৫.০৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য

মজিদ খাঁ একবার নীরবে কি চিন্তা করিলেন| তাঁহার মুখমণ্ডল অন্ধকার হইয়া গেল| ক্ষণপরে তিনি মুখ তুলিয়া কি বলিবার উপক্রম করিতেছে, এমন সময়ে খুব ব্যস্তভাবে হাঁপাইতে হাঁপাইতে দেবেন্দ্রবিজয় সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এই যে, আপনারা সকলেই এখানে আছেন-ভালই হইয়াছে-আপনাদিগের জন্য আজ আমি একটা নূতন খবর আনিয়াছি|”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের নূতন খবর ?”
দে| খুনের| আমি ইতিমধ্যে মনিরুদ্দীনের সহিত একবার দেখা করিয়াছিলাম| সেদিন খুনের রাত্রিতে তিনি কোথায় ছিলেন, কি করিয়াছিলেন, সে সকল বিষয় একপ্রকার জানা গিয়াছে|
হ| এমন কিছু শুনিলেন, যাহাতে তাহাকে এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত বিবেচনা করা যাইতে পারে?
দে| তাহাতে আর বিশেষ কি ফল হইত? এবার আমি প্রকৃত খুনীকে জানিতে পারিয়াছি|
“কে সে লোক?” অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা বলিয়া উঠিলেন| মজিদ খাঁ কিছু বলিলেন না-ব্যকুলনেত্রে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লোক নয়-একজন স্ত্রীলোক-একজন স্ত্রীলোক দ্বারাই এই কাজ হইয়াছে| সে এখন নিজের মুখে খুন স্বীকার করিয়াছে|”
জোহেরা আরও ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কে এমন স্ত্রীলোক? নাম কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “দিলজান|”
জোহেরা সবিস্ময়ে প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল, “দিলজান!”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আশ্চর্য্য ব্যাপার!”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “ভয়ানক!”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আশ্চর্য্য ব্যাপারই হউক-আর ভয়ানক ব্যাপারই হউক, দিলজান এখন নিজের মুখে খুন স্বীকার করিয়াছে| সেই খুনের রাত্রিতে দিলজান দারুণ ঈর্ষা-দ্বেষে মরিয়া হইয়া মেহেদী-বাগান পর্য্যন্ত সৃজানের অনুসরণ করিয়াছিল| সেইখানে সে সৃজানকে নিজ হস্তে খুন করিয়াছে|”
সন্দিগ্ধভাবে মজিদ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপ ভাবে, কোন অস্ত্রে খুন করিয়াছে, দিলজান কি কিছু বলিয়াছে?”
“এই ছুরিতেই সে সৃজানকে খুন করিয়াছে; দিলজান খুন স্বীকার করিয়া নিজের হাতে এই ছুরি আমাকে দিয়াছে, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সেই দিলজান প্রদত্ত ছুরিখানি বাহির করিয়া দেখাইলেন|
মজিদ খাঁ, বিস্মিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহা কি আপনি বিশ্বাস করেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “প্রথমতঃ আমি একটি কথাও বিশ্বাস করি নাই| এখন আমার মনে সন্দেহ হইতেছে, যদি দিলজান নিজেই খুন না করিবে, তবে কেন সে নিজের মুখে খুন স্বীকার করিতেছে?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “ইহার কারণ আছে; আমার মুখেই আপনি তাহা শুনিতে পাইবেন| দিলজান মনিরুদ্দীনকে আন্তরিক ভালবাসে| আপনি এই খুনের অপরাধে সেই মনিরুদ্দীনকেই জড়াইয়া ফেলিতে চেষ্টা করিতেছেন, ইহা হয়ত সে শুনিয়া থাকিবে|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” হাঁ, সেদিন আমি যখন মনিরুদ্দীনের স্কন্ধে এই হত্যাপরাধটা চাপাইবার চেষ্টা করিতেছিলাম, তখন সে অন্তরালে থাকিয়া আমাদের অনেক কথাই শুনিয়াছিল|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “তাহা হইলে ত ঠিকই হইয়াছে; পাছে মনিরুদ্দীনকে আপনি খুনের অপরাধে ফাঁসীর দড়ীতে তুলিয়া দেন, এই ভয়ে সে নিজে খুন স্বীকার করিয়াছে| বিশেষতঃ দিলজান স্বভাবতঃ বড় উগ্র প্রকৃতির স্ত্রীলোক; আপনি বোধ হয়, তাহা বুঝিতে পারিয়াছেন| তাহার উপর ভগিনীর খুনের কথা শুনিয়া, সেই খুনের অপরাধে মনিরুদ্দীনকে জড়াইয়া পড়িতে দেখিয়া দারুণ উত্তেজনায় তাহার মেজাজ আরও বিগ্ড়াইয়া যাইবার কথা| এখন কি বলিতেছে, কি করিতেছে সম্ভব, সে জ্ঞান আর তাহার নাই|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, ” কিন্তু এই ছুরিখানা?”
মজিদ খাঁ অবজ্ঞাভরে বলিলেন, “কিছু না-এই ছুরিতে সৃজান খুন হয় নাই-হইতে পারে না-ইহা কখনই বিষাক্ত নহে; আপনি বরং পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন| আমি খুব জোর করিয়া বলিতে পারি, দিলজানের দ্বারা কখনই এ খুন হয় নাই|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার এ দৃঢ় বিশ্বাসের অবশ্যই একটা কারণ আছে; নতুবা আপনি এরূপ জোরের সহিত দিলজানের পক্ষ সমর্থন করিতে পারিতেন না| আপনার বোধ হইতেছে-বোধ হইতেছে কেন-নিশ্চয়ই আপনি জানেন, কে সৃজানকে খুন করিয়াছে|”
মজিদ খাঁ কহিলেন, “না, আমি ঠিক জানি না| যাহা জানি, আপনাকে বলিতেছি| আমার মনে একটা ঘোরতর সন্দেহ রহিয়াছে; মেহেদী-বাগানের সেই স্ত্রীলোকের লাস যে সৃজানের, তাহা আমি প্রথমেই জানিতে পারিয়াছিলাম| জানিয়াও নাম প্রকাশ করিতে সাহস করি নাই| সাহস না করিবার কারণই হইতেছে, আমি যাহা দেখিয়াছি-অতি ভয়ানক! দিলজান যে খুন করে নাই, আমার দৃঢ়বিশ্বাসের তাহাই একমাত্র কারণ| আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছিলাম, সেদিন খুনের রাত্রিতে সৃজান রাগিয়া চলিয়া গেলে আমি তাহার অনুসরণ করিতে বাহির হইয়া পথে আর তাহাকে দেখিতে পাই নাই| এ কথাটা একেবারে মিথ্যা; বাধ্য হইয়া আমাকে সত্য গোপন করিতে হইয়াছিল| সৃজানের নিজের বাড়ীর দিকে গিয়াছে মনে করিয়া, আমি বাহির হইয়াই কলিঙ্গ-বাজারের পথে প্রথমে যাই| কিছুদূর গিয়া দেখি, পথিপার্শ্বস্থ লণ্ঠনের নীচে-নীচে অস্পষ্ট অন্ধকার-সেই অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া একজন লোকের সহিত সৃজান বিবি কি বকাবকি করিতেছে| লোকটা কথায় কথায় খুব রাগিয়া উঠিল-স্বরও ক্রমে খুব ঊর্দ্ধে উঠিল| ক্রমে সেই লোকটা একহাতে সৃজানের গলা টিপিয়া ধরিয়া, অপর হাতে জোর করিয়া গলা হইতে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইল| সহসা সৃজান ব্যাকুলকণ্ঠে চীৎকার করিয়া উঠিল, এবং প্রাণপণে মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিয়া গেল| লোকটাও সেইদিকে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া গেল| আমি তাহাদের অনুসরণ করিয়া মেহেদী-বাগানের দিকে ছুটিলাম| চারিদিকে যেমন কুয়াশা, তেমনি ভয়ানক অন্ধকার, তাহাদের কাহাকেও কোথাও দেখিতে পাইলাম না| আপনার বোধ হয় স্মরণ আছে, সৃজানের গলদেশে একটা আঁচড়ের দাগ ছিল-তাহা জোর করিয়া কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইবার দাগ| আমার বোধ হয়, সেই লোকটা সেই সময়েই সৃজানের গায়ে কোন বিষাক্ত অস্ত্র বিদ্ধ করিয়া দিয়া থাকিবে| সেই জন্যই ভয় পাইয়া, সৃজান বিবি একবার আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিয়াছে তাহর নিকট হইতে ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাইয়া যায়| তাহার পর মেহেদী-বাগানে গিয়া, সেই বিষের প্রকোপে অবসন্ন হইয়া লুটাইয়া পড়ে; এবং সেইখানেই একান্ত অসহায়ভাবে হতভাগিনীর প্রাণবায়ু বাহির হইয়া যায়| আমার ত ইহই ধারণা|”
দেবেন্দ্রবিজয় অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সমস্ত শুনিতেছিলেন| মজিদ খাঁকে চুপ করিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি সেই লোকটাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন কি?”
সকলে| কে-কে-কে?
ম| মুন্সী সাহেব|
জোহেরা একান্ত স্তম্ভিতভাবে প্রাণহীন পাষাণ-প্রতিমার মত দাঁড়াইয়া রহিল| তাহার মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না|
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি ভয়ানক! তাহা হইলে মনিরুদ্দীন ত আমাকে মিথ্যাকথা বলেন নাই| তিনিও মুন্সী সাহেবকে ঊর্দ্ধশ্বাসে সৃজানের অনুসরণ করিতে দেখিয়াছিলেন| ঘটমাক্রমে এই নারীহত্যাটা স্ত্রী-হত্যায় পরিণত হইল দেখিতেছি| শেষে মুন্সী সাহেবই খুনী দ্মাড়াইলেন-এখনই আমাকে উঠিতে হইল| আর বিলম্ব নয়|” বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন|
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় চলিলেন?”
“মুন্সী সাহেব সৃজানের গলা হইতে যে কণ্ঠহার ছিনাইয়া লইয়াছিলেন এইবার একবার সেই কণ্ঠহার তদন্ত করিতে হইবে, “বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে সেখান হইতে বাহির হইয়া গেলেন|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *