৫.০৯ নবম পরিচ্ছেদ – ধরা পড়িল

ক্ষণপরে কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া, মুন্সী সাহেব বিস্ময়বিক্ষুব্ধকণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ ভয়ানক ষড়যন্ত্র! এই কণ্ঠহার-হাঁ এই কণ্ঠহার আমি রাখিয়াছি বটে-কিন্তু এ তীরের ফলা কোথা হইতে আসিল? আমি ত ইহার কিছুই জানি না|”
সপরিহাসে মোবারক কহিল, “এখন ত আপনি ইহাই বলিবেন, কিন্তু ‘জানি না’ বলিলে কি লোকে এখন আপনার কথা বিশ্বাস করিবে? বিশেষতঃ আপনার ড্রয়ার হইতেই যখন এই সকল জিনিষ পাওয়া যাইতেছে, তখন আর ‘জানি না’ বলা যে একান্ত বিড়ম্বনা!”
মহা গরম হইয়া মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এ গুপ্ত ড্রয়ারের কথা কিরূপে জানিলে?”
মোবারক কহিল, “কই গুপ্ত-ড্রয়ার সম্বন্ধে আমি ত আপনাকে কোন কথাই বলি নাই|”
মুন্সী সাহেব আরও গরম হইয়া কহিলেন, “মিথ্যাবাদী-তুমি নিশ্চয়ই এই গুপ্ত-ড্রয়ারের বিষয় অবগত আছ, তুমি এই গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতরে কি আছে কি না, কিরূপে জানিলে? আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এই তীরের ফলা তুমিই এখানে রাখিয়াছ|”
মোবারক হটিবার পাত্র নহে| কঠিন পরিহাসের সহিত কহিল, “তাই না কি! এ তীরের ফলা আমি কোথায় পাইব? মুন্সী সাহেব, এ বৃদ্ধ বয়সে একজন নির্দ্দোষীর স্কন্ধে নিজের হত্যাপরাধটা চাপাইতে চেষ্টা করিবেন না | চেষ্টা করিয়াও বিশেষ কিছু ফল হইবে না-আপনার পাপের ফল, একা আপনাকেই ভোগ করিতে হইবে|”
মুন্সী সাহেব অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “আমি খুন করি নাই-কে খুন করিয়াছে, তাহাও জানি না| আমার স্ত্রী গৃহত্যাগের সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আমি জানিতাম, স্বীকার করি| সেই খুনের রাত্রিতে আমি গোপনে আমার স্ত্রীর অনুসরণও করিয়াছিলাম| মনিরুদ্দীনের বাড়ী হইতে আমার স্ত্রী বাহির হইয়া আসিলে আমিই তাহার নিকট হইতে এই কণ্ঠহার জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়াছি| সে তখনই ভয় পাইয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া চলিয়া যায়| আমিও তাহার অনুসরণ করি; কিন্তু কিছুদূর গিয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিতে পাই নাই| ইহা ছাড়া সেদিনকার রাত্রির খবর আমি আর কিছুই জানি না| পরদিন প্রাতে শুনিলাম, মেহেদী-বাগানে একটা স্ত্রীলোক খুন হইয়া পড়িয়া আছে|”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি তখন বুঝিতে পড়িয়াছিলেন যে, মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা আপনার স্ত্রী?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “না-তখন আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই| মনিরুদ্দীন সেই রাত্রিতে এখান হইতে চলিয়া যাওয়ায় মনে করিয়াছিলাম, আমার স্ত্রীও তাহার সঙ্গ গ্রহণ করিয়াছে; অন্য কোন স্ত্রীলোক খুন হইয়া থাকিবে| তাহার পর যখন ফরিদপুরে গিয়া দেখিলাম, তখন বুঝিতে পারিলাম, মেহেদী-বাগানে আমার স্ত্রীই খুন হইয়াছে, কিন্তু কে খুন করিয়াছে-তাহার সম্বন্ধে আমি বিন্দু-বিসর্গ জানি না|”
চোখে মুখে পরিহাসের হাসি হাসিয়া মোবারক কহিল, “এখন ত আপনি ইহাই বলিবেন| এরূপভাবে এখন কথাটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করা বুদ্ধিমানের কাজ; কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে আপনার এ কথা কে এখন বিশ্বাস করিবে?”
ভীত হইয়া মুন্সী সাহেব কহিলেন, “তাহা হইলে তুমি এখন আমাকেই হত্যাকারী বলিয়া ধরাইয়া দিতে চাও নাকি?”
মোবারক কহিল, “যদি আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত না হ’ন কাজেই আমাকে তাহা করিতে হইবে|”
মু| কি প্রস্তাব?
মো| পূর্ব্বেই বলিয়াছি-জোহেরাকে আমার সহিত বিবাহ দিতে হইবে|
মু| জোহেরা যদি তোমাকে বিবাহ করিতে না চায়, আমি তো তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করিয়া কোন কাজ করিতে পারি না|
মো| অবশ্য আপনি তাহা পারেন-আপনি তাহার একমাত্র অভিভাবক|
মু| আমি কিছুতেই পারিব না|
মো| না পাড়েন – বিপদে পড়িবেন|
মু| কি বিপদ্?
“সহজ বিপদ্ নহে-ফাঁসী-কাঠে ঝুলিতে হইবে,” বলিয়া মোবারক অত্যন্ত কঠিনভাবে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন| মুন্সী সাহেবও ভীতি-বিস্ফারিতনেত্রে মোবারকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন| কাহারও মুখে কথা নাই| পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে যাঁহারা রহস্যোদ্ভেদের অপেক্ষায় ছিলেন, মোবারকের শেষ কথায় তাঁহাদেরও হৃদয় স্তম্ভিত হইয়া গেল|
কিয়ৎক্ষণ গভীর চিন্তার পর মুন্সী সাহেবই প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন| দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “তুমি যাহা মনে করিয়াছ, কিছুতেই তাহা হইবে না-আমি তোমার প্রস্তাব ঘৃণার সহিত অগ্রাহ্য করিলাম|”
মোবারক মুন্সী সাহেবের মুখের সম্মুখে ঘন ঘন তর্জ্জনী অঙ্গুলিটা কম্পিত করিয়া কহিল, “স্মরণে থাকে যেন, ইহার শেষ-ফল বড় ভয়ানক হইবে|”
মুন্সী সাহেব দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “যেমনই ভয়ানক হউক না কেন, আমি সেজন্য প্রস্তুত আছি|”
মোবারক ক্ষণেক কি ভাবিল| ভাবিয়া বলিল, “আপনার মাথার উপরে এমন একটা ভয়ানক বিপদ্; তথাপি যে আপনি এমন সময়ে কেন এমন করিতেছেন, বুঝিতে পরিলাম না| আপনার মনে কি ভয় হইতেছে না? ইহার কারণ কি?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কারণ-প্রথমতঃ আমি খুন করি নাই| দ্বিতীয়তঃ এই বিষাক্ত তীরের ফলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না| তুমিই আমাকে বিপদে ফেলিবার জন্য ইহা এইখানে রাখিয়াছ| নিশ্চয়ই এ সকল ষড়্যন্ত্র- তোমার|”
মোবারক কহিল, “যে কারণে হউক না কেন, আপনি নির্দ্দোষ হইলেও আপনার আর রক্ষার উপায় নাই| ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া কাজ করিবেন| এখন আপনাকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে ক্ষতি কি-আপনি ত আমার হাতে| আপনাকে এই হত্যাকাণ্ডে জড়াইয়া বিপদে ফেলিবার জন্য আমিই এই তীরের ফলাটা আপনার গুপ্ত-ড্রয়ারের মধ্যে রাখিয়াছিলাম|”
সেই তীরের ফলাটা উদ্যত করিয়া মুন্সী সাহেব ক্রোধভরে মোবারকের দিকে দুই পদ অগ্রসর হইয়া বলিলেন, “বদ্বখ্ত| তবে তুমিই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছ|”
হাত হইতে তীরের ফলাটা কাড়িয়া লইয়া মোবারক কহিল, “আপনার স্ত্রীকে আমি খুন করিয়াছি, এমন কথা ত আমি আপনাকে বলি নাই| প্রকৃত ব্যাপার যাহা ঘটিয়াছে, আমার কাছে এখন শুনুন, তাহার পর আপনি যাহা বলিতে হয়, বলিবেন| আপনি যখন আপনার স্ত্রীকে অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানে গিয়াছিলেন, তখন আমিও আপনাদের অনুসরণ করিয়াছিলাম| আপনার স্ত্রী যে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে সে রাত্রিতে গৃহত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিল, তাহা আমিও শুনিয়াছিলাম| ব্যাপারে কি ঘটে দেখিবার জন্য আপনার ন্যায় আমিও মনিরুদ্দীনের বাড়ীর নিকটে গোপনে অপেক্ষা করিতেছিলাম| আপনি মেহেদী-বাগানে আপনার স্ত্রীকে খুঁজিয়া না পাইয়া, ফিরিয়া আসিয়াছিলেন; কিন্তু আমার সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল| আমি তখন তাহার নিকট হইতে এই সকল গুপ্ত-চিঠি ফেরৎ চাই; তাহাতে সে আপনার ঐ গুপ্ত-ড্রয়ারের ভিতর ঐ চিঠিগুলা পাওয়া যাইবে বলে, আর গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিবার কৌশলও আমাকে বলিয়া দেয়| তাহার পর সেদিন আপনার সহিত দেখা করিতে আসিলাম, তখন এখানে আর কেহই ছিল না| আমি এই চিঠিগুলির জন্য আপনার গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিয়া ফেলিলাম, কিন্তু ইহার ভিতরে চিঠি-পত্র দেখিতে পাইলাম না|”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “না পাইবার কথা-এই চিঠিগুলা আমি গুপ্তড্রয়ার হইতে বাহির করিয়া অন্যস্থানে রাখিয়াছিলাম|” মোবারক কহিল, “হাঁ, এখন আমি তাহা জানিতে পারিয়াছি| যাহা হউক, চিঠির পরিবর্ত্তে আমি আপনার গুপ্ত-ড্রয়রের মধ্যে এই কণ্ঠহার ছড়াটা দেখিতে পাইলাম| আমি সেদিন খুনের রাত্রিতে আপনাকে আপনার স্ত্রীর নিকট হইতে ইহা কাড়িয়া লইতে দেখিয়াছিলাম| আমার আরও সুবিধা হইল; জোহেরাকে বিবাহ করিতে হইলে আগে আপনাকে হাতে রাখা দরকার মনে করিয়া, আমিই এই বিষাক্ত তীরের ফলাটা এই কণ্ঠহারের সঙ্গে রাখিয়া দিয়াছিলাম| এখন আমার সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হইয়াছে-আপনাকে বাধ্য হইয়া এখন আমার প্রস্তাবে সম্মত হইতে হইবে-সকল বিষয়ে আমাকে সাহায্য করিতে হইবে|”
মহা খাপ্পা হইয়া সাহেব গর্জ্জন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সয়তান! তবে তুমিই আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছ নিশ্চয়ই-আর কেহ নহে-এখন আর অস্বীকার করিলে চলিবে না| আমি তোমার মুখ-চোখের ভাব দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোমার দ্বারাই এই কাজ হইয়াছে| আমি এখনই তোমাকে পুলিসের হাতে ধরাইয়া দিব-ফাঁসী-কাঠে ঝুলাইয়া তবে ছাড়িব|”
মোবারক কহিল, “বাঃ! আপনি যে পাগলের মত কথা বলিতেছেন! এখন যদি আপনি আমার বিরুদ্ধে কোন কথা কাহাকেও বলেন, কেহই আপনার কথা বিশ্বাস করিবে না| লাভের মধ্যে নিজেকে আরও জড়াইয়া ফেলিবেন| যদিও আমি দোষী, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে এমন একটাও প্রমাণ নাই, যাহাতে আপনি আমাকে খুনী সাব্যস্ত করিতে পারেন|”
আরও রাগিয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “আর কোন প্রমাণের আবশ্যকতা নাই-তুমি নিজমুখে এইমাত্র খুন স্বীকার করিলে|”
মোবারক কহিল, “ইহাকে খুন স্বীকার করা বলে না-আপনার নিকটে যাহা বলিলাম, সাধারণের নিকটে তাহা আমি একেবারে উড়াইয়া দিব-দুঃখের বিষয়, আপনার একজনও সাক্ষী নাই|”
সাক্ষী নাই কি-মিথ্যাকথা! এই পাশের ঘরে তিনজন সাক্ষী বিদ্যমান, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় বাহির হইয়া আসিলেন| তাঁহার পশ্চাতে-উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু এবং জোহেরা|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *