৫.০৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – মহা বিপদ্

ক্ষণপরে হাস্যপ্রফুল্ল মুখে মোবারক-উদ্দীন সেই বৈঠকখানা ঘরে প্রবেশ করিলেন; কিন্তু তথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না| তাঁহার মুখমণ্ডল সহসা অপ্রসন্নভাব ধারণ করিল| য়ে ভৃত্য তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া উপরে আনিয়াছিল, সে ঘরের বাহিরে দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল| মোবারক-উদ্দীন তাহাকে রুক্ষকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুম্নে অভী বোলা কি জোহেরা বিবি উপর্কা বৈঠকনামে বৈঠৈ হৈঁ; পর বে কাঁহা হৈঁ?”
থতমত খাইয়া বৃত্য বলিল, “খোদাবন্দ! বিবি সাহব্ নে ইস ঘর্মে থী, ঔর উন্কে সাথ্ ঔর দো রইসোঁ ভি থা-”
বাধা দিয়া মোবারক বলিলেন, “কুল দো রইসোঁ| আব্ তো বহুৎ রইসোঁকা আমদানী হোগা| জানে দেও ইস্ বাত্ কো, অব্ জোহেরা বিবি কাঁহা হৈঁ?”
ভৃত্য বলিল, “হুজুর মেরে সমঝ্মে উননে অন্দরমে গয়া হোগা| কহিয়ে তো উন্কো খবর দেঁ|”
মোবারক একখানা চেয়ার টানিয়া বসিয়া, একটা জৃম্ভণ ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “ন্যহি, অভী কুছ্ জরুরৎ ন্যহি হৈ; বাদ্ উন্সে মোলাকাৎ করুঙ্গা| অব্ মুন্সী সাহব্কে সাথ্ একদফে মোলাকাৎ কর্না চাহিয়ে| যবতক্ মুন্সী সাহেব না আবে, তবতক্ হমে ইস্ জায়গা হাজির রহ্না হোগা!”
ভৃত্য একটা সেলাম করিয়া চলিয়া গেল| অনতিবিলম্বে ধীরে ধীরে সাহেব সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন| তাঁহার মুখভাব মলিন, চক্ষু কালিমালেপিত, মাথার চুলগুলাও বড় বিশৃঙ্খল|
তাঁহাকে আসিতে দেখিয়া মোবারক দ্বারপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন| এবং উন্মুক্ত দ্বার ভিতর হইতে চাপিয়া দিয়া বলিলেন, “এই যে আপনি খুব শীঘ্র আসিয়াছেন| আমি মনে করিতেছিলাম, আপনার জন্য কতক্ষণই না আমাকে এখানে বসিয়া অপেক্ষা হইবে|”
মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে আপনার কি প্রয়োজন?”
মোবারক পুনরায় নিজের আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, “বিশেষ প্রয়োজন আছে|”
মুন্সী সাহেব ভ্রুযুগ ললাটে তুলিয়া বলিলেন, “ব্যাপরটা কি?”
মো| ব্যাপারটা-বিবাহ|
মু| কাহার বিবাহ?
মো| আমার|
মু| তা’ আমার কাছে কেন?
মো| আপনার মত না হইলে হইবে না| আমি জোহেরা বিবিকে বিবাহ করিতে চাই|
মু| (চমকিত ভাবে) অসম্ভব! কিছুতেই তাহা হইবে না|
মো| না হইবার কারণ? আমি নীচবংশীয় নই – অর্থোপার্জ্জনে সক্ষম – বাহিরে আমার মান-সম্ভ্রম যথেষ্ট|
মু| (ঘৃণাভরে) কিন্তু চরিত্র সম্বন্ধে?
মো| (সহাস্যে) মন্দ কি? তবে এরূপ বয়সে সকলেরই যেরূপ একটু-আধটু চরিত্র-দোষ ঘটে, আমারও তাহাই জানিবেন-তাহার বেশি কিছু পাইবেন না| আপনি কি বিবাহে আপত্তি করিবেন?
মু| নিশ্চয়ই|
মো| কেন?
মু| প্রথমতঃ-জোহেরা মজিদ খাঁকে বিবাহ করিতে স্থিরসঙ্কল্প|
মো| (ঘৃণাভরে) মজ্জিদ খাঁকে-কি আশ্চর্য্য! হত্যাপরাধে যে লোক জেলে পচিতেছে-অনতিবিলম্বে ফাঁসী-কাঠে ঝুলিবে – তাহাকে বিবাহ!
মু| হত্যাপরাধ হইতে সে শীঘ্র নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন হইবে|
মো| কিরূপে?
মু| (বিরক্তভাবে) সে কথায় এখন দরকার কি?
মোবারক কঠিন হাস্যের সহিত বলিলেন, “এই আপনার প্রথম আপত্তি| দ্বিতীয়টা কি শুনি?”
মুন্সী সাহেব কিছু না বলিয়া পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া সেই প্রকাণ্ড দেরাজের একটা ড্রয়ার টানিয়া খুলিয়া ফেলিলেন| এবং তন্মধ্য হইতে গোলাপী রঙের ফিতে-বাঁধা একতাড়া পত্র বাহির করিয়া সশব্দে টেবিলের উপরে ফেলিয়া দিয়া, সেই তাড়ার প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এগুলি কি, বলিয়া দিতে হইবে কি?”
পত্রগুলি দেখিয়া মোবারকের মুখ একেবারে অন্ধকার হইয়া গেল| অর্দ্ধোত্থিত হইয়া টেবিলের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা আপনি কোথায় পাইলেন?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “এই দেরাজের একটা গুপ্ত-ড্রয়ারের মধ্যে এই চিঠিগুলি পাওয়া গিয়াছে| এই গুপ্ত-ড্রয়ারের বিষয় কেহ কিছু জানে না, মনে করিয়া আমার স্ত্রী এই চিঠিগুলা এইখানেই লুকাইয়া রাখিয়াছিল; কিন্তু তাহার পিতা যখন এই দেরাজটী দেন্, তখনই তিনি এই গুপ্ত-ড্রয়ারের কথা আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন| তাহা আমার স্ত্রী জানিত না| একদিন কি খেয়াল হইল, ঐ গুপ্ত-ড্রয়ার খুলিয়া এই চিঠিগুলা দেখিতে পাইলাম|”
শুষ্কহাসি হাসিয়া মোবারক বলিল, “কিসের চিঠি এ সব?”
কঠিনকণ্ঠে মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কিসের চিঠি তাহা আবার তোমাকে বুঝাইয়া বলিয়া দিতে হইবে? তুমি এই সকল চিঠি আমার স্ত্রীকে লিখিয়াছিলে-এখন একেবারে আকাশ হইতে পড়িয়া কোন ফল নাই|”
মোবারক বলিল, “এই সকল চিঠি আমার লেখা, আমি তাহা স্বীকার করিতেছি; কিন্তু আপনার স্ত্রীকে আমি লিখি নাই-সৃজানকে লিখিয়াছিলাম, তখন আপনার সহিত তাহার বিবাহই হয় নাই| ইহার জন্য আপনি আমার উপরে অন্যায় রাগ করিতেছেন| ইহাতে আমার এমন বিশেষ কি অপরাধ দেখিলেন?”
উঠিয়া ক্রোধে কম্পিতস্বরে মুন্সী সাহেব কহিলেন, “বেত্মিজ, তোমার পরম সৌভাগ্য যে এখনও আমি তোমার রক্ত-দর্শন করি নাই| আমার স্ত্রীর স্বভাব ভাল ছিল না বলিয়াই, আমি ততটা করি নাই; নতুবা তুমি এখন যেখানে বসিয়া আছ, এতক্ষণ ঐখানে তোমার মৃতদেহ লুটাইয়া পড়িত| বেয়াদব্ বেইমান্, কোন সাহসে তুমি জোহেরাকে বিবাহ করিতে চাও? তোমার মত বদ্মাইসের সহিত আমি জোহেরার বিবাহ দিব-এ কথা মনেও স্থান দিয়ো না|”
মোবারক টেবিলের উপরে সজোরে একটা চপেটাঘাত করিয়া বলিল, “নিশ্চয়ই আপনি আমার সহিত জোহেরার বিবাহ দেবেন| বিশেষ একটা কারণে আপনাকে বাধ্য হইয়া জোহেরা-রত্ন আমার হাতে সমর্পণ করিতেই হইবে|”
মুন্সী সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিশেষ কারণটা কি শুনি?”
মোবারক বিরক্তভাবে বলিল, “আমার মুখে কি শুনিবেন? আপনি নিজে কি তাহা জানেন না?”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কই, আমি কিছুই জানি না-তোমার কথা আমি বুঝিতে পারিতেছি না|”
মোবারক বলিল, “এবার পুলিসের লোক তদন্তে আসিলে আমি তাহাদিগকে বলিতে পারিব, সৃজান বিবির হত্যাকারী – সৃজান বিবিরই স্বামী – স্বয়ং মুন্সী সাহেব|”
মুন্সী সাহেব মহা রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “কি ভয়ানক! তুমি মনে করিয়াছ, আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিয়াছি?”
মনে করিয়াছি কি, “টেবিলের উপরে মোবারক পুনরপি সশব্দে আর একটা চপেটাঘাত করিল| বলিল, “আমি নিশ্চয়ই জানি, আপনি আপনার স্ত্রীর হত্যাকারী – ইহা আমি শপথ করিয়াই বলিতে পারি| যদি আপনি আমার সহিত জোহেরার বিবাহ দিতে সম্মত না হন্, তাহা হইলে আমি সকলের নিকটে এ কথা প্রকাশ করিয়া দিতেও কুণ্ঠিত হইব না|”
রাগিয়া, বিবর্ণ হইয়া মুন্সী সাহেব বলিলেন, “কি ভয়ানক মিথ্যাকথা! আমি যে আমার স্ত্রীকে হত্যা করিয়াছি, তাহার প্রমাণ কোথায়?”
মোবারক বলিল, “প্রমাণ আপনার গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যেই আছে-আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কেন কষ্ট পাইতেছেন?”
উন্মেত্তের ন্যায় সবেগে মুন্সী সাহেব দেরাজের কাছে ছুটিয়া গেলেন| দ্রুতহস্তে গুপ্ত-ড্রয়ারটা খুলিয়া ফেলিলেন| খুলিয়া সেই গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যে তাঁহার স্ত্রীর সেই কণ্ঠহার এবং একটা তীরের ফলা দেখিতে পাইলেন| তাঁহার বিবর্ণ মুখ আরও বিবর্ণ হইয়া গেল| এবং মোবারক তাঁহার বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া চোখে-মুখে পরিহাসের মৃদু হাসি হাসিতে লাগিল|
পার্শ্ববর্ত্তী গৃহের দ্বারপার্শ্বে রুদ্ধশ্বাসে উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু, ডিটেক্টিভ ইন্স্পেক্টর দেবেন্দ্রবিজয় ও জোহেরা এতক্ষণে তাহাদিগের নেপথ্যবর্ত্তী এই ভয়ানক অভিনয়ের বক্তৃতাবলী শ্রবণ করিতেছিলেন| রহস্য ক্রমশঃ ভেদ হইতে দেখিয়া সমস্ত কথাগুলি শুনিবার জন্য তাঁহারা সেখানে উদ্বিগ্নহৃদয়ে নীরবে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন|
মোবারক মুন্সী সাহেবের নিকটস্থ হইয়া সেই গুপ্ত-ড্রয়ার মধ্যে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া অত্যন্ত পরুষকণ্ঠে কহিল, “এখন প্রমাণ দেখিতে পাইলেন ত? এই কণ্ঠহার আপনি খুনের রাত্রিতে সৃজান বিবির গলদেশ হইতে জোর করিয়া ছিনাইয়া লইয়াছিলেন, মনে পড়ে, এই বিষাক্ত তীরের ফলা দিয়া সৃজানকে আপনি স্বহস্তে খুন করিয়াছিলেন? এই দেখুন, সেটাও এই পড়িয়া রহিয়াছে|”
মুন্সী সাহেব একান্ত শূন্যদৃষ্টিতে সেই কণ্ঠহার ও তীরের ফলাটার দিকে চাহিয়া রহিলেন| তাঁহার আপাদমস্তক কাঁপিতেছিল-আরও কাঁপিতে লাগিল| সহসা তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *