৪.১২ দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – গুরু ও শিষ্য

বিদ্যালয়ের ছাত্র যেমন নীরবে অবনতমস্তকে শিক্ষকের নিকটে পাঠ গ্রহণ করে, দেবেন্দ্রবিজয়ও ঠিক সেইরূপ নতশিরে রহিলেন| আর উভয়ের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কও বটে|
অরিন্দম বাবু বলিতে লাগিলেন, “সত্যসত্যই তুমি কয়েকটা বড় ভুল করিয়া ফেলিয়াছ| রহস্য-ভেদের তিন-তিনটি সুযোগ তিনবার তোমার হাত এড়াইয়া গিয়াছে; আমি তাহা তোমাকে দেখাইয়া দিতেছি|”
“কিন্তু আপনি যদি-” দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, তখনই বাধা দিয়া, মুখভঙ্গি সহকারে, জিহ্বা ও তালু সংযোগে একটা অব্যক্ত শব্দ করিয়া অরিন্দম বলিলেন, “দুই-একটা কথা আমাকে বলিতে দাও-ব্যস্ত হইও না| কি সূত্র ধরিয়া গোয়েন্দাগিরি করিতে হয়, তাহা তোমার মনে আছে কি? গোয়েন্দাগিরির মূলমন্ত্র হইতেছে যে, কিছুতেই বিশ্বাস স্থাপন করিবে না-যাহা কিছু সম্ভব বা সত্য বোধ হইবে, তাহাই আগে অবিশ্বাস করিবে| এই মূলমন্ত্র কি তোমার মনে ছিল? ইহাই অবলম্বনে কাজ করিতে কি তুমি চেষ্টা করিয়াছিলে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, আমিও এই মূলমন্ত্র লক্ষ্য করিয়া কাজ করিতে চেষ্টা করিয়াছি| অনেক স্থলে চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে| যাহা একান্ত সত্য বলিয়া মনে হয়, তাহার উপরে জোর করিয়া অবিশ্বাস করা বড় শক্ত কাজ|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “তাহাই ত চাই, এই সূত্র ধরিয়া তুমি যে কোন অন্ধকারময় পথ অবলম্বন কর না কেন, ইহা পরিশেষে দীপালোকের কাজ করিবে, বিপথে চালিত হইবার কোন শঙ্কা থাকিবে না; অথচ যথাসময়ে ইহা তোমাকে ঠিক সত্যে উপনীত করিয়া দিবে| এমন মূলমন্ত্র কি একবারও ভুলিতে আছে! নতুবা এমন একটা অবস্থাধীন ঘটনা ঘটিল, যাহা খুবই সম্ভব বলিয়া মনে লাগিল; তুমি এই মূলমন্ত্র ভুলিয়া তাহা বিশ্বাস করিলে; তাহার পর এমন একটা ঘটনা ঘটিল, যাহাতে তাহা তুমি বুঝিলে ইহা আরও সম্ভবপর- ইহা কখনই মিথ্যা হইতে পারে না| তুমি অমনি ইহাই প্রকৃত বলিয়া লাফাইয়া উঠিলে; এরূপ করিলে ডিটেক্টিভগিরি হয়? তা’ হয় না|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমার ত বোধ হয়, আপনি যতটা মনে করিয়াছেন, আমি একেবারে ততটা সরল-বিশ্বাসী নই|”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ঠিকই ততটা| এখন যেরূপ ঘটনা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে মনিরুদ্দীনকেই দোষী বলিয়াই বোধ হয়| তুমিও তাহাই খুব সম্ভব বলিয়া মনে করিতেছ, বিশ্বাসও করিয়াছ| কেমন ঠিক কি না?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, যেরূপ দেখিতেছি তাহাতে মনিরুদ্দীনকেই আমার দোষী বলিয়া বিশ্বাস হয়; কারণ-”
মধ্যপথে বাধা দিয়া অরিন্দম বাবু বলিয়া উঠিলেন, “কারণ তোমাকে বলিতে হইবে না- আমি নিজেই তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি; খুবই সম্ভব বলিয়া বিশ্বাস করিতেছ-সেই বিশ্বাসে কাজ করিয়া পরে কৃতকার্য্য হইবে, এরূপ মনেও করিয়াছ|”
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে বড় বিরক্ত হইলেন| জিজ্ঞাসা করিলেন, “এরূপ স্থলে আপনি যদি দাঁড়াইতেন, তা’ হ’লে আপনি কি করিতেন?”
অরিন্দম বাবু বলিলেন, “ঠিক বিপরীত| হয় ত তাহাতে আমি ভুলও করিয়া ফেলিতাম; কিন্তু সে ভুলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হইত না; এই অবিশ্বাসে পরে আমি একটা ন্যায়সঙ্গত মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিতাম|”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আরও দুই-একটি কারণে মনিরুদ্দীনকে দোষী বলিয়া আমার বিশ্বাস হইয়াছে| তিনি নিজের দোষ ঢাকিবার জন্য মুন্সী সাহেবের ঘাড়ে দোষ চাপাইবার চেষ্টা করিতেছেন|”
অরি| এই জন্যই কি তোমার বিশ্বাস এতটা বদ্ধমূল হইয়াছে?
দেবে| আরও একটা কারণ আছে; বোধ হয়, দিলজান ভিতরের সকল কথাই জানে| মনিরুদ্দীনকে বাঁচাইবার জন্য সে নিজে খুন স্বীকার করিতেছে|
অরি| এইখানে তুমি পদে পদে ভ্রম করিয়াছ|
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইলেন| বলিলেন, “তবে কি আপনি মনে করেন, মনিরুদ্দীন নিরপরাধ?”
সহসা অরিন্দম বাবুর মুখমণ্ডল ঘনঘটাচ্ছন্ন হইল| দেখিয়া ভয় হয়, এমন একটা মুখভঙ্গি করিয়া তিনি বলিলেন, “বোধ করা করি কি, আমি নিশ্চয়ই বলিতেছি, সে নিরপরাধ|”
শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয় ‘থ’ হইয়া গেলেন|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *