৫.০২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রহস্য-দুর্ভেদ্য

এমন সময়ে হরিপ্রসন্ন বাবু তথায় উপস্থিত হইলেন| মজিদ খাঁকে বলিলেন, “তোমার সহিত কয়েকটা বিশেষ কথা আছে, মজিদ!”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “বলুন|”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “বোধ হয়, তোমার স্মরণ আছে, একদিন তুমি বলিয়াছিলে যে, মনিরুদ্দীন এখানে ফিরিয়া আসিলে, সেদিন খুনের রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে রাত্রি বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল, তাহার সম্বন্ধে সমুদয় বিষয় প্রকাশ করিতে আপত্তি করিবে না| এখন মনিরুদ্দীন ফিরিয়া আসিয়াছে, তুমি অনায়াসে সে কথা বলিতে পার|”
মজিদ খাঁর মুখমণ্ডলে মলিনতার স্পষ্ট ছায়াপাত হইল| কম্পিতকণ্ঠে, বিবের্ণমুখে বলিলেন, “মনিরুদ্দীন ফিরিয়াছে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “হাঁ, মনিরুদ্দীন ফিরিয়াছে; যাহাকে লইয়া এত কাণ্ড, সেই দিলজানও ফিরিয়াছে|”
মজিদ চকিতে একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস টানিয়া বলিলেন, “দিলজান!”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “হাঁ, দিলজান, এখন আমরা সকলেই জানিতে পারিয়াছি, সেদিল খুনের রাত্রিতে বারটার সময়ে যে স্ত্রীলোকের সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল-যাহার কথা তুমি প্রাণপণে গোপন করিতে চেষ্টা করিতেছ-সে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী সৃজান| আর মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকের লাস পাওয়া গিয়াছিল, তাহা দিলজানের নয়, সৃজানের| সৃজানই খুন হইয়াছে|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “হাঁ,-তাহাই বটে! তাহাই ঠিক|”
জোহেরা ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “তুমি কি ইহা আগে হইতে জানিতে যে, দিলজান খুন হয় নাই-সৃজান বিবিই খুন হইয়াছে?”
মজিদ খাঁ মুখ নত করিলেন| বলিলেন, “হাঁ, খুনের রাত্রিতে বারটার পর সৃজান বিবির সঙ্গেই আমার দেখা হইয়াছিল| মনিরুদ্দীন ও সৃজান বিবির অবৈধ প্রণয়ের কথা আমি জানিতাম| মনিরুদ্দীন কোন কাজই আমাকে লুকাইয়া করিতে পারিত না-আমি তাহাকে দিন রাত চোখে চোখে রাখিতাম-এমন কি সেজন্য সে অনেক সময়ে আমার উপরে বিরক্ত হইত| আমি অনেকবার সৃজান বিবিকে গোপনে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিতে দেখিয়াছি| যাহাতে উভয়ে নিজ-নিজ চরিত্র সংশোধন করিতে পারে, সেজন্য আমি উভয়কেই অনেকসময়ে বুঝাইয়া নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু পতনের বেগ ক্রমশঃ বর্দ্ধিত হয়|
আমি কিছুতেই কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই| সেদিন রাত্রিতে সৃজান মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল| মনিরুদ্দীন তখন বাড়ীতে ছিল না| আমার সঙ্গেই তাহার সাক্ষাৎ হইয়া যায়| তাহার পর তাহার মুখে শুনিলাম, দিলজান না কি তাহার বাড়ীতে গিয়া উঠিয়াছে, এবং তাহাকে এখনও যে মনিরুদ্দীন ত্যাগ করে নাই, সমভাবে এখনও তাহাকে ভালবাসিয়া আসিতেছে, এমন কি বিবাহ করিবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধও হইয়াছে, তাহা দিলজান, সৃজান বিবির কাছে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে| দিলজানের এই সকল কথা কতদূর সত্য, তাহা মনিরুদ্দীনের নিজের মুখে শুনিবার জন্য সৃজান বিবি তেমন সময়ে দিলজানের বেশে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল| দিলজানের মুখে যাহা সে শুনিয়াছিল, তাহা যে মিথ্যা নহে, আমি সৃজান বিবিকে বুঝাইয়া বলিলাম| আমি মনে করিয়াছিলাম, এই সুযোগে যদি আমি পাপিষ্ঠা সৃজানকে নিরস্ত করিতে পারি, তাহা হইলে মনিরুদ্দীনকে একটা ভয়ানক দুর্নাম হইতে-বিশেষতঃ রাক্ষসী সৃজানের হাত হইতে রক্ষা করিবার অনেকটা সুবিধা হয়| আমার কথা শুনিয়া সৃজান বিবি অত্যন্ত রাগিয়া উঠিল| মনিরুদ্দীন যে এইরূপভাবে তাহার সহিত প্রবঞ্চনা করিয়াছে, সেজন্য মনিরুদ্দীনের প্রতি দোষারোপ করিতে করিতে সে আমাকেই দশ কথা শুনাইয়া দিল| আমি তাহাকে কিছুতেই শান্ত করিতে পারিলাম না| তখনই সে ক্রোধভরে বাড়ীর বাহির হইয়া গেল| সেই ভয়ানক রাগের মুখে সে কি ভয়ানক কাজ করিয়া ফেলিবে, এই ভয়ে আমিও তাহার অনুসরণ করিলাম; পথে আসিয়া আর তহাকে দেখিতে পাইলাম না; সেদিন যেমন ভয়ানক কুয়াশা-তেমনি আবার ভয়ানক অন্ধকার! পথে দাঁড়াইয়া চরিদিকে চাহিতে চাহিতে এক ব্যক্তিকে যেন মেহেদী-বাগানের পথ ধরিয়া যাইতে দেখিলাম| কিছুদূর গিয়া আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না| ক্রমে মেহেদী-বাগানে আসিয়া পড়িলাম| সেখানেও তাহার অনেক অনুসন্ধান করিলাম| এমন কি, দিলজানের বাড়ী পর্য্যন্ত গিয়াছিলাম; সেখানেও গোপনে খবর লইয়া জানিলাম, সৃজানের বাড়ী হইতে দিলজান তখনও বাড়ী ফিরিয়া আসে নাই| ফিরিবার মুখেও মেহেদী-বাগানে আমি সৃজানের অনেক অনুসন্ধান করিলাম| নিরাশ হইয়া যখন বাড়ী ফিরিতেছি, তখন একটা গলির মোড়ে মোবারকের সঙ্গে আমার দেখা হয়| তাহার পর বাড়ীতে ফিরিয়া শয়ন করিলাম| পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়াই এই খুনের কথা শুনিলাম| তাহার পর সেই লাসের পরিধেয় বস্ত্রাদির যেরূপ বর্ণনা শুনিলাম, তাহাতে আমি সহজেই বুঝিতে পারিলাম, সৃজান বিবিই খুন হইয়াছে| এদিকে ক্রমে দিলজান খুন হইয়াছে বলিয়া চারিদিকে একটা রব উঠিয়া গেল| ভালই হইল মনে করিয়া আমিও অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিলাম|”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “তাহার একটা বিশেষ কারণ আছে|”
হ| এই খুন সম্বন্ধে না কি?
ম| খুন সম্বন্ধে বৈ কি|
হ| এখন কি তাহা প্রকাশ করিতে কোন আপত্তি আছে?
ম| একটু সময় দিন্, একবার ভাবিয়া দেখি, তাহার পর বলিতেছি|
হ| বেশ কথা|
জো| (মজিদের প্রতি) এ সকল কথা পূর্ব্বে কেন আমাদিগকে বল নাই?
ম| তাহারও কারণ আছে| আমি সৃজান বিবির নিকটে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম যে, তাহার সম্বন্ধে সেদিনকার কোন কথা কাহারও নিকটে প্রকাশ করিব না| বিশেষতঃ তখন মনিরুদ্দীনের উপরে সৃজান বিবির যেরূপ রাগ দেখিয়াছিলাম, তাহাতে আমার বোধ হইয়াছিল যে, সে নিশ্চয়ই এইবার মনিরুদ্দীনকে ত্যাগ করিবে; এরূপ স্থলে এ কলঙ্ক-কাহিনী একেবারে চাপা পড়িয়া যাওয়াই ভাল| যদি আমি প্রকাশ করিতাম যে, সেদিন রাত্রে সৃজানের সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাহা হইলে আমাকে বাধ্য হইয়াই, সেই সঙ্গে তাহার সম্বন্ধে সকল কথাই প্রকাশ করিতে হইত|
হরিপ্রসন্ন বাবু, “কি আশ্চর্য্য! একজন স্ত্রীলোকের জন্য তুমি নিজের গলায় ফাঁসীর দড়ী জড়াইতে বসিয়াছ|”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “না, এতদূর আমাকে অগ্রসর হইতে হইত না| বেগতিক দেখিলে আমাকে সকল কথাই বলিয়া ফেলিতে হইত| তবে যতক্ষণ পারি, ততক্ষণ কেন না চেষ্টা করিব?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “আগে তুমি কি মনে করিয়াছিলে যে, কে মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গিয়াছে?”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “আগে আমি মনে করিয়াছিলাম, কেহই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে যায় নাই| তাহার পর যখন আপনি দিলজানের কথা আমার কাছে তুলিলেন, তখনই আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম, যদি কেহ গিয়া থাকে, ত দিলজানই মনিরুদ্দীনের সঙ্গে গিয়াছে| দিলজান সৃজানের যমজ ভগিনী| উভয়েই দেখিতে এক রকম, তাহার উপরে দুই জনে পরস্পর পোষাক পরিবর্ত্তন করিয়াছিল; বিশেষতঃ দিলজান খুব চতুর; এমন একটা সুযোগ কি সহজে তাহার হাত এড়াইতে পারে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কথা যাক্, সেই মৃত স্ত্রীলোকের নাম জানিয়াও এমন কোন্ বিশেষ কারণে তখন তুমি প্রকাশ করিতে সাহস কর নাই, তাহা এখন বলিবে কি?”
মজিদ খাঁর মুখ মলিন, এবং ললাটদেশ কুঞ্চিত হইল| এবং অতি কঠিনভাবে তিনি অধর দংশিত করিয়া একান্ত নিরাশভাবে একবার কক্ষের চারিদিকে চাহিলেন| তাহার পর কঠিন-কণ্ঠে বলিলেন, “জোহেরা, সে বড় ভয়ানক কথা-তুমি তাহা সহ্য করিতে পারিবে না|”
জোহেরা বলিল, “যেমনই ভয়ানকই হউক না কেন-আমি তাহা সহ্য করিব| তুমি বল|”
মজিদের মুখের ভাব দেখিয়া হরিপ্রসন্ন বাবুর বড় ভয় হইল| ভাবিলেন, মজিদ নিজেই খুনী না কি| জোহেরার সমক্ষে নিজের খুন-স্বীকার করিতে তাই এত ভীত হইতেছে? না-না-ইহা কখনই সম্ভব্পর নয়|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *