1 of 2

৩.১৫ পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য

আসন পরিগ্রহ করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় সংযতস্বরে হরিপ্রসন্ন বাবুকে বলিলেন, “কেমন আছেন, মহাশয়? অনেকদিন আপনাকে দেখি নাই; এখানে আজ কি মনে করিয়া? বোধ করি, এক অভিপ্রায়েই আমাদের উভয়েরই এখানে আগমন হইয়াছে ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “ঠিক তাহা নহে-মহাশয়, বরং বিপরীত-আপনি মজিদ খাঁকে ফাঁসীর দড়ীতে লট্কাইয়া দিবার জন্য ব্যস্ত; কিন্তু আমি সেই নির্দ্দোষী বেচারার প্রাণরক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেছি ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হরিপ্রসন্ন বাবু, এইখানেই আপনি একটা মস্ত ভুল করিয়া ফেলিয়াছেন । আমিও সেই নির্দ্দোষী বেচারার প্রাণরক্ষার জন্য সচেষ্ট ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “হাঁ, ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই; আমারও বিশ্বাস, মজিদ খাঁ নির্দ্দোষী ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তবে আপনি তহাকে গ্রেপ্তার করিলেন কেন?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাঁহার বিরুদ্ধে যে বলবৎ প্রমণ পাওয়া গিয়াছে, তাহাতে তাঁহকে গ্রেপ্তার করা অন্যায় হয় নাই । সম্প্রতি দেখিতেছি, কয়েকটা বিষয়ে আমি বেশ বুঝিতেও পারিয়াছি, মজিদ খাঁ প্রকৃত পক্ষে দোষী ব্যক্তি নহেন ।”
দেবেন্দ্রবিজয় এমনভাবে কথাগুলি বলিলেন, “হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা তাহাতে অবিশ্বাসের কিছুই দেখিতে পাইলেন না দেখিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন ।
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “তাহা হইলে আপনিও আমাদের দলে আসিতেছেন, দেখিতেছি ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমিই আপনার দলে যাই-আর আপনিই আমার দলে আসুন, এখন তাহা একই কথা । মজিদ খাঁর নির্দ্দোষতা সপ্রমাণ করা এখন হইতে আমাদের উভয়ের প্রধান উদ্দেশ্য রহিল । এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে, প্রকৃত হ্ত্যাকারী গ্রেপ্তার করা ঘটনাক্রমে অনেকটা পরিমাণে সহজ হইয়া আসিতে পারে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সকলই ত বুঝিলাম-আপনারা উভয়েই মজিদ খাঁর প্রাণরক্ষার জন্য সচেষ্ট; আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হউক; কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, আপনি আজ কি অভিপ্রায়ে আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন, সে সম্বন্ধে ত কোন কথাই বলিলেন না?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এইবার বলিতেছি-কাজের কথা আমি কখনও ভুলি না । যে কথাটা উঠিয়াছে, তাহা শেষ করিয়া অন্য কথা আরম্ভ করাই ঠিক । আমি আপনার স্ত্রীর সম্বন্ধে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই । বোধ করি, আপনি কোন ত্রুটি লইবেন না!”
হরিপ্রসন্ন বাবু ও জোহেরা সবিস্ময়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিলেন । বুঝিলেন, তিনি মিথ্যা বলেন নাই-তাঁহারা যে উদ্দেশ্যে আসিয়াছেন, তিনিও ঠিক সেই সেই উদ্দেশ্যে মুন্সী সাহেবের সহিত দেখা করিতে উপস্থিত ।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আপনার স্ত্রী সেদিন রাত বারটার পূর্ব্বে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে গিয়াছিলেন কি?”
মুন্সী । এ কথা আপনাকে কে বলিল?
দেবেন্দ্র । কেহ বলে নাই । গিয়াছিলেন কি?
“আমি কিছুই জানি না ।” বলিয়া মুন্সী সাহেব যাহা জানিতেন, দেবেন্দ্রবিজয়কে বলিলেন । ইতিপূর্ব্বে হরিপ্রসন্ন বাবুকে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহারই পুনরাবৃত্তিমাত্র-সুতরাং তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন ।
দেবেন্দ্রবিজয় তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি সেদিন রাত এগারটার পরই বাড়ীতে ফিরিয়াছিলেন । তাহার পর আর বাড়ী হইতে বাহির হন্ নাই?”
দেবেন্দ্রবিজয়ের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মুন্সী সাহেব যেন একটু বিব্রত হইয়া উঠিলেন । বলিলেন, “না ।”
দেবেন্দ্র । (হরিপ্রসন্নের প্রতি) আপনার কি বোধ হয়, হরিপ্রসন্ন বাবু? সেদিন রাত্রিতে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যে স্ত্রীলোকের সহিত মজিদ খাঁর দেখা হয়, কে সে? কখনই সে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী নহেন । আমার অনুমানই ঠিক- সে দিলজান না হইয়া যায় না-সেদিন রাত বারটার পূর্ব্বে মুন্সী সাহেবের স্ত্রী বাড়ীতেই ছিলেন ।
মুন্সী । কিরূপে আপনি তাহা জানিতে পারিলেন?
দেবে । সাখিয়া বাঁদীর মুখে শুনিয়াছি ।
জোহে । হাঁ, আমাকেও সে ইহা বলিয়াছে । তাহা হইলে-তাহা হইলে-
সহসা মধ্যপথে থামিয়া গিয়া জোহেরা সকলের মুখের দিকে একান্ত ব্যাকুলভাবে বারংবার চাহিতে লাগিল ।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা হইলে কে সে স্ত্রীলোক, কিরূপে এখন ঠিক হইতে পারে? যখন মজিদ খাঁ নিজে কোন কথা প্রকাশ করিবেন না, তখন আমাদিগকে অন্য উপায় অবলম্বন করিতে হইবে । এখন মুন্সী সাহেবের পলাতক স্ত্রীর সন্ধান লইতে হইবে; তাঁহার সহিত একবার দেখা করিতে পারিলে, এই খুন-রহস্যটা অনেক পরিষ্কার হইয়া যাইবে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সে দিলজানের খুন সম্বন্ধে কি জানে?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বেশী কিছু না জানিলেও তাঁহার ভগিনীর খুনের কারণটা হয় ত তিনি কিছু কিছু জানেন-”
সকলে । (সবিস্ময়ে) তাঁহার ভগিনী!
মুন্সী । কে তাহার ভগিনী ।
দেবেন্দ্র । দিলজান-যে মেহেদী-বাগানে খুন হইয়াছে-
মুন্সী । (বাধা দিয়া-বিরক্তভাবে) আপনি পাগল না কি! কে আমার স্ত্রী, তাহা কি আপনি জানেন?
দেবেন্দ্র । খুব জানি-খিদিরপুরের মুন্সী মোজাম হোসেনের দুহিতা । তাঁহার দুই যমজ কন্যা-একজনের নাম মৃজান-মৃজান মনিরুদ্দীনের সহিত পিতৃগৃহ পরিত্যাগ করিয়া দিলজান নাম গ্রহণ করে; অপর কন্যার নাম সৃজান-আপনার সহিতই পরে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল ।
মুন্সী সাহেব অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া ঘৃণাভরে বলিলেন, “ইহাও কি সম্ভব! আমার স্ত্রীর যে মৃজান নামে এক যমজ ভগিনী ছিল, তাহা আমি ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম, কিন্তু আমার বিবাহের পূর্ব্বেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “মৃজান নামে মরিয়া দিলজান নামে সে এতদিন বাঁচিয়া ছিল । এখন সে একেবারেই মরিয়াছে । যখন দেখা যাইতেছে, সৃজানের গৃহত্যাগ এবং মৃজানের হত্যা এক রাত্রিরই ঘটনা, তখন খুবই সম্ভব, সৃজান বিবি এই হত্যাকাণ্ডে কিছু জড়িত আছেন ।”
হরিপ্রসন্ন বাবু দেখিলেন, আবার এক নুতন গোলযোগ উপস্থিত । সন্দিগ্ধভাবে দেবেন্দ্রবিজয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সৃজান বিবি নিজের ভগিনী দিলজানকে খুন করিতে যাইবেন কেন, ইহাতে তাঁহার স্বার্থ কি?”
দেবেন্দ্রবিজয় মৃদুহাস্যে বলিলেন, “ওকালতী অর ডিটেক্টিভগিরি একই জিনিষ নহে, হরিপ্রসন্ন বাবু ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি কি এখন সৃজানকেই খুনী মনে করিতেছেন? ইহাতে তাঁহার কি স্বার্থ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “এখনও কি আপনারা বুঝিতে পারেন নাই-স্বার্থ কি? উভয় ভগিনী এক ব্যক্তিরই প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী । এরূপ স্থলে একজন অপরকে খুন করিবার যে কি স্বার্থ, তাহা পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে ।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সৃজানের স্বভাব-চরিত্র কলঙ্কিত হইলেও আমার বিশ্বাস হয় না, স্ত্রীলোক হইয়া সে সহসা এতটা সাহস করিতে পারে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “পুরুষের অপেক্ষা স্ত্রীলোকের সাহস অনেক বেশী; প্রেম-প্রতিযোগীতায় ঈর্ষায় যখন তাহারা মরিয়া হইয়া উঠে, তখন তাহারা সকলই করিতে পারে-একটা খুন ত অতি সামান্য কথা! ”
এমন সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া মুন্সী সাহেবের হাতে একখানি পত্র দিল । তিনি তখনই পত্রখানি খুলিয়া পাঠ করিলেন । পাঠান্তে বলিলেন, “ঠিক হইয়াছে-এইবার প্রকৃত ঘটনা বুঝিতে পারা যাইবে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কি হইয়াছে-ব্যাপার কি?”
রুক্ষস্বরে মুন্সী সাহেব বলিলেন, “সয়তান আর সয়তানী উভয়ই মিলিয়া ফরিদপুরের বাগানে বাস করিতেছে ।”
ব্যগ্রভাবে জোহেরা জিজ্ঞাসা করিল, “কে-বিবি সাহেবা আর মনিরুদ্দীন?”
মুন্সী । হাঁ, আমি যাহাকে তাহাদের সন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছিলাম, সেই ব্যক্তি তাহাদের সন্ধান করিয়া আমাকে এই পত্র লিখিয়াছে ।
দে । ভালই হইয়াছে-সেখানে গেলে প্রকৃত ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, বুঝিতে পারা যাইবে । আপনি সেখানে যাইবেন কি?
মু । এখন আমি সে কথা বলিতে পারি না; কাল যাহা হয় ঠিক করিয়া বলিব ।
দে । আমরা তিনজনেই কাল একসঙ্গে ফরিদপুরে যাইব । আপনারও সেখানে যাওয়া দরকার ।
মু । কাল সে যাহা হয়, করা যাইবে ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *