1 of 2

২.১১. একাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদে

পরদিন রাত্রি নয়টার সময় দেবেন্দ্রবিজয় গোলদিঘীতে উপস্থিত হইলেন| ইতিপূর্ব্বে তিনি স্থানীয় থানা হইতে কয়েকজন অনুচর ঠিক করিয়া লইয়াছিলেন| তাহাদিগকে স্থানে স্থানে লুকাইয়া রাখিলেন; এবং নিজে গোলদিঘীর ভিতরে গিয়া হত্যাকারীর অপেক্ষা করিতে লাগিলেন|
ক্রমে রাত্রি দশটা বাজিয়া আসিল| দেবেন্দ্রবিজয় কোথায় কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না-হত্যাকারী আসিল না| সম্মুখবর্ত্তী পথ দিয়া পথিকগণ যে যাহার গন্তব্যস্থানে যাইতেছে; কত লোক যাইতেছে-আসিতেছে-কাহাকেও তাঁহার প্রতি লক্ষ্য করিতে দেখিলেন না-সকলেই আপন মনে ফিরিতেছে|
আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে| অষ্টমীর অর্দ্ধচন্দ্রের কিরণ তেমন উজ্জ্বল নহে-কেবল যেন একটু অন্ধকার-মাখা হইয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে| তুলারাশিবৎ লঘু মেঘখণ্ডগুলি আকাশতলে দুষ্ট বালকের মত উদ্দামভাবে ছুটাছুটি করিতেছে| চন্দ্রদেব মৃদুহাস্যে সেই অশিষ্ট মেঘশিশুদিগের সেই ক্রীড়া দেখিতেছেলন; কখনও বা কহাকেও আপনার বুকের উপরে টানিয়া লইতেছিলেন| অন্যত্র অদূরস্থিত অশ্বত্থশাখাসীন কলকণ্ঠ পাপিয়ার ঝঙ্কৃত মধুর স্বরতরঙ্গ আকাশ ভেদ করিয়া উঠিতেছিল এবং দক্ষিণ দিক্ হইতে বৃক্ষশাখা কাঁপাইয়া, পথের ধূলিরাশি উড়াইয়া হু হু শব্দে বাতাস বহিয়া আসিতেছিল| স্থান ও কাল উভয়ই সুন্দর| দেবেন্দ্রবিজয়ের সেদিকে লক্ষ ছিল না-তিনি হত্যাকারীর অপেক্ষা করিতেছিলেন| এবং চারিদিকে তাঁহার সতর্কদৃষ্টি ঘন ঘন সঞ্চালিত হইতেছিল|
চন্দ্র অস্ত গেল| ক্রমে রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর উর্ত্তীণ হইল-তথাপি কেহই আসিল না|
দেবেন্দ্রবিজয় হতাশ হইলেন; নিজের অনুচরবর্গকে বিদায় করিয়া দিলেন| এবং নিজে শীঘ্র বাড়ী পৌঁছিবার জন্য একটা গলিপথে প্রবেশ করিলেন| পথ একান্ত নির্জ্জন| চারিদিকে গভীর অন্ধকার-গলিপথে অন্ধকার গভীরতর; গগনস্পর্শী বৃক্ষগুলির নিম্নে অন্ধকার আরও গভীর হইয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে| সেই গভীর অন্ধকারবেষ্টিত সমুন্নশীর্ষ বৃক্ষসমূহের চতুষ্পার্শ্বে অসংখ্য খদ্যোৎ,হীরকখণ্ডবৎ জ্বলিতেছে-নিবিতেছে-নিবিয়া আবার জ্বলিতেছে| কেহ কোথায় নাই-কেবল অদূরে কতকগুলা শৃগাল ও কুকুর দল-বাঁধিয়া চীৎকার করিয়া ছুটাছুটি করিতেছে| দেবেন্দ্রবিজয় ক্রমশঃ অগ্রসর হইয়া চলিলেন| সহসা একটা পেচক কর্কশকণ্ঠে হাঁকিয়া তাঁহার মাথার উপর দিয়া উড়িয়া গেল| দেবেন্দ্রবিজয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিলেন না, পূর্ব্ববৎ দ্রুতবেগে চলিতে লাগিলেন|
এমন সময়ে কে তাঁহাকে পশ্চাদ্দিক হইতে বলিল, “আমার সঙ্গে চালাকি-এইবার মজাটা দেখ!” দেবেন্দ্রবিজয় যেমন পশ্চাতে ফিরিয়াছেন, দেখিলেন একটা পাহারাওয়ালা উদ্যত সুদীর্ঘ বংশযষ্টিহস্তে দাঁড়াইয়া| দেবেন্দ্রবিজয় আত্মরক্ষারও সময় পাইলেন না-সেই উদ্যত যষ্টি সবেগে তাঁহার মস্তকের উপরে আসিয়া পড়িল|
তিনি একান্ত নিঃসহায়ভাবে সেইখানে মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন|

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *