে অসাবধানে আমি ঐ বিষাক্ত তীরের ফলাতে নিজের হাত কাটিয়া ফেলিয়াছি আর পনের মিনিট – পনের মিনিট পরে আমাকে পাইবে না-সকলই ফুরাইবে| আমি মরিব| আর কেহই আমাকে রাখিতে পারিবে না-এ বিষ একেবারে অব্যর্থ|”
দেবেন্দ্রবিজয় ক্ষুব্ধভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি আপদ্! সব মাটি হইল|”
“একেবারে মাটি! সেজন্য আর অনর্থক ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া ফল কি?” বলিতে বলিতে মোবারক চেয়ার ছাড়িয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল| ক্ষণপরে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল, “আমাকে ধরিয়া ফাঁসীর দড়ীতে ঝুলাইতে পারিলেই কি দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি কৃতার্থ হইতে? আর তাহাতেই বা তোমার কি এমন বাহাদুরি প্রকাশ পাইত? তোমার বাহাদুরি আমি বেশ জানিয়াছি-এতদিন কেবল অন্ধের ন্যায় হাতড়াইয়া ঘুরিয়াছ বৈ ত নয়-বুদ্ধির কাজটা করিয়াছ কি? কিছুই ত দেখিতে পাই না| প্রথমে তুমি মজিদ খাঁকে সন্দেহ কর, তাহার পর মনিরুদ্দীনকে-দিলজানকে-শেষে মুন্সী সাহেবকে একে একে সকলকেই তুমি খুনী মনে করিয়াছ – তখন কাজেই শ – | তোমার গোয়েন্দা-গিরিটা অনেকটা সেই রকমের দেখিতে পাই| তোমার চোখে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আমি কিরূপভাবে নিজের কার্য্যোদ্ধার করিয়া আসিতেছিলাম-একবার মনে ভাবিয়া দেখ দেখি| খুনী বলিয়া কি একবারও আমর উপরে সন্দেহ করিতে পারিয়াছিলে-দৈব এমন প্রতিকূল না হইলে সাধ্য কি তোমার-দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি আমাকে ধরিতে পার? তোমাকে আমি পদে পদে বোকা বানাইয়া নিজের কাজ হাসিল করিয়াছি; আমি সকল সময়েই তোমার পশ্চাতে ফিরিয়াছি-চোখ থাকিতে তুমি অন্ধ-আমাকে দেখিতে পাও নাই| আমিই তোমাকে কয়েকখানা পত্র লিখিয়া সতর্ক করিয়াছিলাম| একদিন রাত্রিতে গলিপথে আমার হাতে তোমার কি দুর্দ্দশা হইয়াছিল, মনে পড়ে কি? কেবল দয়া করিয়াই সেদিন তোমার জীবনটা একেবারে শেষ করিয়া দিই নাই| এখন বুঝিতেছি তোমাকে সেরূপ দয়া করাটা ভাল হয় নাই| সেইদিনই এই পৃথিবী হইতে তোমাকে একেবারে বিদায় করিয়া দিলেই ভাল হইত| তোমার মত একজন নামজাদা ডিটেক্টিভকে এরূপভাবে এ পর্য্যন্ত বোকা বানাইয়া রাখা, যে-সে লোকের কাজ নহে-বড় সহজ কাজও নহে; কিন্তু আমি কত সহজে তাহা করিয়াছি, ভাবিয়া দেখ দেখি; ভাবিয়া দেখ দেখি, কাহার বাহাদুরি বেশি! যদিও আমি এখন দৈব-দুর্ব্বিপাকে তোমার হাতে ধরা পড়িয়াছি-কিন্তু তুমি সহস্র চেষ্টাতেও আর আমাকে ধরিয়া রাখিতে পারিবে না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তুমি মহাপাপী-তোমার পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়াছে| সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এখনও নিজের মুখে নিজের পাপ স্বীকার কর| তোমার অপরাধে মজিদ খাঁ এখনও বন্দী হইয়া রহিয়াছে| দেখি, এ সময়ে একজন ডাক্তারকে আনিলে যদি কিছু সুবিধা হয়|” এই বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
মোবারক হাত নাড়িয়া নিষেধ করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, “ডাক্তার ডাকিয়া কোন ফল নাই| আমি যাহা করিয়াছি-সমুদয় বলিতেছি, একখানা কাগজে তোমরা লিখিয়া লও-লিখিয়া শেষ করা পর্য্যন্ত যদি বাঁচি-লিখিবার শক্তি থাকে, আমি তাহাতে নিজের নাম সহি করিয়াও দিব|”
ইতিপূর্ব্বে জোহেরা অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইতে পারিয়াছিল| হরিপ্রসন্ন বাবু তাহাকে একখানি চেয়ারে বসাইয়া টেবিলের উপর হইতে কাগজ কলম টানিয়া লইয়া বলিলেন, “আমিই লিখিয়া লইতেছি|”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *